#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_৩২
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
” কী নিয়ে কথা হচ্ছে মা-মেয়ের? আমি বাদ পড়লাম? ”
” আরে না বড়ো মা। তুমি এসো তো। ”
পূর্ণতা কন্ঠর হাত ধরে বিনার পাশে দাঁড় করালো।
” মেয়েটা বড্ড বেশি চঞ্চল কন্ঠ আপা। ওকে নিয়ে বড়ো চিন্তা হয়। ”
চিন্তিত চিত্তে সংশয় প্রকাশ করে বিনা বললো। কন্ঠ বিনার হাত ধরে বললো,
” ওর চিন্তা তোমাকে করতে হবে না বিনা। আমরা সবাই আছি। তুমি নিজের খেয়াল রাখো শুধু। যাও ঘুমাও। রাত অনেক হলো। কালকে ঘুরতে বের হবো সবাই। ”
” ঠিক আছে। মা তুমি শুয়ে পড়ো আমি একটু আসছি। শাওনের সাথে ছবি তোলা নিয়ে কথা আছে। ”
পূর্ণতা বিনার প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই বারান্দা থেকে ঘরে তারপর ঘরের বাইরে ছুট লাগালো। কন্ঠও গেলো পেছন পেছন। বিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের দিকে এগোলো।
” ঘুমাচ্ছ না কেনো ইফতির মা?”
শারমিন সুলতানা ব্যস্ত ভঙ্গিতে শুধালো। হাতে তার উলে আর বুননের জন্য কাঁটা। শাওন সেদিন বলেছিল তার একটা উলের সোয়েটার লাগবে। সেজন্য নাতির আবদার রাখতে আদাজল খেয়ে নেমেছেন কন্ঠর মা।
” ঘুম আসছে না। কবে যে শেষ শান্তিতে ঘুমিয়েছি মনেই নেই। আমার সমুদ্রটা কখনো ফিরবে আর? আমার মন কেনো জানি বলে ছেলেটা ভালো নেই। ”
” তোমার মায়ের মন। এজন্য এমন মনে হয়। আল্লাহর কাছে বলো মনের কথা। মানুষের কাছে চাইলে পাওয়া যায় না কিছু। ”
শারমিন সুলতানার কথা শেষ হতেই ওজু করে নফল নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে নামাজের ঘরের দিকে এগোলেন শায়লা। ইদানীং মানসিক অবস্থা একটু ভালো হয়েছে উনার। সবকিছুই নিয়মিত ঔষধ আর কন্ঠর যত্নের ফলাফল।
রাত্রি শেষে নতুন ভোরের সূর্য উদয় হয়েছে। পাহাড়ের গায়ে রোদের ঝিলিক এর আগে কখনো দেখেনি শাওন ও পূর্ণতা। তাই সূর্য উঠার সময় দৃশ্যটা যাতে মিস না হয় সেজন্য ফোনে এলার্ম দিয়ে রেখেছিল দুজনেই। তারপর আবারও ঘুমিয়েছে সকাল আটটা পর্যন্ত। রিসোর্টের ম্যানেজমেন্ট খুবই ভালো। আর নৈশের আচরণও যথেষ্ট সৌহার্দপূর্ণ। সকালের নাশতা সেড়ে সকাল নটার দিকে সবাই রিসোর্ট থেকে বের হলো ঘোরাঘুরি করার উদ্দেশ্যে।বান্দরবান শহর থেকে নীলগিরির দূরত্ব ৫০ কিঃমিঃ। আসা যাওয়াতে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা লাগবে। এর সাথে ঘোরাঘুরির সময় যুক্ত হলে ৭/৮ ঘন্টা লেগে যাবে।সন্ধ্যার মধ্যে আবার বান্দরবান শহরে ফিরেও আসতে হবে । তাই সবকিছুই পরিকল্পনা মাফিক করতে হবে। নৈশ এ বিষয় সাহায্য করছে ইফতিকে। নৈশ নিজেই জিপ ভাড়া করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। নীলগিরি যাওয়ার পথে পড়ল শৈলপ্রপাত, মিলনছড়ি ভিউ পয়েন্ট,চিম্বুক পাহাড়। সরাসরিও নীলগিরি যাওয়া যেতো কিন্তু সবগুলো জায়গায় অল্প সময় করে দাঁড়িয়ে যাবে বলে আর্জি জানিয়েছিল পূর্ণতা। সেজন্য সরাসরি গেলো না ওরা। পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাকা পথ ধরে যেতে হচ্ছে নীলগিরির উদ্দেশ্যে। প্রতিটা বাঁকে যেনো অন্য রকম নতুন নতুন সৌন্দর্য! শাওন ও পূর্ণতা তো সবকিছু হা করে দেখছিল। সারাটাদিন এভাবেই ঘোরাঘুরি করে কাটলো সবার। সন্ধ্যার দিকে রিসোর্টে ফিরলো। পূর্ণতার কাছে পাহাড়ের সৌন্দর্য এতোটা মুগ্ধতা সৃষ্টি করেছে যে মেয়েটা নীলগিরি থেকে আসতে চাচ্ছিল না। হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নেয় সবাই। হালকা নাস্তা সেড়েও নেয়। কিন্তু হুট করে পূর্ণতার মাথায় অন্য প্ল্যান আসে। সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষণ। রাত দশটার আগ পর্যন্ত শহরে ঘোরাঘুরি করে কাটিয়ে দিতে পারলে বেশ হতো। নৈশ দুপুরে বলছিল সাঙ্গু ব্রিজের কথা! সাঙ্গু ব্রিজে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে আসা গেলে মন্দ হয় না। তাছাড়া শহরে বিভিন্ন আদিবাসী পণ্যের দোকান আছে। কিছু কেনাকাটাও করা যায় তো?
” সারাদিন ঘোরাঘুরির পর এখন আবারও ঘোরার মতো এনার্জি তোর কেমনে থাকে আপাই?”
নিজের মনোবাসনা শাওনের নিকট ব্যক্ত করার পরে শাওনের প্রতিক্রিয়া শুনে পূর্ণতা চুপসে গেলো।
” এই বয়সে ক্লান্ত হলে চলবে? যাবি তুই? আমি একা যেতে চাইলে কেউ অনুমতি দিবে না। প্লিজ তুই চল না?”
শাওন ও পূর্ণতার কথার মধ্যে রুমে নৈশ প্রবেশ করলো। নৈশকে দেখে পূর্ণতা থমকাল। লোকটাকে দেখতে ভীষণ ভদ্রলোক ভদ্রলোক লাগে। ভেতর ভেত কেমন কে জানে?
” কী নিয়ে কথা হচ্ছে? ”
নৈশ ঘরে ঢুকে তোয়ালে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো। ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে যাবে সম্ভবত। শাওনই বললো পূর্ণতার পুনরায় ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করার কথা।
” আপাই বলছিল শহরের মার্কেটে ঘুরবে। আর পারলে সাঙ্গ ব্রিজেও যাবে।”
” এখন বিশ্রাম করো পূর্ণতা। তোমরা তো প্রায় সপ্তাহখানেক আছো তাই না? ”
পূর্ণতা বিরসবদনে মাথা নেড়ে “হু ” বললো।
” তাহলে? কালকে যেও। এখন রাতের খাওয়াদাওয়া করে লম্বা ঘুম দাও। ঘোরাঘুরি করার জন্য শরীরে শক্তির দরকার আছে। সেটা তুমি পাবে পর্যাপ্ত ঘুম ও খাবারের মাধ্যমে। ”
“হইছে আর জ্ঞান দেওয়া লাগবে না আপনার। আসছে জ্ঞান দিতে। ”
মনে মনে কথাগুলো বললেও মুখে সেগুলো বলতে পারলোনা। অগত্যা পেটের কথা পেটেই রেখে দিলো।
” ঠিক আছে। আমি গেলাম শাওন। শুভ রাত্রি। ”
” শুভ রাত্রি আপাই।”
পূর্ণতা নিজের ঘরে গেলো। নিশুতি রাতে ঘুম আসছে না বিনার। এই শহরে এসে সমুদ্রর সাথে কাটানো সময়গুলো আরো বেশি করে মনে পড়ছে। ঘর থেকে আস্তে আস্তে বাইরে বেরিয়ে এলো বিনা। রাত বেশি না,সবে বারোটা। কিন্তু পাহাড়ি অঞ্চলে রাত বারোটা মানে মধ্যরাত। তবুও বিনা রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে বাইরে হাঁটার কথা ভাবলো। কিন্তু গেটের কাছে এসে বিপত্তি বাঁধল। এতরাতে তো সিকিউরিটি গার্ডরা বাইরে বেরুতে দিবে না। অগত্যা কিছুক্ষণ রিসোর্টের মধ্যে উঠোনের মতো জায়গায় হাঁটাহাঁটি করে আবারও নিজের ঘরে ফিরে গেলো।
” আমাকে একটু খেতে দিবে? দাও না গো! দু’টো ভাত দাও। কবে থেকে ভাত খাইনি! ”
সকাল সকাল দোকান খুলতেই পাগলের প্রলাপ শুনে মেজাজ বিগড়ে গেলো ফরিদ মিয়ার। ফরিদ মিয়ার ভাতের হোটেল বাজারের মধ্যে। বান্দরবান সদর উপজেলার প্রধান হাটবাজার হলো বান্দরবান হাটবাজার। সেখানেই ফরিদ মিয়ার দোকান।
” সক্কাল সক্কাল কই থেইক্কা আইসে এইগুলান? যা ভাগ এন্তে।”
ফরিদ মিয়া একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় পাগলটাকে। অশ্রুসিক্ত নয়নে অসহায় দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকায় সে। বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশে যখন থাকতো খাওয়া নিয়ে কষ্ট পেতে হতো না লোকটাকে। কিন্তু বাজারের মধ্যে এলো দু’দিন হয়েছে। আর দু’দিন থেকেই অনাহারে দিন কাটছে তার। নৈশের রিসোর্ট থেকে বাজারের দূরত্ব পনেরো মিনিটের। বিনা রাতে হাঁটাহাঁটি না করতে পারায় সকাল হতেই কাউকে না বলে হাঁটতে বের হয়েছে। কতদিন হলো এখানে এসেছে অথচ পায়ে হেঁটে কিছু দেখবে না তা হয়? এসব ভাবতে ভাবতে বাজারের কাছে পৌঁছুল বিনা। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল সাড়ে সাতটা বেজেছে। ছেলেমেয়েরা এখন সব ঘুমে বিভোর সাথে কন্ঠ ও ইফতিও। কিন্তু বাজারে কতো লোকের সমাগম! সবাই তার নিজ নিজ দোকান খুলে বসেছে। অনেকে আবার রাস্তার পাশে তাদের পণ্য ক্রয় করার উদ্দেশ্যে সাজাচ্ছে। বিনা যখন এসব দেখতে ব্যস্ত তখুনি পেছন থেকে অসহায় কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,
” খাবার দিবেন? খাবার? দেন না দুইটা ভাত!”
বিনা চকিতে সেদিকে তাকাল। সে চমকাল,থমকাল। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ তাকে ভিন্ন কিছু উপলব্ধি করাচ্ছে। এই গলার স্বর তার চিরচেনা। চেহারার অবয়ব তার চেনা। অযত্নে বেড়ে যাওয়া চুল আর দাঁড়ির মধ্যে সেই অবয়ব ঢাকা পড়লেও চিনতে কোনো অসুবিধা হলো না তার। মুহুর্ত যেনো থমকে গেছে বিনার। নিজের মস্তিষ্ক মনকে জিজ্ঞেস করছে আসলেই কি সত্যি সে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে? কিন্তু তার এই পরিণতি কেনো? কীভাবে হলো এসব!
” দেবেন না?”
প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললো সমুদ্র কথাটা। বিনার ভাবনার ছেদ ঘটলো তাতেই। জড়িয়ে ধরলো সমুদ্রকে। সমুদ্র কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলো না। শুধু আরেকবার বললো,
” কিছু খাবার দিবেন?”
বিনা বাহুডোর থেকে সমুদ্রকে আলগা করে সামনে থাকা একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। সমুদ্রর বলা মতো সব খাবার অর্ডার করে। ভাগ্যিস পূর্ণতার জন্য কিছু কিনে নিয়ে আসবে বলে টাকার ব্যাগ এনেছিল সাথে! নয়তো আরো সময় ব্যয় হতো। সমুদ্র খাচ্ছে। বিনা সামনের চেয়ারে বসা। দু-চোখ ভেঙে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার। মানুষটা কতদিন না জানি অনাহারে আছে! ভাবতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো বিনার। এতে ভালোবাসার সংসারে কে ঘটালো এই অঘটন? সুস্থ মানুষটা কীভাবে মানসিক ভারসাম্য হারালো?
চলবে,
রিচেক দেওয়া হয়নি। মন্তব্য করবেন অবশ্যই।
আগের পর্বের লিংক https://www.facebook.com/100080128645410/posts/407474305266854/
পরের পর্ব https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=408044928543125&id=100080128645410&mibextid=Nif5oz