#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৫
হোটেলে এসেই শ্রাবণ প্রথমে শাওয়ার নিতে গেলো। আর্শি ব্যালকনিতে গিয়ে আশেপাশের ভিউ দেখছে। শ্রাবণ তিন দিন এই মিলান শহরে থাকবে। তারপর আর্শিকে নিয়ে ভেনিসে দুইদিনের জন্য বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান তার। আর্শিও বলেছে ছুটি নিয়ে নিবে। এইটুকু তো বুঝেছে এই ছেলে যেমন জেদি তেমন মুডি! সামান্য এদিক-সেদিক হলে তিলকে তাল ভেবে গোমড়া হয়ে বসে থাকবে। ফুঁস করে ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ো বারান্দা ছেড়ে রুমে প্রবেশ করলো। ঘাড়ে ব্যাথা হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে প্রেশার কমেছে। রুম সার্ভিসে কল করে কিছু খাবার অর্ডার করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।
শ্রাবণ শাওয়ার নিয়ে শুধু ট্রাউজার পড়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে বলল,
“এতক্ষণে ভালো লাগছে। খিদেও পাচ্ছে। তোমার খিদে পাচ্ছে না?”
বলতে বলতে চেয়ে দেখলো, আর্শি ঘুমিয়ে গেছে। কেবল সন্ধ্যা ৭টার কাছাকাছি এখন। অসময়ে ঘুমাতে দেখে শ্রাবণ এগিয়ে গিয়ে আর্শির কপালে হাত রাখলো। না স্বাভাবিকই আছে। কিন্তু জাগাতে ইচ্ছে হলো না। ভাবলো কিছুক্ষণ ঘুমাক। ততক্ষণে কেক যে অর্ডার করে রেখেছে আগে, সেটাও চলে আসবে। শ্রাবণ রুম সার্ভিসে কল করে জানতে পারলো আর্শি কিছু খাবারও অর্ডার করেছে। তাই বলে দিলো, কিছুক্ষণ পরেই যেন কেকের সাথে একসাথে পাঠায়।
______
প্রায় আধঘণ্টা পর কলিংবেলের আওয়াজে আর্শির ঘুম ছুটে। ঘুম ঘুম চোখ সামান্য খুলে জড়ানো স্বরে বলে,
“কে এসেছে?”
শ্রাবণ দরজা খুলতে খুলতে বলে,
“খাবার অর্ডার করেছিলে যে।”
“ওহ হ্যাঁ।”
আর্শি উঠে বসে চুলগুলো পরিপাটি করে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে যায়। শ্রাবণ এই ফাঁকে জলদি করে রুম কিছুটা ডেকোরেশনের কাজে লেগে পড়ে। কিন্তু হঠাৎই কিছু মনে পড়াতে ওয়াশরুমের দরজায় নক করে। ভেতর থেকে আর্শি বলে,
“আসছি!”
“পরে আসবে। আগে দরজা খুলো।”
“কেন?”
“এক সেকেন্ডের জন্য খুলো।”
বাধ্য হয়ে আর্শি দরজা খুলতেই শ্রাবণ পেছন থেকে একটা বক্স সামনে এনে বলে,
“পড়ে আসো।”
আর্শি বক্সটা হাতো নিয়ে ভ্রুঁ কুঞ্চন করে বলে,
“কী আছে এতে?”
“খুলেই দেখো। আর কোনো কোশ্চেন করবে না। যা আছে পড়ে আসো।”
আর্শি দরজা লাগিয়ে বক্স খুলে দেখে তাতে ল্যাভেন্ডার কালারের একটা ফিনফিনে জর্জেট শাড়ি। শাড়িটা তার পছন্দ হলো কিন্তু কাপড়ের ম্যাটেরিয়ালটা মোটেও না। বিস্ময় নিয়ে দরজা খুলতেই শ্রাবণ ছুটে এসে দরজা চেপে ধরে বলে,
“রেডি হয়ে একেবারে বের হবে।”
আর্শি দরজায় হাত রেখে বলে,
“এটা অনেক পাতলা!”
“তো সমস্যা কই?”
আর্শি তীর্যক স্বরে বলল,
“সমস্যা কই মানে? এই শাড়িতে…. এই আমি এটা পড়ব না!”
শ্রাবণ বলে,
“আই অ্যাম ইউর হাজবেন্ড। তোমাকে কি এই শাড়ি পড়ে বাইরে যেতে বলেছি? তুমি যেতে চাইলেও আমি দিব না। শুধু আমি দেখব।”
“শাড়িটা…”
শ্রাবণ দরজা সামান্য খুলে আর্শির কথা শুরু হওয়ার পূর্বেই বলে,
“প্লিজ! আমি জানি তুমি শাড়িতে কম্ফোর্টেবল না প্লাস এতো পাতলা শাড়িতে তো নাই! তাও রিকুয়েস্ট করছি।”
আর্শি শ্রাবণের মুখপানে চেয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ওকে!”
অতঃপর দরজা বন্ধ করে শাড়িটা পড়ে নেয়। শ্রাবণও বার্থডে কার্ড দিয়ে দেয়ালে লাগায়। ফুল দিয়ে বারান্দার টেবিলটা সাঁজায়। ল্যাভেন্ডার রঙের কেকটাও সেখানে রাখে। কয়েকটা ক্যান্ডেল গ্রিলের উপর রাখে। যদিও সেগুলো আর্টিফিশিয়াল ক্যান্ডেল। সব সাঁজিয়ে শ্রাবণ ভীষণ খোশ মেজাজে বলে,
“অল ডান। এখন বৃষ্টি এসে সারপ্রাইজ হয়ে যাবে পুরো। আসছে না কেন?”
অতঃপর বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে নক করে বলে,
“হয়েছে?”
আর্শি কুঁচি ঠিক করছে। জর্জেট শাড়ি পড়তে সুবিধা কিছুটা। আর্শি জবাব দেয়,
“হয়ে গেছে। আসছি।”
আর্শি কুঁচি ঠিক করতে করতে বক্সটা হাতে নিয়ে বেরোয়। শ্রাবণ হা করে তাকিয়ে আছে আর্শির দিকে। খোলা চুলে বিনা সাঁজে ল্যাভেন্ডার রঙের শাড়িতে স্নিগ্ধ ফুলের মতো লাগছে আর্শিকে। শ্রাবণের বিরতিহীন দৃষ্টিতে আর্শি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। এই দৃষ্টি যেন সাধারণ না। ঘোর লাগানো। এই ঘা*য়েল করা নজর থেকে বাঁচতে সে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। চিড়ুনী উঠিয়ে চুল আঁচড়ায়। বক্স থেকে চুড়িগুলো বের করে হাতে পড়ে নেয়। কানেও ঝুমকো পড়ে নেয়।
শ্রাবণের দৃষ্টি এখনও আর্শিতেই। সে এগিয়ে গিয়ে আর্শির পেছনে দাঁড়ায়। সামান্য ইতস্তত করে আর্শির কাঁধে প্রথমে হাত রাখে। আর্শি দৃষ্টি নিচু করে নেয়। শ্রাবণ আর্শির কানের কাছে মুখ নিয়ে স্মিত স্বরে বলে,
“মে আই?”
আর্শি মুখে জবাব দিতে পারলো না। আয়নায় শ্রাবণের চোখের দিকে একবার চেয়ে তৎপর দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। শ্রাবণ আর্শির হাত ধরে ও-কে বারান্দায় নিয়ে যায়। তারপর চেয়ারে বসিয়ে নিজে বিপরীত পাশের চেয়ারে বসে। ফোনে এই আলো-আঁধারিতে আর্শির কয়েকটা ছবি তুলে বলে,
“কেকটা কাটো। পছন্দ হয়েছে না?”
আর্শি কেকটা দেখলো। অতঃপর স্মিত হেসে বলল,
“সব একদম মিলিয়ে এনেছেন? ফ্লাওয়ার ভাসেও ল্যাভেন্ডার ফ্লাওয়ার।”
শ্রাবণ মাথা চুলকে বলল,
“আসলে আমি তোমার জন্য তিনটা রং সিলেক্ট করেছিলাম। এখানে এসে আজকের দিনে প্রথমে তোমাকে ল্যাভেন্ডার রঙে দেখে মনে হলো, আজকের দিনটা তোমার জন্য ওই রংটাতেই সাঁজাই। লুক, তোমাকে কতোটা স্নিগ্ধ লাগছে তুমি নিজেও জানো না।”
আর্শি লাজুক হাসে। শ্রাবণ হাত বাড়িয়ে আর্শির সামনের চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দেয়। কপোল ও কানে শ্রাবণের হাতের ছোঁয়া লাগতেই কেঁপে উঠে আর্শি। শ্রাবণও তা বুঝে ফিচলে হাসে। আর্শি সামান্য তোঁতলানো স্বরে বলে,
“কে–ক কা*টি! মেল্ট হয়ে যাবে তো!”
“হু হু।”
আর্শি কেক কে*টে প্রথমে শ্রাবণকে খাওয়ায়। অতঃপর শ্রাবণও আর্শিকে খাওয়ায়। দুপুরের মতো দুজনে দুজনকে খাইয়ে দেওয়ার পর রুম সার্ভিসে কল করার পর ওরা বাকি কেক ও খালি ডিশ গুলো নিয়ে যায়। আর্শি ব্যালকনিতে বাইরের দিকে মুখ করে একটা ল্যাভেন্ডার ফুল ফুলদানি থেকে উঠিয়ে হাতে নিয়ে বসে আছে। মুগ্ধতার চোখে কোলো অম্বরে চাদরের মতো বিছিয়ে থাকা তারকারাজি দেখছে। সাথে আছে অর্ধচন্দ্রমা। শ্রাবণ পেছন থেকে এসে সামান্য নিচু হয়ে আর্শির কাঁ*ধে থুতনি ঠেকিয়ে নিরব থাকে। তৎক্ষণাৎ আর্শি লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে সামান্য নড়ে উঠে। শ্রাবণ বলে,
“পূর্ণিমাতেই আকাশের ওই চাঁদটা অনেক সুন্দর দেখায়। কিন্তু আমার কাছে এই অর্ধ চন্দ্রমাকেও মোহনীয় লাগছে। কারণ কী জানো?”
আর্শি মাথা নাড়ায়। শ্রাবণ ঘোরলাগা কণ্ঠে জবাব দেয়,
“কারণ, আমার মনের আকাশের চাঁদটা আমার সামনে বসে আছে! আকাশের চাঁদ যেমন একটাই থাকে। আমার মনেও তুমি একমাত্র চাঁদ। এই চাঁদের সৌন্দর্যে কোন পূর্ণিমা লাগে না। সে সব ক্ষেত্রেই মোহনীয়। এই চাঁদকে ছোঁ*য়ার একমাত্র অধিকার আমার আছে তাই না? ”
আর্শি এবার যেন নড়ন ক্ষমতাও হারিয়েছে। শ্রাবণের শীতল ঘোর লাগা কন্ঠস্বর আর্শিকে যেন বরফ করে দিয়েছে। শ্রাবণ ফের বলে,
“আমি আমার মনের আকাশের চাঁদটাকে একদম নিজের করে পেতে চাই। তাকে খুব গভীরতম ভাবে ছুঁ*য়ে দেখতে চাই। তার আড়ষ্ট ভঙি আমাতেই থাকুক।”
আর্শি নিরব। শ্রাবণ কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষার পর আর্শিকে লজ্জায় আরও মুষড়ে পড়তে দেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিজের বক্ষমাঝারে আগলে দেয়। ভালোবাসা তো স্নিগ্ধতার প্রতিরূপ। ঠিক আকাশের ওই চাঁদটার মতো।
চলবে ইন শা আল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ। রিচেক করা হয়নি।