একটি_সাঁঝরঙা_গল্প #তানিয়া_মাহি #পর্ব_০৩

0
260

#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_০৩

বাড়ির সবাই হাসপাতালে পৌঁছেছে অনেকক্ষণ। জাভেদ সাহেবের হাতের বেশ খানিকটা অংশ কে*টে গিয়েছে। ছয়টা সেলাই পড়েছে সেখানে। নিশো আর আবির মিলে জাভেদ সাহেবকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল। বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে রাবেয়া বেগম ফালাককে নিয়ে চলে এসেছে সেখানে। বাড়িতে থাকতে মোটেও ভালো লাগছিল না তাদের। চিন্তা হচ্ছিল খুব।

জাভেদ সাহেব অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সামনের স্টলে বসেছিল চা খেতে। সেখানেই বসে চেনা-পরিচিতদের সাথে আড্ডায় বেশ জমে উঠেছিল সময়টা। বাড়ি ফেরার কিছু মুহূর্ত পূর্বে হঠাৎ তিনজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি, হাতাহাতি এরপর বাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় দৌঁড়ে দৌঁড়ে দা, বটি, লাঠি যা পেরে এনে মারা*মা*রি শুরু করে দিয়েছিল। দুই পক্ষকে থামাতে গিয়েই মূলত উনার এই খেসারত দিতে হলো।

সেলাইয়ের পর কী কী করতে হবে সেটা ডাক্তার সাহেব বুঝিয়ে দিলেন সবাইকে। ডাক্তারের কথায় এটা স্পষ্ট যে, জাভেদ সাহেবকে কড়া সতর্কতার সাথে অন্তত দুই, তিন সপ্তাহ কাটাতে হবে।

জাভেদ সাহেবকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেতেই নিশো বাহিরে গেল একটা গাড়ি ডাকতে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরেও এলো। চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলল,“কাকা, গাড়ি এসেছে। বাসায় যেতে হবে চলুন।”

জাভেদ সাহেব বেডে বসে ছিলেন। এতক্ষণ ভয়ে,অসুস্থতায় কাউকে খেয়াল করতে পারেননি। নিশোকে দেখে মৃদু হেসে বললেন,“আমার জন্য খুব কষ্ট হয়ে গেছিল তাই না রে, বাপ?”

নিশো মাথা নিচু করল। নরমগলায় বলল,“এরকম একটা পরিবেশ, চিন্তা হবে না? ভয় পেয়ে গেছিলাম একটু।”
“ভালোবাসা আছে দেখি আমার জন্য।”

নিশো এবার মাথা তুলল। চোখে মায়া, সহানুভূতি, অভিমান ফুঁটিয়ে বলল,“আমার দাদা আপনাকে ত্যাজ্য করছিল, বাপ সম্পর্ক ছিন্ন করছিল আমি করি নাই। র*ক্তের আমি আপনার। ওদের ভাগ্য ভালো ওই সময় আপনার ছেলে বা ভাইয়ের ছেলে ছিল না। যদি থাকতো তাহলে লা*শ পরে যেত।”

জাভেদ সাহেবের ভেতর থেকে কেমন প্রশান্তির হাসি বেরিয়ে এলো। ভরসা করেন তিনি নিশোকে। ভালোও বাসেন অসম্ভব। ছেলেটা এত ভালো যে ভালো না বেসে থাকা যায় না তবুও কেন যে ওর বাবা এমন করে বুঝে পান না তিনি।

হাত বাড়িয়ে নিশোকে কাছে ডাকলেন। নিশো গিয়ে পাশে বসতেই জাভেদ সাহেব তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,“সবটুকু ভালো তোর সাথে হোক, বাপ। আমার দোয়া সবসময় তোর জন্য থাকবে।”
____

হাসপাতাল থেকে সবার বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় এগারোটা। রাবেয়া বেগম জাভেদ সাহেবকে রুমে বসেই তুলে খাওয়াচ্ছেন। নিশো আবিরের সাথে কথা শেষ করে তার রুম থেকে বেরিয়ে বাড়ির সামনের দরজার নিকট চলে এসেছিল নিজের রুমে যাওয়ার জন্য। পিছনে ফালাকের ডাকে দাঁড়িয়ে গেল সে। পিছনে তাকাতেই দেখতে পেল ফালাকের হাতে বড় একটা ব্যাগ।

ফালাক সামনে এসে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলল,“এটা একটু সাথে নিয়ে যান। ”

নিশো ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো, “কী আছে এতে?”
“রুমে গিয়ে খুলে দেখবেন।”
“বলো নইলে আমি নিচ্ছি না।”
“ভয় নেই আপনাকে উড়িয়ে দিতে বো*মা রাখিনি ব্যাগে। আপনার সাথে শত্রুতা নেই।”
“তাহলে বললে কী সমস্যা?”
“উফ। এখানে কিছু ফল আর শুকনো খাবার আছে। আমি সন্ধ্যা পর ইলেকট্রেশিয়ানকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। বাসায় তো দুটো ফ্রিজ ছিল তাই একটা আপনার ওখানে পাঠানো হয়েছে। এখন থেকে একটু সময়মত খাওয়া দাওয়া করবেন। এবার ব্যাগটা নিন। ”

নিশো দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল৷ ব্যাগটা হাতে না নিয়েই বলল,“আমাকে নিয়ে তোমার এত ভাবতে হবে না,ফালাক। আমার ছন্নছাড়া জীবনে আর কিছুই সুষ্ঠুভাবে বা নিয়মমাফিক চলবে না। থাকতে দিয়েছ এটাই অনেক৷ এত আতিথেয়তা করতে হবে না৷ শেষে দেখবে মাথায় চেপে বসেছি।”

নিশো আর দাঁড়ালো না। দুই, তিন কদম এগুতেই ফালাক পেছন থেকে আবার ডাকলো। বলল,“এগুলো মা আপনার জন্য গুছিয়ে রেখেছিল। মা আপনাকে নিয়ে চিন্তিত। এখানে থাকবেন কিছুদিন, তিনি চান আপনার যেন কোন অসুবিধে না হয়। মা নিজেই আমাকে বলেছিল বাসার পুরোনো ছোট ফ্রিজটা আপনার ওখানে দিতে।”

নিশো জিভেতে কামড় খেল। সে ভেবেছিল ফালাক নিজে থেকে করছিল এসব। অস্বস্তি হচ্ছিল তার। ফালাকের মা এসব করেছে শুনে একটু শান্তি পেল সে। পিছনে ঘুরতেই দেখল ফালাক আর দাঁড়িয়ে নেই। ব্যাগটা নিয়ে হেঁটে চলেছে রান্নাঘরের দিকে৷ নিশো এক প্রকার দৌঁড়ে এসে ফালাকের হাত থেকে ব্যাগটা নিতে চাইলো। ফালাক ব্যাগটা টেনে নিশোর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে নিশোর দিকে তাকালো।

“কী চাই?”
“ব্যাগটা দাও।”
“আপনি বলেছেন আপনার জন্য এ বাড়িতে যেন কেউ না ভাবে। থাকতে দিয়েছি এটাই অনেক৷”
“ইশ, ভুল হয়ে গেছে। আমি ভেবেছি এসব তুমি করছো।”

ফালাকের চোখ দুটো বড় বড় হলো। তেজে উঠে বলল,“সামনে আসবেন না আপনি আমার।”

নিশো ব্যাগটা নিয়ে বলল,“মায়ের অনুপস্থিতিতে চাচির ভালোবাসায় মায়ের আদর খুঁজি। এটা আর ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। এই একটা জায়গায় আমার আত্মসম্মান দেখাতে ইচ্ছে করে না।”

নিশো ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। যতটুকু সময় তাকিয়ে প্রিয় মানুষের যাওয়া দেখা যায় ততটুকু সময় ধরে দেখলো ফালাক। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে নিজেও প্রস্থান ঘটালো। আবিরের রুমের দরজায় গিয়ে নক করল সে। আবির দরজা খুলে বোনকে দেখে বলল,

“এত রাতে! কিছু বলবি?”
“হ্যাঁ। কালকে আমার কিছু পার্সেল আসবে। কুরিয়ারের ওখানে নিয়ে যাবি আর নিয়ে আসবি।”
“তোকে?”
“হ্যাঁ। ”
“ফ্রি হয়ে আমি এনে দিব, তোর যেতে হবে না।”
“অনেককিছু আসছে৷ দেখেশুনে আনতে হবে।”
“আচ্ছা দেখা যাবে৷ রাত হয়েছে। ঘুমাবি যা।”
“হুম।”

ফালাক আবিরের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে মা-বাবার রুমে উঁকি দিল। রোজকার অভ্যেস তার এটা। বাবা-মা প্রতিদিন ঘুমের আগে আড্ডায় বসে যায়৷ কী সুন্দর করে হাসে দুজন! আজ এত বড় একটা দূর্ঘটনার পরও রাবেয়া বেগমের মন ভালো করতে জাভেদ সাহেব কত কথা বলে যাচ্ছেন! মুচকি হাসলো ফালাক। প্রস্থান করল বাহির থেকে৷ নিজের রুমে এলো। হঠাৎ আবিরের বলা কথায় সুক্ষ্ম চিন্তার ভাজ দেখা দিল ফালাকের কপালে। আবির রেগে আবার কিছু করবে না তো যাদের জন্য তাদের বাবার এমন অবস্থা!

প্রায় একঘণ্টা সময় ব্যয় হলো। ঘুম আসছে না ফালাকের। বিছানা থেকে উঠে বসলো। ফোনের ওয়ালপেপারে থাকা মায়ের সেই নব্বই দশকের ছবি দেখে মৃদু হাসলো সে। হঠাৎ মাথায় কিছু একটা চেপে বসলো। বাচ্চামি করতে মনটা সায় দিল। বিছানা ছেড়ে সোজা আলমারির দিকে চলে গেল সে। আলমারি খুলতেই ভেতরে তিনটা তাক এবং পাশে কাপড়ের হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা শাড়ি দেখে মুচকি হাসলো। বেছে বেছে আকাশি রঙের একটা পাতলা, নরম শাড়ি বের করে গালে চেপে ধরল। ইশ, শাড়িটায় যেন ‘মা, মা’ গন্ধ লেগে আছে। শাড়িটা রাবেয়া বেগমের। অতি পছন্দের হয়ে যাওয়ায় মায়ের থেকে শাড়িটা নিয়ে নিজের কাছে রেখেছিল সে। শাড়িটা দু বছর আগে পরেছিল একদিন। মনকে প্রশ্ন করল- এই মাঝরাতে নব্বই দশকে চলে যেতে চাইলে কি খুব বাচ্চামি করা হয়ে যাবে? মায়ের ঘুম ভেঙে গেলে রুমের দরজায় এসে তাকে গায়ে শাড়ি জড়ানো, চোখে কাজল, দুইপাশে বেণী আর হাতে চিকন ফিতার ঘড়ি দেখলে কি তাকে ‘পাগলী মেয়ে’ সম্বোধন করবে?

সব ভাবনা পিছনে ফেলে নিজের মন ভালো করতে শ্রম দিতে শুরু করল ফালাক। শাড়ি কোনমতে ঠিকঠাক পরতে পারলো কিন্তু চুল নিয়ে ঝামেলায় পরতে হলো তাকে। হাটু অবধি চুল এখন আঁচরে জট ছাড়াতে হবে। চুলের দিকে তাকাতেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।

চুলের পিছনে গুনে গুনে পঁচিশ মিনিট দিতে হলো তার। সবশেষে সুন্দর দুইটা লম্বা বেণীর সৃষ্টি হলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসলো। মায়ের মতো রূপবতী লাগছে তাকে। বিড়বিড় করে বলল, “মা বোধ হয় আমার বয়সী যখন ছিল তখন এরকমই দেখতে ছিল। বাবা বোধ হয় মায়ের ওই নিষ্পাপ চেহারা দেখেই বিয়ের জন্য পাগল হয়েছিল।”

মাথার দুই বেণী ধরে নাড়তে নাড়তে সারা রুমে পায়চারি করতে থাকলো সে। ভাবলো, আচ্ছা এই সাজে তাকে যদি নিশো দেখতো তাহলে কি প্রেমিকা বানানোর কথা ভাবতো? প্রেমিকাকে নিজের করে পেতে বেকারত্ব ঘুচিয়ে কিছু করতে উঠেপড়ে লাগতো? একটা বেকার ছেলের ঠান্ডা মেজাজের প্রেমিকা থাকা দরকার। যার বয়সটা তার মতোই অল্প হবে। যেন পরিবার থেকে বিয়ের চাপ না দিতে পারে। প্রেমিকা যেন সেই নারীর মতো প্রেমিককে সফল হতে সাহায্য করতে পারে যে নারী একজন সফল পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী পরিচয় পায়।

ফালাক হাতের ঘড়িতে সময় দেখলো। দুইটা বাজতে চলেছে। এখন না ঘুমোলে সকালে একদম উঠতে পারবে না সে। দিনে অনেক কাজ আছে তার। এই সময়ে আর শাড়ি খুলতে ইচ্ছে হলো না একদমই। আয়নার সামনে এসে নিজেকে আরেকটাবার দেখে নিল। মৃদু হেসে নিশোকে কল্পনা করে বলল,

“আমার মতো সুন্দর, গুণবতী মেয়ে আপনার প্রেমিকা হোক। যে রাত-বিরেতে শাড়ি পরে, কাজলে চোখ ডুবিয়ে আপনাকে চমকে দেবে। আপনার ঘুম ভাঙলে চোখ ডলতে ডলতে আধ-ঘুমো চোখে তাকে দেখবেন আর বলবেন ‘আমি জিতেছিইইই।’।

#চলবে……..

রেসপন্স করবেন সবাই ❤️

পেইজঃ Bindas Life ✅ ফলো করে রাখুন ।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here