#এলোমেলো_হাওয়া
#পর্ব_৩
লেখিকা- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি
চন্দ্র তারকাবিহীন ম্লান আকাশ। অন্ধকারের বুকে এক ধ্যানে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখজোড়া জ্বালা করছে তীহার। বাহির থেকে তাকে দেখে শান্ত লাগলেও ভেতরটা বিক্ষিপ্তমান। মন বাড়ি বিক্ষোভ লাগিয়েছে যেন,কিছুতেই তাকে শান্ত করা যাচ্ছে না। কিন্তু কেন এত চাঁচল্য মন,তার কারণ বহু অনুসন্ধান করেও ঠাহর করতে পারছে না তীহা। সে হাল ছেড়ে দিয়ে পেছন ঘুরে তাকাতেই চমকে উঠল। আদ্র বারান্দায় পা রেখেছে। তীহা নিজেকে ধাতস্থ করে। ঠান্ডা স্বরে বলল,
“আমি ঘরেই আসছিলাম।”
সে কথার ধার না ধেরে আদ্র খানিকটা কঠিন গলায় বলে উঠল,
“রাত বারোটা বাজে। পাশের বারান্দা থেকে এই বারান্দা দেখা যায়। কেউ যদি দেখে তুমি এত রাতে বারান্দায় বিরহে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো,কী ঘটবে বুঝতে পারছো একবার?”
তীহা মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। অপরাধী কণ্ঠটা ধীর স্বরে নাড়ালো, বলল,
“আমি সরি।”
“এই নিয়ে কতবার সরি বললে! হাতে কামড় দিয়ে সরি, বাহুতে চাপড় মেরে সেই সময়ে সরি বললে, এখন আবার সরি! আমার তো মনে হচ্ছে,তোমাকে না,আস্তো এক সরি’র গোডাউনকে বিয়ে করেছি।”
তীহা আঁড়চোখে তাকাল। লোকটির বাহ্যিক ভাবভঙ্গি কঠোর হলেও তার চোখ হাসছে। তবে কী সে মশকরা করছে তীহার সঙ্গে! তীহা ভেতরে ভেতরে বড় শ্বাস ফেলল। ওর জীবনটাই তো মশকরা হয়ে গেছে। এখন কে মশকরা করল না করল,তাতে কীইবা আসে যায়!
তীহা পুনরায় বলল,
“আমি সরি। যদি মনে হয়, সরি’র গোডাউন নিয়ে ঘোরা সম্ভব নয়, তাহলে ছেড়ে দিতে পারেন। আমার আপত্তি নেই।”
বলেই হন্যপায়ে ঘরের ভেতর চলে গেল সে। রেখে গেল থমথমে একটি মুখ,যে কীনা ভাবছে কেন মেয়েটি নিজেকে দুঃখের সাগরে ডুবিয়ে রেখেছে। কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে!
____
“কাম অন অনি! আমাকে কেমন লাগছে, একটু দেখো না…”
পাতলা ফিনফিনে নাইটি পরে অনিন্য’র ঘরে ঢুকেছে মালোতি। সাদা নাইটির ভেতর দিয়ে শরীরের সমস্ত অঙ্গের ছাপ স্পষ্ট। অনিন্য ক্লান্ত দেহটাকে বিছানায় এলিয়ে রেখেছে। মালোতির এহেন কথায় একবার চোখ মেলে তাকালো। মুহূর্তেই তার ঠোঁটে হাসি খেলে গেল। মেয়েটা কী পরিমাণ নির্লজ্জ! নিজের সম্পদ নিজে থেকেই বিক্রি করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। অবশ্য নির্লজ্জ না হলে কী পতিতা হওয়া যায়! যায় না…
অনিন্য একটা চোখ টিপলো। মালোতি এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
“আমি জানতাম,আমাকে দেখলে তোমার হুশ থাকবে না। আমাকে কাছে না টেনে পারবেই না তুমি…”
“আমার ব্যাপারে সব জানো দেখি!”
“সব না,কিছুটা। তুমি তো আস্তো এক রহস্য! তোমার কোথায় শুরু,কোথায় শেষ- তার কিছুই আমাকে বলোনি।”
“সবকিছু জানলে আগ্রহ কমে যাবে। যতটুকু জানো ততটুকুই ভালো। এবার কী কথাই বলে যাবে,নাকী যে আগুন ধরিয়েছো,তাও কমাবে?”
মালোতি কামনার চোখে তাকালো। ঘরের বাতি নিভিয়ে অনিন্য’র পাশে গিয়ে বসলো।
____
“কী বউ আনলা গো বুবু! এমন ঘরকোণা মেয়ে তো আমি আমার জন্মেও দেখি নাই।”
পান চিবোতে চিবোতে কথাখানা ছুঁড়ে দিলেন নিরুপমা বেগমের একমাত্র ছোট বোন শান্তা বেগম। নিরুপমার কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হলো। সত্য কথাই বলেছে শান্তা। তীহা মেয়েটা কেমন যেন, কোনোদিকে কোনো মনোযোগ নেই। না স্বামীর প্রতি,না সংসারের প্রতি। প্রতি বেলায় ডেকে ডেকে খাবার খাওয়াতে হয়েছে। নিজের প্রতিও মনোযোগ নেই এর! আর সারাক্ষণ মন খারাপ করে রাখে। বিয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত একবারও তার মুখে হাসি দেখেননি তিনি। এর কারণ কী? এই বিয়েতে সে সুখী নয়? তার কী অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে! নিরুপমা বেগম নড়েচড়ে বসলেন। বললেন,
“শান্তা,আমার মনে হয়, আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলছি। আমার ছেলেটাকে সামলে রাখার জন্য এমন একজনের প্রয়োজন ছিল, যে এই পুরো ঘরবাড়ি, সংসার সব নিজের মনে করে সামলে রাখতে পারবে। ওর আব্বা নাই,দু’দিন বাদে আমিও চলে যাবো। তখন কী হবে আমার ছেলের? বউ যদি ভালো না হয় তবে তো আজীবন তিলে তিলে মরতে হবে ওকে। আমি কী ভুলটাই না করলাম! আমার উচিত ছিল আরও খোঁজখবর নেওয়ার।”
“বুবু, সময় এখনো শেষ হয় নাই। তুমি খোঁজখবর লাগাও। আর এই মেয়ে সবসময় মুখ আন্ধার কইরা রাখে ক্যান?”
“তুইও খেয়াল করছোস তাইলে?”
“হ, বিয়া বাড়ি দেইখা কিছু কই নাই। মুখে কোনো হাসি নাই,কোনো আহ্লাদ নাই জামাইর লগে। নতুন বিয়া হইছে,এখন তো তার মহাখুশি থাকার কথা। আবার বিদায়ের সময় এই মাইয়ারে আমি কানতেও দেখিনাই বাপ-মায়ের লইগা। আমি নিশ্চিত, এটার লগে জ্বিন-ভূত আছে।”
নিরুপমা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“রাখ তোর জ্বিন-ভূতের গল্প! ঘটনা সত্যি কিন্তু কারণ অন্য। আর এই অন্য কারণটাই আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। আমার ছেলের জীবন টা এত সহজে ধ্বংস হোক,আমি চাই না রে শান্তা। আমি মরলে ওর যে আর কেউ থাকবে না! ওকে আমি এমন মেয়ের সঙ্গে দেখে যেতে চাই, যে নিজের সবটা দিয়ে ওকে আগলে রাখবে। যদি তীহা এমন না হয়,তাহলে যেভাবে সংসার জোড়া লাগিয়েছি, সেভাবেই সংসার ভেঙে ফেলব। বিয়ে নামক বন্ধনের আগে আমার ছেলে আগে… আদ্র’র কথাই শোনা উচিত ছিল। এই বিয়েটা না দিলেই বোধহয় ভালো হতো।”
নিরুপমা বেগম এক হাতে কপাল চেপে ধরলেন। মাথার ভেতর ঝিনঝিন জাতীয় একধরনের ভোঁতা শব্দ হচ্ছে। যন্ত্রণা বেড়ে হচ্ছে তীব্রতর। শান্তাকে ঘুমাতে বলে তিনি শুয়ে পরলেন।
____
তীহা বিছানায় শুয়ে আছে। তার পরনের ভারী শাড়ি এখনো খোলা হয়নি। সেটা পরেই কোনোরকম গুটিশুটি মেরে সে শুয়ে রয়েছে এক পাশ ফিরে। আদ্র ভ্রু যুগল কুঁচকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ের মতিগতি কিছুই বোঝা যায় না। একেক সময় একেক রকম ভাব ধরে থাকে! আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই মেয়ের মুখে হাসি নামক কোনো চিহ্নের ছিঁটেফোঁটাও নেই। সর্বক্ষণ মেঘযুক্ত আকাশের ন্যায় এর মুখ অন্ধকার, গম্ভীর। এতটুকুন মেয়ের কী এমন কষ্ট! আদ্র’র জানতে ইচ্ছে হয় খুব। চিন্তার গতিপথ টেনে ধরে আদ্র গলা খাঁকারি দিয়ে উঠল। ভাবল, তীহা তাকাবে। কিন্তু না,তীহা যেন শুনতেই পায়নি! আদ্র এবার সরাসরি তীহার নাম ধরে ডেকে উঠল।
“তীহা..”
তীহা ভূত দেখার ন্যায় চমকে উঠে, আদ্র’র দিকে তাকিয়ে হতভম্ব গলায় জবাব দিলো,
“হুঁ।”
“তুমি সবসময় এত চমকে উঠো কেন?”
কোঁচকানো কপাল নিয়ে প্রশ্ন ছোঁড়ে আদ্র। তীহা ঢোক গিলে গলা ভেজালো। সে অনিন্য’র কথা ভাবছিল। অনিন্য’র সাথে প্রথম সাক্ষাৎের কথা, তারপর একটু একটু করে কীভাবে তাদের প্রেমটা গাঢ় হয়ে উঠেছিল, সেইসব সুখ স্মৃতির কথা। তাই হুট করে ডাকটা শুনতে পেয়ে কিছুটা চমকে উঠেছিল সে। তীহার তরফ থেকে কোনোপ্রকার জবাব না পেয়ে আদ্র ছোট্ট দম ফেলে। নাহ, এই মেয়ে পুরোটাই রহস্যে ঘেরা। একে নিয়ে মহা ঝামেলার সৃষ্টি হবে সামনে,নির্ঘাত। এভাবে চলতে থাকলে তার মা যে ক্যাঁচাল সৃষ্টি করবে না- এটা একদমই নিশ্চিত ব্যাপার। আদ্র মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো,একটা মুখোমুখি বৈঠকে বসবে তীহার সঙ্গে। তীহার সমস্যা কী,তা জানবে এবং এর কী সমাধান করা যায়, সেটার চেষ্টা করবে। আপাতত এরচেয়ে আর ভালো সিদ্ধান্ত কিছু হয় না।
“তুমি কী এই ভারী শাড়ি পরেই ঘুমাবে?”
পুনরায় প্রশ্ন ছোঁড়ে আদ্র। তীহা জবাবের বদলে মাথা নেড়ে “হ্যাঁ” বলতেই আদ্র’র মেজাজ একশোতে একশো চড়ে। মুখে কী সোনাদানা লুকিয়ে রেখেছে নাকী! মুখ খুললেই ঝরে পড়বে যেন! কথা বলতেও এত সমস্যা এই মেয়ের! কে এ? মিস বাংলাদেশ, নাকী মিস ইউনিভার্স! অবিবেচক বিরক্তিটাকে অপ্রকাশিত রেখে গমগমে সুরে আদ্র আদেশ দিলো,
“এক্ষুনি পাল্টাও এটা। তোমাকে দেখে আমারই গরম লাগা শুরু হয়ে গেছে! চোখের সামনে এসব দেখে আমি ঘুমাতে পারব না। যাও,পাল্টাও।”
আদ্র ভেবেছিল, এবার নিশ্চয়ই মুখে বুলি ফুঁটবে মেয়েটির। যুক্তি উপস্থাপন করবে,নইলে তর্ক করে বলবে, পাল্টাবো না। কিন্তু না! এবারও একরাশ নিশ্চুপতা নিয়ে তীহা উঠে দাঁড়াল এবং কোনোপ্রকার ধীরতা না করে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকলো। দুঃখে,কষ্টে বিছানায় হাল ছেড়ে বসে পড়ল আদ্র। একে নিয়ে পারা সম্ভব না,কোনোভাবেই সম্ভব না!!
____
“নিজে চলে গিয়েছো,স্মৃতি গুলো কেন নিলে না? নিজে সুখের বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছো,আমায় কেন দুঃখের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছো? যদি চলেই যেতে,তাহলে কেন এসেছিলে জীবনে! আমি তো বেশ ছিলাম একা একা। না তোমার সাথে পরিণয় হতো, আর না আজ নিজের স্বামীকে এভাবে ঠকাতে হতো। আমার খারাপ লাগে ওই লোকটির জন্য। তার তো কোনো দোষ নেই। তবুও আমি তাকে প্রাপ্য সম্মান,মর্যাদা,অধিকার- কিছুই দিতে পারছি না। তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গে আরও একজন অপরিচিত মানুষের জীবনটাও নষ্ট করে দিয়েছো অনিন্য, আমি কোনোদিন তোমাকে ক্ষমা করতে পারব না। কোনোদিন না…”
দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ডুকরে কাঁদছে তীহা। নিরব কান্নার সাক্ষী হয়ে রইলো চারপাশের দেয়াল ও সমস্ত জড় পদার্থ গুলো। বাহিরে অপেক্ষমান লোকটি কী কোনোদিন জানতে পারবে,কতবড় ক্ষত নিয়ে দিব্যি শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটি?
.
টুং করে ফোন বেজে উঠল। চিন্তার ফলে কার ফোন তা দেখার আগেই বিছানা থেকে মোবাইল হাতে নিলো আদ্র। ফোনে লক নেই, হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ এসেছে। ম্যাসেজ বক্স খুলতেই চোখে পড়ল আইডির নামটি, “Life line” এইবার পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে আদ্র তাকাল। ফোন উল্টো করে দেখল,এটা তীহার ফোন! শিট! অন্যের ফোন এভাবে ধরা ঠিক হয়নি। কিন্তু এখন আগ্রহ জন্মে গেছে। বিশেষত, এই লাইফ লাইন নামটি দেখার পর থেকে। কে এই লোক? তবে কী এর কারণেই এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়েছে আদ্র আর তীহার মধ্যিখানে? আদ্র ফোন রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই আবার টুং করে শব্দ হলো। একটা ছবি পাঠানো হয়েছে ওই আইডি থেকে। মানুষ বড় কৌতুহল স্বভাবের প্রাণী। এদের ভেতর একবার যেই বিষয় নিয়ে কৌতুহল জাগে,তা দমন না হওয়া পর্যন্ত নিঃশ্বাস নেওয়াও যেন দায়! আদ্রও নিজেকে দমাতে পারল না। একবার ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে দ্রুত চ্যাট বক্স ওপেন করল। সঙ্গে সঙ্গে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের ভীষণ অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তার চোখের পাতায় ভেসে উঠল। কয়েক সেকেন্ড, থ’ মেরে চেয়ে রইলো আদ্র। পরক্ষণেই হাত থেকে ফোন পরে গেল। তীহা এরকম স্বভাবের মেয়ে হতে পারে, তা ঘুণাক্ষরেও কল্পনায় আসেনি তার। মুখ দিয়ে অজান্তেই উচ্চারিত হলো, “ছিঃ!” শব্দটি…
(চলবে)
[এডিট করিনি। তাই বানান ভুল থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আজকে সবার বড় বড় মন্তব্য চাই।]