ফ্লুজি #অনুপ্রভা_মেহেরিন [পর্ব ২৩ বাকি অংশ]

0
466

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২৩ বাকি অংশ]

ব্যথায় শরীর টনটন করছে মাথাটা কেমন ঝিম ধরে আছে খুশবুর।হঠাৎ আলোর ছটাক চোখে আসতে মাথা ব্যথা ক্রমশ বাড়তে থাকে।চোখে খুলে তাকানোর সাহস করেনি সে।অপরদিকে আরশাদ তার সহিত লেপ্টে আছে।আরশাদের ভার নেওয়ার মতো সামর্থ্য তার হয়নি কিন্তু এই আরশাদ তো তার বুকে মাথা চেপে না শুয়ে ঘুমাবেই না।অবশ হওয়া পা’টা টানটান করার চেষ্টা করলো খুশবু।পিটপিট চোখে তাকানোর চেষ্টা করতে নজরে আসে আরশাদের পিঠ কাঁধ।দ্বিতীয়বার পর্যবেক্ষণ করতে দেখতে পায় সারাটা রুম এলোমেলো,কাল কে তান্ডব চালিয়েছিল?আরশাদকে সরাতে গেলে চোখে আসে ছেলেটার ফর্সা চামড়ায় লাল ছোপ ছোপ দাগ।কিছু স্থানে রক্ত জমাট বেধে কালো কালচে রঙ ধারণ করেছে।আরশাদের বাদামী দাঁড়িতে হাত বুলায় খুশবু ছেলেটার হঠাৎ কি হয়েছে?আঘাত কি করে পেল?খুশবু অস্থির হয়।এলোমেলো হাতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে আরশাদের দেহ।কামড়ের চিহ্ন দেখে পিলে চমকে উঠে সে।ছেলেটাকে সরাতে উদ্যত হয় মুহূর্তে।কিন্তু আরশাদের দেহটাকে উপড়ে ফেলতে পারে না মেয়েটা।হাঁপিয়ে উঠে বাধ্য হয়ে বলে,

” একটা পানির জগ আমার মা আমাকে তুলতে দেয়নি তার ধারণা এত ভার সহ্য করবো কি করে,আর এখন আমি ৭৮ কেজির ভার সামলাই।”

খুশবু হতাশ হলো আরশাদকে সরিয়ে উঠে বসলো সে।আরশাদের ঘুম আর স্থায়ী হলো না খুশবুর সাথে সাথে সেও উঠে বসে।ঘুম ঘুম চোখে ছেলেটা প্রশ্ন করে,

” কি হয়েছে ফ্লুজি?”

” কিছু না।উঠুন বেলা হয়েছে।”

” গত রাতে এটা কি করলে তুমি?”

” কি করেছি?”

” ওয়াইন খেলে কোন সাহসে?”

নিজের মতি ভ্রমের কথা মাথায় আসতে থমকে যায় সে।আসলেই তো কোন সাহসে এই অকাজটা সে করলো?মাথাটা এখনো কেমন ধরে আছে।আরশাদ উঠে দাঁড়ালো বিভ্রান্ত খুশবুর পানে তাকিয়ে চলে গেল কিচেনে এবং লেবুর শরবত নিয়ে ফিরলো সে।

” এটা খাও।”

” না খাব না।”

” আমাকে খাবে?”

” কি!”

” কিছু না।”

আরশাদ শরবতের গ্লাসটা ঠেসে ধরলো খুশবুর মুখে।ছেলেটার রাগান্বিত কার্যক্রম ঠিকি ধরতে পারলো খুশবু।

” আরশাদ রেগে আছেন?”

” আছি তো।কোন সাহসে ওয়াইনের বোতলে হাত দিলে?”

” আমার আসলে হুশ ছিল না।একা ঘরে ছিলাম চিন্তায় আমার পাগল পাগল লাগছিল ক্ষুদাও বেড়েছে তাই কিচেনে গেলাম।ওয়াইনের বোতল দেখে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো,এসব খেলে নাকি চিন্তা দূর হয়।ব্যস আর কিছু জানি না।”

” জানো না?আমার শরীর দেখে বুঝতে পারছো না কি করেছো তুমি।এই রুমের হালচাল দেখো একবার।”

জিভে কামড় বসালো খুশবু।লেবুর শরবত শেষ করে আরশাদের পিঠে বুকে নজর ঘুরালো।

” আরশাদ বেশি চোট লেগেছে তাই না?”

“তোমার চুনোপুঁটি শক্তি আমার কিচ্ছু করতে পারবে না”

খুশবু চুপ হয়ে যায় আরশাদের রাগি রাগি ভাবটা এখনো কাটেনি।

” আমরা কাল সকালে বাংলাদেশ যাব।তোমার অনেক কিছু কেনা বাকি দ্রুত শাওয়ার সেরে এসো বের হতে হবে।”

দেশে যাওয়ার কথা শুনে থমকে গেল খুশবু।মা বাবার কথা মাথায় আসতে আবেগে আপ্লুত সে।কিন্তু দেশে যাওয়ার পর কোন সত্যের মুখোমুখি হবে?
.
খুশবু কিছু বিষয় লক্ষ করেছে আজ।
আফরোজের সেই দোয়ায় ভরা আদুরে হাত দুটো দিয়ে খুশবুর মাথায় হাত বুলালেন না।কেমন যেন বিরক্তিতে ঘেরা দায়সারা ভাব।সবটা খুশবুর নজরে এলো মুখ ফুটে যদিও কিছু বলতে পারলো না।প্লেনে নিজের নির্ধারিত আসনে বসে চিন্তায় মগ্ন মেয়েটা।আরশাদ খুশবুর হাত চেপে ধরে,

” জান কী ভাবছো?”

” মা আমার সাথে কোন কিছু নিয়ে রাগ?তিনি কেমন যেন আচরণ করলেন।”

” না না।মমের কর্মস্থলে কিছু ঝামেলা চলছে তো তাই আরকি উনি খুব চিন্তিত।”

অনায়াসে মিথ্যা বললো আরশাদ।সে চায় না ফ্লুজি সে রাতের ঝামেলার কথা জানুক।জেনে কি হবে?শুধু শুধু মন খারাপ করা ছাড়া কোন উপায় তো আর নেই।
.
রাতের রান্না চুলায় বসিয়ে টিভি দেখতে বসলেন অনিমা।একা একা ঘরে এখন আর ভালোলাগে না।যদিও একা থাকা তার অভ্যস হয়ে গেছে।মাঝে মাঝে মনে হয় বাহারুল হক ঠিকি বলেছেন মেয়েকে তিনি দূরে পাঠাবেন না।একমাত্র মেয়ে কী করে পারবেন দূরে সরাতে?আবার আরশাদের আদর যত্নে মুড়ানো খুশবুর কথা ভেবে নিজের একাকিত্বকে বুড়ো আঙুল দেখান।
ডোর বেলের শব্দে টিভির রিমোট রেখে উঠে এলেন তিনি।নিশ্চয়ই বাহারুল হক এসেছেন।তবে আজ এত তাড়াতাড়ি কেন?দরজা খুলে চমকে গেলেন অনিমা।শিউরে উঠলো আর সমস্ত দেহ।অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে পিছিয়ে গেলেন দু’কদম।দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে খুশবু হাসলো। আজ যে তারা দেশে আসবে এই কথা কাউকে জানানো হয়নি।সম্পূর্ণ ব্যপারটা সারপ্রাইজ হিসেবে রেখেছে তারা।

” আমার মা, আমার কলিজা তুই!”

” কেমন আছো আম্মু?”

খুশবু জড়িয়ে ধরলো তার মা’কে।মা মেয়ের কান্নায় কোনঠাসা হয়ে দাঁড়ালো আরশাদ।

” আমি যে এসেছি কারো কি চোখে লাগেনি?”

অনিমা আরশাদকে বুকে জড়ালেন।মেয়েকে ফিরে পেয়ে সারা বাড়ির যেন প্রাণ ফিরলো।মা’কে ছেড়ে খুশবু সারাটা ঘর ঘুরলো।হ্যাঁ সবটাই আগের মতো আছে তার চিরচেনা রুম বারান্দা কোন কিছুর সাজসজ্জা পালটায়নি।অথচ সময় পাল্টেছে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব পাল্টেছে।
.
রাতের খাওয়া শেষে আজ আর আড্ডা দেওয়ার ধৈর্য নেই খুশবুর।টানা জার্নি শেষে এখন শুধু ঘুমের প্রয়োজন।অনিমা রুমটা পরিষ্কার করে খুশবুকে ঘুমাতে পাঠালেন।আরশাদ বেশ কিছুক্ষণ বাহারুল হকের সহিত আলাপচারিতা করলো।কিছুক্ষণ বাদে আরশাদ নিজেও কক্ষে এলো।ভেবেছিল খুশবু হয়তো ঘুমে কিন্তু না মেয়েটা জেগে আছে।সিলিংএ চোখ রেখে ভাবনায় মত্ত মেয়েটা।

” ফ্লুজি কী ভাবছো?”

” সময় অপচয় হচ্ছে আরশাদ।বাবা মাকে নীরার কথা জিজ্ঞেস করা উচিত।”

” এখনি? ”

” হুম।”

” মোটেও না।অতীত টানলে নিশ্চিয়ই এমন কিছু হবে না তুমি স্থির থাকবে না তোমার বাবা মা।এটা স্বাভাবিক কোন ইস্যু নয় তাই এত তাড়াহুড়োর দরকার নেই আগামীকাল সময় পরিস্থিতি বুঝে যা করার করবে।”

” না না আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।আমি আর পারবো না।সমাধান আমি চাই।”

” অধৈর্য হলে চলবে না।”

আরশাদ খুশবুকে টেনে কাছে আনে।গায়ের উপর কাঁথা জড়িয়ে ঘুমাতে ইশারা করে।মেয়েটার মাথায় চলতে থাকা এত দুশ্চিন্তার আনাগোনা আরশাদ ভালোভাবেই বুঝতে পারে।কিন্তু সে চায় না তার ফ্লুজি এখন এসব নিয়ে ভাবুক জীবন যেভাবে চলছে চলতে থাকুক।

অন্ধকার মাড়িয়ে আলোর দেখা মিললো।বহুদিন পর বাংলাদেশের সকালটা দেখে মনটা ভরে যায় খুশবুর।চিরচেনা ছন্দ ফিরে এসেছে জীবনে।

সকালে নাস্তার টেবিলে সবাই এক সঙ্গে নাস্তা সারলো।নাস্তা শেষে অনিমা চা আনলেন।খুশবু তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,

” বাবা আমার কী কোন জমজ বোন আছে?”

বাহারুল হক অবাক হলেন।হাত থেকে চায়ের কাপ সরিয়ে বলেন,

” হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”

” জিজ্ঞেস যখন করেছি এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন না কোন কারণ আছে তাই না?”

” আমি তোমার প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।”

” তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?আমার প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ নাকি না তা অন্তত বলো।”

” না নেই তোমার কোন বোন।”

বাবা মেয়ের তর্ক অনিমা নিরবে দেখলেন।খুশবু এর আগে তাকেও এমন প্রশ্ন করেছিল কিন্তু মেয়েটার মাথায় হঠাৎ এসব ঘুরছে কেন?অনিমা খুশবুর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুড়েন।

” তোর মাথায় কি ভূত ঢুকলো বলতো?আমাকেও ঘুরে ফিরে একই কথা জিজ্ঞেস করিস।”

খুশবু প্রত্যুত্তর করলো না।দ্রুত নীরার ছবি নিয়ে দেখালো বাহারুল হককে।বাহারুল হক স্কিনে নজর রাখতে দেখতে পেলেন খুশবুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি দেখতে হুবহু তার মতো।বাহারুল হক থমকে গেলেন দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লেন দ্রুত।অনিমা উত্তেজিত হলো।আরশাদের পানে তাকিয়ে বলে,

” এই মেয়েটা কে?”

” নীরা।”

” তার চেহারা আমার মেয়ের মতো কেন?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।খুশবুর বাবা তুমি বলো এই মেয়েটা কে?”

” কেউ না অনিমা।তুমি এসবে কান দিও না।”

” কান দেব না মানে?এই মেয়েটা কে?আমার খুশবুর মতো দেখতে কেন?”

বাহারুল হক সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালেন আরশাদের পানে।তার মেয়ের মাথায় এসব নিশ্চয়ই আরশাদ ঢুকিয়েছে!আরশাদ অনিমা এবং বাহারুল হক দুজনকে নিরবে জহুরি চোখে পরখ করলো এবং আদি অন্ত ভেবে যা বুঝলো এই রহস্যের সমাধান বাহারুল হকের কাছেই আছে।

” আমার কাজ আছে আমি গেলাম।আর খুশবু এসব মাথা থেকে ঝেরে দাও এই মেয়েটা কে আমি এবং তোমার মা কেউ জানি না।”

বাহারুল হক পালিয়ে বাঁচতে চাইলেন কিন্তু খুশবুতো ছাড়ার পাত্রী নয়।দেশে আসার মূল উদ্দেশ্য নীরার পরিচয় খুঁজে বের করা সেখানে বাহারুল হকের এড়িয়ে যাওয়া সে কি এতটা সহজে মানবে?

” আব্বু কোথাও যাবে না।আমার প্রশ্নের জবাব আমি চাই নীরা মেয়েটা কে?”

” বললাম তো জানি না।”

আরশাদ উঠে দাঁড়ালো।অভয় দিয়ে বলে,

” আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?সত্যটা প্রকাশ করুন।সত্য লুকিয়ে থাকার নয় একদিন না একদিন প্রকাশ পাবেই।”

” আমার মেয়েকে তুমি উস্কে দিয়েছো তাই না?”

” একদমি না।যা হয়েছে যা হচ্ছে এসব তার জানা জরুরি।আপনি ভয় পাবেন না খুশবুর যেকোন বিপদ আপদে আমি পাশে আছি।”

বাহারুল হক ঢোক গিললেন।অনিমার ঝাপসা চোখ এখনি তাকে দূর্বল করে দিচ্ছে সত্যটা জানার পর কী হবে?যা হবার হবে এখন আর লুকিয়ে রাখার সময় নয়।বাহারুল হক বলেন,

” অনিমার সাথে আমার বিয়ের আট বছর চলছিলো তখনো আমাদের ঘরে কোন সন্তান নেই।অনিমার প্রেগ্ন্যাসির ২ মাস ৩ মাসে তিনটা বাচ্চা নষ্ট হয়।সবাই বলছিল আমি যেন দ্বিতীয় বিয়ে করি এবং অনিমাকে তালাক দি।আমি এত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।মূলত নেওয়ার সাহস করিনি।আমি একটি এনজিওতে চাকরি করতাম।আমার আব্বা আম্মার সাথে ঝগড়া করে অনিমাকে নিয়ে চলে আসি চট্টগ্রামে।সেখানে অনিমাকে নিয়ে নতুন বাসায় উঠি।ভাগ্যক্রমে সাত মাসের মাথায় অনিমা কনসিভ করে।সেইদিনের খুশি আর ধরে রাখতে পারিনি।একটা সন্তানের আশায় যত যা করতে হয় সব করেছি।অনিমাকে চোখে চোখে রেখেছি বাড়ির কাজ করতে আলাদা কাজের লোক রেখেছি।সব মিলিয়ে আট মাস পেরিয়ে গেল।একদিন ডাক্তারের চেকাপ সেরে আসার পথে আমাদের রিক্সায় পেছন থেকে ট্রাক ধাকায় দেয়।অনিমা ছিটকে পড়ে রাস্তায়।মাঝ রাস্তায় পড়ায় অনিমার উপর দিয়ে চলন্ত সিএনজির চাকা উঠে যায়।এরপর কি হয় তা না বলি।আশা করি বুঝতেই পারছো তোমরা।সেই বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না অনিমা তখন জীবন মরানের সন্ধিক্ষণে।বাচ্চার জন্য অনিমা যে পাগল হয়ে উঠবে আমি জানতাম।কি করবো তখন ভেবে পেলাম না।অনিমার জ্ঞান ফিরলে সে আমাদের সন্তান দেখতে চায় আমি এবং নার্সরা মিথ্যা বলে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম।
সেদিন রাতে একজন আয়া আমাকে জানালো যেদিন অনিমাকে হসপিটাল ভর্তি করা হলো সেদিন রাতে সেই হসপিটালে সিজারে এক দম্পত্তির নাকি জমজ বাচ্চা হয়েছে দরিদ্র পরিবারে তারা একটা বাচ্চা মানুষ করতেই হিমশিমে পড়বে তাই তারা বাচ্চা বিক্রি করতে চায়।ব্যস আমি আর নয় ছয় না ভেবে লক্ষ টাকার বিনিময়ে মেয়েটাকে কিনে নিয়েছিলাম।যেহেতু আমি চট্রগ্রাম একাই ছিলাম তাই এই তিক্ত সত্যটা কেউ জানলো না।শুধু আমি সবটা জেনেও ভুলে গেলাম খুশবুর জন্মদাতা পিতা আমি নই।

চলবে….
গ্রুপে জয়েন হচ্ছেন না কেন হুম?🙁

আসসালামু আলাইকুম পাঠক।গল্পের ছোট্ট গ্রুপে আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ..
🔺গ্রুপ লিংক-https://facebook.com/groups/764407025608497/
🔺আইডির লিংক-https://www.facebook.com/profile.php?id=61555546431041

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here