#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_২৮
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
” এই বিনা! উঠ আমরা চইলা আসছি বটে।”
কবিরের ডাকে ঘুম ভাঙলো বিনার। ক্লান্তিতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল বুঝতে পারেনি মেয়েটা। হুড়মুড়িয়ে বসা থেকে উঠে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো চিরচেনা সেই বাসস্ট্যান্ডে এসে গেছে। সমুদ্রর কথা মনে পড়তেই বুকটা কেমন হুহু করে উঠলো বিনার। মানুষটা একটুও বিশ্বাস করলো না তাকে? এতদিনের সংসারে এতটুকু ভালোবাসাও কি তার মনে জন্মায়নি!
” বিনা লাম বটে। ”
নানির ডাকে ভাবনার রেশ কাটে বিনার। এখান থেকে বাড়ি গিয়ে কি ওই জানোয়ারটার সাথে থাকতে হবে? কবিরের দিকে তাকিয়ে রাগে,ঘৃণায় ফুঁসে ওঠে বিনার মন। বিনা বাস থেকে নামলো। সকালের নরম রোদ এসে গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। এবার আর শয়তানটাকে ছাড়বে না। হয় ওকে মারবে নয়তো নিজে মরবে বলে মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করলো বিনা। যতদূর মনে হচ্ছে নানা ও নানিকে ব্লাকমেইল করেছে কিছু নিয়ে। সেইজন্যই এই ছলচাতুরী করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। আজ যদি বাবা-মা জীবিত থাকতো জীবনটা অন্য রকম হতো বলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে বিনা।
সারা রাত ফ্লোরে বসে কেটেছে সমুদ্রর। ইফতিও ছিল সাথে বসে। কোনো বিপদ না বাঁধায় সেই ভয় ছোটো ভাইকে একা রাখতে পারেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় ইফতি কোনো মন্তব্য পর্যন্ত করার সুযোগ পায়নি। এভাবে কোনো প্রমাণ ছাড়া একজনকে বিয়ে করেছি বললেই হলো? বিনাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে সমুদ্র। চোখ মেলে আশেপাশে তাকায় একবার। মনে পড়ে গতকাল সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া অঘটনের কথা। কবিরের কথাগুলোও মনে পড়ে। রাগে শরীর রিরি করে উঠে। অনুমতি ছাড়া স্বামীরও অধিকার নেই কোনো নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার। কবির যে বিনার সাথে জোরজবরদস্তি করবে সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই সমুদ্রর। মাথাটা আবারও দপ করে উঠে সমুদ্রর। ইফতির দিকে দৃষ্টিপাত করতেই শীতল হয়ে আসে মন ও মস্তিষ্ক। বেচারা ফ্লোরে বসে ঘুমোচ্ছে। ভাইকে না ডেকেই ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলো সমুদ্র। কী করবে জানে না। বিনাকে নিয়ে সংসার করবে কিনা জানে না কিন্তু বিনার অমতে কিছু হতে পারে না। কিছু না!
বেলা এগারোটা ছুঁইছুঁই। ঘরে পায়চারি করছেন শায়লা। সকাল থেকে সমুদ্রকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বাসায়। কন্ঠ মায়ের কাছে গেছে। বিনার বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না কন্ঠ। বিনার নিষ্পাপ দৃষ্টিতে কোনো কপটতা ছিল না গতকাল। বরং কবির নামক লোকটার মধ্যে অনেক ঘাপলা আছে বলে মনে হচ্ছে বিনার। শারমিন সুলতানা নাস্তা তৈরি করেছে মেয়ে ও নিজের জন্য। কন্ঠ ইফতি ও তার শ্বাশুড়ির জন্য ইতিমধ্যে নাস্তা তৈরি করে দিয়ে এসেছে। ইফতি বাসায় থাকবে আজ। জাহাঙ্গীর মল্লিক ব্যবসার কাজে অন্য জেলায় গেছে। উনাকে তাই কিছু জানায়নি কেউ। রাত করে ঘুমানোর জন্য সবারই সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে আজ।
” মনটা কেমন অস্থির লাগছে রে। আজ যদি সত্যি সত্যি বিনা আমার মেয়ে হতো কোনো প্রমাণ ছাড়া এভাবে অবিশ্বাস করতাম? ”
ডাইনিং টেবিলে বসে বললেন শারমিন। কন্ঠ এক টুকরো শুকনো পাউরুটি মুখে পুড়ে চিবুচ্ছে।
” আমিও সেটাই ভাবছি। তাড়াহুড়ায় ভুল হলো কি-না! আমার মনে হচ্ছে ওই কবির নামের লোকটা বিনার নানা,নানিকে কোনো ভয় দেখিয়েছে। বিনা তো এখানে থাকে। কিন্তু উনাদের তো সেই গ্রামেই থাকতে হয়। জলে থেকে কি কুমিরের সাথে লড়াই করে পারে কেউ? ”
” হ্যাঁ এটাই হয়েছে। আমার ভয় লাগছে! মেয়েটার কোনো বিপদ না হয়ে যায়। কী করবো বল তো? পুলিশ নিয়ে যাবো?”
কন্ঠ পানি পান করে মায়ের দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
” যদি সমুদ্র বিনার কাছে না গিয়ে থাকে তবে আমরা দু’জন যাবো। আমি তোমার জামাইকে যেভাবেই হোক ম্যানেজ করবো। মুখে মুখে বোন বললেই তো হবে না। দায়িত্বও পালন করবো। ”
” সমুদ্রকে কল দিয়ে দেখ তাহলে কোথায় গেলো!”
” বারকয়েক দিলাম কল। ধরলো না। দেখি বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। ”
শারমিন সুলতানা মাথা নাড়লেন। মাঝে মধ্যে মানুষ সঠিক সময় সঠিক সিন্ধান্ত নিতে পারে না। মল্লিক বাড়ির লোকজনেরও তাই হয়েছিল গতকাল রাতে। নয়তো তখুনি বিনাকে রাখা যেতো নিজেদের সাথে।
গতকাল রাত থেকে পানি পর্যন্ত মুখে তোলেনি বিনা। বিনাকে একটা ঘরে আঁটকে রেখেছে কবির। বাইরে পাহারা দিচ্ছে দু’জন চ্যালা। রাত হলেই হয়তো জানোয়ারটা আসবে বিনাকে ছিঁড়ে খেতে। এসব ভেবেই পাগল পাগল লাগছে বিনার। সমস্ত ঘরে নজর বুলিয়ে দেখেছে বিনা,নিজেকে শেষ করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই! যদি গলায় দড়ি দিতে হয় তবে পরনের শাড়ি খুলতে হবে। একবার ভাবছে নিজে আত্মঘাতী হবে কিন্তু পরক্ষনেই সমুদ্রর কথা মনে পড়ছে বিনার। মানুষটা ভুল বুঝেছে বলেই এভাবে ছেড়ে দিলো। আসলে যে কতটা ভালোবাসে সেটা বিনা জানে। দরজার খটাখট শব্দে নড়েচড়ে উঠলো বিনা। এখনই কি তবে আসলো কবির?
” বিনা! বাইরে এসো।”
বিনা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সমুদ্রর গলা! বিনা চকিতে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে গেলো। কয়েকজন পুলিশ নিয়ে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। বিনাকে দেখেই অধর কোণে প্রশান্তির রেখা ফুটে উঠেছে। বিনা কোনো দিকে না তাকিয়ে ছুটে গিয়ে সমুদ্রর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। সমুদ্রও এক মুহুর্তের জন্য সবকিছু ভুলে বুকে জড়িয়ে নেয় প্রিয়তমাকে। মিনিটখানেক পড়ে আশপাশে লোকজনের অস্তিত্ব মনে পড়ায় সমুদ্রকে ছেড়ে দেয় বিনা।
” আপনি কোনো চিন্তা করবেন না ম্যাম। আমরা কবিরকে গ্রেফতার করেছি। এখন আপনার সাক্ষ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কবির কি আপনাকে জোর করে নিয়ে এসেছে? ”
পুলিশ অফিসার সোয়েব হোসেন সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিনার দিকে। বিনা কোনো চিন্তা ভাবনা না করেই অকপটে স্বীকার করে সবকিছু।
” হ্যাঁ। ওর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে বলে জোর করে নিয়ে এসেছে। উপরন্তু আমার নানা ও নানিকে প্রাণে মে*রে ফেলার হুমকি দিয়েছে। ”
” ধন্যবাদ। জনাব সমুদ্রও সেটাই বললেন আমাদের। আমরা ওকে জিজ্ঞেসাবাদ করেছি। বিয়ের কোনো প্রমাণ সে দিতে পারেনি।”
বিনার কাছে সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছে। কেমন সিনেমার মতোই। বাস্তবে কপাল এতো ভালো হয় কারো?
” ধন্যবাদ অফিসার। আপনারা সাথে না থাকলে আমার একার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হতো না।”
” আরে না জনগণের সেবা করাই তো আমাদের কর্ম। চলুন আপনাদের বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়ে আসি। কবিরের অনেক সাঙ্গপাঙ্গ আছে। পথে আপনাদের সাথে ঝামেলা করতে পারে। ”
” বেশ চলুন তাহলে। ”
” দাঁড়ান! ”
বিনার কথায় সবাই ওর দিকে দৃষ্টিপাত করলো। বিনা ফের কথার খেই ধরে বলে,
” নানা – নানিকে যাওয়ার আগে একবার দেখে যাবো আর কথা বলবো দু’মিনিট। ”
সমুদ্র রাজি হয়। নানা – নানির সাথে দেখা করে পুলিশের সহায়তায় বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে বিনা ও সমুদ্র। সমুদ্রর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন বিনার নানা ও নানি। এই বয়সে এসে মৃত্যুর ভয়ে নাতনিকে এভাবে জলে ফেলে দেওয়ার মতো পাপ করার জন্য নাতনির কাছেও হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন উনারা। বিনা কোনো অভিযোগ করেনি শুধু হাসি মুখে বিদায় দিয়ে এসেছে সবাইকে। বাসে উঠে বসেছে বিনা ও সমুদ্র। গতকাল রাত থেকে কী মারাত্মক ঝড় বয়ে গেলো মানুষ দুটোর উপর! এরমধ্যে কন্ঠ অবিরত কল দিয়েছে সমুদ্রকে। এতক্ষণ ঝামেলায় থাকায় ফোন পকেট থেকে বের করেনি। কিন্তু এখন ফুরসত পেতেই কল রিসিভ করে সমুদ্র।
” কী রে! কোথায় তুই? সকাল থেকে আমরা সকলে চিন্তায় ম*রে যাওয়ার উপক্রম হয়েছি! একটা টেক্সট তো করতে পারতি?”
সমুদ্র সময় নিয়ে উত্তর দেয়। কন্ঠ অস্থির হয়ে আছে প্রত্যুত্তরের জন্য।
” আমি বাসে। চিন্তা করিস না। মা’কে বল বিনাকে নিয়ে ফিরছি আমি। ”
কন্ঠের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। মনটা আনন্দে নেচে উঠেছে।
” আচ্ছা আচ্ছা তোরা সাবধানে আয়। আমি তোদের দু’জনার প্রিয় খাবার রান্না করবো আজ।”
কন্ঠ উত্তেজনায় কল কেটে দিয়ে বাড়ির সবাইকে জোরে জোরে ডাকতে শুরু করে। রান্নাঘরে বসেই কথা বললো কন্ঠ। শায়লা ও ইফতি যে যার ঘরেই ছিলো এতক্ষণ। কিন্তু কন্ঠর হাঁক-ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলো সবাই।
” কী হয়েছে কন্ঠ? এভাবে চেচামেচি করছিস কেনো? সমুদ্রর খোঁজ পেয়েছিস?”
আগ্রহ নিয়ে শুধলেন শায়লা মল্লিক। কন্ঠ শ্বাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে হেসে বললো,
” ওঁরা দু’জন আসছে মা! বিনাকে নিয়ে আসছে সমুদ্র। ”
শায়লার চোখমুখ খুশিতে চকমক করে উঠেছে। বিনার অতীত নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই উনার। ছেলে সুখে থাকলেই তিনিও খুশি। তাছাড়া মেয়েটা যে সবার কাছে কতটা সেটা বিনার একদিনের অনুপস্থিতিতে সবাই টের পেয়েছে।
” ইফতি দোকান থেকে গিয়ে মিষ্টি নিয়ে আয়। বিনা আর সমুদ্রকে মিষ্টি মুখ করিয়ে ঘরে তুলবো আমি। ”
খুশিতে গদগদ হয়ে বললো শায়লা। ইফতি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।
” যাক আলহামদুলিল্লাহ। শান্তি! ভাই গতকাল রাগের মাথায় হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গিয়েছিল। আর ওকে সামলাতে গিয়ে আমিও ফুরসত পাইনি। তোমরা যদি বিনাকে একটু বিশ্বাস করতে এবং সাথে সাথে পুলিশ ডাকতে তাহলে এতদূর জল গড়াতেই পারতো না। কারো নামে যদি তার মা-ও কিছু বলে সেটা যে সব সময় সত্যি হবে এমন কথা নেই। ”
ইফতির কথায় কন্ঠর নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। বোন হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল বিনাকে সবকিছু থেকে রক্ষা করা।
” আমি মা’কে গিয়ে খবরটা দিয়ে আসি। না কল দিয়ে বলছি বরং। ”
” আমি গিয়ে বলছি তোর মা’কে। ”
শায়লা এ কথা বলেই দরজার দিকে এগোলেন।
“হু যাও,রান্না করতে হবে অনেক কিছু। বিনা আর সমুদ্রর পছন্দের খাবার রান্না করবো।”
” আর আমি বুঝি জলে ভেসে এসেছি হু?”
ইফতি ভ্রু কুঞ্চন করে তাকায় কন্ঠর দিকে। শায়লা ততক্ষণে শারমিনের কাছে গেলো।
” তোমার জন্য রান্না করবো কচু্।”
” কচু খাই না। প্রচুর অ্যালার্জি। তবে তুই চাইলে অন্য কিছু খাওয়াতে পারিস।”
” কী খাবা?”
ইফতি নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে কন্ঠর ঠোঁটের দিকে ইশারা করলো।
” একটা শুষ্ক চুমু দে, কোনো রসকষ থাকবে না আপাতত । ”
” ছিঃ! মুখের ভাষা। কাজ আছে অনেক যাও এখান থেকে। দোকানে বরং মিষ্টি আনো। আর হ্যাঁ আমার জন্য স্পেশাল মালাই নিয়ে এসো।”
” ওকে মহারাণী। গেলাম তবে অভুক্ত হৃদয় নিয়ে। এই আফসোস নিয়ে পরপারে গেলেও শান্তি পাবো না।”
কন্ঠ তড়িৎ গতিতে ইফতির কাছে এসে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। ইফতি একেবারে শকড!
” এরকম কথা আর কখনো বলবে না। মনে থাকবে?”
” এরকম কথা বলে যদি আমার বউয়ের কাছ থেকে স্বইচ্ছায় এরকম রসমালাই পাওয়া যায় তবে হাজারবার বলবো।”
ইফতি কন্ঠর গাল টেনে দিয়ে রান্নাঘর থেকে প্রস্থান করলো। কন্ঠর মনটা একটু খারাপ হলো। কিন্তু পরক্ষনেই বিনা ও সমুদ্রর কথা মনে হতেই আবারও রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলো মেয়েটা।
চলবে,
আমার লেখা বই নীরবে রাত্রি নামে অর্ডার করতে নক করুন ইনবক্সে। কেমন হচ্ছে জানাবেন অবশ্যই। স্টিকার, ইমোজি ব্যবহার না করে একটা শব্দ অন্তত লিখে যান।💜
পরের পর্বের লিংক https://www.facebook.com/100080128645410/posts/406714588676159/