একটি_সাঁঝরঙা_সন্ধ্যা #তানিয়া_মাহি #সূচনা_পর্ব

0
767

“আমার বোনরে বাজারের মেয়ে মনে হয়? বিয়ের আগেই ক্যান রুমে নিয়ে যাইতে চেয়েছিস? তোর বোনরে আগে আমার সাথে রুমে পাঠায় দে। লইচ্চা শা*লা।”

কথাগুলো বলেই বোনের হবু বরকে টানা তিন চারটা থাপ্পড় দিয়ে ক্ষান্ত হলো নিশো। আশেপাশে লোকজন জড়ো হয়ে গেল। তোয়া একপাশে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে।

জাফর সাহেব নিজের সম্মানহানি চুপচাপ দেখতে পারলেন না। অনেক কষ্টে একটা বড়লোক পরিবার যোগাড় করেছিলেন মেয়ের জন্য। মেয়ের হবু জামাইয়ের সাথে এরকম যথেচ্ছাচারী ব্যবহার মেনে নিতে পারলেন না। এতে যে মেয়ের বিয়েটা ভেঙে যাবে। উক্ত স্থানে এগিয়ে গেলেন তিনি। মানুষের সামনে নিশোর গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন।

তোয়ার হবু বর আসিফের দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বললেন,“বাবা, আমি ওর হয়ে মাফ চাইছি। তুমি প্লিজ মাফ করে দাও। তুমি এই ঘটনার জন্য বিয়েটা ভেঙে দিও না, বাবা।”

আসিফ রাগে ফসফস করছে। তার বাবা রাজিব সাহেব তেড়ে এসে ছেলের হাত খপ করে ধরে জাফর সাহেবের দিকে কড়া নজর নিক্ষেপ করে বললেন,“বিয়ের জন্য রিং পরাতে এসেছিলাম আপনার মেয়েকে। আপনার বাড়িতে এমন উদ্ভট, অশিক্ষিত, গুন্ডা একটা ছেলে আছে বলেননি তো! এত মানুষের মাঝে আমার ছেলের গায়ে হাত তুললো এরপরও আমি আমার ছেলেকে এখানে বিয়ে দেব? নো, নেভার।”

আরও কিছু কথা শুনিয়ে ছেলেপক্ষ নিজেদের রিলেটিভদের নিয়ে জাফর সাহেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। পরিবেশ নিশ্চুপ। বাড়ির মানুষগুলো একেএকে বেরিয়ে যেতে শুরু করল। জাফর সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। নিশো মাথানিচু করেই বাবার দিকে অগ্রসর হলো। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই জাফর সাহেব তড়িৎ গতিতে উঁঠে দাঁড়ালেন। কড়া মেজাজে বললেন,

“আজকে থেকে এ বাড়িতে থাকার আয়ু তোমার শেষ। এতদিন খাইয়ে, পড়িয়ে কালসাপ মানুষ করেছি আমি। কিছু করার মুরদ তো নেই, বোনের বিয়েটাও ভেঙে দিলে। আজকের পর থেকে তোর মুখ আমি দেখতে চাই না। এখনই এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি নইলে আমার ম*রামুখ দেখবি।”

বাবার কথায় থমকালো না নিশো। নিজেও কঠোর গলায় বলল,“তোয়াকে হোটেলে ডেকেছিল চৌদ্দ তারিখে। ও নিজের সম্মান নিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছে। কাউকে বলতে পারছিল না সাহস করে। আমাকে বলেছে ও। ওরকম একটা ছেলের সাথে কীভাবে বিয়ে দিচ্ছিলেন আপনি?”

“রূম্পা, তোমার ছেলের অশ্লী*ল কথাবার্তা বন্ধ করতে বলো। বাড়ির আর কোন অন্যা*য় করতে পারছে না, বাপের সম্মান কীভাবে ডুবানো ভাবতে ভাবতে এই রাস্তা বের করেছে ও।” কথাটা বলেই নিশোর হাত চেপে ধরলেন তিনি। টেনে বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত নিয়ে এলেন।

তোয়া এবং রূম্পা বেগম দৌঁড়ে এলেন৷ রূম্পা বেগম ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন,“একবার ছেলেটার কথা শোনো না গো। হতেই পারে আমাদের তোয়ার সাথে যে ছেলের বিয়ের কথা হয়েছিল সেই ছেলেটা আসলেই খারাপ।”

জাফর সাহেব কিছুক্ষণ অকথ্য ভাষায় গালাগা*লি করলেন। কেউ আর কোন কথা বলার সাহস পেল না। তোয়া শুধু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। নিশো মায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিরবে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো। রাস্তায় বেরিয়ে বন্ধু আবিরকে জানালো তার বাড়িতে থাকবে আজ। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় মায়ের চোখের জল আর বোনের ফুঁপিয়ে ওঠা কিছু সময়ের জন্য মাথানিচু করতে বলেছিল তাকে, বলেছিল এ বাড়িতেই থেকে যেতে তারপর কে যেন বলল -প্রতিদিন ম*রার চেয়ে একদিন ম*রা ভালো।
________

“আমি আমার পরিবারের বোঝা। বেকার ছেলেকে কেউ ভালোবাসে না। বাপ-মা একটা ছেলের দায়িত্ব খুব বেশি হইলে টেনেটুনে বিশ বছর পর্যন্ত নিতে পারে তারপর ছেলে কিছু না করলে বাড়িটা আস্তে আস্তে জলন্ত শিখা হইতে থাকে। ওই যে, আলো ছাড়া থাকা যায় না আবার তাপও সহ্য হয় না সেরকম অবস্থায় আছি আমি। আম্মারে না দেখলে কলিজা পু*ড়ে যায় কিন্তু পরিবার বেকার ছেলেরে দেখতে পারে না। পরিবার ছাড়া থাকতে পারি না আবার পরিবারের সবার ব্যবহার বিষের মতো লাগে।”

নিশো একটা চাপা শ্বাস ফেললো। মেকি হেসে বলল,“ধুর, বেকার হয়েও যে নিঃশ্বাস নিচ্ছি, বাড়ির লোক গলা টিপে মে*রে দেয় নাই এটাই সাত পুরুষের কপাল। আম্মায় তো কয় আমারে জন্মের সময় নাকি লবণ খাইয়ে মে*রে ফেললে শান্তি পেত। ঘরে আটাশ-ত্রিশ বছর বয়সী বেকার ছেলে আছে প্রতিবেশীদের কাছে মুখ দেখাইতে পারে না। না পারি বেঁচে থাকতে আর না পারি নিজের মূল্যহীন দেহটারে ঝুঁলিয়ে দিতে। কপাল আমার।”

কথাগুলো বলেই আবিরের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে একটা টান দিল নিশো। হাতের দুই আঙুলের মাঝে সিগারেটটা রেখে আকাশের দিকে মুখ করে ধোঁয়া ছেড়ে বলল,“আল্লাহ ক্যান টাকাওয়ালা বাপের ঘরে পাঠাইলো না? সফলতার গল্প সবাই শুনতে চায় আর ব্যর্থতায় মানুষ নাক সিটকায়। ভাই, জীবন, ভাগ্য, বাড়ির মানুষ, প্রেমিকা, সময় সবকিছু আমার সাথে কি গেইমটাই না খেলছে!”

আবির নড়েচড়ে বসলো। স্বর কোমল করে বলল,“সাবিলার সাথে ব্রেকাপ কবে হলো বলিসনি তো?”

নিশো সিগারেটে আবার ঠোঁট ছোঁয়ালো। বলল,“আড়াই মাস আগে। খুশির সংবাদ নাকি যে উচ্ছ্বাস নিয়ে জানাবো? কথায় আছে না, বেকার প্রেমিকের চাকরির সম্ভাবনা যত কমতে থাকে প্রেমিকার বিয়ের সম্ভাবনা আরও বাড়তে থাকে। ”

নিশোর কথায় শ্বাস টানলো আবির। ছাদে বসে খোলা আকাশটা যেন এবার তার কাছেও ভারি লাগছে। নীরব কণ্ঠে শুধালো,

“কান্না পায় না তোর, ভাই? আমার ফ্যামিলি এমন করলে আমি কী করতাম!”

নিশো হো হো করে হেসে উঠল। বলল,“কাঁদব? ধুর ব্যাডা চোখে পানি থাকলে তো চোখে পানি আসবে। ভেতরটা তো পাথর হয়ে গেছে৷ আঘা*তগুলো ভেতরে লাগলে ঠকঠক আওয়াজ হয়, চোখে পানি আসে না।”

খোলা আকাশের নিচে দুই বন্ধুর কথোপকথনের মাঝে চিলেকোঠার দরজা খুলে কেউ ছাদে এলো। আবির পিছনে তাকাতেই কাউকে দেখে বলল,

“ফালাক, তুই! কিছু বলবি?”

ফালাক যার অর্থ সুন্দর আকাশ। এই মেয়েটা একটা সুন্দর আকাশের মতোই তার পরিবারকে একটা গন্ডির মধ্যে রেখেছে। তার জন্যই পরিবারটা যেন একটা ছোটখাটো ফুলশোভিত বাগানের ন্যায় হয়েছে। এখানে সবটা ভালো হয়, সবটা। এই সতেরো বছর বয়সী মেয়েটা পরিবারে সবটুকু মাথায় রাখে।

ফালাক একটু এগিয়ে গিয়ে বলল,
“ভাইয়া তোর বন্ধুকে সাথে নিয়ে খেতে আয়।”
“তুই যা আমরা আসছি।”

“একটু শান্তি হবে খাওয়ার জন্য? ভাত তো জীবনে কম খেলাম না। বাঁচার জন্য প্রচুর ভাত খাওয়া হয়েছে এবার একটু শান্তি খেয়ে ঘুম দিতে চাই।” কথাটা বলেই নিশো ফালাকের দিকে তাকালো।

ফালাক মাথার ওরনা সামনের দিকে বর্ধিত করে নিল। নরমগলায় বলল,“খারাপ সময়ে ভেঙে পড়তে নেই। খারাপ অবস্থা থেকে বের হতে পথ খুঁজতে হয়। ভালো করে খুঁজলে পথ পাওয়া যায় আর সেই পথ ধরে এগুতে হয়।”

নিশো মুচকি হেসে বলল,“জীবনকে তুমি আমার চোখে দেখোনি, ফালাক৷ জীবন জলোচ্ছ্বাসের চেয়েও ভয়ংকর। গিলে নিয়েছে আমাকে এখন শুধু উগড়ে দেওয়া বাকি।”

“থাম তো, আমি এবার বাবাকে বলে তোর কোন একটা ব্যবস্থা করে দেব। এতদিন বলেছি, রাজি হোস নাই। এবার না করলে তোর সাথে আমার সম্পর্ক শেষ। তুই আমার বাড়িতেই থাকবি আজ থেকে।”

আবির কথাটা বলে নিশোর বাহু ধরে দাঁড় করালো। দুজনকে উঁঠতে দেখে ফালাক সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। একবার পিছনের দিকে তাকিয়ে নিশোর আবছায়া মুখটে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলে উঠল,

“আমি আমার চোখ দিয়ে আপনার পৃথিবী, আপনার জীবন কীভাবে দেখব, নিশো ভাই? আপনি তো আপনার নিজের চোখ দিয়েই আমার পৃথিবী কখনো দেখার চেষ্টা করেননি।”

#একটি_সাঁঝরঙা_সন্ধ্যা
#তানিয়া_মাহি
#সূচনা_পর্ব

এটা নতুন গল্প। বেকারত্ব, লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা, পরিবার, প্রণয়, পরিণয় সব মিলিয়ে গল্পটা হবে। আগেই বলছি না কেমন লাগবে, পড়তে থাকুন হয়তো পড়তে পড়তে ভালো লাগবে।

রেসপন্স করবেন সবাই ❤️
নিয়মিত গল্প পড়তে লাইক ফলো দিয়ে সাথেই থাকুন ।।

পেইজঃ Bindas Life ✅ ফলো করুন ।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here