#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৮
মোট আট ঘন্টা পার করলো তোঁষা একা একা। এরমধ্যে হয়তো ঘন্টা পাঁচ তার কেটেছে ঘুমে। ঘুম ভাঙতেই মনে হলো ওর ক্ষুধা লেগেছে। উঠে ওয়াসরুমে ঢুকে মুখে পানি দিয়ে বের হয়ে যেই না কিচেনে পা বাড়াবে ওমনই মনে পরলো আরহামে’র কথা। তোঁষা’কে কিচেনে যেতে না করেছে একা। ঠোঁট উল্টো করে এদিক ওদিক তাকায় তোঁষা। এটা কেমন কথা, তোষা একা থাকছে এখানে। কিচেনে
যেতে হলে তো তাকে একাই যেতে হবে। তাই না? এখন তোঁষা খাবে কি? দেনামোনা করতে করতে টেবিলে গিয়ে ধপ করে বসে পরলো তোঁষা। ক্ষুধায় মরণ হলেও তোঁষা কিচেনে যাবে না। যেখানে আরহাম ভাই নিষেধ করেছে তোঁষা কখনো সেখানে যায় না। এখনও তাই।
টেবিলের মাঝখানে তাকাতেই তোঁষা’র ভোঁতা মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল। ফলের ঝুড়ি রাখা সেখানে। তোঁষা খেয়াল করে নি সেটা আগে। মনটা যেন নিমিষেই ভালো হয়ে গেল ওর। হাত বাড়িয়ে দুটো আপেল আর কমলা নিয়ে মুখে টপাটপ চর পাঁচটা আঙুল পুরে রুমে হাটা দিলো। মন চাইলো বারান্দায় যেতে কিন্তু সেটা ও তো করা যাচ্ছে না। মন খারাপ করে সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে পরলো তোঁষা। টিভিটা অন করে চ্যানেল পাল্টালেও কার্টুন বাদে কিছুই পেলো না। তোঁষা’র অবশ্য সমস্যা হলো না। কার্টুন ভালো লাগে ওর।
সেই ভালো লাগাটাও বেশিক্ষণ টিকলো না আজ তোঁষা’র। ছোট থেকে যৌথ পরিবারে থাকা মানুষটা এমন একা কতক্ষণ ই বা থাকবে। বাইরে ও বের হওয়া নিসিদ্ধ তার জন্য। জানালা দিয়ে দূর আকাশ পানে তাকালো তোঁষা। অভিযোগ করলো একা একা অনেক কিছু। খুব কি খারাপ হতো পরিবার যদি তাকে আরহাম’কে মেনে নিতো?
_________________
হঠাৎ দরজা খুলতেই হকচকিয়ে যায় আরহাম। ভেতরে ঢুকা মাত্রই দৌড়ে এসে তোঁষা ঝাঁপিয়েছে তার বুকে। দুই হাতে শক্ত করে ধরার দরুন আরহাম ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। হাতের ব্যাগটা ঢিল মে’রে কাউচে ছুঁড়ে দুই হাতে জড়িয়ে নিলো তোঁষা’র দেহটা। এক হাতে মাথায় আদর দিতেই তোঁষা’র নাক টানার শব্দ শুনা গেলো। আরহাম শক্ত হলো। দাঁত দিয়ে দাঁত পিষে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালালো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
— আর যাব না তোকে রেখে।
তোঁষা মুখ তুললো না। একজন মানুষ হয়ে এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা একা পার করাটা মোটেও সহজ কিছু ছিলো না। একদিন না হয় ঠিক আছে তাই বলে আরহাম রোজ রোজ বের হলে তখন কিভাবে থাকবে তোঁষা?
মুখ তুলে আরহামের দিকে তাকাতেই আরহাম তোঁষা’র গালে হাত দিলো। সযত্নে মুছে দিলো জমা পানিটুকু। তোঁষা এবার আরহামে’র বুকে মুখ গুজে বললো,
— মিসড ইউ।
— মি ঠু প্রাণ।
তোঁষা মুখটা ঘঁষে দিলো আরহামে’র বুকে। হাত ধরে রুমে নিতে নিতে বললো,
— কেমন ছিলো আপনার দিন? আচ্ছা মেয়ে পাগল কয়টা এলো? ও একটা কথা ছিলো তো আমার.. মেয়ে পাগলগুলো কি বয়স্ক থাকে না কি আমার বয়সের?
কথাগুলো সহজ গলায় জিজ্ঞেস করতে করতে আরহামে’র গায়ের কোট’টা খুলে টাই আলগা করে তোঁষা। আরহাম ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে আছে ওর তুঁষে’র মুখটা’র দিকে। তোঁষা উত্তর না পেয়ে আরহামে’র শার্টের বোতামে হাত রেখে চোখ দিলো আরহামে’র মুখে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পুণরায় জিজ্ঞেস করলো,
— কি বলুন। আর একটা প্রশ্ন আছে। আপনার সাথে কে থাকে? না মানে নার্স নাকি বয়? আপনি চাইলে আমাকে জবটা দিতে পারেন। এই যেমন আপনার কাছে আসা পাগলদের সিরিয়াল দেয়া বা আপনার খাবার দাবার খেয়াল রাখা। কখন কি লাগে আপনার বুঝা যায় না তাই না? আমি আপনার কেবিনেই একপাশে বসে থাকলাম৷ কি বলেন?
এক নাগারে কথাগুলো বলতে বলতে আরহামে’র শার্টের বোতাম গুলো খুলে দিলো তোঁষা। উত্তর না পেয়ে আরহামে’র দিকে তাকাতেই দেখা মিললো অসহায় আরহামে’র চোখ। তার চোখ থেকেও বেশি অসহায় শুনালো আরহামে’র কন্ঠ,
— তোর কি অনেক কষ্ট হয়েছে তুঁষ?
তোঁষা কথা বলে না। মাথা নিচু করে রাখে। আরহাম ওর হাত ধরে নিয়ে বিছানায় বসলো। ও জানে তোঁষা’র কষ্ট। দেখেছে ওর ছটফটানি। এই যে এখন একা থাকতে পারছে না বলে কত বাহানা ধরছে আরহামে’র সাথে যাওয়ার। তোঁষা’কে বিছানায় শুয়িয়ে কপালে চুমু দিয়ে আরহাম বললো,
— অপেক্ষা কর। সাওয়ার নিয়ে আসছি। এরপর একসাথে খাব।
আরহাম আলমারি থেকে নিজের একটা টাউজার নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে যায়। তোঁষা শোয়া থেকে উঠে বসে। দুই হাতে চোখ ডলে নেমে যায় বিছানা থেকে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে কিচেনে। আরহাম এখন ক্লান্ত। তোঁষা তার বউ। সেই হিসেবে তোঁষা’র উচিত আরহামে’র খাবার রেডি করা। কিন্তু সমস্যা হলো রান্না। কেউ তো কখনো তাকে রান্না শেখায় নি। তবে কিছুটা শিখেছে আরহামে’র জন্য।
মন খারাপ করে ফ্রিজ খুলতেই প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো কিছু খাবার পেলো তোঁষা। ঝটপট বের করে ওভেনে দিয়ে প্লেট রাখলো টেবিলে। আরহাম সকালেই রান্না করে সব গুছিয়ে গিয়েছে।
— কি করছিস তুঁষ?
হঠাৎ আওয়াজে ভয় পেয়ে যায় তোঁষা। আরহাম এগিয়ে এসে ভেজা চুলগুলো ঝাড়া দিলো তোঁষা’র মুখের উপর। চোখ বুজে নেয় তোঁষা। আরহামের চুলের পানি তখন ওর নাকে মুখে। নাকে ভেসে আসে কড়া পুরুষীয় ঘ্রাণ। তোঁষা’র ভালো লাগে শুঁকতে। আরহামে’র কন্ঠে ঘোর কাটে তোঁষা’র,
— বলি নি কিচেনে একা না আসতে?
থতমত খেলেও তোঁষা মুখ সামলে উত্তর দিলো,
— সেটা বলেছিলেন একা বাসায় থাকলে। যেহেতু আপনি এখন বাসায় তাই এই কথা প্রযোজ্য হবে না।
আরহাম তীক্ষ্ণ চোখে তোঁষা’কে দেখে নিয়ে কিচেনে হাটা দিলো। তোঁষা প্লেট হাতে টেবিলে বসতে বসতে বললো,
— আরহাম ভাই, কাল আমি রান্না করব হ্যাঁ? জানেন আপনার জন্য আম্মু’র থেকে রান্না শিখেছিলাম….
বাকিটা বলতে গিয়ে ও তোঁষা চুপ হয়ে গেল। বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো মা’য়ের জন্য। তবে সেই ব্যাথায় পাত্তা দেয় না তোঁষা। আরহাম শেখ বাড়ীর কারো কথা শুনা পছন্দ করে না তাই তোঁষা চুপ করে যায়। আরহাম হাতে ইনসুলিন নিয়ে এগিয়ে এসে তোঁষা’র বাহু টেনে নিলো নিজের কাছে। হাফ হাতা কুর্তি’টার হাতা আরেকটু উপর তুলে সযত্নে পুশ করে দিতেই তোঁষা মুখ কুঁচকে একটু শব্দ করে,
— উফ!
আরহাম ততক্ষণে পুশ করে দিয়েছে। তোঁষা’র মুখে তাকিয়ে ব্যাস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— এই তুঁষ? ব্যাথা পেলি?
তোঁষা মাথা ঝাঁকাতেই আরহাম উলোট পালোট হলো। কপালের শিরা ফুলতে শুরু করেছে কিছুটা। তোঁষা’র পুশ করা জায়গাটায় একটু লাল তরল বের হয়েছে কিন্তু কেন? এমন তো হওয়ার কথা না। আরহাম খেয়াল করলো নিডেলটা বাকা। কেন ও আগে খেয়াল করলো না? কেন ওর তুঁষে’র মুখে ব্যাথাকাতুর শব্দ? তাও আরহামে’র কাছে? আরহাম কি তা মানবে? এটা কি সম্ভব? তোঁষা নিজেই এক আঙুলে বাহু থেকে র*ক্ত মুছে হাত ধুতে যেতে যেতে বললো,
— মনে হচ্ছে নিডেলে সমস্যা।
তোঁষা খেয়াল করে নি আরহামে’র মুখভঙ্গি। পুড়া গন্ধ নাকে আসতেই কিচেনে যায় আরহাম। একসাথে খাওয়া শেষ করে শুয়ে পরে তোঁষা’কে নিয়ে। তোঁষা ঘুমাতেই বিছানা ছাড়ে আরহাম। এগিয়ে যায় অন্ধকারে কিচেনে। ডাস্টবিনে নিডেল ফেলা। তোঁষা ফেলেছে এটা। আরহাম সেটা হাতে তুলে চুপ করে বসলো ফ্লোরে। এক ধ্যানে দেখলো নিডল’টাকে। সোজা না হয়ে কেন বাঁকা এটা? আরহাম ভাবলো।
আরেকটু সময় অতিবাহিত হতেই ঘড়ির কাটায় শব্দ হলো সাথে ভিন্ন এক শব্দ। এই তো রাত বারোটা বাজে এখন। আরহাম কাত হয়ে ফ্লোরে শুয়ে পরলো। বা হাতের বাহু গড়িয়ে তখনও চুয়ে চুয়ে বের হচ্ছে লাল তরল। অগণিত সুচের আঘাত সেই শক্ত পেশি’র বাহুতে। ব্যাথাটা কি ওর তুঁষে’র ব্যাথার সমান হলো? নাকি হলো না? আরো কিছুক্ষণ কি আরহাম খোঁচাবে হাতটা? ভাবতে ভাবতে সুন্দর করে উঠে ফ্লোর পরিষ্কার করে আরহাম অতঃপর একদম শান্ত ভাবে এগিয়ে এসে তোঁষা’র পাশে বসলো। পুশ করা স্থানে ঠোঁট লাগিয়ে ভেজা চুমু খেয়ে ফিসফিস করে আরহাম জানালো,
— সমান সমান তুঁষ। তোর যতটুকু ব্যাথা আমারও ততটুকু ব্যাথা।
#চলবে….
[গল্পটা কাল্পনিক তাই সেভাবেই ভাবুন।]