প্রিয়_প্রাণ #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ১৫

0
404

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৫

মাত্র হট সাওয়ার শেষ করে অর্ধ অনাবৃত্ত দেহে বের হলো তুষা’র। কাঁধে টাওয়াল ঝুলিয়ে চুলগুলো যথাসম্ভব হাত দিয়ে ঝেড়ে অবশিষ্ট পানিটুকু ও ফেলে দেয়ার চেষ্টা। ফর্সা লোমশ সুন্দর এক চওড়া বুক। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলে মন্দ হবে কি? না মোটেও মন্দ হবে না কিন্তু মন্দ কাজ করা থেকে আপাতত নিজেকে সংযত করে তথ্য। এসব বেহায়া আচরণ কি আদৌ তাকে মানায়? উহু। মানায় না৷ তবে এই সুপুরুষ’কে দেখা মাত্র সে নিজের মতো থাকলে তো। সে তো তুষা’রকে দেখলেই উলোটপালোট হয়ে যায়। এখনও যে বসে আছে মনে হচ্ছে এই বুঝি কিছু একটা বলে বা করে ফেললো। নিজের কাঁধ সমান চুলগুলো ঠেলে পিছনে দিয়ে যথাসম্ভব ভদ্র ও শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলো তথ্য। আর্মি ম্যান নিশ্চিত অগোছালো কিছু পছন্দ করে না? ঠোঁট উল্টে কিছু একটা ভেবে পরক্ষণেই মেরুদণ্ড সোজা করে বসলো ও।

তুষা’র আচমকা বসার ঘরে তথ্য’কে দেখে চমকালো কিছুটা। নিজেকে খালিগায়ে আবিষ্কার করে যথাসম্ভব দ্রুত হাতে টিশার্ট তুলে গায়ে জড়িয়ে টেনেটুনে ঠিক করলো। তথ্য যেন লাল টমেটো ততক্ষণে। গলা ঝেড়ে তুষা’র কিছুটা অসন্তুষ্ট দৃষ্টি ফেলে বললো,

— মিস.তথ্য, কোন কাজে এসেছেন?

তথ্য’র গলা যেন শুকিয়ে এলো। পানি খাবার জন্য বড্ড তৃষ্ণার্ত সে। অথচ এই মেয়ে কি না জুনিয়রদের ধমকে ধামকে রাখে? শখের পুরুষের কাছে নিজেকে শক্ত রাখা দায়। তথ্য তা হাড়েহাড়ে টের পেলো। কোনমতে কন্ঠে শব্দ তুলে বললো,

— এমনিতেই কথা বলতে এলাম। অসুবিধায় ফেললাম?

— তা ফেলেছেন মিস.তথ্য।

তথ্য’র মুখটা ছোট হয়ে এলো তবে উঠে চলে যাওয়ার মতো কোন লক্ষণ দেখা গেলো না তারমধ্যে। ভালোবাসা মানুষ’কে বেহায়া করে তুলে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ তথ্য। তুষার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

— কফি?

— খাওয়া যায়।

চটপট উত্তর এলো তথ্য থেকে। এই দফায় হেসে ফেললো তুষা’র। কিচেনে গিয়ে গরম পানি বসাতে বসাতে তথ্য’কে জিজ্ঞেস করলো,

— কোন স্পেশাল কাজ ছিলো?

— না। কেন? আসতে পারি না?

— পারো তবে হুটহাট? আই ফিল অকওয়ার্ড।

–অকওয়ার্ড?

— আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই তথ্য। আমাদের মাঝে তেমন কোন সম্পর্ক নেই যার জের ধরে তুমি এসেছো বা মাঝেমধ্যে আসছো।

তথ্য কথা বললো না। নিশ্চিত আবার কিছু হয়েছে তাই তুষা’রের কথাগুলো ততটা গায়ে মাখলো না৷ একসময় তুষা’র কফি হাতে হাজির হলো।
গরম ধোঁয়া উড়া কফি’তে কফিতে চুমুক বসিয়েই তথ্য’র মনে হলো এই কফির জন্য হলেও তার তুষা’রকে বিয়ে করা উচিত। পরক্ষণেই একগাল হেসে ফেললো নিজের ভাবনার উপর। তুষার দীর্ঘ পলক ফেলে দেখলো সেই হাসি। এমন তো না তার পৌরুষ মন তথ্য’কে অপছন্দ করে তবে নিজের জরাজীর্ণ জীবনে কোথায় ই বা ঠাই দিবে সে তথ্য’কে?

_____________________

আজ দুপুরের পর বের হয়েছিলো আরহাম। মাত্র চারজন রুগী কাউন্সিল করেই আজ বাসায় ফিরলো সে। তোঁষা’টা অসুস্থ। ওকে আজ একা রেখে বেরুতে মন মানেনি আরহামে’র কিন্তু আজকের চারটা কেস তার আন্ডারে ছিলো। যাওয়াটা ছিলো জরুরী নাহলে আরহাম বুঝি যেতো? রাস্তায় জ্যাম দেখে বিরক্ত হলো আরহাম। পেশাটা আজ ভিন্ন হলে এতটা ঝামেলা হতো না। অন্যান্য ডাক্তার’টা যেখানে ঘন্টায় দশ পনেরোটা রুগী দেখে সেখানে সাইকিয়াট্রিস্টদের একজন রুগীকেই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় দিতে হয়। আজ তো তাও সময় কম লাগলো কারণ রিকভারি প্যাসেন্ট ছিলো দু’জন।
তাচ্ছিল্য হাসলো আরহাম। শেখ বাড়ীর সকলের নজরে পাগল আরহাম কি পাগলের ডাক্তার? বিষয়টা চিন্তার বটে।
আরহাম নজর ঘুরালো। কাঁচে টোকা পরেছে। তেরো চৌদ্দ বছরের এক কিশোরী দাঁড়িয়ে। পরণে ময়লা কিন্তু সাদা একটা ফ্রক। খসখসে চেহারাটা মলিনতায় ঘেরা অথচ দারুণ এক হাসি লেপ্টে তার ঠোঁটে। হাতে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে সে।

আরহাম চিন্তায় পড়লো। বছর কয়েক আগের কথা। তোঁষা’টা তখন কিশোরী। তুঁষ’টার জন্মগত ভাবেই বিভিন্ন রোগ বয়ে এনেছে। বাদবাকি জ্বর, ঠান্ডা তার জীবনে বোনাস। এই তো সেই কিশোরী তোঁষা এক গরমের দিনে পাতলা একটা ফ্রক পড়ে ছাদে বসে ছিলো। সবার নজরে তোঁষা ছোট হলেও বাইরের লোকজন তা মারাতো না। কিশোরী তোঁষা’র সেই সৌন্দর্য ফুটে উঠছিলো ঝলমল করে যা ছিলো চোখে পড়ার মত।
রাতে ছাদে উঠেছিলো তোঁষা বাতাস খেতে। ভয়ডরে ভরপুর তোঁষা জানতো তার আরহাম ভাই ছাদে পড়ছে তাই তো একা ছাদে উঠার সাহস করলো।
তবে বিপত্তি ঘটলো অন্যভাবে। তোঁষা জানতো না ঐ দিন ছাদে আরহাম আর আদনান বাদেও অন্য কেউ উপস্থিত ছিলো। তাই তো যখন টাঙ্কির উপর বসতে নিলো তখনই একজন ছেলে বলে উঠলো,

— কি পিচ্চি তুলে দিব?

তোঁষা হকচকিয়ে যাওয়ার দরুন পড়ে গেলো টাঙ্কি থেকে। ব্যাথা সে পায়নি ততটা তবে লজ্জা পেয়েছিলো। গলা ফাটিয়ে সে কি কান্না। আরহাম তোঁষা’র কন্ঠ শুনে আসতে আসতে তোঁষা কান্ড ঘটিয়ে ফেললো। আরহাম এসেই দেখলো তোঁষা কাঁদছে ছাদের মেঝেতে অন্যদিকে অরুন কপাল চেপে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অরুনের কপাল বেয়ে চিকন ধারায় র*ক্ত গড়াচ্ছে। তবে আরহাম অরুনে’র দিকে বিশেষ খেয়াল করলো না। ও ব্যাস্তপায়ে তোঁষা’কে টেনে তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করলো,

— কি রে তুঁষ, ব্যাথা পেলি? পড়লি কিভাবে? উঠ।

তোঁষা আরহামে’র টিশার্ট খামচে ধরে উঠে দাঁড়ালো। ফুপাতে ফুপাতে নিজের বয়ে যাওয়া নাকটা মুছে নিলো আরহামে’র বাহুতে। আরহাম সেসবে পাত্তা দেয় না অথচ তার রয়েছে ওসিডি রোগ। সুচিবাই মানুষ’টা একদম ভিন্ন তার তুঁষে’র ক্ষেত্রে।
আদনান এসে অরুণ’কে ধরলো। তোঁষা’কে আরহাম নীচে নিয়ে যেতেই আদনান অরুন’কে ঘটনা জিজ্ঞেস করলো। অরুন কি বলবে ভেবে পেলো না। ঘটনাটা যতটা হুট করে হলো তাতে তার বলার কিছুই নেই। আদনান কিছু আবার জিজ্ঞেস করার পূর্বেই কোথা থেকে আরহাম এসে অরুণে’র উপর হামলে পড়ে।
তোঁষা থেকে ঘটনা যা শুনা গেলো তার সারমর্ম হলো, তোঁষা টাঙ্কিতে উঠতে নিলেই অরুণে’র কন্ঠ শুনে ভয়ে পরে যায়। অরুণ তাকে তুলতে গিয়ে পিঠে হাত রাখতেই তোঁষা পাশ থেকে ইটের টুকরো ছুঁড়ে মা’রে ওকে।
অরুণ মাথা নামিয়ে নিলো। ঘটনা মিথ্যা নয় আবার পুরোপুরি সত্যি ও নয়। হয়তো পিঠে অরুণ হাতটা রেখেছিলো তবে নিয়ত খারাপ ছিলো না।

— ভাই ফুল নিবেন না? একটা নেন না।

হঠাৎ আকুতি ভরা কন্ঠ শুনে আরহামে’র ধ্যান ভাঙে। অল্পবিস্তর হেসে মেয়েটার মাথায় হাত রেখে বললো,

— কত দিব?

— পঞ্চাশ টাকা পিস। ফেব্রুয়ারিতে দাম একটু বেশিই গোলাপের তবে আপনি ভালা মানুষ তাই দশটাকা কম দিয়েন।

এবার শব্দ করে হেসে ফেললো আরহাম। কচকচা একটা হাজার টাকার নোট মেয়েটাকে দিয়ে অবশিষ্ট সবগুলো গোলাপ নিয়ে বললো,

— গোলাপের কখনো মূল্য হয় না। এই যে ফুটন্ত এক গোলাপ তুমি। মূল্যহীন এক রত্ন।

মেয়েটা অর্ধবির্ধ বুঝে হাসলো। আরহাম গাড়ি ছাড়লো।

বাসায় পৌঁছেই সব অন্ধকার পেলো আরহাম। তোঁষা কি তাহলে উঠে নি? উত্তর জানা আরহামে’র। তবুও ডাকলো,

— তুঁষ?

উত্তর এলো না। পা চালিয়ে বেড রুমে যেতেই চোখ আটকালো ঘুমন্ত তোঁষা’র পানে। মাথা কাত করে ঘুমুচ্ছে সে। আরহাম এগিয়ে এসে ওর মুখে নিজের হাতটা রাখতেই চমকালো। কাঁথা সরিয়ে গলা, হাত-পা ধরতেই দেখলো অসম্ভব গরম শরীর। জ্বর এলো অথচ আরহাম কি না জানলো না? এতক্ষণ তো ভেবেছিলো ঘুমাচ্ছে কিন্তু…। চিন্তিত আরহাম তোঁষা’র মুখের উপর ঝুঁকলো। গালে আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে ডাকলো,

— তুঁষ?

— হু।

— খারাপ লাগছে?

— উহু।

— একটু উঠ।

— উহু।

— প্লিজ না প্রাণ।

তোঁষা উঠবে না। আরহাম নিজেই বালতি ভর্তি পানি এনে পানি ঢাললো ওর মাথায়। আধ ঘন্টা খানিক যেতেই তোঁষা কথা বললো,

— আর না।

— আরেকটু দেই?

— উহু।

আরহাম উঠলো। তোঁষা’র লম্বা, ঘন চুলগুলো সযত্নে টাওয়াল পেঁচিয়ে ভেজা টাওয়াল এনে যতটুকু পারলো মুছে দিলো। তোঁষা চোখ বন্ধ করেই ডাকলো,

— আরহাম ভাই?

আরহাম তখন অতি যত্নে তার তুঁষে’র পায়ের পাতা মুছে দিচ্ছে। ডাকের জবাবে বললো,

— বল প্রাণ।

— আব্বু-আম্মু’র কথা মনে পরছে আর ভাই’কে। চাচ্চু-চাচি’কেও।

আরহামে’র নরম মুখটা নিমিষেই শক্ত হলো। তোঁষা একাএকাই কিছু বিরবির করতে করতে চুপ করে গেলো। আরহাম উঠে সব গুছিয়ে নিজেও ফ্রেশ হয়ে এসে তোঁষা’র পানে তাকিয়ে গোলাপ গুলোর দিকে তাকালো। হাত বাড়িয়ে একটা ছুঁয়ে দিতেই অতি সুক্ষ্ম এক কাটা বিধলো ওর আঙুলে। সঙ্গে সঙ্গে র*ক্ত আসতেই আরহাম হাসলো। ঝুঁকে বৃদ্ধাঙ্গুলী’টা দিয়ে তোঁষা’র ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিতেই তা আরহামে’র র*ক্তে রঞ্জিত হলো। বিগলিত হাসে আরহাম। শুনা যায় তার চাপা কন্ঠস্বর,

— প্রাণ আমার, এই গোলাপে’র ভালোবাসা পেতে যেমন কাটার আঘাত পেতে হয় তবুও কেউ গোলাপ’কে ত্যাগ করে না তেমনই আরহামে’র ভালোবাসা পেতে তোকে আমার কাছেই থাকতে হবে। এরমাঝে আর কেউ থাকবে না। কেউ না। শুধু আমি আর আমার প্রাণ।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here