#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৯
রোদ্দুরে ঝকমক করছে ধরণী। আমানিশা কেটেছে কিছুক্ষণ আগে। বেভুর ঘুমে থাকা তোঁষা আরহামের টিশার্টের বুকের দিকে খাঁমচে ধরে আছে। আরহামে’র একটা হাত তোঁষা’র মাথায়। বা হাতটা সাইডে ফেলে কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে সে। আস্তে ধীরে ঘুম ভাঙে তোঁষা’র। এদিক ওদিক মুচড়ে চোখ খুলে ধীরেসুস্থে। সম্মুখে নজর তাক করতেই দিদার মিলে আরহামে’র। ঘুমের রেশ লাগা মুখটায় দেখা মিলে হাসির। যতটুকু দূরত্ব আছে তোঁষা ঘুচিয়ে দেয় তা। একদম আরহাম’কে ছুঁই ছুঁই করে এগিয়ে আনে নিজের শরীর’টাকে। কাত হয়ে দেখতে থাকে আরহামে’র সুশ্রী সুদর্শন চেহারাটা’কে। সুন্দর আরহাম ভাই তোঁষা’র। ঠিক যেন ঘোর আমাবস্যা’র রাতে পূর্ণিমার চাঁদ। তোঁষা দুই আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো আরহামে’র গালটা। খোঁচা খোঁচা লাগলো আঙুলে। তোঁষা ভাবলো আরহাম’কে বলবে যাতে একটু দাড়ি রাখে। চাপ দাঁড়িতে নিশ্চিত তাকে আরো মানানসই লাগবে।
আরহামে’র চোখের মনি নড়ছে কিছুটা। ঠাহর করতে পেরে তোঁষা চোখ বুজে নিলো কিন্তু চোখ মেললো আরহাম। তোঁষা’কে নিজের এতটা কাছাকাছি দেখে মুহুর্তে চমকালেও সামলে নিলো নিজেকে। ওর দুষ্ট প্রাণ যে সজাগ তা ও জানে আরহাম। না জেনে উপায় আছে? এই যে দুষ্ট পাখিটা ঘুমের ভান ধরেছে বলে এমন শক্ত হয়ে সোজা শুয়ে আছে অথচ তার ঘুম হলো এলোমেলো। শরীর ছেড়ে ঘুমায়। আরহাম নিজেও দুষ্ট কম না। ঠিক তোঁষা’র মতোই তোঁষা’র গালে দুই আঙুল বুলিয়ে দিলো। প্রচন্ড স্পর্শকাতর মেয়ে তোঁষা। আরহাম যখনই ওর গাল থেকে থুঁতনিতে আঙুল চালালো ওমনিই শরীর মুচড়ে মুখে “উমম” উচ্চারণ করলো।
অল্প হেসে আরহাম তোঁষা’র হাত টেনে নিজের কাছে আনতেই তোঁষা তাকালো। তাকালো আরহাম নিজেও। দু’জনের গভীর দৃষ্টি দু’জনে চোখে। তোঁষা সম্মোহীন হয়ে দেখে যাচ্ছে আরহাম’কে আর আরহামের দৃষ্টিতে উত্তাপ।
মনোবিজ্ঞানী’রা বলেন, “একজন প্রাপ্তবয়স্ক নর ও নারী পরস্পরের চোখের দিকে টানা এক মিনিট তাকিয়ে থাকলে হয় তারা পরস্পর’কে খু*ন করতে চাইবে অথবা পরস্পরের সানিধ্য চাইবে”।
তোঁষা’র ক্ষেত্রে বোধহয় সেটাই হলো। হঠাৎ করে আরহামে’র মুখোমুখি মুখ আনতেই আরহাম আটকে দিলো। তোঁষা মানলো না। আরহামে’র বাঁধা উপক্রম করতে নিলেই শক্ত হাতে আরহাম জড়িয়ে ধরে তাকে। জোরে জোরে শ্বাস টানে আরহাম। নিজেকে কি সে সামলাতে পারছে বা পারে? মোটেও পারে না। এই যে গত তিন চারটা দিন ধরে তুঁষটা’কে নিয়ে নিস্তব্ধতায় ঘেরা এই ফ্ল্যাটে থাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ হিসেবে আরহাম কি দাঁত কামড়ে পরে রইছে না? সে কি নিয়ন্ত্রণ করছে না? হুটহাট তোঁষা’র আলিঙ্গনে বেসামাল কি আরহাম হয় নি? হেয়েছে। একবার না বারবার আরহাম বেকায়দায় পড়েছে অতঃপর নিজেকে সামলেছে।
তোঁষা’র এই ভালোবাসা টাইটুম্বুর থাকে আবেগে। আরহাম চাইছে তোঁষা আগে নিজেকে সামলে উঠুক। এমন ভাবে আচানক কিছু না ঘটুক যাতে তোঁষা’র স্ব্যাস্থে তার প্রভাব পড়ে। এমনিতেই তোঁষা’র শরীর ততটা ভালো থাকে না। অনেকটা সমস্যা নিয়েই সে ভূমিষ্ট হয়েছিলো ধরণীতে।
আরহামের ভাবনার মাঝেই তোঁষা নড়াচড়া শুরু করলো। প্রচন্ড জেদী এই তুঁষ। আরহাম ছাড়া কাউকে মানতে ও চায় না। শক্তপোক্ত আরহামে’র সাথে পেরে উঠবে না জেনেও শক্তি ক্ষয় করে যাচ্ছে। আরহাম শক্ত করে তোঁষা’কে বুকে পিষলো। তোঁষা বুঝি এতটাই বুঝার মেয়ে? ছটফট করে ছুটতে চাইছে সে। নীরব যুদ্ধ চলছে এই ভোর সকালে। এসময় আরহাম “উফ” শব্দ করতেই তোঁষা শান্ত হলো। এ কি যেই সেই শান্ত? একদম ঠান্ডা পানি যাকে বলে। যেন ঘাসের উপর লেপ্টে থাকা তুঁষা’র।
আরহাম গালে হাত ডলতে ডলতে বললো,
— দেখ তো প্রাণ র*ক্ত বের হলো নাকি?
তোঁষা দেখা তো দূর নড়লোই না। আরহাম হেসে ফেললো। কাত হয়ে তোঁষা’র নাক টেনে দিয়ে বললো,
— বুঁচি’র আবার লজ্জা লাগে?
— হু।
— তাহলে কামড় দিলি কেন?
………….
— কি? এখন চুপ কেন? কথা বল।
— তোমার দোষ। কথা বলবে না।
আরহাম অল্প বিস্তৃত ভ্রু কুঁচকে হাসছে। প্রচন্ড আদুরে ভাবে আছে তার তুঁষ। এই “তুমি” ডাকটা বছরে এক দুই বার শুনা যায় তার মুখে। আরহাম মুখ এগিয়ে এনে চুমু খেল তোঁষা’র মাথায়। নিজে উঠতে উঠতে বললো,
— আরেকটু ঘুমা।
___________________
আরহামে’র সাথে তোঁষা’র বিয়ে কেউই দিবে না। তোঁষা’র হাজার পাগলামি কাজে লাগে না। একা ছোট্ট তোঁষা কত লড়বে? কত মা’র খাবে? কতই বা মায়ের বকা, বাবা’র সেই অসন্তুষ্ট দৃষ্টি দেখবে? আরহামে’র সাথে তোঁষা যে লুকিয়ে কথা বলতো তা ধরা খেয়েছিলো আদনানে’র কাছে। পরিক্ষা’র জন্য রাতে পড়ার জন্য জেগে থেকে তুঁষা’রের ফোনটা লুকিয়ে এনে কথা বলে তোঁষা যা আদনান দেখে ফেলে কোনভাবে। তখন তোঁষা’কে কিছু না বলে তোঁষা’র জন্য আনা দুধ’টা নিয়ে ফেরত চলে যায় ও। আদনান সারাটা রাত জেগে ছিলো তোঁষা সজাগ বলে। তুঁষ’টা পড়ছে আদনান কিভাবে ঘুমাবে? সারাদিন কাজ শেষে রাত জাগাটা মোটেও সহজ কিছু না। তবুও আদনান জেগে থাকে তোঁষা’র জন্য। মনের ভেতরে লুকায়িত ভালোবাসা সে কোনদিন প্রকাশ করে নি। করার সুযোগটাও হলো না। সেদিন ই ছিলো তোঁষা আরহামে’র শেষ কথা। এরপর থেকে আর কারো ফোন লুকায় নি তোঁষা। সুযোগ ও হয় নি। মা তাকে সকালে ঘুম থেকে তুলে রাবারের স্কেল দিয়ে পিটিয়েছে। সারারাত জেগে থাকা তোঁষা হঠাৎ হামলায় ঘুমের মধ্যেই চিৎকার করে কেঁদে উঠে। ওর ভয়ানক এই আর্তনাদে ছুটে আসে বাড়ী’র সকলে কিন্তু দরজা লক থাকায় কেউ ঢুকতে পারে না। তোঁষা’র একেকটা আত্মচিৎকারে ভারী হয়ে আসে শেখবাড়ী।
— আম্মু….আম্মু মে’রো না। মে’রো না আম্মু। আম্মু ব্যাথা পাই। আব্বু? আব্বু? ভাইয়া! ভাইয়া ব্যাথা পাচ্ছি।
অপরপাশে পাগল হয়ে যায় তুঁষা’র। শক্ত হাতের থাবা বাসায় দরজায়। শক্ত দেহটা কাঁপছে তখন রাগে। বোনের চিৎকারে। বাঁচাতে না পারার অক্ষমতায়। দরজা যেন ভাঙার উপক্রম তুঁষা’রের,
— মা মা দরজা খুলো। পুতুল’কে ছাড়ো মা। ভালো হবে না মা! ছাড়ো পুতুল’কে। দাও ওকে। মা!!
ওর মা কথা শুনে না। তোঁষা তখনও চিৎকার করে কাঁদছে।
আদনান গিয়েছিলো মর্নিং ওয়াকে। সারারাত ঘুম হয় নি তাই সকালে ও আর ঘুমায় নি সে। বাসায় ফিরে তোঁষা’র চিৎকার শুনে দৌড়ে আসতেই পরিস্থিতি বুঝে যায় ও। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে তুঁষা’রকে বলে,
— ভাই ধাক্কা দাও।
এদিকে তুরাগ আর তুহিন ও থেমে নেই। তোঁষা’কে হাজার রাগ দেখালেও তোঁষা’র ঐ দিনের কান্নায় পাষাণ হৃদয় ও বুঝি কাঁদতো। ছোট্ট একটা প্রাণ, ভালোবাসার দায়ে কতটাই না আঘাত পেলো।
তুঁষা’রের মতো আর্মি ম্যান ও যেন হঠাৎ থমকে যায়। তোঁষা’র কান্না বন্ধ তখন। তুহিন দুই পা পিছিয়ে যান। নাজুক তার কলিজার টুকরো’টার কিছু হলো কি? তুরাগ তাড়া দিলেন দরজা ভাঙতে। ততক্ষণে বিলাপ জুড়েছেন তার স্ত্রী।
তুঁষা’র শেষ বারের মতো সজোরে ধাক্কা দেয়ার আগেই খট করে দরজাটা খুলে গেলো। ওর দাদা এই দরজাগুলো জার্মান থেকে আনিয়েছিলেন। প্রচুর মজবুদ ধাঁচের। তুঁষা’র দেখলো ক্লান্ত মা’কে। মধ্যবয়স্ক সুশ্রী নারীটি ক্লান্ত। তুঁষা’রের পুতুল মে’রে ক্লান্ত, ভাঙা শরীর নিয়ে হেলেদুলে বেরিয়ে যান তিনি। তুঁষা’র ঠাই দাঁড়িয়ে রয়। আদনান ততক্ষণে চিৎকার করে ডাকে,
— তুঁষ!
র*ক্তাক্ত জ্ঞান হারা তোঁষা তখন ফ্লোরে পড়া। পরণে থাকা টিশা’র গলার দিকে র*ক্ত। কোথায় কাটলো? কোথায় ফাটলো? তুঁষা’রের মতো আর্মি বুঝে না সেটা। বিচক্ষণতা’র যেন মুহুর্তে ই বিলুপ্তি ঘটলো। তুঁষা’র দৌড়ে এসে তোঁষা’কে ধরে। তুহিন এগিয়ে এলো না। বৃদ্ধ শরীর তার শক্তি পায় না। তুরাগ তাড়া দিলেন হাসপাতালে নিতে। ওর চাচি তোঁষা’র মুখে পানি দিচ্ছে। তুঁষা’র এগিয়ে এসে বোনকে আগলে নিলো। কে বলে পুরুষ বাবা স্বাদ পায় নিজের অস্তিত্বের আসছে এই খবর পাওয়ার পর? তুঁষা’র তো এই পুতুল’টাকে দেখেই পিতৃ স্বাদ পায়। যেন তুঁষা’রের অবিচ্ছেদ্য দেহটা। একই র*ক্তের টান আছে না।
আদনান হতভম্ব হয়ে যায়। চাচি এমন কাজ করবে ও ভাবেনি।
তোঁষা’র দেহটা যেন ভারী লাগে তুঁষা’রের নিকট। বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে ফোন হাতে কল লাগায় পরিচিত ডক্টর’কে। হাসপাতালে নিলে যখন পুলিশ আসবে তখন কাকে দোষারোপ করবে আর্মি ম্যান? মা’কে নাকি ভাগ্য’কে?
তোঁষা’র সেদিনের কম্পমান র*ক্তাক্ত দেহটা ভেসে উঠে চোখের পর্দায়। তিনটা ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরতেই কাকে ডাকলো তোঁষা? ক্লান্ত তার মুখটা শুধু অভিযোগ জানালো,
— ভাইয়া, আব্বু, আম্মু মে’রেছে। আরহাম ভাই আসুক। বলে দিব সব।
ফট করে চোখ খুলে তুহিন। দরদর করে ঘামছে সে। এই তো মাস কয়েক আগের ঘটনাটা আজও স্বপ্নে দেখলো সে। তোঁষাটা কি বেঁচে আছে?
নিজের প্রশ্নে অবাক তুহিন। পাশেই প্রায় অচেতনের মতো ঘুমাচ্ছে তার স্ত্রী। কুঁচকানো চামড়ার হাতটা বাড়িয়ে স্ত্রী’র কাপালে রাখেন তুহিন। জ্বরটা কেন যে থামছেই না।
#চলবে….
[গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক তাই সেভাবেই ভাবুন।]