#নিশীভাতি
#৫১তম_পর্ব
“আমি চাই না, আমার স্বামী কোনো আক্ষেপ বা দায় নিয়ে ওপাড়ে যাক। এইডা গেরামের পশ্চিম পাশের আধা কানা জমির দলিল। আমার দেনমোহরের টেহা দিয়া কাওছারের বাপে জমিডা আমারে কিন্না দিছিলেন। কইছিলেন, আমি না থাকলে তুমি বউ এইডা বর্গা দিয়ে পেট চালাইতে পারবা। যে মানুষডা কোনো দিন আমার কাছ থেইক্যা কিচ্ছু চায় নাই, সেই মানুষডাই যখন কালকেরা আমারে কইলো, “কাওছারের মা, জমিডা বেইচ্যা কালামরে টেহাডা ফেরত দেওনের ব্যাবস্থা কইরো”। আমার বুজা উচিত ছেলো, মানুষডা মনে হয় আর থাকবো না”
কথাখানা বলতেই গলা ধরে এলো আতিয়া খাতুনের। তিনি অশ্রু সামলে নিলেন। চোখ মুছে কঠিন স্বরে বললেন,
“জেবনে কোনোদিন বুড়ার অমান্য করি নাই। আজও করুম না। তুমি এইডা বেঁইচ্যা তোমার টেহা নিয়ে নাও। আর যা বাঁচবো কাওছাররে দিয়া দিও। ও ওর জীবন কাটাইবো“
তার এমন বক্তব্যে সবাই অবাক। সবার হতবিহ্বল দৃষ্টিতে অগ্রাহ্য করলেন তিনি। কালামও আনুগত্যের সাথে দলিলটা নিলো। সকলে সাক্ষী হলো তার টাকা পরিশোধের। রাশাদ এবং হুমায়রাও অবাক দাদীর এমন সিদ্ধান্তে। আতিয়া খাতুন এবার দাঁড়ালেন রাশাদের সামনে। ধরা স্বরে বললেন,
“রাশাদ, তোমার ধারে এক্কান অনুরোধ। তোমার দাদা নাই, এই বাড়িখানের প্রমুখ এহন তুমি। তাই অনুরোধ এক্কান, কাওছারের বাপ বলছিলেন, সে আর কোনো দিন কাওছারের মুখ দেকবেন না। আমি চাই না, তার মরা মুখ কাওছার দেহুক। তুমি ভাই, তারে লইয়্যা যাও। বাইচা থাকতে তো কম কষ্ট পাইলো না। এখন মইর্যা জাওনের পর কষ্ট না পাক”
আতিয়া খাতুনের জরাজীর্ণ মনটা দিয়ে ধীর পায়ে শামসু মিঞার কাছে গেলেন। ফিসফিস করে কিছু বললেন কানে। কাঁদলেন মন খুলে। এরপর বললেন,
“আমি আইবো বুড়া, খুব তাড়াতাড়ি। আসসালামু আলাইকুম”
সবাই শেষ দর্শন করলেন শামসু মিঞাকে। তারপর লাশ তোলা হলো। কাধ দিলো রাশাদ এবং ফাইজান। অবশেষে শামসু মিঞা পারি দিলেন অজানা গন্তব্যে। বর্গা চাষী শামসু মিঞার দেহটি ছাড়লো তার আশিয়ান। আতিয়া খাতুন নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছেন স্বামীর খাটিয়ার যাওয়ার পানে। গতকাল মানুষটি ঘুমানোর আগেও তাকে ডাকলেন,
“কাওছারের মা কি ঘুমাছোনি?”
শামসু মিঞার ডাকে তন্দ্রাঘোর স্বরে আতিয়া বললেন,
“কিছু লাগবো?”
“না, কথা কমু। খুব কথা কইবার মন চাইছে”
বিরক্তি নিয়ে উঠলেন আতিয়া খাতুন। ময়লা শাড়ীর আঁচলখান কাঁধে তুললেন। বিরক্তি নিয়ে শুধালেন,
“এই রাত বিরাইতে কি কথা শুনি?”
“রাগ করো কেন কাওছারের মা, মইর্যা গেলে তো আর কতা কইতে পারুম না”
“ধুরো, সারাক্ষন মরনের কতা কন কেরে?”
আতিয়া খাতুনের রাগ বাড়লো। কথার ধারে তা প্রকাশ্য। হাসলেন শামসু মিঞা। হেসে বললেন,
“মরতে হো হইবোই কাওছারের মা। কিন্তু আফসোস গো। কি পাপ খান করছিলাম যে কাওছারের মতো পোলা হইছে আমার। এইডা সারাজীবন আমারে শুধু জ্বালাইছে। তুমিও ওর স্নেহতে অন্ধ্য হইয়্যা গেছো। কাওছারের লাইগ্যা রাশাদের লগে ঝগড়া করছো। শোনো কাওছারের মা, পোলাপাইন খারাপ হইলে তার থেইক্যা যন্ত্রণা আর নাই। তুমি কার পক্ষ নেছো কও, কাওছারের। তোমার মনে হয় আমি চোখ বন্ধ করলে ওয় তোমারে দেখবে? সেই জমি দিয়া জুয়া খেলবে। তোমারে আর রাশাদরে এক্কেরে পথে নামায় দিবে। তাই আমি কিছু ভাবছি। আমি জানি তুমি সেইডা অমান্য করবা না।“
“কি ভাবছেন?”
“এই বাড়িখান আমি রাশাদ আর তোমার নামে লিকখ্যা দিছি”
“আর কাওছার?”
“তুমি এহনো তারে নিয়া ভাববা?”
“ওরে কিছু দিবেন না আপনি?”
“নাহ, কারণ ও সেডার যোগ্য না”
শামসু মিঞার এমন এমন সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ আতিয়া খাতুন। নিজের ছেলের হয়ে ওকালতি করলেন। শামসু মিঞা বিরক্ত হলেন না। তিনি কেবল ই হাসছিলেন। স্ত্রীর সাথে তর্কতেও জড়ালেন না। একটা সময় শুধু এটুকু বললেন,
“আমি বাঁইচে থাকতে কিন্তু কাওছারের মুখ দেহুম না কাওছারের মা”
এ কথাটায়-ই ক্ষান্ত হয়ে গেলেন আতিয়া খাতুন। শামসু মিঞা বললেন,
“এতো অন্ধ্য হইয়ো না কাওছারের মা। যে মানুষ নিজের মেয়ের ঘরে লোক ঢুহায় হ্যা মারেও ছাড়বো না। তোমার কাছে এক্কান অনুরোধ আছিল। কালাম টেহা পায় কিছু, কাওছার ওই টেহা জন্মে দিতি পারবে না। জেলে পচলেও তো টেহা শোধ হইবো না। এর থেক্যা মা-বাপ হিসেবে আমরা আমগোদ দায়িত্বডা ঠিকঠাক পালন করি। পশ্চিমের আধ কানি জমি ছেলো মনে আছে? কাওছারের মা, জমিডা বেইচ্যা কালামরে টেহাডা ফেরত দেওনের ব্যাবস্থা কইরো। আমি দেনার ভার লইয়্যা মরতে চাই না। রাশাদ কোনদিন আমগোরে ফালাইবো না। ছেলেডা মানুষ হইছে এমনে। ওর উপর আর চাপ না বাড়াই। যে আইতাছে সে যাতে আমগোরে দোষী না করে”
আতিয়া খাতুন মৌন রইলেন। কোনো কথা বলার ইচ্ছে হলো না। শামসু মিঞা অনেক কথা বললেন রাতে। আক্ষেপগুলো এক এক করে জাহির করলেন। আতিয়া খাতুন একটা উত্তরও দেন নি। মিথ্যে বলবেন না, তার তখন উনার উপর রাগ হয়েছিলো খুব। কিন্তু সেই রাগ এখন বাস্পে উড়ে গেছে। মানুষটির লাশ আর দেখা যাচ্ছে না। আর চাইলেও তার সাথে কথা বলার উপায় নেই। ইশ! কেনো রাগটা করলেন। মানুষটা কথা বলতে চাইছিলেন। কেন শুনলেন না।
মধ্যাহ্ন ঢলে অপরাহ্নের তামাটে রোদ এসে পড়েছে ভিটার আঙ্গিনায়। আজ আর চুলা জ্বলে নি রাশাদদের বাড়ি। খাবার রাশেদা পাঠিয়েছে। কিন্তু প্রিয় মানুষটির বিদায় গলায় খাবার নামছে না। জোর করে একটু খাওয়া এই যা। লোকের সমারহ কমে গেছে। আছে শুধু মেয়ে বউ। অবাককর ব্যাপার হলেও সত্য জানাযাতে বিপুল মানুষের সমারহ ছিলো। কাওছারের শত্রু বা মিত্র সকলেই এসেছিলো মানুষটির জানাযায়। দেলওয়ার সাহেবের সাথেও ফাইজানের দেখা হলো। কুশলাদি বিনিময় হলো। তার মুখখানা বেজার বেশ। দুশ্চিন্তায় কপালে তীব্র ভাঁজ। কারণটা অজানা নয়। ফাইজান অভিনেতা ভালো। মিত্রর অভিনয় করলো নিপুন ভাবে। যতই হোক, মামামশাইকে বুঝতে দেওয়া যাবে না সর্ষের ভুত কে!
রাশাদের দোকান আজ বন্ধ। একা একা ঘরের চৌকাঠে বসে রয়েছে সে। মনটা মলিন। দাদাকে কবরে নামানোর পর থেকে খা খা টা বেশি বেড়েছে। হুমায়রা ইলহাকে বললো,
“তুমি বরং ভাইজানের কাছে থাকো। দাদীকে আমি দেখছি”
ইলহা তাই করলো। স্বামীর পাশে যেয়ে বসলো। স্বামীর মূর্ছানো নয়ন আঙ্গিনার দিকে চেয়ে আছে। যে অংশটিতে ছিলো শামসু মিঞার লাশটি সেই অংশটির দিকে। অশ্রুরা শুকিয়ে গেছে। হৃদয়ের ব্যাথাটা থেকে গেছে। আর একটা শুন্যতা। যে শুন্যতা ভরাট করার কেউ নেই। ইলহা তার হাতটা ধরলো। স্বম্বিৎ ফিরলো তার। ফ্যালফ্যালিয়ে তাকাতেই ইলহা শুধালো,
“খাবেন না? অসুস্থ হয়ে যাবেন তো?”
“খাওয়া নামবে না ইলহা। আপনি খেয়েছেন?”
“না, একা একা খেতে ভালো লাগছে না।“
“তা বললে হয়? আপনি কিন্তু একা নন।”
“সেটা কিন্তু আপনার উপরও প্রযোজ্য”
রাশাদ থমকালো। মৌন রইলো। ইলহা হাটুতে হাত রেখে থুতনি ঠেকালো। মৃদু স্বরে বললো,
“দাদার পর কিন্তু এই বাড়ির প্রতিটা প্রাণ আপনি নির্ভর। আমাদের সকলের ভরসার জায়গা বলুন বা অভিভাবক সেটা আপনি। এই দক্ষিণের পাঁচ ঘরের প্রমুখ কিন্তু আপনি। তাই আপনি শক্ত না থাকলে আমরা কিন্তু ঝড়ে যাবো। আমাদের ভিত্তি আপনি”
ইলহার কথাটা বুঝতে পারলো রাশাদ। কিন্তু শক্ত থাকবো বললেই কি থাকা যায়? ঘাড়টা নত হলো। ডুকরে কাঁদলো আবার। ইলহা তাকে আঁকড়ে ধরলো। তার শক্ত আলিঙ্গনে দূর্বল রাশাদের বিষাদসিন্দুগুলো জমলো। সূর্যের নরম আলো এসে ভিড়ছে শ্যাম মুখখানায়। ইলহা তার স্বামীকে সামলে নিলো সন্তর্পণে।
*****
ধীর পায়ে গাঢ় সন্ধ্যা নামলো ধরনীতে। আগরবাতিটা জ্বলতে জ্বলতে ক্ষয়ে গেছে। বিদ্যুৎ নেই। হারিকেন জ্বালানো হয়েছে। মানুষের সমারোহ এখন আর নেই। ঘরময় মাত্র পাঁচটা জীবন। আতিয়া খাতুনকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে। উনি ঘুমাচ্ছেন। ইলহা হাসপাতাল থেকে লিভ নিলো। এক সপ্তাহ যাবে না। হুমায়রা ঠিক করলো সেও থেকে যাবে। ইলহার এই সময়ে একটু সাহায্য হবে। সামনে টেস্ট পরীক্ষাও শুরু হবে। তাই পরীক্ষা অবধি এখানেই থাকবে সে। ফাইজানকে কথাটি বলতেই সে আপত্তি করলো না। বরং নরম স্বরে বললো,
“থেকে যাও”
“আম্মাকে জানাই নি এখনো”
“আমি জানিয়ে দিয়েছি। আমি এমনিতেও ঢাকা যাচ্ছি। এ সময়টা তোমার এখানে থাকা প্রয়োজন”
“কবে যাচ্ছেন?”
“কাল সকালে”
“জানালেন না যে”
“জানানোর সময় পাই নি। জানোই তো মাত্র ইলেকশন হয়েছে। অনেক কাজ থাকে। আর ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। আমান তোমার সামনে আসবে না”
ফাইজানের কথাটার মর্মার্থ বুঝলো না হুমায়রা। ফাইজান মাথায় বুলালো আলতো করে। গাঢ় স্বরে বললো,
“আমি আজ আবার মুগ্ধ হলাম হুমায়রা। মানুষ তোমাকে সুন্দরী তকমা দিয়েই ক্ষান্ত হয়, কিন্তু তোমার এই সুন্দর মুখখানার পেছনে যে কতটা দায়িত্ববান নারী লুকায়িত তা কেউ দেখে না”
বলেই কপালে চুমু আঁকলো ফাইজান। তার ঠোঁটে অকৃত্রিম হাসি। তার চোখের দিকে স্থির হুমায়রার নয়ন। মানুষটির চোখে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতেও যেনো শান্তি। নিস্তব্ধতা বিস্তৃত হলো ঘরে। কেউ কোনো কথা বললো না, মৌনতায় আলাপন হলো দুজনার।
*****
গভীর রাত। দূর থেকে ক্ষণে ক্ষনে শেয়ালের কান্নার সুর ভেসে আসছে। সম্পূর্ণ বাড়ি ঘুমে। আকাশে আজ চাঁদ নেই। হারিকেনটা নিয়ে বের হলো হুমায়রা। কলপাড়ের দিকটায় ঝিঝিপোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। মরাবাড়িতে নীরবতাগুলো গা ছমছমে থাকে। হুমায়রাও সেটা অনুভব করতে পারলো। আয়াতুল কুরসী পড়ে পা বাড়ালো বাথরুমের দিকে। তখনই অনুভূত হলো লাউগাছটার পাশে কে যেন উঁকিঝুকি দিচ্ছে। আবছা আধারে তার মুখখানা দেখা যাচ্ছে না। কালো একখানা বোরখা পড়া সে। একটি কালো ওড়না পড়া। হুমায়রা চোখ ছোট ছোট করে দেখলো তাকে। আধার হলেও চিনতে অসুবিধা হলো না। কারণ সকালে মানুষের সমারোহতে তার দৃষ্টি এড়ায় নি। এগিয়ে গেলো সে। মানুষটির হাত ধরে তাকে আঙ্গিনার মধ্যিখানে নিয়ে আসলো সে। কড়া স্বরে শুধালো,
“এখানে কি করছেন আপনি?”
হুমায়রার এমন আকস্মিক কাজে যুবাইদা ঘাবড়ে গেলো। তার চোখে মুখে ভয়ের ছায়া পরিলক্ষিত হলো। সে বুঝতে পারে নি হুমায়রা তাকে ধরে ফেললো। হুমায়রা প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই বললো,
“আস্তে কথা বল, রাশাদ জানতি পারলে খুব রাগ করবে?”
“সে নিয়ে তো আপনার মাথা ব্যাথা থাকার কথা নয়। আমার প্রশ্ন আপনি এখানে এসেছেন কেন?”
“আব্বার মরার খবর শুনে কিভাবে বইয়্যা থাকুম ক। মনের এক্কান টান তো থাকেই। মানুষডারে শেষবার দেখার জন্য আইছিলাম। চইল্যাই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম একবার আম্মারে দেইখ্যা যাই”
যুবাইদা জড়তাহীন স্বরে কথাগুলো বললো। অপরাধবোধ তার কন্ঠে ছলকালো। কিন্তু তার উত্তরকে তোয়াক্কা না করেই প্রশ্ন ছুড়লো হুমায়রা,
“আপনি জানলেন কি করে, দাদা মারা গেছে?”
চলবে
[আগামীকাল প্রথম রোজা, গল্প না দেবার সম্ভাবনা বেশি। আমি নিজের সময়টা বুঝে গল্প দিবো]
মুশফিকা রহমান মৈথি