#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৯ (২য় ভাগ)||
১০০।
বেশ কয়েকদিন ধরেই আফিফ দেরীতে বাসায় ফিরছে। চুপচাপ হয়ে গেছে সে। পদ্মের সাথে প্রয়োজনের বাইরে কথা বলছে না। পদ্মের এসব সহ্য হচ্ছে না। যাকে পাওয়ার জন্য সে এতো বড় দুঃসাহসিক কাজ করেছে, আজ সেই মানুষটাই তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আহির ক্ষতি করার কথা সে জীবনেও ভাবে নি। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার মনে হয়েছিল, আফিফকে না পেলে সে সুখী হবে না। এজন্যই তাজওয়ারকে সাহায্য করেছিল পদ্ম।
আফিফ রান্নাঘরে এসে জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে। রান্নাঘরে টুকটাক শব্দ শুনে পদ্ম দৌঁড়ে গেলো। দেখলো আফিফ কিছু একটা খুঁজছে। পদ্ম আফিফের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমাকে বলুন না, কি লাগবে। আমি খুঁজে দিচ্ছি।”
আফিফ চুপ করে রইল। পদ্ম আফিফের হাত স্পর্শ করার আগেই আফিফ সরে দাঁড়ালো। তখনই তারা দেখলো রান্নাঘরের বাইরে আফিফা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। আফিফা বেগমকে দেখে আফিফ বলল,
“মা, তুমি? চা খাবে?”
আফিফা বেগম বললেন,
“তুই এখানে কি করছিস?”
“চা বানাতে এসেছি।”
“তুই কেন চা বানাবি? পদ্ম আছে না?”
“আমার বানাতে ইচ্ছে করছিল।”
আফিফা বেগম পদ্মের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি আমার ছেলেকে রান্নাঘরে কেন ঢুকতে দিলে? সারাদিন কাজ করে এসে ক্লান্ত হয়ে যায় আমার ছেলেটা। যাও, আফিফ আর আমার জন্য কড়া করে দুই কাপ চা বানিয়ে আনো।”
পদ্ম মাথা নেড়ে বলল, “জ্বি, আচ্ছা।”
পদ্ম যেন এই সুযোগটাই চাচ্ছিলো। সে ক্ষিপ্র গতিতে দুই কাপ চা বানিয়ে আফিফের সামনে এনে রাখলো। আফিফ এক কাপ মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্য কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। পদ্ম আফিফের চলে যাওয়া দেখে সেও তার পিছু পিছু গেলো। আফিফা বেগম পদ্ম আর আফিফের মধ্যে চলা শীতল সম্পর্ক আন্দাজ করতে পেরে মনে মনে খুশি হলেন। বিড়বিড় করে বললেন,
“এবার অন্তত আমার ছেলেটা একটা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিক।”
এদিকে আফিফ বারান্দায় গিয়ে বসতেই পদ্ম তার পাশে এসে বসলো। আফিফ চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। পদ্ম আফিফের হাত ধরে বলল,
“আপনি বলেছিলেন, সত্যটা স্বীকার করলে আমাকে ছেড়ে যাবেন না।”
আফিফ কোনো উত্তর দিলো না। পদ্ম আফিফের গালে হাত রেখে বলল,
“আহিকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু আপনার চেয়ে বেশি না। আপনারও কি উচিত না, আমাকে আহির চেয়ে বেশি ভালোবাসা।”
আফিফ এবার ভ্রূ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্ম বলল,
“আমি আপনার স্ত্রী।”
“তুমি আমার স্ত্রী কীভাবে হয়েছো? আমাকে ঠকিয়ে, আমার সাথে প্রতারণা করে। এখন আমাদের সম্পর্কটাই তো মিথ্যে হয়ে গেছে।”
“কিন্তু তবুও আমি আপনার স্ত্রী।”
আফিফ কাপটা ধপ করে বারান্দার মেঝেতে রাখলো। পদ্ম কেঁপে উঠে বলল, “মা শুনবে।”
আফিফ রুমের ভেতরে যেতে চাইলেই পদ্ম তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করা যায় না?”
“তুমি যদি আমাকে সেই দিনটা ফিরিয়ে দিতে পারো, তাহলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেবো।”
পদ্ম আফিফকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“সেই দিনটা মানে? কোন দিনটা? আপনি কি আবার আহিকে ফেরত চাচ্ছেন?”
“আমি আহিকে চাচ্ছি না। আমি সেই দিনটা চাই, যেদিন তোমার চোখ, তোমার হাসি, তোমার কথাবার্তা দেখে মনে করেছিলাম, তোমার মতো ইনোসেন্ট মেয়ে হয়তো আল্লাহ খুব কম বানিয়েছেন। কিন্তু এখন যদি সেই দিনটা ফিরে পাই, আমি আবার ভালোভাবে তোমাকে দেখতে চাই। জানতে চাই, কি এমন ভুল ছিল আমার চোখে যে আমি তোমার অভিনয়টাই ধরতে পারলাম না।”
পদ্ম চুপ করে রইলো। আফিফ বলল,
“তুমি তো আগে থেকেই সব জানতে! তাহলে অজ্ঞ থাকার জন্য তুমি ঠিক কি কি অভিনয় করেছিলে, বলবে? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তোমার মধ্যে কোন সত্তাটা সত্য, কোনটা মিথ্যে। তোমাকে আমি চিনতেই পারছি না, পদ্ম। আমাদের সংসারটাই তুমি মিথ্যে দিয়ে শুরু করেছো। পাঁচ বছরের সংসার আমার কাছে এক মুহূর্তেই মিথ্যে হয়ে গেছে। আমি এই সম্পর্কে আর কোনো আগ্রহ পাচ্ছি না।”
“আপনি বলেছিলেন, আপনি আমাকে ছাড়বেন না।”
“ছাড়বো না বলেছিলাম। কিন্তু তোমাকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না। পারবোও না। বিশ্বাস ছাড়া বাকি জীবন কাটানো খুব কষ্টকর হয়ে যাবে। আর হয়তো এটাই আমার শাস্তি। তোমাদের দুই বান্ধবীর সাথে দেখা হওয়ার শাস্তি। বিনা অপরাধে তুমি আর ওই তাজওয়ার খান মিলে ইচ্ছেমতো কিছু মানুষকে শাস্তি দিয়ে যাচ্ছো। আমাদের জীবনটা কি তোমাদের বাবার নামে লেখা ছিল?”
“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আগে তো কখনো এভাবে আমার সাথে কথা বলেন নি!”
“তখন কি জানতাম, তুমি কি কি করেছো আমার সাথে?”
“কি করেছি আমি? শুধু আপনার ডায়েরী পড়েছি। আহিকে আপনার কাছ থেকে দূরে সরানোর জন্য তাজওয়ারকে আপনার ভালোবাসার কথা জানিয়েছি। তাজওয়ার তো আহির কোনো ক্ষতি করতো না। ও শুধু আপনাকে ভয় দেখিয়েছিল। আর রেনুর ব্যাপারে আমার জায়গায় আহি থাকলে একই কাজটাই করতো।”
“কখনো না। আহি আর তোমার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। মেয়েটা তোমার জন্য নিজের আবেগটা কীভাবে ধরে রেখেছে, তুমি ভাবতেও পারবে না। কি করে নি সে? একবারো আমাকে এসে বলে নি, পদ্মকে ছেড়ে দিয়ে আমার হাত ধরো। একবারো বলে নি। ও যদি সত্যটা জানে, ঘৃণা করবে তোমাকে। ইনফ্যাক্ট, আহি ঘৃণায় করতে জানে না। ও তো তোমাকে ক্ষমা করে দেবে। সে তো আবার মহানুভবতার জ্বলন্ত মূর্তি! তবে একটা কথা কি জানো, ওর মতো একটা মেয়েকে ফ্রেন্ড হিসেবে অন্তত তুমি ডিজার্ভ করো না। তোমার ভাগ্যটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের ভালো, তাই আহির মতো একটা বান্ধবী পেয়েছো। আহির জায়গায় তুমি থাকলে আমার সংসার যেদিন মা ক্যাম্পাসে গিয়েছিল, সেদিনই ভেঙে যাওয়ার কথা ছিল। মেয়েটা তোমাকে ঊর্ধ্বে রাখার জন্য, মায়ের সামনে নিজেকে ছোট করেছে। মাকে বুঝিয়েছি, সে পদ্মের মতো নম্র, ভদ্র, শালীন ঘরের মেয়ে নয়। সে তোমার চরিত্রকে ফুলের মতো দেখানোর জন্য রাদকে জড়িয়ে ধরে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।”
“আর আপনার সেটা ভালো লাগে নি।”
আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“ভালো লাগে নি। একদম ভালো লাগে নি। আমি যাকে ভালোবাসি, তাকে সুখী দেখতে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু উৎশৃঙ্খল দেখতে চাই না।”
“তার মানে আপনি আহিকে ভালোবাসেন?”
“তুমি না আমার ডায়েরী পড়েছিলে? তুমি তো সব জেনে গেছো। এখন আবার এমন অভিনয় করছো কেন?”
“আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।”
“ভালোবাসতাম। এখন আমার দায়িত্ব তুমি, তাই আহির প্রতি ভালোবাসা দেখানোর আমার কোনো অধিকার নেই। আমি আমার ভালোবাসা নোংরা করতে চাই না। তোমাদের মতো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিজের ব্যক্তিত্বকে নিচে নামানোর ইচ্ছে আমার নেই। যাকে পাওয়ার ক্ষমতা নেই৷ তাকে ধরে রাখি না আমি। আহির প্রতি মায়া আমার এখনো আছে। মায়া থাকার অর্থ এই না যে আমি ওর সাথে প্রেম করবো, নোংরামি করবো, তোমার আড়ালে গিয়ে ওর সাথে ঘুরাঘুরি করবো। মায়া মানে যত্ন করা, তার ভালো চাওয়া, তার বিপদে সাহায্য করা। তোমাকে কেন বলছি এসব? তুমি কি বুঝবে মায়া আর ভালোবাসা। তোমার আর তাজওয়ারের মধ্যে মায়া আর ভালোবাসা নেই। জেদ আছে। শুধুই পাওয়ার জেদ। আর ভালোবাসা মানে ত্যাগ করতে জানা।”
(***)
সুনেহরাহ লিনাশার হাতে লাবণির কিছু গোপন তথ্য দিয়ে বলল,
“এখানে সব আছে। ফাইলস, রেকর্ডিং সবটাই। লাবণি মেহেরা অনেক ছেলের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িত ছিলো। আর এখন তার নতুন বয়ফ্রেন্ড তাজওয়ার খান।”
লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আহির সাথে তো তাজওয়ারের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।”
“হ্যাঁ, কিন্তু লাবণি মেহেরা তো বিয়ের করার জন্য কারো সাথে সম্পর্কে যায় নি। জাস্ট ইনজয়…”
লিনাশা সুনেহরাহকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমাদের কাছে যেসব সম্পর্ক সো কল্ড ইনজয়মেন্ট, অনেকের কাছে সেই সম্পর্ক জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তোমাদের মতো মেয়েরা ছেলেদের সিডিউস করে তাদের চরিত্র নষ্ট করবে আর তাদের সংসারও ভাঙবে। তবে আমি তাজওয়ারকে ভালো বলবো না। খারাপ হওয়ার থাকলে মেয়েদের এক ইশারায় ছেলেদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। আর যারা আলটিমেট ভালো, তাদের সামনে হাজার বার কোমড় দুলিয়ে গেলেও তোমাদের মতো চিপ ক্যারেক্টরের মেয়েদের দিকে তারা চোখ তুলে তাকাবে না। আর তোমরা পাবেও তোমাদের মতো চিপ ম্যান।”
সুনেহরাহ চোখ-মুখ শক্ত করে লিনাশার কথা হজম করে যাচ্ছে। লিনাশা ধমকের সুরে বলল,
“যাও। তোমার প্রেম লীলা আপতত আমাদের কাছেই থাকুক। যতোদিন লাবণিকে এই প্রমাণগুলো দ্বারা ফাঁসাতে না পেরেছি, তোমাকে তোমার কুকর্ম থেকে মুক্তি দেওয়া যাচ্ছে না। বলা তো যায় না, আমরা তোমার কুকর্মের সব তথ্য তোমাকে দিয়ে দিলাম, আর তুমি অনেস্ট চামচি হয়ে তোমার সো কল্ড ম্যাডামকে আমাদের কথা বলে দাও। যাও এবার। তোমার মুখটা দেখার রুচি চলে গেছে।”
সুনেহরাহ ধীর পায়ে হেঁটে চলে গেলো। দরজার কাছে গিয়ে সে পেছন ফিরে বলল,
“তাজওয়ার আর লাবণি ফিজিক্যালিও ইনভলভড।”
লিনাশা চমকে সুনেহরাহর দিকে তাকালো। সুনেহরাহ বলল,
“তাজওয়ার খান তার একটা বাংলো বাড়ি লাবণির নামে করে দিয়েছিলো। ওখানে তাদের প্রায়ই যাওয়া হয়। ক্লাবে যাচ্ছে বলে, লাবণি মেহেরা সেখানেই যায়।”
সুনেহরাহ কথাটি বলেই চলে গেলো। লিনাশা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। কেমন অস্থির লাগছে তার। লাবণির বিরুদ্ধে থাকা প্রমাণগুলো টেবিলের উপর রেখে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তুমি কখন থেকে এতো খারাপ হলে আপু? আমার আপু তো এতোটা খারাপ ছিল না। নিজেকে তোমার বোন বলে পরিচয় দিতেও লজ্জা করছে। আমার শ্বশুড় বাড়ির লোকেরা যখন জানবে, আমার বড় আপু এতো নীচ চরিত্রের, আমাকে কি একটুও কথা শুনতে হবে না? লোকে কি বলবে না, একই মায়ের সন্তানে এতো পার্থক্য কীভাবে? ওরা কি আমাকেও সন্দেহ করবে না? নায়ীব কি আমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারবে? কখনো কি একটুও খোঁচা খেতে হবে না? তুমি শুধু নিজেকে কলঙ্কিত করো নি, আপু। আমাকে ডুবিয়েছো, বাবা-মার সম্মানও ডুবিয়েছো। কেন এমন পালটে গেলে তুমি?”
(***)
তাজওয়ারের দেশে আসার খবরটা আফিফ পেয়ে গেছে। দেশে এসে সে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। তাজওয়ার খুব বাজে একটা পরিকল্পনা করেই যে দেশে এসেছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত আফিফ। যে করেই হোক এক সপ্তাহের মধ্যে তাজওয়ারকে গ্রেফতার করাতে হবে। নয়তো সে যে কারো ক্ষতি করতে পারে। আফিফ নিলয়ের সাহায্যে অনেক গবেষণার পর বের করলো তাজওয়ার তার নতুন বাংলো বাড়িতে উঠেছে। জায়গাটা কাপ্তাইয়ের কাছাকাছি। নিলয় বলল,
“পাশেই বিজিবি ক্যাম্প আছে। একটু রিস্কি হয়ে যাবে৷ তুই এই বাইক নিয়ে ওখানে যেতে পারবি না। কারণ তাজওয়ার কিন্তু আগেই সেই কালো বাইকারের উপর কেইস করে রেখেছে।”
“আমি জাস্ট যাবো, আর জেনে আসবো ও ওখানে কি ষড়যন্ত্র করছে।”
“অনেক সিকিউরিটি। ফেঁসে যাবি তুই।”
“কিন্তু এটাই শেষ সুযোগ। তাজওয়ার মুহূর্তেই যে কোনো কিছু করতে পারে। ওকে আগে থেকেই হাতে রাখতে হবে।”
“আর তোকে কে বলেছে ওখানে গেলেই তুই সব তথ্য পাবি?”
“অন্তত দেখে আসা যায়।”
“কি দেখবি গিয়ে?”
“আমার মনে হচ্ছে ও যেহেতু ওখানে গেছে, নিশ্চিত ওখানে কিছু একটা থাকবে যেটা অত্যন্ত গোপনীয়৷ আর বিজিবি ক্যাম্প পাশের রাস্তায়। ওর বাংলোটা আরো আগে। কিছু হবে না।”
“আর ওখানে ওর বডিগার্ডরা!”
“আগে যাই। এরপর বুঝবো ভেতরে কীভাবে ঢুকতে হবে। না গিয়ে তো আর আন্দাজ করতে পারছি না৷ আর ওই জায়গাটা সেইফ। তাজওয়ার হয়তো ওতো সিকিউরিটি রাখবে না। কারণ প্রটেকশন দরকার এমন জায়গায় ওর সিকিউরিটি খুব দুর্বল।”
“কেন? ও কি মনে করে কেউ ওর ক্ষতি করবে না?”
“ওভার কনফিডেন্স আছে তাজওয়ারের। ও মনে করে একমাত্র ওর মাথায় মগজ আছে। বাকিরা গরু।”
“তুই গরুই তো ছিলি। এতো বছর কিছু করিস নি।”
আফিফ চোখ ছোট করে নিলয়ের দিকে তাকালো। বলল,
“আমি দুর্বল ছিলাম। আমি স্বীকার করতে বাধ্য, আমার মনের জোর কম ছিল। কিন্তু আমি জানি না, সেদিন আহিকে দেখে আমার কি হয়েছিল। সেদিন ও সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে শুনেই আমার আমিটাই পরিবর্তন হয়ে গেলো। মনে অদ্ভুত রকমের সাহস জন্মালো। ভেবে নিয়েছি, এবার আমি মরে গিয়েও ওই তাজওয়ারের হাত থেকে আহিকে মুক্ত করে যাবো। আর কোনো কিছুর পরোয়া করবো না। কারণ আপার জায়গায় আমি আর কাউকে দেখতে চাই না।”
“আহিকে এখনো ভালোবাসিস?”
আফিফ নিলয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। নিলয় তার একমাত্র বন্ধু, যাকে সে আহির ব্যাপারে হালকা জানিয়েছিলো। পুরোটা জানানোর আগেই সে আহিকে হারিয়ে ফেলেছিল। নিলয় এর অনেক পরেই আহির জন্য আফিফের জীবনে আসা ভয়ংকর অধ্যায়গুলো সম্পর্কে জেনেছিল। ততোদিনে পদ্ম আফিফের স্ত্রী। পদ্মকে ভাবী হিসেবে বেশ পছন্দ নিলয়ের। তবে আফিফ এখনো পদ্মের সত্যটা কাউকে জানায় নি। জানাতে পারবেও না। কারণ শত খারাপ হলেও পদ্ম এখনো তার স্ত্রী।
(***)
রাদকে না বলে আহি একাই চলে এসেছে কাপ্তাই। রাদ ইদানীং একটু বেশিই আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে আহির উপর। দায়িত্ববান পুরুষ হয়ে আহির পাশে থাকতে চাইছে। কিন্তু আহি রাদকে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতেই পারছে না। রাদের স্পর্শে শান্তি পাচ্ছে না সে। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের দ্বিধাদ্বন্ধ বুঝতে পেরে বলেছিলেন, আপতত বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে না তার। আগামী কয়েক বছরেও তিনি বিয়ের জন্য আহিকে চাপ দিবেন না। আহি প্রশান্তির হাসি হেসে সালমা ফাওজিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
“আমি কখনোই বিয়ে করতে চাই না। আমার মনটা এখন মৃত সাগর। এখানে শুধু ভাসা যায়৷ ডুবা যায় না। এই মনে একজনকে ডুবিয়েই তো এর মৃত্যু ঘটিয়েছি। কেউ চাইলেই কি সেই অনুভূতির গভীরতা স্পর্শ করতে পারবে? কিন্তু আমি রাদকে বন্ধু হিসেবে অনেক ভালোবাসি। আমার জন্য অনেক করেছে ছেলেটা। তাই আমি কি এই মনটা আরেকটু মেরে ফেলতে পারি না ওর জন্য? তুমি তো বাবার সাথে কম্প্রোমাইজ করে অনেক বছর সংসার করেছিল। আর রাদ তো মানুষ ভালো।”
কথাটি শুনেই আহির ভেতরের তীব্র দহন উপলব্ধি করলো সালমা ফাওজিয়া। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“একা থাকো। তবুও এমন কাউকে জীবনে এনো না, যাকে ভালোবাসা যায় না। তার চেয়ে একা থাকো, ভালো থাকো। মানসিক তৃপ্তি পাবে। আমি তো আছিই তোমার পাশে। আবার যদি সেই ভালোবাসা খুঁজে পাও, সেদিন আমিই তোমার বিয়ে দেবো। আহি, একদিন তুমি আবার ভালোবাসবে। নতুন করে ভালোবাসবে। তখন আর কেউ তোমাকে আটকাবে না। না তাজওয়ার খান, না তোমার বাবা।”
এদিকে লিনাশার কাছ থেকে তথ্য নিয়েই কাপ্তাই এসেছে আহি। কাপ্তাইয়ে তাজওয়ারের একটা বাংলো বাড়ি আছে। যেখানে সে লাবণিকে নিয়ে এসেছে। চুনিকে ফোন করে জেনে নিয়েছে লাবণি এখন বাসায় নেই। সে না-কি তার বান্ধবীদের নিয়ে তিন দিনের ভ্রমণে বের হয়েছে। কয়েক দিন আগে চুনি তাকে ফোন করে বলেছিল, লাবণির ফোনে না-কি তাজওয়ারের কল এসেছে। তাজওয়ারের নাম সেইভ করা ছিল হার্ট দিয়ে। ইংরেজিতে ছিল তাই চুনি পড়তে পারে নি। তবে আহি তাকে ইংরেজি বর্ণমালা চিনিয়েছিল। তা দেখেই সে আহিকে বলেছিল, সেই নামটিতে এইচ ই এ আর টি এই বর্ণগুলো ছিল। আর পেছনে তাজওয়ারের ছবি। আহি শুনেই লাবণি আর তাজওয়ারের মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। আর সুনেহরাহ বলার পর যেন মাত্রাতিরিক্ত নিশ্চিত হয়েছে। তাজওয়ার আর লাবণির সম্পর্ক যে এতো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাবে সেটা ভাবতেই পারে নি আহি। আর যাই হোক, লাবণি আহির বাবার স্ত্রী। সেই সূত্রে তার সৎ মা। তার বাবার সম্মান। আহির এবার লাবণির সত্যটা তার বাবাকে দেখাতেই হবে। তাই সে কাপ্তাই চলে এসেছে, তাদের হাতেনাতে ধরে তার বাবার সামনে লাবণির মুখোশটা উঠানোর জন্য।
(***)
বিকেলেই বাংলো বাড়ির কাছে চলে এলো আহি। গাড়ি নিয়ে আসে নি। সিএনজি থেকে অর্ধেক রাস্তায় নেমে ড্রাইভারটির নম্বর নিয়ে নিয়েছিলো সে। প্রয়োজন হলে ফোন করবে বলে বিদায় করেছিল তাকে। এরপর হেঁটে হেঁটেই বাংলো বাড়ির কাছাকাছি চলে এলো। পাশে ঘন জঙ্গল। গেট টপকে যাওয়া অসম্ভব। গেটের কাছেই পাহারাদার। তাদের হাতে বন্দুকও আছে। আহি পাশের জঙ্গলে ঢুকলো। সে জঙ্গল ঘুরে বাংলো বাড়ির সীমানায় এসে দাঁড়ালো। কয়েক ফুট উঁচু দেয়াল। এই দেয়াল টপকানোর জন্য পায়ের জুতো খুলে অনেক কারসাজি করে আহি দেয়ালের উপর উঠলো। দেয়ালের উপর সূচালো ফলার মতো গ্রিল লাগানো। আহি শক্ত করে ওইগুলো ধরে উঠে দাঁড়ালো। এরপর নিজেকে সূচালো ফলা থেকে বাঁচিয়ে লাফিয়ে পড়লো অন্য সীমানায়। এদিকে পাহারা দেওয়ার কেউ নেই। আহি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সিসি ক্যামেরাও কোথাও লাগানো নেই। পাহারাদাররা পাহারা দিচ্ছে শুধু গেটের কাছেই। আহি ভালোভাবে নিজেকে ঝোপঝাড়ে আড়াল করে রাখলো। অন্ধকার হলেই ক্যামেরা নিয়ে ভেতরে ঢুকবে। এদিকে কয়েক ঘন্টা কেটে গেলো। সন্ধ্যা নামতেই আহি ভেতরে ঢুকলো। পেছনের জানালা হাতিয়ে হালকা ফাঁকা জায়গা পেয়েই বাড়ির ভেতরে চোখ দিলো আহি। ভেতরে তাকাতেই আহির লোম দাঁড়িয়ে গেলো। লাবণি মেহেরা একটু বেশিই খোলামেলা পোশাক পরেছেন। আহি চাইলে এখুনি ভিডিও করতে পারে। কিন্তু সে আশেপাশে তাজওয়ারকে দেখছে না। আর তাজওয়ার সহ ভিডিওতে না এলে তার বাবা কখনোই তার কথা বিশ্বাস করবে না। ভেতরে ঢুকার কোনো ব্যবস্থায় নেই। পাশে একটা পানির পাইপ আছে। ওটা বেয়ে বারান্দায় যাওয়া যাবে। আহি অনেক ভেবে সেই পাইপটা বেয়ে উপরে উঠলো। বারান্দায় উঁকি মারতেই বুঝলো এই রুমে কেউ থাকে না। আহি রুমে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। সাবধানে রুমের দরজা খুললো। ধীরে ধীরে রুমের বাইরে মাথা বের করে দেখলো উপরের তলায় কেউ নেই। আহি হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এসে নিচে তাকালো। দেখলো তাজওয়ার বিশ্রীভাবে সোফায় শুয়ে আছে। তার দৃষ্টি টিভির স্ক্রিনে। লাবণি দু’টি কাপ হাতে নিয়ে তাজওয়ারের পাশে বসলো। তাজওয়ার লাবণির স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দিচ্ছে। স্পষ্ট ভাবে লাবণির চেহারা বোঝা যাচ্ছে। আহি ক্যামেরা বের করে তাদের প্রেমলীলা রেকর্ড করে নিলো। মনে মনে হাসলো আহি আর বলল,
“তুমি তো গেছো লাবণি মেহেরা। এতো বড় ফিল্ম রিলিজ হলে, তুমি তো সুপারস্টার হয়ে যাবে। আর আমি আমার প্রথম হিট ফিল্মের জন্য এওয়ার্ড পাবো। ওয়াও।”
আহি ক্যামেরা ব্যাগে ঢোকানোর মুহূর্তেই লাবণির দৃষ্টি উপরে গেলো। আহির চেহারা না দেখলেও সে কারো হাত স্পষ্টভাবে খেয়াল করেছে। লাবণি অস্থির হয়ে পড়লো। ভীত কন্ঠে বলে উঠলো,
“কে ওখানে?”
তাজওয়ার তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো। এদিকে আহি বুঝতে পারলো লাবণি তাকে দেখে ফেলেছে। সে ভয় পেয়ে গেলো। দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে পাশের রুমে ঢুকে পড়লো। ভেতরে ঢুকে বারান্দার কাছে যেতেই খেয়াল করলো, রুমের দরজাটা সে বেখেয়ালিতে জোরে বন্ধ করে ফেলেছে। এদিকে রুমের দরজা জোরে বন্ধ হওয়ায় তাজওয়ার আর লাবণি বুঝে ফেললো উপরে কেউ আছে। তাজওয়ার দেরী না করে দ্রুত জামা গায়ে দিয়ে তার ড্রয়ার থেকে পিস্তল বের করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। আর লাবণিকে বলল, উপরে উঠে দেখতে। আহি ততোক্ষণে লাফিয়ে নিচে নেমে এসেছে। লাফিয়ে পড়তেই পা মুচড়ে গেছে আহির। জোর পাচ্ছে না হাঁটার। এদিকে তাজওয়ার চেঁচিয়ে পাহারাদারদের বলল, বাড়িতে কেউ ঢুকেছে। আহির কানে সব শব্দ আসছে। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে তার। কোনোভাবে সে সরে জঙ্গলের দিকে যেতেই তাজওয়ার সেখানে চলে এলো। অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় শুধু অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। তাজওয়ার পিস্তল তাক করে ইচ্ছেমতো গুলি ছুঁড়তে লাগলো। আহি দৌঁড়ে ঝোপঝাড়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার মনে হচ্ছে বেশিক্ষণ বাঁচতে পারবে না। হঠাৎ কোমড়ে কারো স্পর্শ পেলো আহি। কিছু বলার আগেই সে অনুভব করলো তাকে কোলে নিয়ে কিছু একটা বেয়ে উঠে যাচ্ছে একটা মানুষ। আহি শব্দ করলো না। দেয়ালের এপাড়ে এসে অন্ধকারেই বেঁধে রাখা রশিটা টেনে তুললো হেলমেট পরা এক যুবক। আহি কিছু বলার আগেই গোলাগুলির শব্দ বাড়লো। জঙ্গলের দিকেই তাজওয়ারের পাহারাদারগুলো এগিয়ে আসছে। আহি কিছু বুঝে উঠার আগেই পাশের যুবকটি তার হাত ধরে দৌঁড়াতে লাগলো। কিছুদূর গিয়েই ঢালু পথের কাছে এসেই দু’জনেরই পা ফসকে গেলো। আর তারা ঢালু অংশ বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আহির পা চলছে না। মুচড়ে যাওয়া পায়ের উপর জোর দিয়ে হাঁটায় হয়তো তার পা’টাই অসার হয়ে গেছে। এখন শরীরের কিছু অংশে যেন শুধু আঘাত পাচ্ছে। সে অনুভব করলো একটা হাত তার হাত ধরে তাকে কাছে টেনে আনলো। আহির এবার শুধু পিঠেই আঘাত হচ্ছে। তার হাত দু’টি কারো বুকের সাথে সেঁটে আছে। হেলমেট থাকায় যুবকটি মাথায় আঘাত পাচ্ছে না। সে খুব শক্ত করে আহির মাথাটা তার হাত দিয়ে আড়াল করে রেখেছে। অনেক দূর গড়িয়ে পড়ার পর হেলমেট পরা যুবকটি নিজের ভারসাম্য ধরতে পারলো। আহি বুঝলো তারা অনেক ধাক্কা খেয়ে ঢালু পথ পার করতে পেরেছে। সে এবার মাথা তুলে যুবকটির দিকে তাকালো। হেলমেট পরা যুবকটি হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। এদিকে আহির শরীরে ভীষণ ব্যথা। তবুও সে কষ্ট করে যুবকটির বুকের উপর থেকে নেমে পাশে শুয়ে পড়লো। ঘোলাটে লাগছে সবকিছু। নিভু নিভু দৃষ্টিতে পাশ ফিরে একবার আগন্তুকটির দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলো সে।
চলবে-