উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৪৮||

0
490

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৮||

৯৭।
বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে আহি। তার দৃষ্টি আটকে আছে ফোনের স্ক্রিনে। আহির হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন সালমা ফাওজিয়া। তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে?”

আহি ফোনটা টেবিলের উপর রেখে অবিশ্বাস্য হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“মা, তুমি ভাবতেই পারবে না কি হয়েছে!”

“কি হয়েছে, বলো!”

“তাজওয়ার আর একটা মেয়ের….”

আহি কিছুক্ষণ থেমে ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটিয়ে বলল,
“তাজওয়ারের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এখন ওর মান-সম্মান সব শেষ। আমার খুব শান্তি লাগছে।”

তখনই আহির ফোনে উজ্জ্বলের কল এলো। আহি সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করে বলল,
“নিউজ দেখেছেন!”

উজ্জ্বল চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“কিন্তু এই কাজটা করলো কে?”

“ওর কি শত্রুর অভাব আছে?”

“আর যাই বলো! যে করেছে, তার খুব সাহস আছে। তাজওয়ারের মতো কঠোরভাবে প্রাইভেসি মেইনটেইন করা ছেলের ভিডিও ভাইরাল হওয়া সহজ কথা না। ওর বাসা, এক্সট্রা ফ্ল্যাট, বাংলো বাড়ি সব জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। বাইরের কেউ এই কাজ কখনোই করতে পারবে না। ওর কাছের কেউ এই ভিডিও করেছে।”

আহি হেসে বলল,
“যেই করেছে, ভালো করেছে। এখন অন্তত ওর দাম্ভিকতা কমবে। খুব তো অহংকার তার! আমাকে সবার সামনে নিজের ফিয়োন্সে হিসেবে পরিচিত করানোর জন্য মিডিয়া নিয়ে এসেছিলো। এখন সেই মিডিয়া থেকেই পালাবে।”

(***)

রুমের জিনিসপত্র ভেঙে ফেলছে তাজওয়ার। কোনোভাবেই তাকে আটকানো যাচ্ছে না। চাকর-বাকর জড়োসড়ো হয়ে তার রুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। রেহানা খান ছেলের হাত ধরে রেখেছেন। তাজওয়ার মাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলল,
“কেউ আমাকে থামানোর চেষ্টা করবে না।”

রেহানা খান ছেলের চিৎকারে কেঁপে উঠলেন। দোয়েল ভেতরে ঢুকে রেহানা খানকে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। রাগের মাথায় তাজওয়ার কি না কি করে বসে, বলা তো যায় না। কারণ তাজওয়ার আজ ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। নিজের পরাজয় মেনে নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। এতো বছর সে মেয়েদের সম্মান নিয়ে খেলেছে, আর আজ তার সম্মানে এতো বড় প্রশ্ন! যদিও এটা কয়েক বছর পর সবাই ভুলে যাবে। কিন্তু সাময়িক সময়ের জন্য সে দশজনের সামনে দাপট দেখিয়ে চলতে পারবে না। তাকে মিডিয়ার আড়ালে থাকতে হবে। তাজওয়ার গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,
“যে এই কাজ করেছে, আজ তার শেষ দিন।”

তাজওয়ার ড্রেসিংয়ের ভাঙা আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। ভাঙা কাচ তাজওয়ারের চেহারা ধারণ করার চেষ্টায় ব্যস্ত, আর তাজওয়ারের মস্তিষ্ক ব্যস্ত সেই মানুষটিকে খুঁজতে যে তার এতো বড় ক্ষতি করেছে। মুহুর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো তিনটি মুখ। আফিফ, লাবীব অথবা রাদ। নিশ্চয় এদের তিনজনের মধ্যে কেউ এই কাজ করেছে। তাজওয়ার চেয়ারে শান্ত হয়ে বসলো। কিছু একটা ভেবে বলল,
“সেই কালো হেলমেট পরা ছেলেটিই এই কাজ করেছে। আর সে আফিফ ছাড়া কেউ না।”

তাজওয়ারের ভাবনার মাঝে তার রুমের দরজায় কড়া নাড়লো আফিফ। তাজওয়ার রুমের দরজার কাছে আফিফকে দেখে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। আফিফ বিনয়ের সুরে বলল,
“আসতে পারি, স্যার?”

তাজওয়ার তেড়ে এসে আফিফের কলার ধরে তাকে রুমে ঢুকিয়ে তার নাক বরাবর ঘুষি দিয়ে তাকে মেঝেতে ফেলে দিলো। আফিফ সেকেন্ড খানিক মেঝেতে অচেতন হয়ে ছিল। সেকেন্ড খানিক পর আফিফ মাথা তুলে বলল,
“স্যার, আই এম সরি। আজ আমার ডিউটি ছিল, তাই এসেছি।”

তাজওয়ার আফিফের বুকে লাথি মেরে তাকে আবার মেঝেতে শুইয়ে দিলো। এবার সে আফিফের বুকে পা রেখে বলল,
“আমার সাথে এমন কেন করেছিস? প্রতিশোধ নিয়েছিস, তাই না?”

আফিফ ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
“স্যার, আপনার মতো দুঃসাহস আমার নেই। তবে আপনার সাথে যা হয়েছে তার জন্য বিন্দুমাত্র আফসোস নেই আমার। হয়তো আল্লাহ আপনাকে শাস্তি দিয়েছেন।”

তাজওয়ার কথাটি শুনেই আফিফের মুখ সজোরে একটা লাথি দিলো। এরপর আফিফকে ছেড়ে আলমারি খুলে তার পিস্তলটি বের করল। আফিফ কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমাকে সন্দেহ হওয়ার কারণ কি, স্যার?”

তাজওয়ার পিস্তলে গুলি ভরে আফিফের দিকে পিস্তল তাক করে বলল,
“কারণ তুই আমার প্রথম শত্রু।”

আফিফ শান্ত দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল,
“শত্রু তো আপনি। আপনি আমার আপার ক্ষতি করেছেন, আমার ছোট বোনের জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছেন। আর আমার…..”

আফিফ থেমে গেলো। তাজওয়ার ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তোর কি? হুম, বল? ডোন্ট সে, আহি তোর ভালোবাসা। আহি শুধু আমার। আর শোন, আমি তোকে আহির কাছে যেতে দেই নি, এটা ঠিক। কিন্তু তুই চাইলে আহির কাছে যেতে পারতি। তুই কি জানতি আহি তোকে কতোটা ভালোবাসতো? শুধু চিরকুট পড়েছিস। বাকিটা জানিস? এক তরফা ভালোবাসার সব সীমা অতিক্রম করেছে আহি, শুধু তোকে ভালোবেসে। ও তোর জন্য কি কি করেছে, তা আমি দেখেছি। আর যতোবার দেখেছি, ঠিক ততোবার তোকে খুন করতে ইচ্ছে করেছিল। কারণ আহির ভালোবাসা শুধু আমি ডিজার্ভ করি। আর কেউ না।”

আফিফ কোনো উত্তর দিলো না। তাজওয়ার আফিফের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে বলল,
“তুই যদি জানতি, নিশ্চয় আহিকে ফিরিয়ে দিতি না। তুই কি জানতি তোর ফিরিয়ে দেওয়ার পরও আহি তোর অপেক্ষায় ছিল?”

তাজওয়ার কথাটি বলে হাসলো। আফিফের কপাল থেকে পিস্তল সরিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো। সে আরো শব্দ করে হাসছে। হাসতে হাসতে জোরে জোরে তালি দিচ্ছে। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার দুই হাতের উপর ভর দিয়ে বিছানায় শুয়ে দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ মুখ ঘুরিয়ে নিতেই তাজওয়ার বলল,
“পদ্মকে ভালোবেসেছিলি?”

পদ্মের নাম শুনে আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার হেসে বলল,
“যদি বলি, তোর পদ্মফুল সব জানতো।”

আফিফ অবাক দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার হেসে বলল,
“পদ্মফুল নামটা কেন দিয়েছিস বল তো? ফুলের মতো পবিত্র, তাই?”

তাজওয়ার কথাটি বলে আবারও হাসতে লাগলো। আফিফ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“পদ্ম এই বিষয়ে কেন আসছে?”

তাজওয়ার উঠে বসে বলল,
“পদ্ম আসবে না? পদ্মই তো আমাকে…..”

তাজওয়ার থেমে গেলো। উঠে আফিফের সামনে এসে দাঁড়ালো। এরপর আফিফের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়া’র। আহি আফিফকে ভালোবাসে। কিন্তু তাজওয়ার ভালোবাসে আহিকে। পদ্ম আফিফকে ভালোবাসে, কিন্তু আফিফ ভালোবাসে… কাকে? হুম?”

আফিফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পদ্ম কি করেছে?”

“ইউজ ইউর ব্রেইন, আফিফ।”

তাজওয়ার সেকেন্ড খানিক থেমে বলল,
“ওপস, তুই বাঁচলেই তো ব্রেইন ইউজ করবি। তুই আমার এতো বড় ক্ষতি করে পার পেয়ে যাবি?”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ইউজ ইউর ব্রেইন ঠু। যেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেই ভিডিওটা রেকর্ড করার জন্য, বা ক্যামেরা সেট করার জন্য কি একবারো আমি আপনার সেই বাড়িতে গিয়েছিলাম?”

তাজওয়ার থেমে গেলো। মুহূর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো হ্যারির মুখটি। হ্যারি গিয়েছিল সেদিন রাতে। আবার সকালেই এসেছিল নাস্তা নিয়ে। অর্থাৎ এসব হ্যারি করেছে? তাজওয়ার আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ বলল,
“আপনি সিসিটিভি ফুটেজ দেখুন, আমি ওই বাড়ির আশেপাশেও যাই নি।”

তাজওয়ার কিছুই বললো না। তার পিস্তলটি বিছানা থেকে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তাজওয়ার চলে যেতেই আফিফ হালকা হাসলো। কিন্তু তার হাসিটা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো। তার মাথায় এই মুহূর্তে শুধু একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। আর সেটা হলো,
“পদ্ম কি করেছে, যার জন্য তাজওয়ার ওর নাম নিলো? পদ্ম কী জানতো?”

৯৮।

মেঝেতে শুয়ে আছে পদ্ম। শরীর-মন কিছুই চলছে না তার। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে আহির নম্বর। পদ্ম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই নামটির দিকে। তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে, একটি নাম। খেয়ালী। না, ভাবতে পারছে না পদ্ম। ফোনটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো সে। ধাক্কা খেয়ে ফোনটি দরজার কাছে গিয়ে থামলো। তখনই রুমে ঢুকলো আফিফ। আফিফকে দেখে পদ্ম উঠে বসলো। ব্যস্ত হাতে চোখ মুছলো। মেঝেতে পড়ে থাকা পদ্মের ফোনটি হাতে নিলো আফিফ। স্ক্রিনে আহির নাম দেখে সে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম আমতা-আমতা করে বলল,
“মাথা ব্যথা করছিল তাই।”

আফিফ নিঃশব্দে দরজা আটকে দিলো। ফোনটা টেবিলের উপর রেখে পদ্মের সামনে এসে দাঁড়ালো। পদ্ম উঠে দাঁড়াতে যাবে, তখনই আফিফ তাকে বসতে বললো। সে নিজেও পদ্মের সামনে পা গুটিয়ে বসলো। পদ্ম ভীত চোখে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আফিফ পদ্মের চোখের দিকে তাকালো। পদ্ম কাঁপা কন্ঠে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

আফিফ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“আহির ফোন ধরছিলে না কেন?”

“খেয়াল করি নি।”

“পদ্ম, তুমি হয়তো কিছু জানো, যা আমি জানি না। আমাকে বলো প্লিজ।”

পদ্মের চোখ ছলছল করে উঠলো। তাজওয়ার কি আফিফকে সব জানিয়ে দিয়েছে? আফিফ পদ্মের হাত স্পর্শ করে বলল,
“আমি তোমাকে চিনতে ভুল করি নি তো!”

পদ্ম আফিফের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি, আফিফ। আমি আপনাকে ভালোবাসি।”

“ভালো তো সবাই বাসে। কারো ভালোবাসা সুন্দর, আর কারোটা কুৎসিত।”

পদ্ম উঠে দাঁড়াতে যাবে তখনই আফিফ পদ্মকে শক্ত করে চেপে ধরলো। পদ্ম বলল,
“আমাকে মেরে ফেলুন, কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।”

“এজন্যই এই কয়েকদিন বেশ ভয়ে ছিলে, তাই না? যখন জানতে পারলে আহি আর তাজওয়ারের বিয়ে হবে না, তখন থেকেই তুমি খুব চিন্তিত। নিজের বান্ধবীর ক্ষতি করার মতো মেয়ে তো তুমি নও, পদ্ম।”

“আমি আহির কোনো ক্ষতি করি নি।”

“তাহলে কেন তুমি তাজওয়ারকে ভয় পাচ্ছো? লিনাশা, পুষ্প ওদের চোখে তো সেই ভীতি নেই। তাহলে তোমার চোখে কেন এতো ভয়?”

পদ্ম চুপ করে রইলো। আফিফ পদ্মকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
“আমি চাইলে নিজেই সব তথ্য বের করতে পারতাম। কিন্তু তখন আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যেতো। এখন নিজেই সত্যটা বলো। তোমার মুখ থেকেই সব জানতে চাচ্ছি। বলো, প্লিজ।”

পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল,
“ভালোবাসি আপনাকে। ভীষণ ভালোবাসি। আমি কিছু করি নি।”

“পদ্ম প্লিজ।”

পদ্ম কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“আমি জানতাম আহি আপনাকে ভালোবাসে। আপনিও আহিকে ভালোবাসতেন, তাই না?”

আফিফ চুপ করে রইলো। পদ্ম দেয়ালে লাগানো আহির সেই ছবিটির দিকে তাকালো। তারপর বলল,
“এক্সিভিশনে যেই মেয়ের ছবি এঁকেছেন, মেয়েটা আহি ছিল। আপনাকে ছবি তুলে পাঠিয়েছিল ও। আমার বান্ধবীর ছবি আমি চিনবো না? পড়েছি আপনার সেই নামহীন বইটা। বিয়ের আগেই পড়েছিলাম। যেদিন জানলাম, আহির সেই এআর আপনি, সেদিন আমার কেমন লেগেছে আপনাকে বোঝাতে পারবো না। কতোবার আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু আপনার দৃষ্টি শুধু এই দেয়ালের ফ্রেমে আটকে থাকতো। আহিকে ভালোবাসতেন আপনি। এই সত্যটা সহ্য হয় নি আমার। বিয়ের আগেই আমি অনেকবার আপনার ঘরে এসেছিলাম। মিষ্টি, নাস্তা এসব দেওয়ার বাহানায় আপনাদের বাসায় চলে আসতাম। ভীষণ ভালোবাসতাম আপনাকে। যেদিন টেবিলে আপনার সেই বইটি পেলাম, দম বন্ধ হয়ে এসেছিল আমার। আমি জানতাম, আপনি আমাকে কখনোই খুঁজবেন না। এই ছবির আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুখটিকেই খুঁজবেন। তাই আমি আপনাকে আহির ব্যাপারে জানাই নি। আহি প্রতিদিন ক্লাস শেষে আপনার ভার্সিটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমার খুব অস্থির লাগতো। যদি আপনি আহিকে দেখে ফেলেন? যদি জেনে যান, মেয়েটা কে? যাকে না দেখে এতোটা ভালোবাসলেন, তাকে জেনে গেলে কি পাগলের মতো ভালোবাসতেন না?”

আফিফের চোখ লাল হয়ে আসছে। সে এক দৃষ্টিতে পদ্মের দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল,
“বইটি পড়ে জেনেছি, আপনার আপার সাথে যা হয়েছে সেসবের জন্য কোনো না কোনো অংশে আহি দায়ী। তাজওয়ার খানই এসব করেছে। রেনুকেও নিয়াজীর সাথে বিয়ে দেওয়ায় তার হাত ছিল। তাজওয়ার খান ভেবেছিল, রেনুকে হাতে রাখলে আপনি আর আহির কাছে যাওয়ার সাহস পাবেন না। কিন্তু আমি তো জেনে গেছি সব। আমি জানতাম, আপনি আহিকে পাওয়ার জন্য, রেনুকে সেই সম্পর্ক থেকে বের করে আনতে চাইছিলেন। আমি ভয় পেয়ে যাই। যদি একবার রেনু নিয়াজীর বাড়ি থেকে চলে আসে, আর আপনি যদি জেনে যান, আহি তখনো আপনার অপেক্ষায় ছিল, আমার হয়তো আপনাকে আর পাওয়ায় হবে না।”

আফিফ থমথমে কন্ঠে বলল,
“তাই তুমি মাকে বুঝিয়েছো, রেনুর উপর হওয়া অন্যায়ের কথা আমাকে জানালে, আমি রেনুকে নিয়ে আসবো। তুমি আমার বোনটাকে সেই জাহান্নামে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস থাকতে বাধ্য করেছিলে?

পদ্ম ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
” না, না। মা নিজেই আপনার উপর এতো চাপ ফেলতে চান নি। আমি তো নিষেধ করি নি। শুধু এইটুকু বলেছি, আমাদের সংসার তো চলছে না। রেনুর তিনটা সন্তান, আফিফ কীভাবে চালাবে? যদি রেনু সন্তান রেখে আসে, তাহলে তো সহজ হবে।”

“আর তুমি জানো, রেনু কখনো নিজের সন্তানদের ওই বাড়িতে রেখে আসবে না।”

পদ্ম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো,
“এজন্যই হয়তো আমি কখনো মা হতে পারবো না। আমার পাপের শাস্তি আমি পেয়ে গেছি, আফিফ। আমাকে ছেড়ে দিবেন না। আমি সহ্য করতে পারবো না।”

“তাজওয়ারকে তুমি কি বলেছিলে?”

“আপনি এখনো আহিকে ভালোবাসেন। বইটাতে যা ছিল, সব বলেছি।”

“কি লাভ হলো এসব করে?”

“এরপরই তাজওয়ার আপনাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলো। বললো, যদি আপনি একমাসের মধ্যে কাউকে বিয়ে না করেন, তাহলে আহির সাথে সেই একই কাজ করবে, যেটা আপনার আপার সাথে করেছিল। আপনিও ভয় পেয়ে গেলেন। বিয়ের জন্য মাকে বোঝালেন। আমিও সুযোগ পেলাম। আপনার সামনে বার-বার চলে আসতাম। কথা বলতে চাইতাম। আগেও এমনটা করতাম। কিন্তু তখন আপনি বুঝেন নি। শুধু প্রতিবেশীই বানিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তাজওয়ার আপনাকে চাপ দেওয়ার পর, আপনি আমাকে খেয়াল করলেন। আপনার মনে হলো, আমি আপনার যোগ্য। আপনার শূণ্য হাত ধরার ক্ষমতা আমার আছে। আপনার ভেঙে যাওয়া মনটা জোড়া লাগানোর ক্ষমতাটাও আমার হাতে। এরপর কি সুন্দর করেই না আপনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। এরপর মাকে বোঝালেন। কিন্তু মা রাজী হলেন না। তিনি তো সেই ফোন কলের ওপাড়ে থাকা মেয়েটিকেই মনে মনে পছন্দ করে রেখেছিলেন। তবে তাতে আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। এতো ভালোবাসার পরও আপনাকে পাওয়ার ক্ষমতা আহির ছিল না, অথচ আমার হলো। আর এর চেয়ে বড় জয় তো কোনো কিছুতেই নেই। আর এরপর তো আপনি তাজওয়ারকে দেখানোর জন্য কাজী অফিসে গিয়ে আমাকে বিয়ে করলেন। আর এরপর ধীরে ধীরে আমি আপনার মন থেকে আহিকে বের করে নিজের জায়গাটা করে নিলাম।”

(***)

আফিফ দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। পদ্ম তার সামনে বসা। আফিফের চোখে অশ্রু ভীড় করেছে। পদ্ম তা মুছে দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই আফিফ তার হাত আটকে দিয়ে বলল,
“ভালোবেসে বিয়ে করি নি। কিন্তু তোমাকে ভালো মেয়ে ভেবেই স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। আমি তো ঠকে গেছি, পদ্ম।”

“না, আফিফ। আমি এতোটাও খারাপ না।”

“তুমি রেনু আর আহির কথা ভাবলে না? এটা কেমন সম্পর্ক!”

“আমার চেয়ে কি এখন আহি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো? আমি আপনার স্ত্রী। আহি কেউ না।”

“রেনু আমার বোন। আহি কেউ হোক না হোক। অন্যায় তো করেছো তুমি। আমার বিশ্বাসটা ভেঙে দিয়েছো।”

“আমি আপনাকে সত্য বলেছি। আপনি একটু আগে কি বললেন, আমি সত্য বললে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হবে না।”

আফিফ শার্টের হাতায় চোখ মুছে বলল,
“তুমি আমাকে ঠকিয়েছো। পদ্মফুল নাম দিয়েছি তোমার! ফুল ভেবেছি তোমাকে। আর তুমি অপমান করেছো আমাকে।”

আফিফ উঠে দাঁড়াতেই পদ্ম আফিফের পা ধরে বলল,
“আপনি আমাকে ছেড়ে দিলে, আমি নিজের প্রাণ নিয়ে নেবো।”

“নীরবে নীরবে তো তুমি অনেকের প্রাণ নিয়ে নিয়েছো। তুমি তো তাজওয়ারের চেয়েও ভয়ংকর।”

(***)

হ্যারির কপালে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে আছে তাজওয়ার। হ্যারি ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার তা দেখে বলল,
“আ’র ইউ রেডি টু গো টু হেল?”

“ইউ কিল্ড মাই ফ্রেন্ড। আই হ্যাভ এক্সপোসড ইউ।”

“এন্ড আই উইল কিল ইউ, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড হ্যারি।”

“আই ডোন্ট কেয়া’র।”

হ্যারি কথাটি বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো, আর তখনই তাজওয়ার তার পিস্তল চালালো।

পরদিন সন্ধ্যায় হ্যারির মৃত শরীরটা হোটেল রুম থেকে বের করলো পুলিশ। স্পষ্ট তাজওয়ারই এই খুন করেছে। কারণ সিসিটিভি ফুটেজের রেকর্ডে তাজওয়ারই শেষবার হ্যারির সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষকে মোটা অংকের টাকা দেওয়ায় তারা রেকর্ডটা ডিলিট করে দেয়৷ আর শেষমেশ পুলিশও ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে মিডিয়াতে চালিয়ে দেয়। হ্যারির পক্ষে তাজওয়ার ছাড়া কেউই ছিল না। অজ্ঞাত আমেরিকান যুবক হ্যারি। বাবা-মার কোনো পরিচয় নেই। তাজওয়ারের সাথে আমেরিকায় একসাথে পড়াশুনা করেছিল। সেই সূত্রেই তাদের বন্ধুত্ব। এরপর দেশে আসা। তাজওয়ার পোস্টমর্টেমের সুযোগ দেয় নি। মিডিয়ার হুড়োহুড়ির জন্য ঘর থেকে বের হতে পারে নি সে। তার উপর হ্যারির মৃত্যুটাও তাজওয়ারকে কয়েক সপ্তাহ প্রতিটি গণমাধ্যমে আলোচনায় রাখবে। তাই গোপনেই কয়েক সপ্তাহের জন্য দেশ ছাড়তে বাধ্য হলো তাজওয়ার।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here