#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৮
আকাশে চলছে মেঘের গর্জন। বিদ্যুৎ চমকানিতে বিরতি নেই। অদূরে বিদ্যুতের খুঁটির ওপর বাজ পড়তেই আলো শূন্য হলো ঘর। চৌকির ওপর অপূর্বর রানি ও রাজকন্যা শুয়ে আছে। অপূর্ব টিউবওয়েল চেপে গোসল করেছে। পরিধান করেছে ইরফানের ব্যবহৃত লুঙ্গি ও ফতুয়া। কলতলাল ভেতরে থাকাকালীন বিদ্যুৎ যাওয়াতে অপূর্ব দরজা খুঁজে পেল না। টিনের ওপর ধাক্কা দিয়ে ডাকে ইরফানকে, “ইরফান, আলো নিয়ে এদিকে আসো। আলোতেই আমি খুঁজে ঘরে যেতে পারব না, এখন তো অন্ধকার।”
কলতলা থেকে ঘরের দ্রুত অনেকটা। কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যবধানে ইরফান কুপি ও ছাতা মাথা নিয়ে এলো কলতলায়। দরজার উপরে খানিক ফোকট ছিল বিধায়, আগমনের সাথে সাথে হলদে আলো পৌঁছে গেল ভেতরে। টিনের দরজায় ধাক্কা দিয়ে ইরফান বলল, “তাড়াতাড়ি বের হন স্যার, ঘরে দুইটা কুপি। একটা ভাবির কাছে রেখে অন্যটা নিয়ে এসেছি। আমার স্ত্রী অন্ধকারে রুটি বানাচ্ছে।”
লহমায় দরজা খুলে বের হলো অপূর্ব। এক হাতে ভেজা জামাকাপড়, অন্য হাতে সাবানের বক্স নিয়ে পা ফেলতেই ইরফান দ্রুতি কণ্ঠে বলল, “স্যার, এগুলো আপনি আমাকে দিন। আমি দড়িতে মেলে দিব। আপনি ছাতা আর কুপি ধরুন।”
হাত অদলবদল করে পালটে নিল জিনিসপত্র। অতঃপর এগিয়ে গেল ঘরের ভেতরে। অপূর্বকে ঘরে ভেতরে দিয়ে ইরফান চলে গেল রসুইঘরে। অপূর্ব গামছায় নিজের মাথা মুছে চৌকির সাথে মেলে দিয়ে আরুর পাশে বসল। পাখির ঘুমন্ত মুখের পানে চেয়ে বলল, “কখন ঘুমিয়েছে?”
“মাত্রই ঘুমিয়েছে।”
“মশা কামরাচ্ছে?”
“হাতপাখা দিয়ে গেছে। হাওয়া করছি। বৃষ্টির সময় সব মশা ঘরে চলে এসেছে। এমনিতেই শীতল আবহাওয়া। হাওয়া করলে পাখির ঠান্ডা লাগবে।”
“দেখি ইরফানকে বলে মশারির ব্যবস্থা করতে পারি কি-না। তুই পাখিকে দেখ।” বলেই অপূর্ব অগ্রসর হলো। আরুর মনে পড়ল তার ময়না পাখির কথা। অয়নের চিন্তায় পাখিদের খাবার দেওয়া হয়নি। উদ্বিগ্ন হয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই অপূর্ব এলো মশারি হাতে। সাথে এলো মিতা। পেরেকের সাথে মশারির কোনা লাগাতে লাগাতে বলল, “তোমার কিছু প্রয়োজন হয়ে আমাকে বলো আরু। বয়সে তুমি আমার ছোটো। নির্দ্বিধ আমাকে বলবে। লজ্জা পেয়ে আমার থেকে এড়িয়ে গেলে মেয়ে অসুস্থ হবে।”
“দুঃখিত বুবু। কিছু প্রয়োজন হলেই বলল আপনাকে।”
“মনে থাকে যেন। লজ্জা পেয়ো না। এখন তোমরা আমাদের কাছে আছো। তোমাদের বিপদ দেখার দায়িত্ব আমাদের।”
ততক্ষণে হাতের কাজ শেষ মিতার। মশারি চৌকির চারদিকে গুটিয়ে দিয়ে বলল, “রুটি বানিয়েছি। আরেকটু অপেক্ষা করো, নিয়ে আসছি।”
আরু লজ্জাবনত হয়ে বলল, “এই বৃষ্টির ভেতরে ঝামেলা কেন করতে গেলে বুবু?”
“বুবু বলে ডাকছ, আর তোমার জন্য এইটুকু করতে পারব না? এই সময়ে তোমার ভারি খাবার খাওয়া উচিত। বৃষ্টি না থাকলে তোমার ভাইকে দোকানে পাঠাতাম। যেহুতু বৃষ্টি তাই আটা দিয়ে রুটি করেছি। তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।” বলেই ছুটে গেল মিতা। আরু বিছানা থেকে একটু উত্তরে সেঁটে গেল। ঠান্ডা হাওয়া দেহে মেখে বলল, “একটু বাবাকে কল দিবেন? ময়নাদের আজ খাবার দেওয়া হয়নি। বাইরে খাঁচায় রেখেছে ওদের। কেন যে আপনি গতকাল ওদের বাড়িতে আনতে গেলেন!”
“কিন্তু ফোন আমি বন্ধ করে রেখেছি।”
“খুলে কল দিন। বৃষ্টিতে ভিজে ওদের ঠান্ডা লেগে যাবে। এখন আমিও নেই ওদের পাশে। কে যত্ন নিবে?” মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠে আবদার করল আরু। সেই আবদার ফেলার সাধ্য অপূর্বর নেই। অপূর্বকে এত বড়ো গিফট ‘পাখি’ দিল! তার বিনিময়ে হলেও আরুর কথা রাখা উচিত অপূর্বর। টেবিলে ওপর থেকে নিজের মুঠোফোন হাতে নিয়ে চালু করল। অতঃপর ডায়াল করল ইমদাদ হোসেন মৃধার নাম্বারে। এই কলটির জন্যই বোধ হয় ইমদাদ হোসেন অপেক্ষায় ছিলেন। চকিতে কল রিসিভ হলো। বিরতিহীন বলে গেল, “অপূর্ব কোথায় তুই? আরু কোথায়? পাখি কেমন আছে? ওদের নিয়ে কোথায় চলে গেছিস তুই?”
“আমরা শহরে আছি এখন ফুফা। আরু ও পাখি দুজনেই সুস্থ আছে। বাড়ির পরিবেশ এখন কেমন?” অপূর্ব এপাশ থেকে বলল।
“রোয়াকে বসে আছি আমি। পারুলকে নিয়ে গেছে ভাইজান। তোরা কোথায় আছিস বল, আমি গিয়ে নিয়ে আসব।”
“আমাদের নিয়ে চিন্তা করবেন না। যার জন্য ফোন করেছি, ময়নারা বাইরে আছে। ওদের ভেতরে নিয়ে খাবার দিন।”
আরুর কথা শুনতেই ইমদাদ হোসেন পাখির খাঁচা নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। ভাঙা চাল দিলেন খাবার হিসেবে। সারাদিন পর খাবার পেতেই ক্ষুধার্ত পাখিরা দিশেহারা হয়ে খেতে লাগল। অতঃপর আশ্বস্ত করল অপূর্বকে, “ওদের খাবার দিয়েছি।” ফের কিছু বলার আগেই অপূর্ব লাইন বিচ্ছিন্ন করল। বন্ধ করে রাখল ফোন। ইমদাদ হোসেনের কল আর সংযোগ দিল না।
__
রুটি ও সবজি ভাজি রেঁধেছে মিতা। বিদ্যুৎ এখনো আসেনি। ঘরের মাঝামাঝি একটা হারিকেন জ্বালিয়ে রাখা। আরুর জন্য হাতে করে খাবার এনে মিতা বলল, “ভাই কি এখানে খাবেন? ড্রাইনিংয়ে আসুন।”
“না। এমনিতেই আমার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। আপনি আরুর জন্য দুটো রুটি নিয়ে আসুন।” অপূর্বর জবাব শুনে আরু বলল, “আমিও খাব না। খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“আপনি আরুর কথা শুনবেন না। নিয়ে আসুন!” দৃঢ় গলায় অপূর্ব বলতেই মিতা চলে গেল। পরপর আরুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আজ তোর শরীরের উপর দিয়ে ধকল গেছে। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো না করলে অসুস্থ হয়ে পড়বি। আগে খাওয়া তারপর সবকিছু।”
আরুর মুখে টু শব্দ নেই। মিতা খাবার বিছানার পাশের টেবিলের ওপর ঢাকা দিয়ে রেখে গেল। আরু বিছানা মধ্যে থেকে কিনারায় কোনোরকম বসল। অপূর্ব কাঠের চেয়ার টেনে বসে টেবিল ও আরুর কাছাকাছি। রুটি ছিঁ/ড়ে ভাজি মিশিয়ে আরুর মুখে তুলে দিয়ে বলল, “আমাদের পাখির জন্য একটু শক্ত হ আরু। একটু।”
আরুর চোখের বাঁধ ভাঙল। উপচে পড়ছে জল। ভাঙা গলায় বলল, “এমনটা কেন হলো? এই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই যে।”
আরুকে হৃদমাঝারে নিয়ে অপূর্ব বলল, “তুই একজন মা, আরু। মায়েদের হতে হবে তুলার চেয়ে কোমল, আবার লোহার চেয়ে শক্ত। কাঁদিস না।”
__
শেষ রাতে আরুর চোখের পাতা একত্রিত হয়নি। বৃষ্টির ধারাও নেমে এসেছে শূন্যতায়। নেই মেঘ, নেই বজ্রপাত, নেই বিদ্যুৎ। এখনো জ্বলছে হলদে কৃত্রিম আলো। অপূর্ব ঘুমালেও ক্ষণে ক্ষণে তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে। আগামীকালের কাজের কথা মাথায় রেখে ঘুমাচ্ছে আবার আরুর কথা ভেবে উঠে যাচ্ছে। ভোরের আলোতে আংশিক অন্তরিক্ষ স্বচ্ছ হতেই কেঁদে উঠল পাখি। অপূর্ব ধরফরিয়ে উঠে বসে পাখির দিকে তাকায়। ক্লান্ত মুখমণ্ডল আরুর, ঘুমে কাঁদা সে। ডাক দেওয়ার স্পৃহা নেই তার। পাখিকে কোলে দিতেই লক্ষ করল, পটি করে দিয়েছে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে পরিষ্কার করল। অতঃপর কোল নিয়ে একা একা কথা বলতে বলতে পার করে দিল বহু ক্ষণ।
অফিসে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসতেই দরজার কড়া নেড়ে উঠল ইরফান। ফিসফিস করে বলল, “স্যার উঠেছেন? আজকে চেম্বারে যাবেন?”
“হ্যাঁ যাব।” প্রতুক্তি দেওয়ার সেই মুহুর্তে আরুর ঘুম ভাঙল। হাতিয়ে মেয়েকে না পেয়ে উঠে বসল। সন্ধান পেল বাবার কোলে মেয়েকে। হাত বাড়িয়ে কাছে চাইল মেয়েকে, “আমাকে ডাকতেন, কতক্ষণ পাখিকে কোলে নিয়ে ঘুরেছেন?”
“সারা রাত না, তবে অনেকক্ষণ।”
দরজা খুলে ইরফানকে যেতে বলল অপূর্ব।মুখ ধুতে যাওয়ার আগে আরুকে পর্যবেক্ষণ করল। বাড়ি থেকে এক কাপড়ে নেমে এসেছে। ভালো কিছু পোশাক কেনার পাশাপাশি আসবাবপত্র কিনতে হবে। আজ না পারলেও আগামীকাল নতুন ভাড়া বাড়িতে উঠবে। এবার থেকে পরিবারের বোঝা বইতে হবে তাকে।
চলবে ইন শা আল্লাহ