#এলোমেলো_হাওয়া
#পর্ব_৬
লেখিকা- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি
“গতকাল তুমি নাকী ফ্ল্যাটে ভাঙচুর করেছো?”
আহসান খানের কথায় অনিন্য সেকেন্ড দুই চুপ করে থেকে শক্ত চোয়ালে জবাব দিলো,
“এই খবর কার থেকে পেয়েছো শুনি।”
“তুমি ভালো করেই জানো, ফ্ল্যাটে কী হয় না হয় তার সব খবরই আমার কাছে চলে আসো অনিন্য। এমনকি গত এক মাসের কাছাকাছি ধরে যে একটা মেয়েকে নিয়ে রেগুলার সংসার করতেছো ওখানে,তাও আমার কানে আসছে। কিন্তু আমি কিছু বলি নাই। মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করতেছো,করো। কিন্তু ভুলেও বিয়েশাদি করে বসো না। নিজের কপালে নিজেই আযাব ডেকে এনো না।”
অনিন্য’র কপালের শিরা রাগে দপদপ করতে লাগলো। আহসান খান সম্পর্কে তার বাবা হলেও তাকে শেষ কবে বাবা বলে ডেকেছে, তা মনে পড়ে না অনিন্য’র। এই লোকটার কারণেই তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। কথার জবাব না দিয়ে সে বলল,
“ফোন রাখলাম।”
“অনিন্য, শোনো..”
অনিন্য চুপ করে রইলো।
“বাসায় আসো। ফ্ল্যাট ছেড়ে দাও।”
“কেন? আমি আপনার ফ্ল্যাটে আছি দেখে কী কষ্ট হচ্ছে?”
“কষ্ট হতে যাবে কেন। নিজের বাড়ি থাকতে শুধু শুধু ফ্ল্যাটে পড়ে থাকবে কেন?”
“বাড়ি গিয়ে কী করব? কে আছে আমার?”
“কেন,তোমার মা কী নেই?”
অনিন্য কাঠ গলায় বলল,
“ভুলে যাচ্ছেন, উনি আপনার স্ত্রী কিন্তু আমার মা না।”
আহসান খান মৃদু হাসলেন।
“তোমার জেদ গেল না! ঠিকাছে, থাকো ফ্ল্যাটে। কিন্তু ভাঙাভাঙি করো না। একটা রেপুটেশন আছে আমার,সেটাকে নষ্ট করো না।”
অনিন্য খট করে মোবাইলের লাইন কেটে দিয়ে হাতের কাছে থাকা একটা ফ্লাওয়ার ভাস তুলে আছড়ে মারলো মাটিতে। মালোতি বাড়িতে নেই। নইলে দৌড়ে আসতো এতক্ষণে। অনিন্য সোফায় গা এলিয়ে দিলো। রাগটা কোনোভাবেই সংবরণ হচ্ছে না। কার উপর এত রাগ? তীহার উপর? বাবার উপর? নাকী নিজের উপর? অনিন্য এই প্রশ্নের উত্তর জানে না। ফ্ল্যাটে ঘটা সমস্ত কর্মকাণ্ড যে দারোয়ান ব্যাটা বাবার কানে লাগিয়ে দেয়,সেটা আগে থাকতেই সন্দেহ করেছিল সে। এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হলো। দারোয়ানকে একটা উচিত শিক্ষা দিতে হবে। তার থেকে ঘুষ খায়,আবার তার কথাই বাবাকে লাগিয়ে দেয়! ব্যাটা মস্ত বড় চালবাজ।
____
তীহা মুখ ভার করে বসে রয়েছে। নিরুপমা বেগম একটু আগে তাকে অনেকগুলো কথা শুনিয়েছেন। মেহমান বিদায় হতে না হতেই এরকম আচরণ করে বসলেন! সামনে না জানি কত কিছু করবেন। তীহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়েদের বিয়ে করা কী খুব জরুরি! বয়স পঁচিশ পার হতে পারে না,তার আগেই বিয়ের জন্য রীতিমতো চাপাচাপি করা- কেন রে ভাই! ছেলেরা যদি চল্লিশে গিয়ে বিয়ে করতে পারে,মেয়েদেরও সেই স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। আবার কেউ যদি জীবনেও বিয়ে করতে না চায়,তবে তাকেও প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
ঘরের ভেতর আদ্র’র উপস্থিতি টের পেয়ে তীহা চট জলদি চোখ মুছে নিলো। তখনই আদ্র তার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল।
“মায়ের কথায় মন খারাপ করো না তীহা। বিয়ের পর তোমার বাড়ি যাব, দুদিন থেকে চলে আসবো। এটাই নিয়ম। অথচ তুমি যেতে চাচ্ছো না। তাইজন্যে মা একটু রিয়েক্ট করে বসেছে। প্লিজ, মন খারাপ করো না।”
তীহা দুঃখী গলায় বলল,
“আমার তো মনই নেই, আবার মন খারাপ!”
“বাবা-মায়ের উপর রাগ করে থাকতে হয় না। মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে তাকে পাত্রস্থ করা প্রতিটি বাবা-মায়ের দায়িত্ব তীহা। তোমার বাবাও তাই করেছেন৷ এইজন্যে তুমি তার উপর রাগ করে থাকবে? তাদের বাসায় যাবে না? তাদের মনে এভাবে আঘাত দেওয়া কী ঠিক তীহা?”
তীহার দায়সারা জবাব,
“আমি জানি না।”
আদ্র হাঁটু মুড়ে তীহার মুখোমুখি বসল। তীহার কোলের উপর নিজের হাতের ভার ছেড়ে দিয়ে চোখ বরাবর তাকাল। তীহা স্তব্ধ হয়ে গেল।
আদ্র বলল,
“আমরা বিকেলে তাদের বাসায় যাব। এটাই ফাইনাল। তুমি আর না করো না। আমার জন্য হলেও!”
শেষ কথাটা আদ্র এমনভাবে জোরালো কণ্ঠে বলল যেন তীহার উপর তার কত জনমের বিশ্বাস, ভরসা! তীহা ছোট্ট করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“যাব।”
____
তীহার মা শিখার আজ আনন্দ যেন ধরছেই না। বিয়ের পর এই প্রথম মেয়ে তার জামাইকে নিয়ে বাড়িতে এসেছে। এর চেয়ে আনন্দের দিন একটি মায়ের জীবনে আর কীইবা হতে পারে! সকাল থেকেই এটা ওটা তৈরি করে চলেছেন তিনি। এখন পর্যন্ত রান্নাবান্না অব্যাহত রেখেছেন। ওদিকে আদ্র’র কাঁদো কাঁদো অবস্থা। খেতে খেতে গলা অবধি উঠে গেছে। তবুও রক্ষে নেই। শ্বাশুড়ি মা একটার পর একটা জিনিস আনছেন, এমনভাবে আবদারের সুরে খেতে বলছেন যে না খেয়েও পারা যাচ্ছে না। তীহার দেখা নেই। মেয়েটা যে কই গেল তাকে এভাবে একা একা রেখে!
আদ্র’র কথামতো এখানে আসতে রাজী হলেও তীহার মুখে হাসির ছিঁটেফোঁটা নেই। সবার সাথেই হাই-হ্যালো টাইপ আচরণ। তীহার বাবা হয়তো কিছু একটা বুঝতে পেরেছেন। তিনিও ঘরে নেই। মেয়ের আচরণে কষ্ট পেয়ে কোথাও একটা বেরিয়ে গেছেন। আদ্র মনে মনে ভাবল, বাবা-মেয়ের এই নিরব স্নায়ুযুদ্ধ তাকেই ভাঙতে হবে। বাবার রাজকন্যা মন খারাপ করে রাজার থেকে দূরে দূরে থাকতে পারে না।
তীহার ছোট বোন সানজিদাকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল,তীহা ছাদে আছে। শেষ বিকেলের আলো মাখছে গায়ে। আদ্রও তাই ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
____
গাছগুলো বেশ ভালোই আছে। আগের চাইতেও আরও বেশি প্রাণবন্ত লাগছে দেখতে। তীহা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। গাছ নিয়ে বরাবর পাগলামিটা তীহারই ছিল এ বাড়িতে। সানজিদা ফোন থেকে চোখ তোলার সময় পেলে তবে তো গাছের দিকে খেয়াল দিবে! তাই কিছুটা চিন্তা ছিল এই ভেবে যে কে পানি দিবে রেগুলার। কেইবা যত্ন নিবে? কিন্তু এখানে এসে গাছের চেহারা দেখে সেই চিন্তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তীহার। তীহা বুঝল, তার থাকা বা না থাকা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। সে না থাকলেও সবাই দিব্যি বাঁচবে। যেমন গাছগুলো বেঁচে আছে। অথচ সেই থমকে আছে একজনের জন্য!
তীহা মনে মনে বলল,
“আপনার চেহারাটা কখনো যেন আর না দেখায় আল্লাহ।”
ঠিক তখনই সামনের রাস্তায় চোখ পড়ল তীহার এবং ভূত দেখার ন্যায় চমকে উঠল সে। সামনের রাস্তাটা দুই গলির চিপা। একপাশে ময়লার স্তুপ রাখা। তাই এদিকটায় লোকজন আসে না বললেই চলে। সেই নির্জন রাস্তায় দেয়ালে হেলান দিয়ে আকাশমুখে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে এক যুবক। এই যুবকই তার সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। এই যুবকের কারণেই তার চোখের তলায় গাঢ় কালির স্তর জমেছে। এই যুবকই তার নিঃশ্বাসের সহিত বিষ ঢুকিয়ে ভেতরটা দগ্ধ করে দিয়েছে৷ অথচ এ এখানে কেন! এর তো এখানে আসার কথা নয়!
এমন সময়ই পেছন থেকে আদ্র তীহার নাম ধরে ডাকলো,
“এই তীহা,এই… পড়ে যাবে তো..”
(চলবে)