#এলোমেলো_হাওয়া
#পর্ব_৪
লেখিকা- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি
চোখ মুছে তীহা বাহিরে বের হলো। কোনো জামা কাপড় তো নেওয়া হয়নি। চেঞ্জ করে পরবে টা কী? কিন্তু বাইরে বেরিয়ে যখন আদ্র’র রক্তচক্ষু দেখল,তখন অনেকটাই ভয় পেয়ে গেল। বিছানার এক পাশে তীহা,অন্য পাশে আদ্র। আদ্র’র হাতে তীহা তার ফোন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। তীহার শরীর দিয়ে একটা শীতল শিহরণ বয়ে গেল। আদ্র কী অনিন্য’র কথা জেনে গিয়েছে? ভেতরটা ধীরে ধীরে চাপা উত্তেজনায় ছেয়ে গেল।
আদ্রই প্রথম মুখ খুললো। প্রশ্ন করল,
“তোমাকে আমি এইধরনের মেয়ে মনে করিনি।”
তীহা ভ্রু কুঁচকালো। কথার অর্থ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
“কী বলছেন! আমি কী করেছি?”
“তুমি এত বড় জিনিস লুকালে আমার থেকে? অন্তত বিয়ের আগে জানাতে পারতে!”
তীহা কাচুমাচু হয়ে গেল। নিশ্চয়ই অনিন্য’র কথা বলছে উনি। যাক,অবশেষে তো উনি জেনেছে। সত্যটা একদিন না একদিন জানতোই অবশ্য! কিন্তু এভাবে তীহার ফোন ঘাটাঘাটি করার ব্যাপারটা বিশেষ পছন্দ হলো না তার কাছে। চেনাজানা হয়নি দুদিনও, এরই ভেতর ফোন ঘাটাঘাটি! প্রাইভেসি বলে কী কিছু নেই মানুষের? নাকী বিয়ে করেছে বলে মাথা কিনে নিয়েছে? তীহার বিরক্ত লাগলো। চুপ থাকতে চেয়েও সে চুপ করে রইলো না। বলল,
“কিছু জিনিস চাইলেই কনফেস করা যায় না! তার জন্য সময়ের প্রয়োজন। আর আপনিও বা কেমন, আমার অনুমতি ছাড়াই ফোন ঘাটাঘাটি করছেন! এটা কী ভদ্র লোকের স্বভাব?”
আদ্র’র এমনিতেই মেজাজ খারাপ, তার উপর তীহার এরকম কথায় সে আরও বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। বিছানার উপর ফোন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল,
“সাধ করে তোমার ফোন কে ধরতে গেছে? তুমি রঙ্গ করে বেরিয়েছো আর সেগুলো এখন চোখের সামনে আসছে! প্রেম পর্যন্ত একটা বিষয় ওকে, কিন্তু একদম বিছানা পর্যন্ত যাওয়া! ছিঃ তীহা.. তোমাকে বাহির থেকে দেখলে তো মনে হয় না ভেতরটা এত কুৎসিত!”
“মুখ সামলে কথা বলুন। আপনি কী বলছেন, কোনো আইডিয়া আছে? আমার রিলেশন ছিল, আমি স্বীকার করছি সেটা। কিন্তু তাই বলে বিছানা অবধি গিয়েছি,এইধরনের কথা আপনি কীভাবে বলতে পারলেন?”
“তাহলে এটা কী? এটা কী তোমার ভূত?”
বিছানার উপর থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে পুনরায় হোয়াটসঅ্যাপে ঢোকে আদ্র। “লাইফ লাইন” নামক চ্যাটবক্স ওপেন করে ছবিটার দিকে দ্বিতীয় বার না তাকিয়েই সেটা তীহার দিকে ছুঁড়ে মারে। তীহা বিব্রত হাতে দ্রুত ফোন তুলে নেয়। স্ক্রিনে স্থির হয়ে থাকা ছবিটি দেখে জমে যায় ওখানেই। এই মেয়েটা সে না, কিন্তু আলো আঁধারির খেলায় আর অনিন্য’র ছবি তোলার দক্ষ হাতের জন্য মেয়েটার চেহারাও স্পষ্ট নয়। এই কারণে আদ্র সাহেব ওকে এই মেয়ে মনে করছেন? কীভাবে পারলেন উনি! তীহা তো এরকম নয়! সামান্য হাত ধরা নিয়েও কত তোলপাড় ছিল তার! ভালোবাসতে হলে শরীর নয়,মন দিলেই যথেষ্ট হয়। এটাই তো তীহা করেছে। আর ফলস্বরূপ কী পেল!
দুই প্রকার কষ্টে তীহার চোখ ভরে এলো।
এক- অনিন্যকে অন্য আরেকটি মেয়ের সাথে এত কাছাকাছি থাকতে দেখে। আর
দুই- আদ্র’র ভুল বোঝা দেখে।
তীহা মাথা তুলে আদ্র’র চোখে চোখ রাখতেই আদ্র বলে উঠল,
“হ্যাঁ এখন এই চোখের পানি দিয়ে ঘায়েল করা ছাড়া আর কীইবা করার আছে তোমার?”
তীহা ভার গলায় বলল,
“আমি আপনাকে ঘায়েল করার জন্য কাঁদছি?”
“তা নয়তো কী?প্রমাণ দাও,এই মেয়েটা তুমি নও।”
“যদি না দেই?”
আদ্র সেকেন্ড কতক নিরব চেয়ে রইলো। তারপর ঠান্ডা অথচ রাগপূর্ণ গলায় বলল,
“কেয়ামত হয়ে যাবে তীহা,কসম!”
তীহার বাম চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা উত্তপ্ত জল গড়িয়ে পড়ে। বিছানার উপর অবহেলায় ফোনটা রেখে হাতের উল্টোপাশ দিয়ে দু’চোখ মুছে নেয় চটজলদি। তারপর এগিয়ে এসে আদ্র’র মুখোমুখি দাঁড়াল। আদ্র চেয়ে আছে,তীহাও চাইলো। দুই জোড়া এক হয়। কতক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে নিজের ডান ঘাড়ের চুল সরালো তীহা। আদ্রকে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে বলে বলল,
“ভালো ভাবে দেখুন,এখানে কোনো তিল আছে কীনা…”
আদ্র দায়সারাভাবে জবাব দিলো,
“নেই।”
“এবার বাম ঘাড়ে দেখুন। এখানে আছে?” বলে বাম ঘাড়ের উপর থেকে চুল সরালো তীহা। আদ্র পুনরায় মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,
“নেই।”
তীহা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে। ফোনের ভেতর আবার ছবিটা বের করল। এবার সেটা আদ্রকে দেখিয়ে বলল,
“অথচ ছবির এই মেয়েটার ঘাড়ে তিল আছে। অনেক বড়, তাই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দেখুন। এমনকি ওর গালে তিল.. আর ওর ওই এক চোখ, ওর চোখ দেখুন, আর আমার চোখ দেখুন…”
আদ্র নিজের ভুলটা বুঝতে পারল। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে উঠল সে। না জেনে শুধু শুধু এরকম রিয়েক্ট কেন করল, তা বোধগম্য নয়। ভালোভাবে জিজ্ঞেস করলেই হয়তো হতো। আসলে শত হোক নিজের স্ত্রী তো… মাথা ঠিক রাখতে পারেনি আদ্র।
তীহা বলল,
“কী ব্যাপার,তাকান আমার দিকে। আমার চোখ দেখুন। আর নিজেই এই ছবির সাথে মিলিয়ে নিন।”
“থাক, দরকার নেই আর।”
“কেন দরকার নেই? আপনাকে দেখতেই হবে। তাকান আমার চোখে,তাকান বলছি…”
শেষ শব্দ দুটি অনেকটা ধমকের সুরে বলে উঠল তীহা। আদ্র অবাক চোখে তীহার চোখের ভেতর দৃষ্টি ফেলল। তার মনে হলো, এত সুন্দর চোখ, সে আর কোনোদিন দেখেনি! এ যেন টলটলে জলের এক স্বচ্ছ দীঘি! দীঘির জলে কেউ আঘাত করলে যেমন পানির তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, তীহার চোখেও সেরকম নোনা জলের তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে দেয়াল টপকে গাল ছোঁবে তারা…
আদ্র চোখ নামিয়ে নিলো। তীহা এবার কেঁদেই ফেলল। নিজেকে, নিজের ভেতরে পাথর চাপা দেওয়া কষ্টগুলোকে কিছুতেই আর সামলে রাখতে পারছে না সে। মেঘ যেমন অপেক্ষা করে একটা নির্দিষ্ট সময়ের,তীহার জন্যেও সেই নির্দিষ্ট সময় এসে গেছে। এখন শুধু বর্ষণের পালা.. নিজের দুঃখ, কষ্টগুলোকে ভেতর থেকে উদগীরণ করার পালা….
বিছানার উপর শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ল তীহা। দুই হাতে চাদর খামচে ধরলো। অপাত্রে ভালোবাসা দানের কথা এবং বিনিময়ে সে কী পেয়েছে- তারই আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করতে লাগল একা একাই। আদ্র বাধা দিলো না। সামনে দাঁড়িয়ে এক মনে শুনতে লাগলো সবটা…
“আ..আমি আপনাকে সবটা জানাতে চেয়েছিলাম। আপনাকে বিয়ে করে ঠকানোরও ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু আমার পরিবার থেকে আপনার সাথে আলাদা ভাবে কথা বলতে সুযোগ দেওয়া হয়নি। এমনকি আপনার নাম্বার ও আমার কাছে ছিল না। আর আমি তখন এমনই ট্রমার ভেতর ছিলাম, যে আমাকে যেভাবে চাইছে সেভাবেই করছি। তারা চাইছে আমার বিয়ে হোক, ব্যস বিয়ে করছি। নিজের ভেতরের সমস্ত বিবেক, বুদ্ধি জ্ঞান,সবকিছুই লোপ পাইছিল যেন। কিন্তু বিশ্বাস করেন, আমি আপনাকে বিন্দুমাত্র ঠকাতে চাই না। আমাকে নিয়ে আপনার আফসোস হোক,এটাও চাই না। আপনি যদি বলেন, চলে যেতে। আমি চলে যাব। নিজের মুখটা আর দেখাবো না আপনাকে, সত্যি.. আমার জীবন থেকে ভালোবাসাটাই তো হারিয়ে গেছে। এখনো যে দম নিচ্ছি,তাই তো ঢের! আর কী চাই? কিছু চাই না। কিছু না..”
তীহা কাঁদছে। অঝোরে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে তার। চোখের পানি,নাকের পানি মিশে চিবুক ছুঁয়েছে। আদ্র থামাচ্ছে না। এই কান্নাটা বরং আরও আগে করা দরকার ছিল। তাহলে আরও আগেই স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরে আসতে পারতো মেয়েটা। আজ যখন বাঁধ ভেঙ্গেই গেছে,তখন কাঁদুক প্রাণ খুলে। আদ্র একটুও বাঁধা দেবে না।
একসময় তীব্র মাথাব্যথা নিয়ে তীহা ফোলা চোখ মেলে। তাকাতেই দেখে,এক গ্লাস পানি তার দিকে এগিয়ে ধরেছে আদ্র। সেকেন্ড তিনেক চুপ করে থেকে তীহা হাত বাড়ায়। শান্ত হয়ে পুরো পানিটা গিলে নিয়ে আবার আদ্র’র দিকে তাকাল। আদ্র বলল,
“ফিলিং বেটার?”
তীহা ইতস্ততভাবে ঘাড় নাড়ালো। এখন ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। লোকটা কতটা দুর্বল ভাবছে তাকে,কে জানে! আড়ষ্ট হয়ে উঠে দাঁড়াল তীহা। চোখেমুখে পানি দেওয়া প্রয়োজন।
আদ্র বলল,
“ভালোমতো ফ্রেশ হয়ে আসো। একটা কাজ আছে।”
“কী কাজ?”
“যার জন্য এত কান্না,তাকেও তো একটু কাঁদানো উচিত, তাই না?”
আদ্র’র কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না তীহা। তবুও আদ্র’র কথামতো ভালো করে ফ্রেশ হয়ে এলো। পরনের শাড়িটা পাল্টাতে চাইলে আদ্র বাঁধা দেয়। একটু ক্রিম তীহার গালে মেখে দিয়ে একটা গোলাপি শেডের লিপস্টিক তীহার দিকে এগিয়ে দিলো।
“এটা লাগাও তো।”
“কেন?”
“আহা, লাগাতে বলছি লাগাও। এত কথা কেন?”
তীহা অবাক, কিন্তু আর কোনো প্রশ্ন করল না। আদ্র’র কথামতো ঠোঁটে সুন্দর করে লিপস্টিক আঁকলো। এলোমেলো চুলগুলোতে হাত রাখলো আদ্র। তীহাকে আরও চমকে দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে মেলে দিলো। বড় জানালা খুলে সেখানে নিয়ে দাঁড় করালো তাকে। তারপর নিজেও পাশে দাঁড়ালো। তীহাকে বলল,
“আমি এখন যা যা করব, তুমি শুধু চুপচাপ উপভোগ করবা। একটাও প্রশ্ন করবা না,ঠিক আছে?”
তীহা মাথা দোলায়, হ্যাঁ বলল। আদ্র ক্যামেরাটা সেট করে তীহার কাছে আসে। তীহা আর সে- দু’জনেই মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তীহার কপালে চট জলদি নিজের ঠোঁটটা ছুঁইয়ে দিতেই তীহা ছিটকে সরে দাঁড়াল। কপালে ভাঁজ ফেলে এক হাত বাড়িয়ে তাকে নিজের দিকে টেনে নিলো আদ্র। বাহুডোরে মিশিয়ে পুনরায় কপালে নিজের অধর স্পর্শ করল। এবার আর ছিটকে সরলো না তীহা বরং চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলল। এক অদ্ভুত অনুভূতিতে তার পুরো শরীর হেলদোল লাগিয়ে দিয়েছে। মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। ভালো লাগছে আবার কান্নাও পাচ্ছে। অথচ এই কান্নার কোনো সঠিক কারণ, তীহার জানা নেই।
কয়েক মুহূর্ত এই দমবন্ধকর অনুভূতি নিয়েই কাটলো তীহার। একসময় আদ্র’র কণ্ঠস্বরে চোখ মেলে তাকালো সে। আদ্র ভীষণ মনোযোগ দিয়ে ছবি গুলো দেখছে। সে যেরকম চেয়েছিল, ঠিক তেমনটাই উঠেছে। এবার তীহাকে একটা ছবি দেখিয়ে বলল,
“দেখো তো, দেখে রোমান্টিক কাপলের ন্যায় লাগছে না?”
তীহা ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। আদ্র বলল,
“এবার এই ছবিটা দ্রুত ওই লাইফ লাইনে পাঠাও। আর আমি যা যা বলব, তাই তাই লিখে ম্যাসেজ পাঠাবা। ওকে?”
তীহা চমকে উঠে বলল,
“এসব আপনি কী বলছেন!”
“আমি যা বলছি,তাই করো। বেশি দেড়ি কোরো না। নাও..”
তীহা প্রথমে রাজী না হলেও আদ্র’র জোরাজুরিতে কয়েকটা ছবি অনিন্যকে পাঠিয়ে দিলো। এরপর আদ্র’র কথামতোই লিখলো,
“তোমাদের এসব ছবি আমাকে আঘাত করতে পারে না এখন আর। আমি বুঝেছি, ভালোবাসা শুধু শারীরিক নয়, আত্মিক! আর এই আত্মিক ভালোবাসা শরীরের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে না, উদাম কপালেও লেপ্টে থাকে। সেটা তোমার মতো ক্যারেক্টারলেস অনিন্য’র জানার কথা নয়, আই থিংক!”
উল্লাসে ফেঁটে পড়ে আদ্র বলল,
“আমার বউকে কাঁদানোর সাজা তোকে এভাবেই দেব ব্যাটা। দেখি, তুই আর কী করতে পারিস।”
আদ্র’র মুখ থেকে “আমার বউ” শব্দটি শুনতে পেয়ে তীহা ‘হা’ হয়ে রইলো। সেই সাথে তার ভালোও লাগলো। কিন্তু কেন,কে জানে!
(চলবে)