#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_৩১
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#স্পেশাল_পর্ব
( প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
মেঘমুক্ত আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। চাঁদের দিকে তাকিয়ে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে বিনা। মানুষটা হারিয়েছে না চলে গেছে আঠারো বছরের বেশি হলো। এতটা পাষাণ মনের পুরুষ তো সে ছিলো না! তাহলে কীভাবে পরিবারের সবাইকে রেখে এরকম চলে গেলো? বিনার মস্তিষ্কে এরকম প্রশ্ন প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খেতে থাকে। কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। মানুষ মারা গেলে চিরাচরিতভাবে মেনে নেওয়া যায় কিন্তু হারিয়ে গেলে? জীবিত মানুষ হারানোর শোক যে আজন্ম তাড়া করে বেরোয়। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে চমকে উঠে বিনা। পেছন ফিরে তাকায় সে।
” খেতে চলো মা। সাড়ে দশটা ছুঁইছুঁই! ”
” তুই খেয়ে নে। আমি পরে খাবো। ”
পূর্ণতা মায়ের দু-হাত ধরে নিজের মুখশ্রীতে স্পর্শ করায়।
” মা! আমার দিকে একবার তাকাও তো। দেখো বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাও কি-না! ”
বিনা পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পূর্ণতার দিকে। মেয়েটার চোখ,নাক একেবারে বাবার মতোই হয়েছে। বিনার বুকটা কেমন করে উঠলো। বাচ্চাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলো মেয়েকে। পূর্ণতা নিজের চোখের জল লুকিয়ে গেলো মায়ের থেকে। মা’কে স্বান্তনা দেওয়ার কোনো ভাষা তার জানা নেই। তবে সৃষ্টিকর্তার নিকট মাঝে মধ্যে খুব অভিযোগ করে অবুঝ মেয়েটা। নানির কাছে তো মায়ের জীবনের সব কথাই শুনেছে সে। ছোটো থেকে বিনার এতিম হওয়া, নানা – নানির ঘরে বড়ো হওয়ার কথা সবকিছুই! এতো কষ্টে বড়ো হওয়ার পরেও স্বামী,সংসারের সুখ থেকে বিধাতা কেনো তার মা’কে বঞ্চিত করলেন? কেনো!
পাহাড়ের গায়ে সূর্য উঠার দৃশ্য কতটা মনোরম সেটা না দেখলে বোঝা যায় না। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখলে যেকোনো মানুষ আকৃষ্ট হবে। পাহাড়ি ছোটো গ্রামের কাচা রাস্তার পাশে একটা টঙের দোকান। সেখানে স্থানীয় লোকজন চা খেতে খেতে গল্প গুজব করছে। এমন সময় এক পাগলের আগমন ঘটে সেখানে। পরনে প্যান্ট, শার্ট। মুখভর্তি দাড়ি আর বড়ো বড়ো চুলে চেহারা দেখে চেনা দুষ্কর। পাগলটাকে দেখে একজন চায়ের কাস্টমার বলে উঠলো,
” পাগলটর লাইগা বড়ো দুঃখট্ট লাগে বটে। শহুরে পোলাটা এইখানে পাগলো হয়ে ঘুরে!”
” আল্লাহ মালুম কার ঘরের ছেলেট্ট বটে।”
পাশের জন প্রত্যুত্তরে বলে। এলোমেলো চেহারার পাগলটা পেটের দিকে ইশারা করে তাদের বোঝায় ক্ষিদে লেগেছে। নেহাৎ গ্রামের মানুষগুলো ভালো। তাই খাওয়ায় তেমন কষ্ট হয় না। দোকানদার নিজেই পাগলটাকে একটা পাউরুটি আর একটা বিস্কুটের প্যাকেট দিলো। খাবারের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে তার। মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে একটা নাম “বিনা”!
নিশুতি রাত! চেয়ারে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে ইফতি। বাবার মৃত্যুর পরে শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজেদের জমিজমা ও ছোটখাটো ব্যবসাও সামলাতে হয়।
” ঘুমাবে কখন?”
কাঁধে কন্ঠর স্পর্শে পেছন ফিরে তাকায় ইফতি। শাওন অন্য ঘরে শোয়।
” হ্যাঁ। তুই এখনো জেগে রইলি কেনো?”
” এমনি।”
ইফতি কাজকর্ম রেখে বিনার হাত ধরে নিয়ে বিছানায় বসলো। কাজের ব্যস্ততায় আর পারিবারিক অশান্তিতে একান্তে সময় কাটানো দুষ্কর হয়ে গেছে। ইফতি বহু দিন পর আজকে আবারও কন্ঠকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। চেহারায় হালকা বয়সের ছাপ স্পষ্ট তবে সেই চিরচেনা চোখের চাহনি। ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসি! সবকিছুই একরকম আছে।
” এমনি না। কী হয়েছে? ”
” নতুন করে কিছু হয়নি গো। ”
” বুকে আয়।”
ইফতি হাত দু’দিকে প্রসস্থ করে কন্ঠকে ইশারা করতেই বাধ্য মেয়ের মতো নিজেকে স্বামীর বক্ষে সঁপে দিলো সে। ইফতি দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো কন্ঠকে। এই মানুষটাকে বুকে রেখেই কেটে গেলো কতগুলো বছর!
” আচ্ছা সমুদ্র কি পৃথিবীতে সত্যি আছে? যদি থেকে থাকে একদিনের জন্যও কি দূর্বল হয়নি আমাদের কথা ভেবে! কীসের জন্য এরকম নিরুদ্দেশ হলো ছেলেটা?”
ইফতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কন্ঠকে আরো জোরে আষ্টেপৃষ্টে ধরে।
” তুমি যেখানে আমিও সেখানে। তাই কিছু শিওর না হয়ে বলতে পারছি না। ”
” হুম। ”
ইফতি কন্ঠকে বক্ষে জড়িয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো। পূণতা মায়ের সাথে এক ঘরেই শোয়। যদিও বিনা অনেক বার আলাদা ঘরে শোয়ার কথা বলেছিল, কিন্তু পূণর্তা সেটা চায়নি বলেই হয়নি। মেয়ে সাথে থাকলে নিজেকে ভেঙেচুরে প্রকাশ করতে পারে না বিনা। একা ঘরে থাকলে ইচ্ছে মতো চোখের জল ফেলতে পারে।
তপ্ত রোদে পুড়ছে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণ। ফাগুনমাস প্রায় শেষের দিকে। সারাদিন গরম আর রাতে হালকা শীত এভাবেই কাটছে দিন। বিনা তার নানা, নানির মৃত্যুতেও নিজ গ্রামে যায়নি। কিন্তু ইদানীং গ্রামে যাওয়ার জন্য পূর্ণনা ভীষণ জ্বালাতন করছে। ছোটো থেকে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি তার। তাছাড়া সারাদিন মা’কে ঘরে একা একা গুমরে মরতে দেখতে কোন মেয়ের ভালো লাগে?
কলেজ থেকে ফিরেছে পূর্ণতা। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে তার। শাওন এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। খাবার টেবিলে বসে আছে সবাই। শায়লা মল্লিক নিজের ঘরে বসে খান। গোসল সেড়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে চেয়ার টেনে বসলো পূর্ণতা। শাওন ভেংচি কেটে হাসলো। দুই ভাইবোনের মধ্যে প্রচুর মারামারি হয়। বিনা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বললো,
” কতদিন বলেছি চুলগুলো ভালো করে মুছে খেতে বসবি? খাওয়ার টেবিলে বসে কেউ চুল মোছে?”
” আহ বিনা! এভাবে বকাবকি করো না পূর্ণতাকে। ও করুক যা খুশি।”
কন্ঠ পূর্ণতার পক্ষপাতিত্ব করে সব সময়ই। ইফতিও সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
” মল্লিক বাড়ির একমাত্র মেয়ে পূর্ণতা, ও এসব করবে না কে করবে? যেমন ইচ্ছে করুক ও। পূর্ণ মা তুই চুল মুছে খেতে বস।”
” ঠিক আছে বড়ো আব্বু। আচ্ছা তোমরা একটু সবাই মা’কে বলো না, আমার না খুব বান্দরবান যেতে ইচ্ছে করছে। মা’কে বললাম তবুও কিছু বললো না। কতগুলো বছর পেরিয়ে গেলো। এখন তো আর সেসব সমস্যা নেই। তাই না?”
পূর্ণতার কথায় ইফতি,কন্ঠ ও বিনা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। শাওন আনন্দে নেচে উঠেছে প্রায়।
” সত্যি পাহাড়ে যাবি আপাই? ছোটো আম্মু,ও ছোটো আম্মু প্লিজ চলো না? আব্বু আব্বু তুমি একটু বলো না!”
” তোর যে পরীক্ষা চলছে সেটা কি মাথায় আছে শাওন?”
বিনার প্রশ্নে মুখটা মলিন হয়ে গেছে শাওনের। কিন্তু পূর্ণতা তো আছেই উত্তর দেওয়ার জন্য। মেয়েটা একেবারে বাবার স্বভাব পেয়েছে। খুব চনমনে, দুরন্ত, মজাদার একটা মেয়ে।
” মার্চ মাস চলতেছে মা। আর কয়েকদিন পর পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। ”
কন্ঠ ইফতির প্লেটে আরেক চামচ লালশাকের তরকারি দিলো। ইফতি ভাত মাখাতে মাখাতে বলে,
” বিনা ওরা সবাই যখন বলছে তাহলে একবার চলো। সবাই মিলে ঘুরে আসি? ”
ইফতি বড়ো ভাইয়ের মতো। তাছাড়া এ বাড়ির সর্বেসর্বাও বটে। তার কথা কি ফেলতে পারে বিনা? তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সম্মতি দিলো বিনা।
” ঠিক আছে ভাইয়া। আপনি যা বলবেন তাই হবে। ”
পূর্ণতা আর শাওন একসাথে হেসে বলে উঠে, ” হিপ হিপ হুড়রে এএএ!”
মেয়ের হাসিখুশি মুখখানা দেখে বিনারও অধর কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটলো। সমুদ্রর অবর্তমানে এই মেয়েটাই তো বিনার বেঁচে থাকার সম্ভল।
” এক্সকিউজ মি আপু। আপনার পাশের সিটটা আসলে আমার। আমি কি বসতে পারি?”
বাস থেমেছিল এতক্ষণ। এরমধ্যেই যাত্রী উঠলো কয়েকজন। উপরোক্ত কথাগুলো পূর্ণতার পাশে দাঁড়িয়ে এক সুদর্শন যুবক শুধালো। পরনে জিন্সের প্যান্ট সাথে কালো শার্ট। চুলগুলো ঘাড় পর্যন্ত বড়ো কিন্তু সামনে দিয়ে ছোটো করে ছাঁটা। চোয়াল জুড়ে ছোটো ছোটো চাপদাড়ি। পূর্ণতা বাসে সব সময় একা একটা সিটে বসে। সেজন্য ইফতি পূর্ণতার একার জন্যই দু’টো সিট কেটেছিল। পেছনের সিটে বসেছে শাওন ও বিনা আর তার পেছনে ইফতি ও কন্ঠ।
” আপনি বসবেন মানে! দু’টো সিটই তো আমার নামে কাটা হয়েছে। ”
পূর্ণতার কথায় ছেলেটা নিজের টিকেটটা সামনে বাড়িয়ে ধরে হেসে বললো,
” আপু আপনি নিজেই দেখে নিন।”
পূর্ণতা কিছু বলার আগেই পেছন থেকে ইফতি এগিয়ে এলো বিষয়টা দেখতে। ইফতি এসে টিকেট দেখলো। সত্যি এই সিটটা অন্য নামে বরাদ্দ। টিকিটের মালিক নৈশ চৌধুরী। ইফতি বাসের কন্ডাক্টরকে ডাকলো।
” আপনাদের কাউন্টার থেকে দু’টো টিকিট আমরাই কাটলাম। তবুও উনাকে কীভাবে সিটটা দিলেন? ”
ইফতি বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলে বললো। কন্ডাকটর মামা কিছুটা ভড়কে গেলো। আসলে আর কোনো সিট অবশিষ্ট ছিল না বলে এই সিটটা নৈশকে দিয়েছিল বাসের মালিক নিজেই। বাসের মালিকের সাথে নৈশের বাবার আগে থেকেই পরিচয় আছে বেশ।
” স্যার সবটাই তো শুনলেন। তাছাড়া আপনাদের তো একটা সিটই লাগবে। আর এই ভাইয়ের কাজের জন্য বান্দরবন যেতে হবে। তাই বিষয়টা মানবিক ভাবে বিবেচনা করলে ভালো হতো।”
ইফতি কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বললো,
” আচ্ছা। পূর্ণতা তোর সমস্যা হলে তুই সিট চেঞ্জ করে নে। ”
” না থাক। উনি বসুক।”
পূর্ণতার সামনের দিকে সিটে বসতেই ভালো লাগে। তাছাড়া সামান্য বিষয় বলে অতটা গুরুত্ব দিলো না। নৈশ বসলো পূর্ণতার পাশেই। বাস চলতে শুরু করলো তার আপন গতিতে। নৈশ আরামসে বসলো। তারপর পকেট থেকে ইয়ারফোন বের করে ফোনে কানেক্ট করে কানে গুঁজে দিলো। পূর্ণতার দৃষ্টি জানালার বাইরে। কিছুক্ষণ পরে কী জানি মনে করে নৈশের দিকে তাকালো পূর্ণতা। কিন্তু নৈশকে দেখেই ফিক করে হেসে উঠলো মেয়েটা। নৈশ এতটাই ঘুমে মগ্ন আরেকটু হলেই সিট থেকে ওপাশে পড়ে যাবে যাবে অবস্থা। অবস্থা বেগতিক দেখে পূর্ণতা ডাকলো নৈশকে।
” এই যে শুনছেন? এই যে ভাই! ও ভাই! আরে এই নেশা ভাই! ”
পূর্ণতার কানের কাছে এসে ডাকাডাকির ফলে নৈশের ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভাঙতেই নিজেকে সামলে সোজা হয়ে বসলো সে। দু-চোখ মেলে ভালো করে তাকাল পূর্ণতার দিকে।
” আরেকটু হলে তো ওপাশে পড়েই যেতেন! মানুষ গাড়িতে বসে এভাবে মরার মতো কীভাবে ঘুমায়?”
পূর্ণতা ফের কথায় খেই ধরলো। নৈশ ঘুৃম ঘুৃম চোখে পূর্ণতার কথায় হাসলো। নৈশের এই হাসিটায় যেনো কী ছিলো। পূর্ণতা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল সেদিকে।
” আমি ঘুমাই। বাই দ্য ওয়ে, আপনি আমাকে নেশা ভাই বলে ডাকলেন?”
পূর্ণতা চমকাল। মুখ ফসকে নৈশের বদলে নেশা হয়ে গেছে। ইশ! কী লজ্জার কথা। পূর্ণতা আমতা আমতা করে বললো,
” আসলে চামড়ার মুখ তো, মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। প্লাস্টিকের হলে হয়তো বলতাম না।”
পূর্ণতার অদ্ভুত কথায় নৈশ না হেসে পারে না। আবারও হাসে ছেলেটা। জোরে জোরেই! পূর্ণতা বেশ বিব্রতবোধ করে।
” আচ্ছা বুঝলাম। তা আপনি কী করেন? লেখাপড়া নাকি চাকরি? ”
” এইচএসসি দিবো সামনে। ”
” সিরিয়াসলি! ”
নৈশ কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বললো। পূর্ণতা মুচকি হাসলো। পূর্ণতা দেখতে স্বাস্থবতী। লম্বা চুল, জোড়া ভ্রু। দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না যে, কলেজের গেট পেরিয়ে এখনো ভার্সিটিতে যায়নি।
” ইয়েস। ”
” তুমি তো তাহলে একেবারে পুচকি। আমি মাস্টার্স শেষ করে আপাতত ঘোরাঘুরি করছি। তবে বান্দরবান যাচ্ছি রিসোর্টে কিছু কাজ আছে । আমার বাবার রিসোর্ট। বাবা বলেছেন ওটা আমাকেই দেখাশোনা করতে হবে। তাই মাঝে মধ্যে এসে দেখতে হয়। ”
” বাহ! অভিনন্দন। তবে আমি পুচকি নই মোটেই। আঠারো হয়েছে হুহ।”
” হ্যাঁ অনেক বড়ো হয়ে গেছো। তা সাথে বুঝি বাবা-মা যাচ্ছে? ”
বাবার কথা শুনতেই পূর্ণতার মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেলো। বিষয়টা নৈশ ভালো করেই খেয়াল করেছে।
” মা,ভাই, আর বড়ো আব্বা-আম্মু যাচ্ছে। ”
” বাহ। তা ওখানে গিয়ে কোথাও উঠবে? বুকিং করা আছে? ”
” আমি তো জানি না সেসব। বড়ো আব্বু জানেন সব।”
” আচ্ছা বুঝলাম।”
নৈশের কথা শেষ হওয়ার আগেই তার ফোনের রিংটোনের আওয়াজে আড়চোখে সেদিকে তাকাল পূর্ণতা। বিষয়টা ঠিক নয় কিন্তু কেনো জানি নজর ফোনের দিকে গেলো। বাংলায় সুন্দর করে লেখা অপ্রিয় প্রাক্তন! ছেলেটার তাহলে প্রেমিকাও ছিল? আনমনে ভাবে অষ্টাদশী পূর্ণতা। নৈশ সৌজন্যমূলক হেসে কলটা রিসিভ করে। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বাজখাঁই আওয়াজে বলে উঠে,
” এখন তো কলটাও ধরবে না। কল ধরতেও ভীষণ কষ্ট হয় তোমার। ”
” বুঝতেই যখন পারো আমার কষ্ট হয়,বিরক্ত লাগে তবুও কেনো বেহায়ার মতো কল দাও?”
নৈশ চাপা স্বরে বললো কথাটা। পূর্ণতা ততক্ষণে আবারও বাইরের দিকে দৃষ্টিপাত করেছে।
” নৈশ প্লিজ আর একবার সুযোগ দাও। আমি আর প্রান্তর সাথে সংসার করতে পারছি না।”
” আমি গাড়িতে আছি। দয়া করে আগামী চব্বিশ ঘন্টার জন্য রেহাই দাও। ঢাকা ফিরেই সিম পাল্টে ফেলবো আমি। নির্লজ্জ মেয়ে মানুষ কোথাকার! ”
নৈশ ওপরপাশে থাকা রমণীকে আরকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে ফোন ফ্লাইট মুডে রেখে দেয়। বাসের সিটের সাথে হেলান দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেলে। মানুষগুলো জীবন থেকে চলে গিয়েও শান্তিতে বাঁচতে দেয় না। যখন খুব করে রাখতে চেয়েছিল তখন মুখের উপর লাথি দিয়ে চলে গিয়েছিল। আজ যখন বুঝতে পেরেছে ভালো পেতে গিয়ে অধিকার ভালো হারিয়ে ফেলেছে, তখুনি আবারও অধিকতর ভালোর নিকট ফিরতে চাইছে। নৈশ আবারও ঘুমিয়ে পড়ে।
বিকেলের দিকে বান্দরবান বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে সবাই। নৈশের সাথে ইফতিরও আলাপচারিতা হওয়ায় ওদের রিসোর্টেই থাকবে বলে ঠিক করে ইফতি। ছেলেটার সাথে কথা বলেও ভালো লেগেছে সবার। পড়ন্ত বিকেলে পাহাড়ী অঞ্চলে এই প্রথম পূর্ণতা ও শাওনের আগমন। দুজনের মনেই আনন্দের বন্যা বইছে। বিনার বুকটা কেমন খা খা করছে। এখানেই কেটেছে তার শৈশব, কৈশোর। এখানেই সমুদ্রর সাথে বিয়ে। কতশত স্মৃতিরা হানা দিচ্ছে মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে। রিসোর্টে গিয়ে তিনটে রুম নেয় ইফতি। একটাতে বিনা ও পূর্ণতা, আরেকটায় কন্ঠ ও ইফতি। বাকি থাকে শাওন! ওর জন্য আলাদা একটা। তবে সমস্যা হলো অজানা জায়গায় একা একা রাতে থাকতে কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল শাওনের। কিন্তু সেই সমস্যার সমাধান করে দেয় নৈশ। নৈশ শাওনের সাথে রুম শেয়ার করবে বলে প্রস্তাব দেয়। শাওনেরও নৈশকে বেশ ভালো লাগায় রাজি হয়ে যায়।
” এখানে দাঁড়িয়ে কী করছো?”
বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাসায় কল করার চেষ্টা করছিল ইফতি। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। পাহাড়ে দ্রুত রাত নামে। কন্ঠকে দেখে হাত বাড়িয়ে নিজের পাশে দাঁড় করালো ইফতি।
” এসে থেকেই বাসায় কল দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু নেটওয়ার্ক এত্তো স্লো কল যাচ্ছে না।”
” এসব এলাকায় গ্রামীনফোনে নেটওয়ার্ক থাকে না শুনেছি। আসার আগে একটা রবি কিংবা এয়ারটেল সিম কেনা দরকার ছিলো। মা,আম্মা সবাই চিন্তা করছে নিশ্চিত। ”
ইফতির কপালে চিন্তায় ভাজ পড়েছে।
” ঠিকই বলছো তুমি।”
” আচ্ছা নৈশ ছেলেটা তো এখানে যাওয়া আসা করে, ওর কাছে নিশ্চিত অন্য সিম আছে। তুমি বরং ওকে একবার বলো।”
” যদি কিছু মনে করে? ”
” ছেলেটাকে দেখে তেমন মনে হয়নি। ”
” তাহলে তুমি থাকো। আমি গিয়ে একটা কল করে আসি। কালকে সিম কিনবো না হয়।”
” ঠিক আছে যাও।”
ইফতি ঘর থেকে বেরিয়ে রিসিপশনের দিকে এগোলো। কিন্তু পথেই নৈশের সাথে দেখা হয়ে গেলো। নৈশ মুচকি হেসে শুধালো,
” কোনো সমস্যা হলে জানাবেন আঙ্কেল। ”
” হ্যাঁ জানাবো। তবে আপাতত একটু সাহায্যের জন্য তোমার শরণাপন্ন হলাম।”
” হ্যাঁ নিঃসংকোচে বলুন।”
” আসলে বাড়িতে বয়স্ক মায়েরা আছেন। উনাদের এখনো জানাতে পারিনি পৌঁছানোর খবর। ”
নৈশ সবজান্তা ভাব করে আগবাড়িয়ে বলে উঠলো,
” বুঝতে পেরেছি। নেটওয়ার্ক পাচ্ছেন না। আমার ফোন দিয়ে কথা বলুন। আমি রবি সিম ইউজার।”
ইফতি কৃতজ্ঞ হলো। হেসে বললো,
” ধন্যবাদ তোমাকে। ”
নৈশের ফোন দিয়ে বাসায় কথা বললো ইফতি। শারমিন ও শায়লা এক বাসায় আছে এখন। সাথে আছে লাবনী নামক এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলা। উনাকে সম্প্রতি কাজে রেখেছে কন্ঠ। তাছাড়া বাড়ির দারোয়ান জালাল আছে। কিছু কেনাকাটা লাগলে সে করে দিবে। কথা বলা শেষে ইফতি নৈশকে ফোন ফেরত দিয়ে ফের ধন্যবাদ জানিয়ে রুমে যায়।
❝ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া এ সময়
মেনে নেয় তার পরাজয়
জীবন পড়ে ধূলোতে, হারিয়ে সঞ্চয়
ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া এ সময়
মেনে নেয় তার পরাজয়
জীবন পড়ে ধূলোতে, হারিয়ে সঞ্চয়
যার কথা ভাসে, মেঘলা বাতাসে
তবু সে দূরে তা মানি না
যার কথা ভাসে, মেঘলা বাতাসে
তবু সে দূরে তা মানি না।❞
” কী হলো থামলে কেনো মা?”
ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আনমনে গান গাচ্ছিল বিনা। পরনে সাদা, কালো রঙের মিশ্রণের শাড়ি, চুলগুলো বিনুনি করা। চোখে চশমা লাগে আজকাল। আজকে ভীষণ করে সমুদ্রর কথা মনে পড়ছে। মানুষটা নেই এটা কিছুতেই মানতে নারাজ অবুঝ মন। মেয়ের উপস্থিতি টের পেয়ে গান থামিয়ে দিয়েছে বিনা।
” এমনি। বাইরে যাবি না একা একা। আর একটু চঞ্চলতা কমা।”
” এসব রাখো তো! তুমি যে এতো সুন্দর গান গাইতে পারো আগে তো জানতামই না। আর কী কী পারো মা?”
” মানুষ ধরে রাখতে পারি না পূর্ণতা। পারলে তোর বাবাকে হারিয়ে ফেলতাম না।”
” মা! মানুষ ইচ্ছে করে হারালে তাকে ধরে রাখা যায় না। যে থাকার কারণে কিংবা অকারণে থেকেই যায়। দোষগুণ নিয়ে থেকে যায়। ”
মেয়ের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বিনা। কবে এতো বড়ো হয়ে গেলো মেয়েটা? কেমন বড়দের মতো কথাবার্তা বলতে শিখে গেলো।
” আমার মেয়েটা বড়ো হয়ে গেছে। ”
” হ্যাঁ এবার বিয়ে দিয়ে দাও। সুন্দর করে সংসার করবো। তোমাদের মতো একটা বাচ্চাকাচ্চা নিবো না মোটেই। কম হলেও তিনটে ছেলেমেয়ে হবে আমার। ”
মেয়ের কথায় না হেসে পারে না বিনা। পিঠে আলতো করে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।
” একেবারে বাবার মতো নির্লজ্জ হয়েছিস তুই। মেয়ে মানুষের এতো কম লজ্জা থাকলে লোকে খারাপ বলে।”
” লোকে তো সব কথা-ই নাক গলায়। এজন্যই তো সবাই বলে লোকে কী বলবে!”
” হয়েছে। এবার থাম মা। শাওন কোথায়? ”
” ওকে দেখলাম নেশা না নৈশ ভাইয়ের সাথে কথা বলছে।”
” নেশা! এটা আবার কেমন কথা? ওর নাম নৈশ, নেশা না। ভালো হ বুঝলি।”
” ওই হলো। পৃথিবীতে এতশত নাম থাকতে একখানা নাম উনার,নৈশ চৌধুরী! মনে নৈশভোজের আয়োজন করেছিল জন্মের সময়। ”
” আহ পূর্ণতা! ”
মা, মেয়ের কথার মধ্যে কন্ঠর উপস্থিতি টের পেয়ে বিনা সেদিকে তাকাল।
” কী নিয়ে কথা হচ্ছে মা-মেয়ের? আমি বাদ পড়লাম? ”
” আরে না বড়ো মা। তুমি এসো তো। ”
পূর্ণতা কন্ঠর হাত ধরে বিনার পাশে দাঁড় করালো।
চলবে,
আগের পর্ব https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/972859127769193/?mibextid=Nif5oz
পরের পর্ব https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/973813867673719/?mibextid=Nif5oz