এলোমেলো_হাওয়া #পর্ব_৭ #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

0
334

#এলোমেলো_হাওয়া
#পর্ব_৭
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি

দারোয়ানকে একচোট দেওয়ার পর মনটা আরও বেশি বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে অনিন্য’র। বারবার হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে সম্পর্ক থাকাকালীন তীহা আর তার ছবিগুলো জুম করে করে দেখেছে বারবার। তবুও যেন তৃষ্ণা মিটছিল না। তীহাকে একবার সামনা সামনি দেখার আকুতিতে ছেয়ে গেছিল ভেতরটা। সেই আকুতি মেটাতে কেন যেন ভরদুপুরেই রোদ মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অনিন্য। বের হওয়ার আগ মুহূর্তে মালোতি জিজ্ঞেস করছিল,

“কোথায় যাচ্ছো!”

তার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়েই অনিন্য চলে এসেছে। মালোতি একা একা বাজার করেছে আজ, অনিন্য’র পছন্দের জিনিস রেঁধেছে। নিশ্চয়ই এখন কাঁদবে। কাঁদুক, অনিন্য তাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। তীহাকে হারানোর পর থেকে তার মনটা যে বড্ড কাঁদে! সেই কান্না কাউকে বোঝানোর নয়। মনে মনে হিসেব কষে তীহাদের বাড়ির সামনে এসেছে অনিন্য। আজ তো জামাইসহ এবাড়িতে আসার কথা তার। যদি আসে,তবে একনজর দেখা হলেও হতে পারে। সেই আশায় ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষারত অনিন্য শেষতক যখন তীহার দেখা পেল, তখন নিমিষেই দু’চোখে জল ছাপায় তার। সেই জল লুকোতেই আকাশ পানে চেয়ে রইলো সে। তীহার দিকে তাকালেই যে জল গড়িয়ে পড়বে! কিন্তু একটি পুরুষালী কণ্ঠে “তীহার” নামটা শোনামাত্র সে সামনে তাকাল।

____
আদ্র’র ডাকে তীহা পেছন ঘুরতে গিয়ে শরীরের ব্যালেন্স হারায়। এদিকটায় রেলিং দেওয়া নেই, টাকা এবং সময়ের অভাবে রেলিংটা করা হয়নি। এপাশে কেউ আসেও না খুব একটা। আর তীহা এদিকটাতেই গাছ দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে। যাতে কোনো বাচ্চারা চাইলেও ছাদের এইদিকে না আসতে পারে। কয়েক পা এদিক ওদিক হলেই নির্ঘাত তীহা নিচে পড়বে আর নইলে গাছের উপর পড়ে একটা মারাত্মক ব্যথা পাবে। তীহার চোখের কোণায় জল, এখান থেকে পড়ে গিয়ে মরতে পারলেই শান্তি হতো বোধহয়। সেইটাও কপালে লেখা নেই। তার আগে একটা শক্ত হাত তার বাহু চেপে ধরে। নিমিষেই টান দিয়ে একটা উষ্ণ বুকে জায়গা করে দিলো। সেই বুকের মধ্যে কান রাখতেই হৃদযন্ত্রের ধুকপুক টা ভীষণ জোরালো ভাবে শুনতে পেল তীহা। আদ্র’র ভেতরটা কাঁপছে। যদি তীহা পড়ে যেতো! কী হতো!

আদ্র গলায় কাঠিন্য যোগ করে বলল,

“এখানে কেন এসেছো তুমি? কী চাও?মরতে? তাহলে চলো আমি ধাক্কা দিয়ে ফালিয়ে দেই। চলো..”

তীহাকে বুক থেকে টেনে তুলে দু’কাধ ধরে ঝাকি দেয় আদ্র। তীহা হু হু করে কেঁদে ফেলে সেইমুহূর্তে। আদ্র’র মারাত্মক মায়া হয়। মেয়েটা কেন সব ভুলতে পারছে না! পুনরায় তাকে টেনে নিজের বুকের মাঝে জায়গা করে দেয় আদ্র। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে পরম মমতায়। তীহা আদ্র’র বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। আদ্র’র একটুও খারাপ লাগছে না,বরং ভালো লাগছে।তীহা যদি সারাজীবন তার বুকে কাঁদতে কাঁদতে বন্যাও করে ফেলে তবুও তার খারাপ লাগবে না।

একসময় নিজেকে সামলে তীহা মাথা তুললো। অনিন্য কী এখনো আছে! প্রশ্নটা মাথায় বারি দিতেই তীহা মুখ ঘুরিয়ে গলির দিকে তাকাল। কিন্তু নাহ, অনিন্যকে আর কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না।চলে গেছে হয়তো। কিন্তু এসেছিলই বা কেন? আর অনিন্য’র চোখেমুখে এতই বা বিষাদ আঁকা ছিল কেন? সবটা একটা প্রশ্ন হয়ে মাথায় জট পাঁকিয়ে গেল।

পেছন থেকে আদ্র বলল,

“কিছু খুঁজছো?”

তীহা চমকে উঠে বলল,

“না, কিছু না।”

“আমার একটা রিকোয়েস্ট রাখবে?”

“বলুন।”

“আসো, বসি একটু।”

ছাদের যে পাশে রেলিং দেওয়া,ওখানেই সিমেন্ট দিয়ে তিনটি ঢিবি তৈরি করে রেখেছে তীহার বাবা। অবসর সময় যে কেউ গিয়ে যেন বসতে পারে,এই উপলক্ষে। সেখানে গিয়েই দু’জনে বসল। তীহা চুপচাপ হয়ে রইলো। আদ্র খানিকটা সময় নিয়ে ভেতরকার কথাগুলো সাজিয়ে নিলো। তারপর বলতে শুরু করল,

“তীহা,তুমি কী জানো তোমার চাইতেও আরও বড় ধাক্কা খেয়েও মেয়েরা নিজেদের গুছিয়ে নেয়?”

তীহা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল।

“তোমার তো মন ভেঙে দিয়ে একজন চলে গেছে। অথচ এমনও মেয়ে আছে,যারা অবৈধ পাপে জড়িয়ে পেটে সন্তান আনার পর রিয়েলাইজ করতে পারে যে তারা কতবড় ভুল করেছে। এরপর যার জন্য এমনটা হলো সেও অস্বীকৃতি জানায়। তখন ওই মেয়েটার কী হাল হয় একবার ভেবে দেখেছো?”

“কী আর হবে! ফাঁসি দেয় গলায়।”

“উঁহু, সবাই ফাঁসি দেয় না। আমার নিউজ চ্যানেল গুলোয় শুধু ফাঁসি দেওয়া কেসগুলোই ফলাও করে দেখানো হয়। অনেকেই যে এইধরনের জীবন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে লাইফে শাইন করে,তা খুব কমই দেখানো হয়। শোনো তীহা, জীবনটা খুব ছোট তবে লম্বা! যতদিন তুমি বেঁচে থাকবে,মনে রাখবে কিছু না কিছু একটা কারণেই তুমি বেঁচে আছো যা তোমার করা দরকার। যখন তোমার সব কাজ এই পৃথিবীতে ফুরিয়ে যাবে তখনই তুমি মারা যাবে। এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতি অযথা কাউকে বাঁচিয়ে রাখে না। সময় দেয় না। তুমি বেঁচে আছো, অনেক বড় কষ্ট নিয়েও শ্বাস ফেলছো। এর মানে তোমার দ্বারা এখনো অনেক কাজ করানো বাকী!”

তীহা চুপ করে রইলো।

আদ্র ফের বলল,

“যার জন্য তুমি মিনিটে মিনিটে চোখের জল ফেলছো,সে কী তোমার কথা আদৌও ভাবছে তীহা? বলো তো, যদি ভালোবাসতোই তবে কী ছেড়ে যেত তোমাকে? আমি তোমার স্বামী হলেও বন্ধুর মতো গাইড করতে চাই। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে এই সুবিধাটা নাও পেতে পারতে। অন্য কেউ জোর খাটালেও তোমার কিন্তু কিছুই করার ছিল না।”

আচমকা তীহা মেজাজ দেখিয়ে বলল,

“আপনাকে কে বলছে সাধু সাজতে? শরীর চাইলে নিন, আমি তো সামনেই আছি। মানা তো করিনি। করুন যা ইচ্ছা.. কে ধরে রাখছে!”

আদ্র হতাশা মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“আমি এইরকম কিছু মিন করিনি! তুমি একটু বেশিই বোঝো..”

“হ্যাঁ,এখন তো এই কথাই বলবেন।”

“স্টপ! লিসেন টু মি.. আমি রিকোয়েস্ট করব,আমাকে অন্তত একটা চান্স দাও। আমি…আমি তোমাকে তাই দেব যা তুমি পাওনি তীহা।তোমার জীবনটা সাজানোর দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।”

তীহা হোঁচট খেল। এভাবে যদি একবার অনিন্য বলতো! কে বলেছে অনিন্য তার কথা ভাবে না? ভাবে,নিশ্চয়ই ভাবে। অনিন্যকে এক পলক দেখেই তীহা বুঝেছে,সে ভালো নেই। তীহাকে হারিয়ে এখন বুঝতে পারছে। তীহা কী করবে? অনিন্য’র সাথে আবার যোগাযোগ করবে? ফিরে যাবে? তীহা মাথা নাড়ালো। এটা হওয়ার সম্ভাবনা আর নেই! তীহা এখন বিবাহিত। সে চাইলেও কী পারবে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে চলে যেতে? আর অনিন্য,ও যদি আবার মাঝপথে তীহাকে ছেড়ে চলে যায়। ওর-ই বা গ্যারান্টি কী!
তীহার আবার কান্না পাচ্ছে। কেন আজ অনিন্যকে দেখল! কেন এসেছিল সে! কী কারণ! তীহা ফাঁকা ঢোক গিলে কান্নাটাকে দমানোর চেষ্টা করল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“নিচে যাব।”

আদ্র তীহার হাত টান দিয়ে তাকে বসিয়ে দিলো।

“পরে,আমার কথা শেষ হয়নি।”

“আপনি ইদানীং অনেক অধিকার খাটাচ্ছেন!”

“খাটাতেই পারি। আমার বউ তুমি..”

‘আমার বউ তুমি’ কথাটি শোনামাত্র তীহার ভেতরে কী যেন হলো। ভালো লাগলো নাকী খারাপ লাগলো,বোঝা গেল না। একটা মিশ্র অনুভূতিতে ভেতরটা দগ্ধ হচ্ছে। তীহা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

“বলুন, আর কী?”

আদ্র ঠোঁট চেপে হাসলো।

“আমরা হানিমুনে যাবো।”

“কীহ!”

প্রায় আঁতকে উঠে তীহা। পুনরায় দাঁড়িয়ে গেলে আদ্র আবার বসিয়ে দেয়।

“উফ! তুমি এত চমকাও কেন বলো তো! হানিমুনে যেয়ে আর দশজন যা করে,আমরা তা করব না। তোমার মন ভালো করতেই দূরে কোথাও যাচ্ছি। দেখবে ভালো লাগবে। আর যদি তুমি চাও,আর দশজন যা করে তা করতে,তবে আমার কোনো আপত্তি নেই কিন্তু…”

তীহা ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল,

“ছি! কত খারাপ আপনি। ধুর,কথাই বলব না আর। সরুন..”

বলে তীহা হন্য পায়ে ছাদ থেকে নেমে গেল। রেখে গেল মৃদু হাসিতে আছন্ন হওয়া আদ্র’র মুখ। আদ্র মনে মনে বলল,

“তোমাকে স্বাভাবিক জীবনে আসতেই হবে তীহা। এটা আমার চ্যালেঞ্জ!”

____

এলোমেলো পায়ে হাঁটছে অনিন্য। তীহাদের বাড়ি থেকে এখন অনেকটাই দূরে চলে এসেছে সে। তীহাকে দেখতে গিয়েছিল, কিন্তু ফিরে এলো তীহার সঙ্গে আরও একজনকে দেখে। যখন তীহাকে সে বুকে জড়িয়ে নিলো, সেই দৃশ্য! অনিন্য রাস্তায় সজোড়ে লাথি মারলো। পারছে না নিজেই নিজেকে আঘাত করে মেরে ফেলে…
তীহা, তার তীহা আজ অন্য কারো। তার তীহার পাশে রাতে আরেকজন ঘুমোয়। তার তীহাকে সে জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছে চিরতরে।আচ্ছা,যদি সে আবারও ভালোবাসার দাবী নিয়ে তীহার সামনে দাঁড়ায়, তবে কী তীহা চলে আসবে না? নাকী সমাজ আর পরিবারের কথা ভেবে তীহা ফিরিয়ে দিবে তাকে?
অনিন্য একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো। সমাজ বা পরিবার এবার আর কারো পরোয়া করে না সে। সে যাবে,তীহার সামনে ভালোবাসার আকুতি নিয়ে দাঁড়াবে। যদি তীহা আসতে চায়,সবকিছু ভেঙেচুরে তাকে নিয়ে আসবে। আর যদি তীহা না আসতে চায়! যদি তীহা আর না ভালোবেসে থাকে তাকে!
অনিন্য ভাবতে পারছে না। রাগে তার মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। সামনে একটা কারেন্টের বড় খাম্বা পড়ল। সে আচমকা সেই খাম্বায় নিজেই নিজের মাথা বারি দিয়ে ফাটিয়ে ফেলল।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here