প্রিয়_প্রাণ #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ১৬

0
604

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৬

জ্বর ছেড়ে ছিলো তোঁষা’র গতরাতে। সেই যে সন্ধ্যা রাতে জ্বর উঠলো কমার নাম গন্ধ নেই। সারাটা রাত আরহাম জেগেই ছিলো। ঘুমাবে কিভাবে তার তুঁষ’টা যে জ্বরে হুশহীন। শেষ রাতে তোঁষা’র জ্বর ছাড়তেই ঘেমে-নেয়ে উঠে তোঁষা। আরহাম যেন সস্তি’র শ্বাস ফেলে। মেডিসিনগুলো কাজ করতে বেশ সময় নিয়েছে। আরহাম তোঁষা’র মুখপানে তাকালো। সবেই সূর্য উঠা শুরু করেছে হয় তো পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, না সূর্য এখন উঠবে না। ফজরের আজান হলো সবে। আরহাম তোঁষা’র ঘামে ভেজা শরীরটা নিজের বুক থেকে সরিয়ে পাশে বালিশটাতে রাখলো অতি যত্নে। তুঁষ’টা অসুস্থ হলেই কেমন করে জানি কাঁদে। আরহামে’র বুকে কম্পন ধরে সেই কান্না শুনে। সহ্য হয় না। অসুস্থ এক কান্না। ঘুমের মাঝেই কাঁদে। তোঁষা কি জানে সেই কান্না কারো হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করতে সক্ষম?

ধীর পায়ে বিছানা ছাড়ে আরহাম। বুকের দিক ভেজা তার৷ টিশার্ট টা একটানে খুলে তা দুই হাতের মাঝে ভাজ করে ওয়াশরুমে’র ঝুড়ি’তে রাখলো। নতুন একটা টিশার্ট গায়ে গলিয়ে দিয়ে উত্তম রুপে ওযু করে নিলো।
একপলক তোঁষা’কে দেখে নিতেও ভুল হলো না তার।
.
টুংটাং শব্দ করে আরহাম রান্নাঘরে কাজ করছে। ওর তুঁষরাণী’র আবদার অথবা হুকুম যেটাই হোক তা হলো সে সকাল সকাল ঝাল খাবে অথচ আরহাম জানে এই তু্ঁষ ঝাল খেলেই কুপোতকাত হয়ে যায়। আরহাম যথেষ্ট মাথা খাটিয়ে রান্না বসিয়েছে। তোঁষা খেতে চেয়েছে খিচুড়ি, আরহাম বানাচ্ছে ওটস খিচুড়ি। এটা হেলদি ফুড। তোঁষা’র খাবারের দিকটা উলোট পালোট হলেই যত সমস্যা দেখা যায়। রান্নার মাঝে আরহাম একবার ডাকলো,

— তুঁষ?

— কিইইই।

আরহাম থতমত খেলো। এত উচ্চ গলায় কেন উত্তর এলো। পা বাড়াতে নিলেই পানির শব্দ এলো। তোঁষা কি গোসল করছে তাহলে? এই সকালে? গ্যাসটা কমিয়ে আরহাম দ্রুত রুমে ঢুকলো। যা ভেবেছিলো তাই। তোঁষা ওয়াশরুমে। আরহাম ঠক ঠক শব্দ করে দরজায়,

— তুঁষ? তুঁষ?

— কি?

— কি মানে কি? কি করছিস তুই?

— গোসল করছি তো।

— এই দরজা খোল তুই। তুঁষ দরজা খোল। বেরিয়ে আয়।

— এমন করো কেন?

“তুমি” ডাক? আরহাম জানে এই আদুরে কথায় আরহাম’কে গলাতেই এই মেয়ে “তুমি” শব্দটা ব্যবহার করছে। একটু দমে গিয়ে আরহাম পুণরায় বললো,

— এক মিনিটে বের হ তুঁষ নাহয় দরজা খুল।

অগত্যা এক মিনিটেই তোঁষা দরজা খুললো। কালো একটা টাওয়াল পেঁচিয়ে ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে তোঁষা। ফর্সা নাদুসনুদুস তোঁষা’র পরণে কালো এই টাওয়াল বড়ই আকর্ষণীয় দেখালো। আরহাম নজর ভরে দেখেও নিলো। দেখতে মানা নেই। কেন থাকবে? তুঁষ’টা কার? তারই তো।
আরহামে’র মুখের সামনে ঠান্ডা এক হাঁচি দিয়ে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে তোঁষা। আরহাম ফিরে তাকালো। তোঁষা’টা তার একদম ভিন্ন। এই যে এমন এক ভেজা মুহুর্তে যে কোন মেয়ে লজ্জা পাবে, নিজেকে লুকাতে চাইবে, লালিমা’র দেখা মিলবে ফর্সা গালে সেখানে তুঁষ তার ভিন্ন। গাল তারও লাল তবে ঠান্ডা’র জন্য। তোঁষা মাথার টাওয়াল খুলে চুল মুছতে মুছতে অভিযোগ জানায়,

— এত ডাকছিলেন কেন? গোসল করছিলাম না?

— এই সকাল সকাল কে বলেছে গোসল করতে তোকে? বলেছি আমি? বল বলেছি?

— ঘেমে ছিলাম তো।

— থাকতি। আমি মুছিয়ে দিতাম না গরম পানি দিয়ে? এখন হাঁচি আসছে কার…..

দ্বিতীয় দফায় আরহামে’র মুখে হাঁচি পরলো। তোঁষা নাক টেনে বললো,

— ঠিকমতো গোসল হলো না।

তোঁষা’র হাতে থাকা টাওয়ালে মুখ মুছলো আরহাম। ভালোভাবে তোঁষা’র চুলমুছে দিতে দিতে বললো,

— এমন আর করবি না ঠিক আছে?

— হু।

— তোর জন্য খিচুড়ি করেছি প্রাণ। বস এখানে ইনসুলিন নিয়ে আসি।

আরহাম যেতেই তোঁষা নিজের চুলগুলো একপাশে কাঁধে রাখলো। এতো গোঁছা আর বড় চুল সামলানোটা বড্ড কঠিন।

আলমারি খুলে তোঁষা নিজের পোশাক বের করছে তখনই কানে এলো আরহামে’র কণ্ঠে,

— তুঁষ!!

চমকে উঠে তোঁষা’র ছোট্ট শরীরটা। আরহাম দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে তোঁষা’কে ঘুরিয়ে দিলো। অসংখ্য কালো কালো ছোপ দাগ পিঠে। কালসিটে দাগগুলো দেখেই বুঝা যাচ্ছে কিছুটা মাস খানিক পুরাতন কিছুটা বা কয়েক সপ্তাহ আগের। লম্বা লম্বা কালো দাগগুলো স্কেল অথবা বেত দিয়ে মে’রেছে। আরহাম ভেজা চোখে তাকিয়ে রইলো। তোঁষা’র ধবধবে ফর্সা পিঠে এরূপ দাগ বড্ড বেমানান। একদমই মানা যায় না। আরহাম নিজের হাত বাড়ালো। ধীর হাতে ছুঁয়ে দিলো তার তুঁষে’র আঘাতপ্রাপ্ত নরম পিঠ’টা। তোঁষা’র শরীর শিউরে উঠে তাতে। তোঁষা’র নাকের পাটা ফুলে উঠলো ততক্ষণে। ঘুরে দাঁড়িয়ে আরহামে’র হাতটা ধরতেই হঠাৎ যেন হুসে এলো। তোঁষা’কে ঘুরিয়ে ওর পিঠের দিকে অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলো,

— তুঁষ?? এই তুঁষ, তোর পিঠে… প্রাণ আমার, তোর পিঠে কি…. এই তোকে মে’রেছে না? আমাকে কেন বলিস নি?

দুই হাতে অস্থির আরহাম’কে জড়িয়ে ধরে তোঁষা। ওকে শান্ত করতে বলে,

— কিচ্ছু হয় নি। সত্যি বলছি।

— অনেক ব্যাথা পেয়েছিস প্রাণ? তোকে এত কষ্ট দিলো? আমার জন্য?

— কষ্ট নেই এখন। আপনি এমন করছেন কেন?

আরহাম’কে আজ প্রথম এমন দশায় দেখলো তোঁষা। কেমন অস্থির হয়ে দম আটকে আটকে শ্বাস ফেলছে। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। রাগ নাকি অসহায়ত্ব? বুঝে এলো না তোঁষা’র। শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো তোঁষা। আরহাম শান্ত হতে চাইলো। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তেমন একটা সুবিধা করতে পারলো না ও কিন্তু তোঁষা’র কাছে অস্বাভাবিক হওয়া যাবে না। কিছুতেই না। খুব সুক্ষ্ম ভাবে নিজেকে সামাল দিলো আরহাম। তোঁষা’কে নিজেও জড়িয়ে ধরতেই তোঁষা জিজ্ঞেস করলো মৃদু শব্দে,

— ঠিক আছেন?

— হু।

তোঁষা অতঃপর আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। আরহাম নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলো,

— কে মে’রেছে?

…………

তোঁষা’র জাবাব এলো না। আরহাম নিজেই বললো,

— চাচি?

উত্তরে তোঁষা হাতের বন্ধনী দৃঢ় করলো। আরহাম ওর মাথায় চুমু খেয়ে আস্তে করে নিজের থেকে ছাড়ালো। তোঁষা’র পিঠ এখন আরহামে’র সম্মুখে। একদম সামনে। আরহামে’র চোখ টাইটুম্বুর অথচ লাল। খুব ধীরে সে মুখ নামিয়ে চুমু খেলো কালসিটে দাগে। তোঁষা’র এখন মনে হচ্ছে তার ব্যাথা নেই আর। সবটা তো উসুল সেই কবেই হলো যবে সে আরহাম ভাই’কে পেলো। আরহাম পুণরায় চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— এখনও ব্যাথা প্রাণ?

— উহু।

_________________

তুষা’র আজ যাচ্ছে রাজশাহী। তাদের কোন একটা মিটিং আছে সেখানে। কিছু সৈন্য পাঠানো হচ্ছে আফ্রিকায়। সেটার জন্যই মূলত এই মিটিং। চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী পথটা কম না৷ এই মিটিং এ সব সিনিয়র অফিসার’রা ই যাচ্ছে। কোন জুনিয়র নেই।
তথ্য এদিক ওদিক তাকালো একবার। মাত্রই দেখলো অফিসার রিদ নিজের রুমে ঢুকেছে। নিজের কথা মনে গুছিয়ে তথ্য দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে শুনা গেলো,

— কাম ইন।

তথ্য ঢুকেই সজোরে বা পা মাটিতে আঘাত করে সটান দেহে স্যালুট করলো। রিদ সালামের জবাব নিয়ে বললো,

— ইজ এনি থিং রং মিস.তথ্য?

— নো স্যার।

— দ্যান?

তথ্য কিছু বলার আগেই অফিসার রিদ পুণরায় বললো,

— বসুন আগে।

তথ্য বসতেই অফিসার রিদ বললো,

— এবার বলুন।

— স্যার আই থিং….

তথ্য’কে সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই রিদ বললো,

— ইউ থিংক?

— স্যার আসলে…

— ক্যাম্পে যেতে চাইছেন রাজশাহী।

তথ্য চোরা হাসলো। রিদ এবার শব্দ করে হেসে বললো,

— কারণ?

তথ্য’কে এবারও উত্তর দিতে দিলো না রিদ। নিজেই বললো,

— কারণ যেটাই বলেন না কেন মেইন রিজন তো অফিসার তুষার শেখ।

তথ্য এবার লাজুক হাসলো যা অদ্ভুত দেখায়। অদ্ভুত সুন্দর। আর্মির গেটাপে থাকা মেয়েদের ফর্মাল ড্রেসে মুখে লাজুক হাসি বড়ই অদ্ভুত। এই সৌন্দর্য বর্ননা করা মুশকিল।

তথ্য বেরিয়ে এক দৌড়ে চলে গেল তুষা’রের কটেজে। এখন বানিয়ে ছানিয়ে কাহিনি করবে ও একটা। এই কাহিনী করে করেই তো তুষারের পিছু নেয় বারংবার।

________________

তোঁষা আজ পাংশুটে মুখে বসে আছে বারান্দায়। সামনে ওর পরিক্ষা। বই-খাতা নেই কিছুই। ভাবলো আজ আরহাম এলেই তাকে বলবে বই খাতা এনে দিতে নাহলে পরিক্ষায় লাড্ডা শিওর। আরো কিছু লাগবে তোঁষা’র। ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে। বাবা’কে দেখতে হবে। মায়ের সাথে তোঁষা’র রাগ তবে মায়ের কথা ওর মনে পরে। চাচি’র কথা মনে পরছে। চাচি না থাকলে তোঁষা শেষ মুহুর্তে হয়তো ম’রে যেতো।
ওর ভাবনার মাঝেই আরহামে’র আগমন হলো। তোঁষা’র মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বারান্দা থেকে দৌড়ে দরজা অবদি গিয়েই আরহাম’কে জড়িয়ে ধরে তোঁষা ওমনিই ওকে পাঁজা কোলে তুলে আরহাম। তোঁষা হাসি মুখে গলা জড়িয়ে ধরে কিছু আবদার করে যাচ্ছে। আরহাম আদৌ শুনছে কি না জানা নেই। তবে সে এক ধ্যানে তোঁষা’কে দেখে যাচ্ছে। বিছানায় তোষা’কে রাখতেই তোঁষা উঠে বসতে চাইলো তবে বাঁধা দিলো আরহাম। তোঁষা’কে বিছানায় রেখেই সাইড টেবিলে কিছু খুটুর খুটুর করে যাচ্ছে ও। এদিকে তোঁষাও প্রশ্নের ঝুড়ি খুললো,

— কি করছেন আরহাম ভাই?

— তেমন কিছু না প্রাণ।

— ভাইয়ার সাথে কথা বলব আজ।

–একটু কাজ আছে প্রাণ। অপেক্ষা কর।

তোঁষা দেখলো আরহামে’র হাতে একটা সিরিঞ্জ ভর্তি। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আরহাম ওকে উল্টো করে শুয়ে দিলো। তোঁষা ইনজেকশন ভয় পায় না তবে বড্ড কৌতুহলী সে। তাই জিজ্ঞেস করলো,

— এটা কিসের?

আরহাম উত্তর না দিয়ে বললো,

— ব্যাথা দিব না প্রাণ। দেখি দিতে দে।

বলেই তোঁষা’র পরণে থাকা পোশাক তুললো আরহাম। দৃশ্যমান হলো কোমড়ের দিক। ঠিক মেরুদণ্ড বরাবর পুশ করে আরহাম। মিনিট খানিক কি গেলো? না মিনিট গেলো না তবে গগন বিদারি চিৎকার করে উঠলো তোঁষা। ছটফট করতে করতে বলতে লাগলো,

— ক..কি দিচ্ছো? কি দিচ্ছো? ব্যাথা পাচ্ছি। জ্ব…জ্বলছে আমার। ছাড়ো। ছাড়ো আমাকে৷ আরহাম ভাই অনেক জ্বলছে।

আরহাম ছাড়লো না। পুরোটা পুশ করে তোঁষা’কে ঝাপ্টে ধরে ও। তোঁষা’র অবস্থা তখন খারাপ। ও ছটফট করে কেঁদে যাচ্ছে,

— আম্মু…. আম্মু….জ্বলছে আমার। আব্বু। ছাড়ো আমাকে। ছাড়ো। জ্বলছে।

— ব্যাথা নেই। ব্যাথা নেই প্রাণ। তোকে যে ব্যাথা দিয়েছে তার থেকে তোকে মুক্তি দিব আমি প্রাণ। একটু ধৈর্য ধর।

কাঁপা কাঁপা গলায় বলে গেলো আরহাম। বহু কষ্টে তোঁষা’কে চেপে রেখেছে সে। হাই ডোজটা সহ্য করতে পারলো না তোঁষা’র দেহ। একসময় কয়েকটা ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেলো ওর ছটফট করা দেহটা।

আরহাম নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তোঁষা’র জ্ঞানহীন দেহটাকে। মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অসহায় গলায় বললো,

— তোর সব ব্যাথা আমি মুছে দিব প্রাণ৷ একটা বার তুই আমার হ, পুরো দুনিয়া আমি পর করে দিব।

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here