এলোমেলো হাওয়া
অলিন্দ্রিয়া রুহি
৫.
মালোতির ঠোঁটের পাশ ঘেঁষে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের কালো দাগ। সোফার উপর বসে মালোতি ফোঁপাচ্ছে ক্রমাগত। অনিন্য তার নিজের রুমে,মালোতির সঙ্গে ভীষণ কাছাকাছি ছিল সে। তখন হঠাৎ করে ফোনে কীসের যেন ম্যাসেজ এলো এবং সেটা দেখামাত্রই তাকে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলে দেয় অনিন্য। টাল সামলাতে না পেরে বেড সাইড টেবিলে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয় ঠোঁট জোড়া।
জানালায় সিংহের ন্যায় বড় থাবা ফেলে ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়ছে অনিন্য। মেঝেতে অবহেলায় পড়ে আছে ভাঙাচোরা ফোনটা। এই ফোনটা কয়েক মিনিট আগেও ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু তীহার পাঠানো ছবির ভার সইতে না পেরে তাকে আছড়ে মাটিতে ফেলেছে অনিন্য। সেই থেকেই ভীষণ বিক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে বসে রয়েছে সে। এত দিনের সম্পর্কের সময় তার হাতটাও ধরতে দিতে চায়নি তীহা, আর আজ অন্য একজন পুরুষের অধর কীনা তার কপাল ছুঁয়েছে! ব্যাপারটা কোনোভাবেই হজম হচ্ছে না অনিন্য’র কাছে। তার ইচ্ছে করছে,এক্ষুনি তীহাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসতে….
তিমিরাছন্ন আকাশের দিকে চেয়ে নিজের রাগটাকে সংবরণ করল সে। মাথা কিছুটা ঠান্ডা হলে বুঝতে পারল, ওই লোকটা তীহার স্বামী! তার তো পূর্ণ অধিকার আছে তীহাকে স্পর্শ করার। অনিন্য হাঁটু মুড়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। কেন সে ওদের ভয়ে তীহাকে দূরে ঠেলে দিলো! কেন করল এমনটা! চাইলেই তীহাকে নিয়ে চলে যাওয়া যেতো এত দূরে… যেখানে সে আর তীহা বাদে কেউ থাকত না। কেউ তাদেরকে আলাদা করতে পারত না! কিন্তু তারা.. তবুও কী তারা পিছু ছাড়তো? যদি সত্যি সত্যি তীহাকে মেরে ফেলতো? অনিন্য’র মাথায় জট পাঁকায়। সে মাথা নিচু করলে একফোঁটা গরম জল হাতের উপর পড়ল। অনিন্য চমকে উঠে আবিষ্কার করল, সে কাঁদছে!
____
“আপনি তো ভীষণ পাজি লোক! এবার শান্তি হয়েছে আপনার?”
চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে প্রশ্ন ছোঁড়ে তীহা। তার চোখেমুখে হাসির ঝিলিক, একটু আগে যে এই মেয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল, তা বোঝার উপায় নেই এখন আর। আদ্র হঠাৎই অন্যরকম কণ্ঠে বলে উঠল,
“খোলাই তো ভালো ছিল। বাঁধতে গেলে কেন?”
“গরম লাগছে আমার। আপনি বুঝবেন না। আপনার তো ছোট ছোট চুল..”
বলে কাবার্ড থেকে একটা থ্রিপিস বের করে বাথরুমে ঢুকে যায় তীহা। যদি খেয়াল করত,তবে হয়তো বুঝতে পারতো তার অপরপক্ষ, যে কীনা দুদিন আগেও ছিল তার অজানা,সে প্রেমে পড়েছে৷ কঠিন প্রেমে পড়েছে…
আদ্র ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। বুকের ভেতর সৃষ্ট আলোড়ন সে ঠিক ঠিক টের পাচ্ছে। কিন্তু আফসোস হয়, এই মেয়েকে কীভাবে বোঝাবে সে কথা! এই মেয়ে আদৌও অতীত ভুলে আদ্র’র সঙ্গে একটি স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে কী? আদ্র তীহার ভালোবাসা চায় না, শুধু চায় তীহা থাকুক। তার থাকুক! আজন্ম একসঙ্গে বাঁধা থাকুক দু’জনে। এত ছোট্ট চাওয়া! তবুও পূরণ হবে কীনা,কে জানে..
____
চাঁদ মিলিয়ে গেছে। মিটিমিটি তারকারাজি শেষরাত পর্যন্ত আলো দিয়ে যাবে। চারিদিক নিস্তব্ধ,নিঝুম। সবাই ঘুমুচ্ছে,উঁহু- হয়তো কেউ কেউ আদ্র’র মতো জেগে জেগে এক রাশ চিন্তায় নিমজ্জিত রয়েছে। পাশেই তীহা বেঘোরে ঘুম। আদ্র’র হুট করেই ঘুম ভেঙে গেছে। তারপর থেকে আর ঘুম আসছে না। কতক্ষণ তীহাকে এক ধ্যানে দেখেছে। দেখার পর থেকেই হয়েছে যত জ্বালা! এখন একটু ছুঁতে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে। ওর ফোলা ফোলা গাল দুটোতে আঙুলের ডগা মেশাতে ইচ্ছে করছে। আঙুল গুলো নিশপিশ করছে রীতিমতো! কী যন্ত্রণারে বাবা! আদ্র ফিসফিসিয়ে উচ্চারণ করল,
“শিট!”
পরমুহূর্তেই বিছানায় উঠে বসল। মনটাকে ঘোরানোর জন্য এলোমেলো নানান চিন্তাভাবনাকে প্রশ্রয় দিলো কিন্তু তাও বিশেষ ফল হলো না। অবাধ্য মনটা ঘুরে ফিরে ওই এক কথাই জপে,
“পাশেই তো শুয়ে,কী হবে একটু ছুঁয়ে দিলে! একটুও তো..কেউ টের পাবে না। তীহাও না..”
খানিকক্ষণ মন মস্তিষ্কের যুদ্ধ চললো রীতিমতো। শেষমেশ আদ্রকে হার মানতে হলো মনের কাছে। সে করুণ চোখ মেলে তাকালো তীহার মুখপানে। মেয়েটার গভীর শ্বাস পড়ছে। আদ্র চোখ সরিয়ে নিলো। আবারও নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা চালালো,কিন্তু এবারও ব্যর্থ হলো। শেষতক সে সিদ্ধান্ত নিলো, একবার, অন্তত একবার তীহাকে ছোঁবে। এতে যদি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়!
আদ্র’র অবস্থা এমন যেন সে কোনো বড় চুরি করতে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ,মাথা ঘুরছে ভনভন করে। এই মুহূর্তে স্ট্রোক করলেও বিশেষ অবাকের বিষয় হবে না সেটি। কপাল দিয়ে ঘাম ফোঁটা ইতিমধ্যেই উঁকি দিয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের নিরবতা, তারপর চোখমুখ খিঁচে একপ্রকার দ্রুত গতিতে তীহার গাল ছুঁতে গিয়ে একটা অঘটন ঘটিয়ে বসে বোকা ছেলেটা। আস্তে ছোঁয়ার বদলে এত জোড়ে ছুঁয়ে ফেলল যে তীহার ঘুম ছুটে গেল। চোখ মেলে তাকাতেই আদ্র’র চোখে চোখ পড়ল। সেকেন্ড তিনেক দু’জনেই থম মেরে বোঝার চেষ্টা করল, আসলে হচ্ছেটা কী! এরপর দুটো ঘটনা ঘটলো। আদ্র ঝড়ের গতিতে হাত সরিয়ে নিলো এবং তীহা আগাম সুনামির সংকেত স্বরুপ চিল্লানি দিয়ে উঠল।
ভ্যাবাচ্যাকা আদ্র দ্রুত তার মুখ চেপে ধরে অপরাধী কণ্ঠে বলে উঠল,
“মাফ চাই, আস্তে চিল্লাও! প্লিজ.. কেউ শুনলে ভাববে টা কী?”
তীহা আদ্র’র হাতের ভেতর কামড় বসিয়ে দিলো। খুব জোরে না,আবার খুব আস্তেও না। আদ্র চট জলদি হাত সরিয়ে নিলো।
“আপনি কী করছিলেন? আমার শরীরে টাচ করছেন কেন?”
“আ..আমি তো… আমি তো মশাটাকে মারার জন্য..”
“মশা? মশারি টানানোর পরও মশা এসে বসেছে আমার গালে?”
আদ্র চোপসানো গলায় বলল,
“কেন,মশারির ভেতরে কী ঢুকতে পারে না নাকী? আরে তুমি তো জানো না,মশাদের কত নিঞ্জা টেকনিক আছে। এরা কয়েল জ্বালানোর পরও বেঁচে থাকে! মশারির এই ছোট্ট ছোট্ট ফুটো দিয়েও কী করে যেন ঢুকে যায়। এসব টেকনিক তুমি বুঝবা না।”
তীহাকে বিভ্রান্ত দেখালো। আদ্র’র কথাগুলো সে বিশ্বাস করল কীনা,ঠিক বোঝা গেল না। ওদিকে আদ্র সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঢোক গিলছে। নিজের অবাধ্য আর বেহায়া মনকে ইচ্ছেমতো গালাগাল করছে। আজ এই ব্যাটার জন্যেই এরকম একটা পরিস্থিতির স্বীকার হতে হলো! নাহ, এই মনকে আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। দেখা যাবে কোনদিন তীহার হাতে মাইর খাইয়ে তবে মানবে।
“আমার আপনার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনি মিথ্যে বলছেন।”
“আমি মিথ্যে বলছি না তীহা.. তোমার গালে মশা বসেছিল। সেটাকে সরাতেই…”
“আচ্ছা,মানলাম। তো এই ভোর রাতে আপনি উঠে বসে আছেন কেন? আমার গালে কখন মশা পড়বে তা দেখতে?”
আদ্র মিনমিন করল। ঠিক কী উত্তর দিবে এবার বুঝতে পারছে না। তীহা মুচকি হাসলো। বলল,
“শুনুন, এসব টেকনিক বাদ দিন। মশার চাইতেও বড় নিঞ্জা টেকনিক তো আপনি জানেন দেখছি! আপনি যেই কলেজের ছাত্র,আমি ওই কলেজের মাস্টার কিন্তু!”
“মা..মানে?”
“আপনি মাত্র প্রেমে পড়েছেন, আর আমি বহু আগেই একজনের প্রেমে পড়ে হাত-পা সব ভেঙে লুলা হয়ে বসে আছি।”
আদ্র’র মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল। সে আর কিছু না বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। তীহাও শুয়ে পড়ল। হঠাৎ বলল,
“আমি আবারও বলছি, আমার তরফ থেকে কবে একটা সুস্থ স্বাভাবিক সংসার পাবেন, আমি জানি না। আমি আপাতত যেই স্টেজে আছি,সেই স্টেজ টাকে উপভোগ করতে চাই একটু। বিরহেও সুখ আছে,যদি তা উপভোগ করতে পারেন। আমাকে দিয়ে যদি পোষায়, থাকুক এই বিয়ে নামক বন্ধন নয়তো ছেড়ে দিতে পারেন আদ্র সাহেব। আমার কোনো অভিযোগ থাকবে না আপনার প্রতি.. সত্যি।”
আদ্র জবাব না দিলেও মনে মনে বলল,
“আমি তোমাকে কোনোদিনই ছেড়ে দেবো না তীহা। বৈধ সম্পর্কের জোর কতটুকু তা বোধহয় তোমার জানা নেই। মনে রেখো,তুমি প্রেমে পড়েছিল,কিন্তু সঠিক ভালোবাসাটা পাওনি। আর সেটাই আমি তোমাকে দেব৷ তোমাকে বোঝাবো,ভালোবাসার শক্তি কতটুকু! ভালোবাসাকে পৃথিবীর কোনো শক্তিই এত সহজে ভেঙে দিতে পারে না।”
(চলবে)
[রেগুলার দেব ইনশাআল্লাহ। তবে এরকম ছোট ছোট পর্ব হবে]