#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২
উষ্ণীয় আলিঙ্গনে ঘুমের জোড় বাড়লো তোঁষা’র। নাক,মুখ ডুবিয়ে শ্বাস টেনে নিলো সে। শীতের সকালে এহেন আলিঙ্গন তার নিকট নতুন। আরহাম জেগেছে ঘন্টা খানিক আগেই কিন্তু তোঁষা’কে এতটা আদুরে মুহূর্তে পেয়ে আর ছাড়তে পারে নি সে। এই মেয়েটা যে তার প্রাণে’র অনেকটা জুড়ে। এই প্রথম এতটা কাছে পেয়েছে তাকে আরহাম। না চাইতেও তার মনে হানা দেয় বিভিন্ন সংশয়। যদি কেউ ছিনিয়ে নেয় তার প্রাণ’কে? যদি কেউ টের পায়? আদনান কি টের পাবে এই লোকালয়ের বাইরে যে তার ভালোবাসা’কে লুকিয়েছে আরহাম? পরক্ষণেই সকল অযাচিত চিন্তাভাবনা বাদ দেয় আরহাম। কেউ টের পাবে না। কখনোই না। এই বাইশ তলার উপর কে ই বা টের পাবে যে আরহাম লুকিয়ে রেখেছে তার প্রাণ’কে? তবুও যেন আরহামের চিন্তার শেষ নেই। মাঝেমধ্যে ভীষণ রাগ উঠে ওর শুধুমাত্র তোঁষা’র উপর। কে বলেছিল এই মেয়ে’কে আরহাম’কে এতটা পাগল করতে? ছোট থেকেই সে দৌড়ে বেড়ায় আরহামে’র রন্ধ্রে রন্ধ্রে। শিরায় উপশিরায়। ইশ! কতটাই না জ্বালাময় সে অনুভূতি।
পিটপিট করে চোখ খুলার চেষ্টা করে তোঁষা। গালে এখনও টনটনে ব্যাথার উপস্থিতি তার ঘাড় সহ মাথায় ও উঠেছে যেন। অল্প সল্প খোলা চোখে অক্ষিপটে ভেসে উঠে আরহামে’র সুশ্রী মুখমন্ডল। প্রথমে অবাক হলেও ক্ষাণিকের মাঝেই ওর মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেলো। লাল হওয়া গাল দুটো তখন গর্তে ঢুকেছে যেন। গালের পেশির মাঝে বড়বড় গর্ত এই রুপসীর রুপ যেন বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। আরহাম আলতো হাতে ছুঁয়ে দেয় ওর গাল। অল্প ব্যাথায় মুখে শব্দ করে তোঁষা,
— আহ!
তোঁষা’র ব্যাথাটা অল্প হলেও আরহাম উত্তেজিত হয়ে উঠে,
— ব্যাথা পেলি? তুঁষ! দেখি গালটা।
তোঁষা নাক, মুখ কুঁচকে উঠে বসে। আরহাম ও সাথে সাথেই এক লাফে উঠে বসতেই তোঁষা বোঁচা নাকটা ফুলিয়ে বললো,
— কিছুই হয় নি। আপনি শুধুই এমন করেন।
আরহাম চাচ্ছে না রাগ করতে। কিছুতেই এখন রাগ করা যাবে না। অন্তত পক্ষে ওর তুঁষে’র সামনে তো না ই। তোঁষা’র বাহুটা ছাড়তেই তোঁষা বিছানা থেকে নামতে যায়। যেই না এক পা এগুবে ওমনিই ধপ করে হুমড়ি খেয়ে পরলো ফ্লোরে। আরহাম তারাতাড়ি বিছানা ছেড়ে তোঁষা’কে ধরতে গেলেই তোঁষা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। এতটা আহ্লাদী যদিও সে না তবে আরহামের নিকট সে বড্ড আহ্লাদী হয়ে উঠে। আরহাম টেনে তুলে ওকে বিছানায় বসিয়েই ব্যাস্ত হয়ে চোখ মুছে দেয়। তোঁষা’র পড়নের টাউজারটা রাতে গুটিয়ে দিলেও তা এখন ছুটে গিয়েছে ওটাতেই পা বেঝে আছারটা গেলো তোঁষা। বোঁচা নাকটা টানতে টানতে তোঁষা মুখ নাক লাল করে ফেললো। আরহাম ওর পা টা নিজের কোলে তুলে দেখতে দেখতে অস্থির হয়ে শুধালো,
— তুঁষ? ব্যাথা পেলি কোথায়? মোচকেছে? এই কথা বল!
অস্থির হয়ে প্রথমে বললেও পরে কিছুটা রেগে যায় আরহাম। তার এই রাগ যে কিছুতেই আয়ত্তে থাকে না। তোঁষা কিছুটা চমকে যায় হঠাৎ ধমক খেয়ে কিন্তু চমকানো টা বেশিক্ষণ টিকে না। আরহাম স্বাভাবিক করে নেয় নিজেকে। মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে। গত কাল থেকে আজ পর্যন্ত ওর তুঁষ’টা তো কম আঘাত পাচ্ছে না। তখন না হয় আরহাম কাছে ছিলো না। পাশে ছিলো না কিন্তু এখন? আরহামের এতটা কাছে থেকে কেন ওর তুঁষ আঘাত পাচ্ছে? এটা কোনভাবেই আরহাম মানবে না। মন’কে মানালেও মস্তিষ্ক তার কিছুতেই মানতে চায় না।
হঠাৎ করেই তোঁষা’কে জড়িয়ে ধরে আরহাম। ভ্রু কুঁচকায় তোঁষা। বিছানা থেকেই তো পরলো তাতে এতটা চিন্তিত হওয়ার কি আছে? আরহাম তোঁষা’কে ছেড়ে নিজের মুঠোয় তোঁষা’র নরম হাতটা পুরে নেয়। তোঁষা তাকায় আরহামের চোখের দিকে। বাদামী বর্ণের চোখের মনির দিকে তাকাতেই তোঁষা’র ভ্রু কুচকানো টান টান হয়ে যায়। আরহামের চোখে মুখে চিন্তার ভাজ। মুখভঙ্গি ও আদল বদলেছে। কেন? শুধু মাত্র তোঁষা এই অল্প ব্যাথা পেলো বলে? নরম হয়ে আসে তোঁষা,
— বেশি লাগে নি তো।
আরহাম কিছু বলে না। মাথা নিচু করে কিছু ভাবছে সে। তোঁষা শ্বাস ফেলে ডাকে,
— আরহাম ভাই?
আরহাম কোন কালেই তার তুঁষে’র এই ডাক উপেক্ষা করতে পারে নি। আজও পারলো না। অল্প হাসার চেষ্টা করে বললো,
— আয়।
আরহামের বাড়িয়ে দেয়া হাতে হাত রাখে তোঁষা। পায়ে যে একেবারে ব্যাথা পায় নি তা না। পেয়েছে কিন্তু অল্প। তোঁষা ওয়াসরুমের দরজা লাগাতেই এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের ফোনটা খুঁজে আরহাম। টেবিলের সাইডে রাখা সেটা। হাতে তুলে দ্রুত গতিতে বৃদ্ধাঙ্গুলি চালিয়ে কিছু টাইপ করলো। অতঃপর ছুঁড়ে মা’রলো তা কাউচে। ঘাড়টা এদিক ওদিক নাড়িয়ে হাত দুটো প্রসারিত করে অলসতা কাটানোর মতো করে আরহাম। লালচে গোলাপি রঙা ঠোঁটে তার বক্র এক হাসি। বড়ই অদ্ভুত সুন্দর সেই পুরুষের পুরো ঠোঁটের হাসিটা। তোঁষা দেখলেই বলত, “আরহাম ভাই, আপনি এভাবে হাসলে আমার কিছু হয়”।
কথাটা ভাবতেই খট করে দরজা খুলে কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বের হলো তোঁষা। আরহাম গিয়ে ধরে এনে কাউচে বসিয়েই রুমের বাইরে গেলো। তোঁষা গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো ওর আরহাম ভাই নামক জামাই’টার দিকে। তোঁষা’র প্রাণে’র অস্তিত্ব সম্পূর্ণটা জুড়ে এই আরহাম ভাই। একে পেতেই তো এত সব পাগলামি তোঁষা’র। এই আরহাম ভাই এর টিশার্ট জড়িয়েই তো বুক ভরে শ্বাস টানতো তোঁষা। নিন্দ্রাহীন রজণী কেন কাটাতো? ফোনে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলে বুকের ভার কমাতো। রাত বিরাতে মনে মনে কান্না করতো তোঁষা। এই আরহাম ভাই’কে পেতে জীবনের সবচেয়ে বড় সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছে ও গত কয়েকটি দিন। যার শেষ ছিলো গতকাল। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছে তোঁষা ওর আরহাম ভাইয়ের কাছে। একজনকে ভালোবেসে নিশ্চিত আরেকজনের সাথে সংসার করাটা সম্ভব ছিলো না তার জন্য? তোঁষা কি বাঁচতো ওর আরহাম ভাই ছাড়া? বাবা’কে কত বললো। যেই বাবা’কে জমে’র মতো ভয় পেত সেই বাবা’র সামনে দাঁড়িয়ে জাহির করেছিলো মনের কথা। তোঁষা ভাবুক হলো,
~বাবা’কে যথেষ্ট ভয় পেয়ে চলে তোঁষা। অথচ বাবা ছাড়া তার চলেও না। সারা বাড়ি টো টো করা ওর একমাত্র কাজ। সকলের আদুরে বাচ্চা কি না। পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ মেয়ে তোঁষা। যাকে বড় চাচা সহ বাকিরা পুতুল নামে ডাকে। যার লাল, ফর্সা দুধের রঙের শরীরটা শীতের দিনে ঠিক তুষের ন্যায় লাগতো। তাই তো ওর আরহাম ভাই ওর নাম রেখেছিলো তুঁষ যা একসময় ঠিকঠাক করে সকলে রাখলো তোঁষা। তোঁষা’র নিকট তুঁষ নামটাই বেশি ভালোবাসার। ওর আরহাম ভাই ডাকে এই নামে। আরো একজন ডাকে তবে তাকে মনে করতে ইচ্ছুক নয় তোঁষা।
আরহাম’কে বিয়ে করার কথা বাবা’র সামনে বলতেই বাবা গম্ভীর কণ্ঠে না করে। তোঁষা তখন বাবা’র সামনে ঐ গতকাল প্রথম সাহস জুগিয়ে বলেছিলো,
— আরহাম ভাই ছাড়া বিয়ে করব না আমি।
ননীর পুতুলের ঠোঁট দিয়ে বের হওয়া কথা শুনেই রেগে যান তুহিন। উঠে এসে সজোরে থাপ্পড় বসান আদরের মেয়ের গালে। যেই গালে সবাই ঠেসে চুমু খেলেই লাল লাল দাগ পরতো সেই গালে ঐ থাপ্পড়টা ছিলো আবিরের ন্যায়। একদম রঙা করে দিয়েছিলো তোঁষা’র গাল। যার দাগ এখনও মিটে নি।
তোঁষা কিন্তু দমে নি। ভীতু মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে বড় চাচা তুরাগে’র পা ধরে। অনুরোধ করে জানায়,
— চাচ্চু…চাচ্চু আব্বুকে বোঝাও না। আমি তো আরহাম ভাই’কে ভালোবাসি। তোমরা না বলেছিলে আরহাম ভাই আমার বর হবে তাহলে অন্য কারো সাথে কেন বিয়ে দিচ্ছো?
তুরাগ অপারগ। হাজার হোক তার ছেলে আরহাম। তিনি কখনোই তোঁষা’র বিয়ে দিবেন না আরহামের সাথে। তোঁষা’কে পা থেকে বহু কষ্টে টেনে তুলে চাচি। তোঁষা শুধু কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করে,
— মিথ্যা ওয়াদা কেন দিয়েছিলে? কেন বলেছিলো আরহাম ভাই আমার বর? আরহাম ভাই ফিরবে। নিশ্চিত ফিরবে।
কথাটা শেষ করতে না করতেই তুঁষার ওকে টেনে হিচরে নিয়ে যায় ওখান থেকে। তোঁষা তখন বড় ভাইয়ের কাছে নালিশ জানায়। লাভ হয় না। তুঁষার শুনে না। ওর টান হেচরিতেই তোঁষা আঘাত পায় কিছু জায়গায়।
হঠাৎ হাতে সূচ ফুটতেই মুখে “উফ” শব্দ করে অতীত থেকে বেরিয়ে আসে তোঁষা। আরহাম ততক্ষণে ওকে ইনসুলিন পুশ করেছে। তোঁষা হাসলো। আরহাম ওর মাথায় হাত দিয়ে বললো,
— পয়েন্ট কত যাচ্ছে ইদানীং?
তোঁষা’র হাসি মিলিয়ে গেলো নগদে। জন্মের কয়েক বছর পরই ওর মধ্যে ডায়বেটিস দেখা গিয়েছিলো। ইনসুলিন নিতে নিতে জীবন তেঁতো হয়ে আছে। আরহাম রেগুলার পয়েন্ট চেক রাখে। গত কয়েকমাস রাখা হয় নি। সুযোগ হয় নি বলা যায়। তোঁষা তো ইচ্ছে মতো খেয়েছে। পয়েন্টের হুস কি ছিলো?
ওর মুখের চোরা চোরা ভাবটা দেখেই আরহাম চেক করার জন্য ড্রয়ারে হাত দিলো। পয়েন্ট দেখেই যেন মাথায় হাত। খালি পেটে নয়। মোটেও কম কথা না। আরহাম রেগে তাকাতেই তোঁষা মুখ কালো করে। নীচু কন্ঠে বলে,
— ক্ষুধা লেগেছে আরহাম ভাই।
— কে তোর ভাই??
আরহামের ধমকে কাঁপে তোঁষা। আরহাম হুট করে ওর একবাহু চেপে ধরতেই তোঁষা ব্যাথায় মুখ কুঁচকায়। দাঁত পিষে আরহাম শুধু বললো,
— বলেছিলাম আমার জন্য তোর খেয়াল রাখিস।
— ব্যাথা পাই।
— পা।
— ছাড়ুন।
আরহাম ছাড়লো না বরং চাপ বাড়ালো। তোঁষা শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা মা’রতেই কদম দুই পেছালো আরহাম। চক্ষু ওর তখনও টকটকে লাল।
#চলবে….?