#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৭
শেখ বাড়ীর সকলের চোখে মুখে বিষাদ লুকোচুরি খেলা করছে। বাড়ীটা যেন আস্ত এক ম’রা বাড়ী। বলা যায় গত কয়েক মাস ধরেই এটা ম’রা বাড়ী হয়ে ছিলো তবে এখন যেন মৃতপুরী’তে রুপান্তর হয়েছে। হাজার তোঁষা বিগত মাস কয়েক চুপচাপ থাকতো, হুটহাট সবার সামনে এসে আবদার করতো আরহামে’র জন্য, মাঝেমাঝে তেঁজী রুপ দেখা যেতো ওর। কিন্তু এখন? সবটা নিঃস্তব্ধতার চাদরে মুড়ানো। তাদের পুতুল নেই তাদের কাছে। সবাই জানে সে কোথায়, কার সাথে আছে কিন্তু তাদের হাত বাঁধা। তুহিন আর তুরাগ দুই ভাই গত দুই’টা দিন ধরে কম তো খুঁজলো না। পুলিশ জানিয়েও লাভ হয় নি। তারা জানে হবেও না। আরহাম প্রচন্ড ধুর্ত এক ছেলে। সে কোথায় লুকিয়েছে তা জানা মুশকিল। তবে এটা ভেবে তারা কিছুটা হলেও সস্তি’তে আছে যে আরহাম আর যা ই হোক এখন পর্যন্ত তোঁষা’কে কিছু করে নি। হঠাৎ কলিং বেল বাজতেই তুঁষা’রের মা দরজা খুলেন। পুলিশ অফিসা’র দেখেই স্বামী’কে ডাকতে চলে আসেন ভেতরে। ততক্ষণে আদনান এগিয়ে এসে তাদের ভেতরে আনলো।
বাড়ী’র পুরুষ’রা সকলে সোফায় বসা। তাদের সামনে টেবিলে ল্যাপটপে চলছে একটি ভিডিও যাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তোঁষা পার্লার থেকে পালিয়ে নিজে গিয়ে একটা গাড়ীতে চড়ে বসছে। তবে এর আগে আদনান পার্লারে ঢুকেছে। আদনান সেটা দেখেই চমকে উঠে বললো,
— ভাই।
পুলিশ অফিসার নিজেও ব্যাপারটা নিয়ে বিভ্রান্তি’তে ছিলেন৷ তিনি ভেবেছিলেন ওটা আদনান তবে না সেটা ছিলো আরহাম যে আদনান সেজে পার্লারে ঢুকেছিলো। হয়তো তখনই কোনভাবে তোঁষা’র সাথে যোগাযোগ করেছে যার দরুন তোঁষা পালাতে পেরেছে।
সবটা শুনে অফিসার তুরাগে’র দিকে তাকিয়ে বললেন,
— স্যার এখানে কিডন্যাপ এর মতো কিছুই নেই। তোঁষা নিজে পালিয়েছে। সবটা পরিষ্কার। কোন ক্লু এর ভিত্তিতে তোঁষা’র খোঁজ করব?
তুহিন চুপ করে গেলেন আর তুরাগ সে নিজের ছেলের কৃতকর্ম দেখে বাকহারা। তোঁষা’র মা দূর থেকেই মেয়ের পালানোর দৃশ্য দেখে মুখে আঁচল গুজে কাঁদছে। আরহামের মা দুই হাতে নিজের সাথে জাপ্টে ধরেন তাকে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি শুধু বললেন,
— ভাবী মেয়েটাকে বিয়ের সকালেও মে’রেছি আমি। ও ভাবী ও কি আর ফিরবে না? আমার বুকটা কেমন করছে ভাবী। আমার পুতুল।
তুঁষা’রের কানে যাচ্ছে মায়ের কান্না। তবে তার চতুর মস্তিষ্ক দেখছে অন্য কিছু। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই সে প্রশ্ন করলো,
— তোঁষা’র নাকে, মুখে র*ক্ত কিসের?
হঠাৎ এহেন প্রশ্নে চমকে তাকান সকলে। হ্যাঁ তাই তো। কেউ কেন খেয়াল করলো না বিষয়টা না। পার্লার থেকে বের হলে কেন তোঁষা’র নাকে, মুখে র*ক্ত আর কেন ই বা এক হাতে পেটের দিকে চেপে রেখেছে? এত এত প্রশ্ন অথচ উত্তর শূন্য।
অফিসার বিদায় হতেই ধপ করে বসে পরে তুহিন। তুরাগে’র মুখে ভাষা নেই ছোট ভাই’কে কিছু বলার বা সান্ত্বনা দেয়ার। আরহাম’কে কিছুতেই সহজে নেয়া যাচ্ছে না। তবে এটাও ঠিক এখন পর্যন্ত সে হয়তো তোঁষা’র গায়ে মশার কামড় ও পরতে দেয় নি তবে সামনে কি হতে পারে তা ভাবতেই যেন গা শিওড়ে উঠছে। আদনান দুই হাতে মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দ্রুত পায়ে রুমে চলে গেল। এখানে টিকা যাচ্ছে না আর। কিছুতেই না।
তুঁষা’র এতক্ষণ চুপ থাকলেও হঠাৎ বললো,
— এই সপ্তাহে চলে যাচ্ছি চাচ্চু।
তুরাগের দৃষ্টিতে হতভম্বতা। আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— চলে যাচ্ছো মানে?
— ক্যাম্পে যাচ্ছি।
তুহিন মাথা তুলে ছেলের দিকে অসহায় দৃষ্টি ফেলেন। তুঁষা’র সেটা দেখে নির্লিপ্ত গলায় বললো,
— এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই আব্বু। আমি বহু আগেই তোমাকে বলেছিলাম। শুনো নি। এখন ভুগো। আমার কথা শুনলে অন্তত আজ আমার পুতুল আমার বুকে থাকতো।
বলেই হনহনিয়ে রুমে চলে যায় তুঁষা’র। বোনের জন্য তার হৃদয়ে যে ভালোবাসা তা শুধু মাত্র ভাইয়ের না বরং তোঁষাটা’কে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে তুঁষা’র। না চাইতেও বারবার মনে হয় এই বুঝি মাস গড়াতেই আরহাম তার পুতুল’টার প্রাণহীন দেহ নিয়ে হাজির হয়। ভাবতেই তুঁষা’রের হাত-পা শীতল হয়ে আসে। মনকে বুঝ দেয় এখন পুতুল ভালো আছে। আরহাম যেমন তোঁষা’কে বুকে করে রাখবে ঠিক তেমনই ঐ বুকে তোঁষা’র সমাধি দিতেও পিছু পা হবে না।
________________
পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনা যাচ্ছে তবে দূর থেকে। ফুরফুরে বাতাস তেড়ে আসছে রুমে। আরহাম ঘুম জড়ানো চোখে একবার তাকালো। জানালা লাগানো তবে বারান্দার থাইটা একটু খোলা। তা দিয়ে ই এমন বাতাস আসছে। পাখির শব্দ এই বাইশ তলার উপর ঠিকঠাক শুনা যায় না তবে শীত হওয়াতে কিছুটা টের পাওয়া যাচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস তোঁষা’র গায়ে লাগবে ভাবতেই আরহাম তাকালো। আরহামের বাহুর ভেতর ঢুকে বিড়াল ছানার ন্যায় গুটিয়ে তার বুকে মিশে আছে তোঁষা। ঘুম ঘুম মুখটাতে আরহামের হাসি। তৃপ্তিময় এক হাসি। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো তোঁষা’র ফুলা গালটা। আরহামের চোখটা হঠাৎ জ্বলে উঠলো যেন। বছরের পর বছর কিভাবে পার করেছে তা কেবল আরহাম জানে। এই তোঁষাটা’কে ছাড়া বহু কষ্টে দেশের বাইরে থেকেছিলো সে। মনে বিশ্বাস ছিলো সে সফল হয়ে ফিরার পর তোঁষা’কে পাবে। নিজের করে। কিন্তু না, ধোঁকা খেলো খুব বাজে ভাবে। একজন সফল, ক্ষ্যাতিমান সাইকিয়াট্রিস্ট হওয়ার পরও শেখ বাড়ীর সকলে মিলে কি ধোঁকাটাই না দিতে চাইলো।
চোখ গড়িয়ে এক ফোঁটা পানি পরতেই আরহাম তোঁষা’র মাথায় মুখ দিয়ে রাখলো। তোঁষা আরেকটু জড়িয়ে নিলো নিজেকে আরহামে’র সাথে। সায় পেয়ে আরহামের বন্ধনী দৃঢ় হলো আরো। তোঁষা তখন অল্প ব্যাথা পেলেও কিছু বললো না। হোক না মরণ, বুকটা তার প্রাণে’র হলেই শান্তি।
.
আরহাম’কে তৈরী হতে দেখেই তোঁষা’র মন খারাপ হয়ে এলো। এদিক ওদিক ঘুরঘুর করছে ও। আরহাম আড় চোখে সবটা দেখছে তবে চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। তোঁষা উৎসুক দৃষ্টি ফেলে এবার আরহামে’র কাছে আসতেই আরহাম টাইটা বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে। তোঁষা যদিও টাই বাঁধতে পারে না তবুও এতক্ষণে আরহামে’র মনোযোগ পেয়ে সে টাই’টা হাতে তুলে নিলো। আরহাম থেকে অনেকটা খাটো হওয়ার দরুন তোঁষা নাগাল পাচ্ছে না তাকে। আরহাম দেখলো তোঁষা’র চেষ্টা। পায়ের তালু উঁচু করে সে চেষ্টায় আছে আরহামের টাই বাঁধতে। আরহাম ব্যাপারটা সহজ করলো ওর তুঁষে’র জন্য। দুই হাতে কোমড় জড়িয়ে উঁচু করে নিজের বরাবর করে দিলো। তোঁষা তখনও চেষ্টায়। বেচারী এতশত চেষ্টার পর ও যখন পারলো না তখন মুখটা পেঁচার মতো করে বললো,
— পারি না তো।
— চেষ্টা কর।
— করলাম তো।
— আবার কর।
এবার আরহাম গাইড করলো আর তোঁষা বাঁধলো। পাঁচ মিনিট লাগিয়ে সুন্দর করে তোঁষা কাজটা সম্পূর্ন করেই বিজয়ের হাসি হাসলো। উঁচু হওয়ায় আরহামের গলা জড়িয়ে উচ্ছাসিত গলায় বললো,
— আরহাম ভাই! বেঁধেছি আমি।
— হু। তুই বেঁধেছিস।
এগিয়ে একটু কাছাকাছি হলো আরহাম। তোঁষা ও নিজের মুখটা এগিয়ে নিতেই আরহাম ওর বোঁচা নাকে একটা চুমু খেয়ে বললো,
— আমার বুঁচি।
তোঁষা আবার বিনিময়ে একদম পাকা। নিজেও ঠেসে এক চুমু খেলো আরহামে’র গালে। পরপর নাকে দিয়ে বললো,
— আমার খাঁড়া নাক ওয়ালা শেখ সাহেব।
আরহাম হেসে ফেললো এহেন সম্মোধন শুনে। তোঁষা মুখটা ভোঁতা করে আরহামে’র চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কখন ফিরবেন?
— ফিরার জন্য তো আগে যেতে হবে।
তোঁষা মুখ গোমড়া করেই রাখলো। আরহাম নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তোঁষা’র দেহটাকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
— শিঘ্রই ফিরব প্রাণ।
তোঁষা আরহাম’কে দরজা পর্যন্ত বিদায় দিতে চাইলেও তা সম্ভব হলো না। তোঁষা’কে ভেতরে রেখে বাইরে দিয়ে মেইন ডোর লক করে গিয়েছে আরহাম। বারবার তোঁষা’কে তোতাপাখি’র মতো বলেছে যাতে দরজা না খুলে, বারান্দায় না যায়, রান্না ঘরে না যায় সহ এত কথা। তোঁষা সবটা শুনেছে। তবে এখন আর ভালো লাগছে না ওর। কিছুতেই না। পরপর তিনটা ঘন্টা পার হতেই ওর মন মেজাজ খারাপ হওয়া শুরু করলো। পায়চারি করতে করতে এলো আলমারি’র সামনে। খুলে হাতে নিলো আরহামে’র শার্ট। আলগোছে সেটা নিয়ে বিছানায় যায় তোঁষা। শার্টে নাক ডুবিয়ে চেষ্টা করে ঘ্রাণ নেয়ার। হায়! এতটা মাদকীয় কোন পুরুষের ঘ্রাণ হয় নাকি?
#চলবে…..
[ গল্পটা কাল্পনিক তাই সেভাবেই ভাবুন]