#নিশীভাতি
#৫০তম_পর্ব
এর মাঝেই হুমায়রার ফোনটা বেজে উঠলো কর্কশ ভাবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছেড়ে দিলো ফাইজান। হুমায়রা স্ক্রিনে দেখলো “ভাইজান” ভেসে আছে। ফোনখানা ধরতেই ভেসে এলো কান্নার সুর। ভাঙ্গা, মূর্ছিত স্বরে ভাইজান বললো,
“দাদা আর নাই”
কথাটা কর্ণপাত হলো ঠিক কিন্তু অনুধাবনে সময় লাগলো। মস্তিষ্ককোষগুলো যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো। কাঁপা স্বরে নিশ্চিত হতে শুধালো,
“হ্যা?”
“দাদা আর আমাদের মাঝে নেই রে। আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন”
ভাইজানের স্বর কাঁপছে। ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইজান আজ ভেঙ্গে পড়েছে। হুমায়রার মনে হলো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আপন মানুষের এই বিচ্ছেদটা ঠিক ধাতস্থ করতে পারলো না। ধপ করে বসে পড়লো অষ্টাদশী। তার স্বচ্ছ চোখগুলো ভিজে আসলো। ফাইজান ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলো। ফোনটা তার হাত থেকে নিলো। ভারী স্বরে শুধালো,
“হ্যালো?”
“ফাইজান সাহেব, আপনারা যহরের আগে আগে চলে আসেন। জানাযাটা যহর বাদ হবে”
বলেই ফোনটা রেখে দিলো রাশাদ। হুমায়রা ডুকরে উঠলো। ফাইজান তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মৃত্যু জিনিসটা হৃদয় কাবু করে, কাছের মানুষের মৃত্যু হৃদয় ছিড়ে ফেলে। হয়তো মানুষটি আমাদের প্রিয়র কাতারে পড়ে না, তবুও তার জন্য চোখের কোনে নোনাজলের ভিড় হবে। কারণ মৃত্যু কেউ কামনা করে না। সেখানে শামসু মিঞা ছিলো এই দুই ভাইবোনের জন্য বটগাছ। আজ শামসু মিঞা বা আতিয়া খাতুন না থাকলে রাশাদ বা হুমায়রার কি হতো সেটা কল্পনাও করতে পারে না হুমায়রা। মানুষটি তাদের পাহাড়ের মতো দুজোড়া প্রবীন হাতে আগলে রেখেছিলো। কখনো মা কিংবা বাবার জন্য আফসোস করার সুযোগ দেয় নি। কাওছার তো বরাবর ই ছিলো অমানুষ। তার কাছে পরিবার, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ের মূল্য ছিলো না। সেই পিতৃতুল্য স্থানটি পূরণ করেছিলো শামসু মিঞা। মা-বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত দুটো শিশুকে তিনি সর্বস্ব দিয়ে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন, কমতি রাখেন নি। নিজ স্বার্ধের উর্ধ্বে যেয়ে দামী জমিটা বেঁচে হুমায়রার বিয়ের গহনা এবং যৌতুকের টাকা জোগাঢ় করেছেন। এই মানুষ দুটো ছিলো বলেই হয়তো হুমায়রা এবং রাশাদের জীবনটা একটু হলেও সহজ ছিলো। আজ মানুষটি নেই। ভাবতেই ভেতরটা অব্যক্ত ব্যাথায় কুকড়ে উঠছে। দাদার সাথে কয়েকদিন যাবৎ কথা হচ্ছিলো না হুমায়রার। তিনি কারোর সাথেই কথা বলছিলেন না। শেষ যখন কথা হয়েছিলো বৃদ্ধ শুধিয়েছিলো,
“বুবু, তুমি পড়াশোনা করতেছো তো? জামাই এর খেয়াল রাইখো কিন্তু। তারা ভালা মানুষ”
ফাইজানের বুকে মুখ গুজে অঝরে কাঁদছে হুমায়রা। ফাইজান তাকে আগলে ধরে আছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কোথাও না কোথাও খবরটি তাকেও ব্যাথিত করেছে। যতবার দেখা হয়েছে, মানুষটির ঠোঁটে হাসি দেখেছে। কৃতজ্ঞতার হাসি। সে তাদের জন্য কিছুই করে নি। অথচ শামসু মিঞা সর্বদা তাকে খুব স্নেহ করতো। হয়তো নাতনীর সুখটাই তার কাম্য ছিলো। নাতনীর হাস্যজ্জ্বল মুখখানাই তার প্রাপ্তি। ফাইজানের কাছে প্রতিবার একটি অনুরোধ ই করতো,
“আমার নাতীন তোমার যোগ্য না, তয় একটু শিখায় নিলেই দেখবা সে সব পারবো”
নিস্তব্ধ ঘরে গুঞ্জছে হুমায়রার আর্তনাদ। ফাইজান তাকে সামলাচ্ছে নিপুন হস্তে।
******
বাড়ির উঠোনে মৃত্যুর গন্ধ, হাড় ভাঙ্গা বিষাদের সুরগুলো বাতাসে মিশে গেছে। আশেপাশের লোকের আফসোস এবং সহমর্মিতার অভাব নেই। উঠোন ভর্তি মানুষ। আগরবাতির গন্ধ নাকে আসছে। উঠোনে এক হাটু ভেঙ্গে এবং আরেক হাটু ছড়িয়ে বসে আছে রাশাদ। চোখগুলো ভেজা। মুখশ্রীতে অশ্রুর বিলীন দাগ। চ্যাটচ্যাটে হয়ে আছে চোখ। তবুও অশ্রু থামছে না। বুকটা কেঁদে উঠছে বারংবার। গ্রামের পরিচিত বৃদ্ধ, জোয়ান পুরুষেরা তার পাশে বসে আছে। সান্ত্বনা দিচ্ছে। রাশাদ মৌন। কথা বলার ইচ্ছেটুকুও অবশিষ্ট নেই। আচ্ছা! গতকাল রাতেও না মানুষটি কথা বলছিলো? হ্যা, গতকাল রাতের কথা, মানুষটি অনেক দিন পর তৃপ্তি করে খেয়েছে। শরীরের কোনো সমস্যা নেই। প্রেসার স্বাভাবিক। কোনো ব্যাথা নেই। সন্ধ্যায় রাশাদকে ডাকলো কাছে, কথা বললো,
“তুই কি আমার উপর রাইগ্যা আছোস রাশাদ?”
“কেনো দাদা? এমন কথা কেনো বলছেন?”
“সব জাইন্যা শুইন্যাও সব সময় তোর উপর অন্যায় চাপাই দিছি। তুই আমারে কইছিলি কাওছাররে না ডুকতে দিতে, আমি দিছি। তুই কইছিলি হুমায়রার বিয়া না দিতে, আমি দিছি। জেদ করিছি, তোর কতা হুনি নাই”
“আপনে গুরুজন, যা করবেন ভাইবাই করবেন। তাই না?”
“আসলে কি জানোস, ছেলেডার থেইক্যা সুখ পাইলাম না। দুর্ভাগ্য। আমারো, কাওছারেরো। কারণ আমি কাওছার থেইক্যা শান্তি পাই নাই, আর তোর মত পোলা হয়নের পরও কাওছার সেই পোলার সুখ নেয় নাই। আমি ওরে মানুষ করতে পারি নাই। ছবেদা মরার পর থেইক্যা, আমি ওরে লায় দিছি। কারণ বুড়া কালে সন্তানহারা হইবার চাই নাই। ভুল ছেলো। মস্ত ভুল। আল্লাহ আমার মাইয়্যাডারেও লইয়্যা গেলো। ওয় থাকলে এই আক্ষেপডি থাকতো না”
“ফুপুর কথা মনে পড়তেছে আপনার?”
“ওয় তো আমার মনেই থাহে রে, আমি কি ভুলিছি ওরে। ওই আমগাছটার নিচে আমার মাইয়্যা আছে। তুই আমার উপর রাগ কইর্যা থাকিস না। ক্ষমা কইর্যা দিস। আর দাদীর কথায় কিছু মনে করিস না। মুক্ষু মানুষ, বোজে না। মনে করে, সন্তান শুধরাইয়্যা যাইবো। বুজে না”
রাশাদ শুনে। দাদাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
“আপনে ঘুমান দাদা, এইসব চিন্তা ঠিক না এই বয়সে। যা হবার তা তো হবেই”
শামসু মিঞা সবার সাথে কথা বলেছিলো। খাবার সময় ইলহাকে বলেছিলো,
“বউ, এত্তো কাম কইরো না। বাচ্চার উপর পভাব পড়বো”
“আমি তো কোনো কাজ করি না দাদা”
“করো করো, দেহা যায় না। কিন্তু তুমি মেলা করো। দেখবা একদিন খুব বড় ডাক্তার হইবা তুমি। আমার নাতীডারে তখন ভুইলো না কিন্তু। তোমার লগে ও যায় না, কিন্তু মানুষ আমার নাতী খাটি। এই বুড়ার মিলায় লইয়্যো”
“আপনে খান, হইছে। কথা কম কন”
আতিয়া খাতুন রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলো। শামসু মিঞা হাসলো। হাসতে হাসতে বললো,
“আরে কাওছারের মা, চেতো কে? কতাডি কইয়্যা যাই”
“হইছে থামেন”
আতিয়া খাতুনের কথায় হাসতে হাসতেই থেমে গেলো শামসু মিঞা। অথচ আজ সে চিরকালের জন্য শান্ত। কেউ তার কণ্ঠ শুনতে চাইলেও শুনতে পারবে না। কারণ তার কথাগুলো ফুরিয়ে গেছে। শান্তির ঘুমে সে শায়িত। নিজ ঘরের বিছানাতেই লাশটি। মুখ ডাকা। কিন্তু যে দেখেছে, সেই বলেছে কি শান্ত চেহারা। কেউ বলবে না মানুষটি মৃত। যে দেখবে সেই বলবে গভীর ঘুমে। এখন ই উঠে বলবে,
“কাওছারের মা, খাতি দাও”
আতিয়া খাতুন শামসু মিঞাকে ধরে আছেন। তার চোখগুলো শান্ত, অশ্রুসিক্ত। কতগুলো বছর এই একটা মানুষের সাথেই কাটিয়েছেন। মুর্খ বিধায় গুনে বলতে পারবে না। সে খুব ছোট বয়সে শামসুর হাত ধরে এসেছিলো। তখন বটিও ধরতে জানতো না। রান্নায় নুন পড়ে যেত। ভাতের ফ্যান ফেলতেও পারতো না। হাত পুড়ে যেতো। অথচ আজ কতগুলো বছর হয়ে গেছে। মানুষটি আজ আর নেই। সকালে উঠে যখন নামাযের জন্য ডাকতে গেলো তখনই টের পেলো মানুষটির শরীর ঠান্ডা। চিৎকার করে রাশাদকে ডাকলো। তারা ছুটে এলো। ইলহা পালস চেক করলো। পেলো না। সিপিআর দিলো। কাজ হলো না। সে তো চলে গেছে। বর্গাচাষী শামসু মিঞা যে দক্ষিণের পাঁচ ঘর মিলিয়ে থাকতো আজ সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে। সকল পার্থিব সুখকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পারি দিয়েছে অজানা গন্তব্যে। সেই তিন হাতের জায়গায় কেউ তার নয়, সেই কারোর নয়। পৃথিবী থেকে শামসু মিঞা আজ বিদায় নিয়েছে।
পাশের বাড়ির রাশেদা ইলহাকে বললো,
“বউ, তোমার দাদীরে কিছু খাওয়াও। মানুষডা তো অসুস্থ হইয়্যা যাইবো। কথা কয়াও। ওরা লাশরে গোসল করাইবো। উঠানে রাখবো। তুমি এককাম করো তারে কও ছাইড়্যে দিতি”
ইলহা আতিয়া খাতুনের কাছে গেলো। ধীর স্বরে বললো,
“দাদী, দাদারে তারা নিয়ে যাবে। গোসল করানো হবে”
আতিয়া খাতুন ফ্যালফ্যাল করে চাইলেন। ছাড়তে ইচ্ছে করছে না মানুষটিকে। কিন্তু ছাড়তে হবে। চোখ বেয়ে নেমে এলো বিষাদবর্ষণ। ছেড়ে দিলো সে। ইলহাকে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে দিলো। ইলহা তাকে সান্ত্বনা দিলো না। কাঁদুক, এই অশ্রু তো নামানোর নয়।
******
হুমায়রা আসলো এগারোটা নাগাদ। লাশ তখন গোসল করে রাখা হলো উঠানে। সাদা কাপড়ে মুড়ে শামসু মিঞা শায়িত। হুমায়রা এসে ছুটে গেলো ভাইজানের কাছে। বোনকে দেখা মাত্র শক্ত রাশাদ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। জড়িয়ে সজোরে কেঁদে উঠলো। প্রলাপের মতো আওড়াতে লাগলো,
“আমার মাথার উপর ছাঁদটা এবার সত্যি সরে গেলো। আমি সত্যি ই অনাথ হয়ে গেলাম। আমার অভিভাবক চলে গেলো হুমায়রা। আমি একা হয়ে গেলাম রে। আমি কার থেকে এখন বুদ্ধি নিবো? কার সাথে পরামর্শ করবো? দাদা আমাকে একা করে দিলো হুমায়রা। একা করে দিলো”
“ভাইজান, কাইন্দো না। ভাইজান”
দুই ভাইবোনের কান্নার সুরে হৃদয় ব্যথিত হলো উপস্থিত মানুষগুলো। অজান্তেই তাদের চোখে জমলো অশ্রু। সমবেদনা বা মায়া, যাই হোক তাদের জন্য খারাপ লাগলো না এমন কেউ নেই বোধ হয়। ইলহা দরজা চেপে দাঁড়িয়ে রইলো। রাশাদ আজ বিক্ষিপ্ত। মানুষটিকে এভাবেও দেখবে কে জানতো। হুমায়রা ভাইজানের অশ্রু মুছিয়ে দিলো। কিন্তু পারলো না। ভাইজানের ভরসার স্থানটি ই আজ নেই। আজ আর কেউ বলবে না,
“রাশাইদ্দা আমি আছি”
*****
লাশ এবার নিয়ে যাবার পালা। আতিয়া খাতুন অশ্রুসিক্ত নয়নে স্বামীর খাটিয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। তখন লোকেদের একজন বলে উঠলো,
“ছেলে বাদে কবর দিবে? কাওছার তো বাপের শেষযাত্রা দেখলো না”
কথাটা অগ্নির বেগে ছড়ালো। হ্যা, কাওছারকে জানানো হয় নি। সে তো জেলে। তাকে ছাড়ায়ও নি রাশাদ। রাশাদ কিছু বললো না। চুপ করে বসে রইলো। তখন প্রবীন একজন বললো,
“রাশাদ, তুমি কাওছাররে ছাড়ায় আনো। যতই হোক ওর বাপ তো। এইডার জন্য দায়ী থাইক্যে যাবা কিন্তু তুমি”
“ভাইজান এখানে কি করবে? ভাইজান তো তাকে জেলে পাঠায় নি। সে নিজ কৃতকার্যেই জেলে গেছে। ভাইজান তার কর্মের শাস্তি ভোগ করবে কেনো?”
হুমায়রা সাথে সাথেই উত্তর দিলো। প্রবীন ধ্মক দিতে যেয়েও থেমে গেলেন। কারণ ফাইজানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সেখানে। ফলে মনে মনে বিড়বিড় করেই থেমে গেলেন। এর মাঝেই আতিয়া খাতুন এগিয়ে এলেন। অদ্ভুত ব্যাপার কালাম সেখানেই উপস্থিত। তিনি কালামকে শুধালেন,
“কাওছার তোমার থেইক্যা কত টাকা নিছিলো বাপ?”
“দুই লক্ষ ত্রিশ হাজার”
আমতা আমতা করে কথাটা বললো আতিয়া। তারপর কিছু কাগজ এগিয়ে বললো,
“আমি চাই না, আমার স্বামী কোনো আক্ষেপ বা দায় নিয়ে ওপাড়ে যাক………………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
৪৯তম পর্ব
https://www.facebook.com/share/p/w4C6zaFZqBfxT3vz/?mibextid=oFDknk