#যার_কথা_ভাসে_মেঘলা_বাতাসে
#পর্ব_৩০
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
সন্ধ্যার দিকে সবাই একসাথে বসে কক্সবাজার যাওয়ার সমস্ত প্ল্যান সেড়ে নিলো। কালকে ইফতি ছুটির জন্য আবেদন করবে। তাই পরশু রওনা হবে।
” বিকেলে যে বললেন নায়িকা আপনার প্রেমিকা ছিল, কীভাবে বললেন? একবারও ভাবলেন না আমার যদি কষ্ট হয়!”
অন্য পাশ ফিরে শুয়ে বিনা অভিমানী সুরে বললো কথাটা। সমুদ্র মুচকি হাসলো।
” দেখলাম বউ আমার মান করে কিনা। কিন্তু সে তো হেসে উড়িয়ে দিলো সবকিছুই। ”
” মনে মনে তো ঠিকই খারাপ লেগেছে। কিন্তু মুখে কিছু বলিনি। ”
সমুদ্র আলতো করে জড়িয়ে ধরলো বিনাকে। বালিশের পরিবর্তে সমুদ্রর হাত হলো বিনার মাথা রাখার স্থান।
” আমি তো মজা করেছি পাগলি। এসব রাখো কাছে এসো একটু আদর করি।”
বিনা তড়িৎ গতিতে সরে গেলো সমুদ্রর কাছ থেকে।
” একদম না। ”
” ঠিক আছে। ”
সমুদ্র বালিশের পাশ থেকে ফোন হাতে নিয়ে সেদিকে নজর দিলো। বিনার প্রত্যাশায় ছাঁই পড়লো। ভেবেছিল মুখে না বলবে সমুদ্র ঠিক সেধে সেধে বলবে। কিন্তু তা আর হলো কই? এখন কি নিজে থেকে কাছাকাছি যাওয়া যায়? লজ্জা লাগে যে!
” হু। ”
বিনা চুপচাপ রইলো কিছুক্ষণ। ভাবছে সমুদ্র একটু পর হয়তো আবারও আসবে কাছে। কিন্তু না! সময় গেলো কিন্তু সমুদ্র নিজে থেকে আর কথা বললো না। একটা সময় পরে বিনা তাকিয়ে দেখে ছেলেটার মুখের উপর ফোন পড়ে আছে। আর সে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। অগত্যা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেও ঘুমানোর চেষ্টা করলো। মাঝে মধ্যে হয় না? একটা জিনিস পেলাম কিন্তু লজ্জায় কিংবা অস্বস্তিতে সেটা ফিরিয়ে দিচ্ছি। ভাবছি আরেকবার পেলেই আর “না” বলবো না। কিন্তু সব সময় দ্বিতীয় বার সুযোগ আসে না। তাই কখনো কোনো কিছু ফেরাতে নেই। বিশেষ করে প্রিয়জনকে তো না-ই।
পূর্ব আকাশে সূর্য উঠেছে। যান্ত্রিক শহরে শুরু হয়েছে যন্ত্র মানবদের আনাগোনা। সবাই যার যার কাজে ছুটছে। কেউ অফিসে, কেউ স্কুল কিংবা কলেজে। আবার কেউ অন্য প্রয়োজনে। সকালবেলার নাস্তা সেড়ে বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে সমুদ্র। বিনা রান্নাঘরে থালাবাসন পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। সমুদ্র একেবারে রেডি হয়ে বিনার কাছে গেলো। কন্ঠকে দেখে বিনাকে ডাকবে কি-না ভাবলো একবার। যাগগে কন্ঠ ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করলে করুক!
” বিনা এদিকে এসো।”
সমুদ্রের ডাকে বিনা ও কন্ঠ ওর দিকে দৃষ্টিপাত করলো।
” আসছি।”
কন্ঠ ঠোঁট টিপে হাসছে। বিনা এগিয়ে গেলো সমুদ্রর দিকে।
” আমি একটু বের হচ্ছি। টিউশনির কিছু টাকা বাকি। ওগুলো দেওয়ার কথা আজকে। ”
” ঠিক আছে যাও।”
” যাওয়ার আগে একটা ইয়ে দাও ঠোঁটে। রাতে তো অতৃপ্ত চিত্তে ঘুমিয়ে গেলাম। ”
বিনার চোখগুলো বড়ো হয়ে গেছে। পেছনে কন্ঠ! এরমধ্যে কী বললো সমুদ্র সাহেব এটা?
” পেছনে কন্ঠ আপা তো।”
” তাহলে রুমে চলো।”
” হুঁশ। রাতে দিবো এখন যান।”
” না এখন দাও। বুকটা কেমন জানি লাগছে।”
” এতো বাহানা! আজকে রাতে আদর করতে দিবো। বাঁধা দিবো না।”
লজ্জা মাখা মুখশ্রী অন্য দিকে ঘুরিয়ে ফেললো বিনা। এ কথা বলার পরে চোখ চোখ রাখা সম্ভব নয় আর। সমুদ্র আনন্দে বিনাকে কোলে তুলতেই যাবে এমন সময় খেয়াল হলো পেছনে কন্ঠ!
” ঠিক আছে বউজান। যাই।”
” আসুন। সাবধানে যাবেন।”
” ওকে। রাতে খবর আছে। রেডি থেকো।”
” ধ্যাৎ! ”
সমুদ্র হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো। বিনাও রান্নাঘরে গেলো আবার। কন্ঠ যেনো আজকে ভদ্র হয়ে গেছে। সমুদ্রকে কিছু বলেনি। কিন্তু মনে মনে ঠিক সবকিছু জমিয়ে রাখছে। যাতে বাঁশটা পরে ভালো করে দেওয়া যায়।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। কিন্তু সমুদ্র বাসায় ফিরলো না। বিনার চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। বাড়ির সবার হচ্ছে তবে কম। কারণ সবাই ভাবছে চলে আসবে। কিন্তু সবার ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে সমুদ্র আর ফিরলো না। সব জায়গায় খোঁজ নিলো ইফতি। কিন্তু কোনো বন্ধু কিংবা বান্ধবীর সাথে সে যায়নি কোথাও। চিন্তায় বিনা ও শায়লা মল্লিকের অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেছে। মল্লিক বাড়ির সব আনন্দ, হাসি-তামাশা সবকিছু একটা ঝড় এসে এলোমেলো করে দিলো। এভাবেই কাটলো তিন মাস। ছোটো ছেলের শোকে পাগলপ্রায় শায়লা। জাহাঙ্গীর মল্লিক কাজকর্মের দিকে উদাসীন হয়ে গেছেন। ইফতির কাঁধে দায়িত্বের বোঝা বেড়েছে। বিনাকে সব সময় চোখে চোখে রাখে কন্ঠ ও শারমিন। মেয়েটার চেহারা দেখার মতো নেই। চোখের নিচে কালো দাগ হয়ে গেছে। এভাবেই একদিন হুট করে জ্ঞান হারালো বিনা। ডাক্তার আসলো। কিছু টেস্ট দিলো। খবর আসলো বিনা প্রেগন্যান্ট! বিনার বাচ্চা হওয়ার খবর ছিল মেঘলা আকাশে একটুকরো রোদের আলোর মতো। ধীরে ধীরে সবাই বিনার প্রতি ভীষণ যত্নশীল হয়ে উঠলো। সময় গড়ালো। বিনার কলিজা স্বামী হারানোর দুঃখে পুড়ছে সারাক্ষণ। তারচে বেশি আফসোস হচ্ছে শেষবারের মতো স্ত্রী’র স্পর্শ চেয়েছিল মানুষটা। সেদিন যদি বুঝতো এটাই ছিল শেষ যাওয়া তবে কন্ঠর সম্মুখেই স্বামীর ইচ্ছে পূর্ণ করতো বিনা। সমুদ্রর চলে যাওয়ার ধাক্কাটা মনে মনে ভীষণ রকম আঘাত করেছিল জাহাঙ্গীর মল্লিককে। একদিন রাতে ঘুমানোর পড়ে আর চোখ খোলেননি জাহাঙ্গীর মল্লিক। ডাক্তার বলেছিল ঘুমের ঘোরে স্ট্রোক করে মারা গেছেন।
” তারপর কীভাবে জানলো সবাই বাবা নিজের ইচ্ছেতে বাড়ি ছেড়েছে?”
পূর্ণতা কৌতুহল প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করলো শারমিন সুলতানাকে। শারমিন সুলতানা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বয়সের ভারে আজকাল উঠতে কিংবা দাঁড়াতে গেলে কোমরে কষ্ট হয়।
” একটা চিঠি এসেছিলো বছর পাঁচেক পরে। বেনামি, কোনো ঠিকানা ছিল না। তবে হাতের লেখাটা সমুদ্রর ছিলো। সেখানে লেখা ছিলো সে কখনো আর ফিরবে না। কিন্তু কেনো সেসব কিছু লেখেনি ছেলেটা। ”
পূর্ণতার কষ্ট হচ্ছে। চোখ ভেঙে পানি গড়িয়ে পড়ছে। এ জীবনে বাবার আদর কাকে বলে জানে না সে। মায়ের কাছেও সেরকম ভালোবাসা পায়নি। বাবার চলে যাওয়ার পর থেকেই মা কেমন হয়ে গেছে। দাদির মানসিক অবস্থা ভালো নয়। সমুদ্র যে নেই বাড়িতে সেটা শায়লা মল্লিক মানতে পারেননি। তার উপর স্বামীর মৃত্যু তো আছেই! ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করলো পূর্ণতা। ততক্ষণে শারমিন জানালার পাশে দাঁড়িয়েছেন।
” নানি রাত হয়েছে। আমি এখন যাচ্ছি। ”
” খেয়ে যা বরং।”
” না। ইচ্ছে করছে না। মায়ের সাথে খাবো। আমি গেলাম এখন। ”
শারমিন আর আটকালো না পূর্ণতাকে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সে নিজের বাসায়। কলিংবেলের আওয়াজে দরজা খুলে দিলো শাওন। শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ তার,মাথায় ঘন চুল। পরনে হাফপ্যান্ট আর টি-শার্ট। শাওন ইফতি ও কন্ঠর ছেলে। পূর্ণতার দুই বছরের ছোটো।
” আপাই এতক্ষণে তোর ফেরার সময় হলো? মা এখুনি তোকে ডাকতে পাঠাচ্ছিল। ”
” এইতো এসেছি। বড়ো মা কেনো ডাকছিল?”
ভেতরে ঢুকে দরজা আঁটকে দিয়ে শুধালো পূর্ণতা।
” কেনো আবার! ডিনার করবি না? সেজন্য। ছোটো মা সেই সন্ধ্যায় ছাদে গেলো। এখনো সেখানেই। ”
” ঠিক আছে। তুই খেতে যা আমি মা’কে নিয়ে আসছি।”
” আচ্ছা আপাই।”
শাওন মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোলো। পূর্ণতা চঞ্চল পায়ে ছুটলো ছাঁদের দিকে। ছোটো থেকেই দেখে আসছে তার মা প্রায় ছাদে গিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কখনো সেটা রাতে আবার কখনো দিনে!
” পূর্ণতা আসলো না?”
ছেলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো কন্ঠ। বয়স বেড়েছে। চেহারায় কাঠিন্য ফুটে উঠেছে বেশ। আগের মতো মনখোলা ধরনের নেই কন্ঠ। পরিস্থিতির কারণে একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছে। বাবা মৃত্যুর পরে ইফতিরও দায়িত্ব, কর্তব্য বেড়েছে। একদিকে কন্ঠর মা,আবার নিজের পরিবার। প্রথম প্রথম সবকিছু সামলাতে হিমসিম খেতে হতো ইফতিকে। পরে সবকিছু ঠিক হয়েছে।
” ছোটো মা’কে ডাকতে গেলো ছাদে। একসাথে আসবে বললো। বাবাকে দেখছি না?”
” আসছে। ঘরে বসে দেখলাম ল্যাপটপে মাথা গুঁজে কাজ করছে।”
” তাহলে আমাকে খাবার দাও। আমার ভীষণ ক্ষিদে লেগেছে মা।”
কন্ঠ শাওনকে খাবারের প্লেট এগিয়ে দিলো। শাওন খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো। এরমধ্যে ইফতি এসে বসলো চেয়ারে।
মেঘমুক্ত আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। চাঁদের দিকে তাকিয়ে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে বিনা। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে চমকে উঠে বিনা। পেছন ফিরে তাকায় সে।
” খেতে চলো মা। সাড়ে দশটা ছুঁইছুঁই! ”
” তুই খেয়ে নে। আমি পরে খাবো। ”
চলবে,
আগের পর্ব https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/972670924454680/?mibextid=Nif5oz
পরের পর্ব https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/973426911045748/?mibextid=Nif5oz