অন্তহীন💜 #পর্ব_৫ #স্নিগ্ধা_আফরিন

0
624

#অন্তহীন💜
#পর্ব_৫
#স্নিগ্ধা_আফরিন

তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াস রুম থেকে বেরিয়ে আসলো প্রহন। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো,
বিছানার উপরে বসে চৈতি উশখুশ করছে। চৈতি কে এমন করতে দেখে প্রহন জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু প্রয়োজন তোমার?”
প্রহনের স্বায় পেয়ে চৈতি মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,
“আমার খুব জল তেষ্টা পেয়েছে।”
এই প্রথম বার প্রহন নিজের নবনী কিশোরী বউয়ের কন্ঠস্বর শুনলো।কী মিষ্টি শুনালো কথা টা!”মেয়েটার কন্ঠস্বর সত্যিই কি এত সুন্দর?নাকি আমার কানেই শুধু সুন্দর লাগলো?”
প্রহন দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে গলার স্বর উঁচু করে বললো,
“আম্মু আমার রুমে এক জগ পানি পাঠিয়ে দাও।”

মিসেস ইয়াসমিন তখন মাগরিবের নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তার সামনে থাকা কাজল কে দেখেই বললেন,
“কাজল প্রহনের রুমে এক জগ পানি দিয়ে আয় তো মা।ফুপ্পি নামাজ পড়েনি।”
মিসেস ইয়াসমিন এর কথা শুনে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো কাজল। অনেকক্ষণ যাবৎ প্রহনের রুমে যাওয়ার সুযোগ খুচ্ছিলো সে।যাই হোক। শেষ পর্যন্ত সুযোগ টা পেয়েই গেলো।
ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা পানি ভর্তি জগ আর গ্লাস হাতে প্রহনের রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেল কাজল।

“পিচ্চি,এত গর্জিয়াস একটা শাড়ি পড়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে না তোমার?”

“আমি তো বসে আছি।তাই তেমন কষ্ট হচ্ছে না।”

প্রহন হাতের তোয়ালেটা চৈতির হাতে ধরিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“বেলকনিতে এটা মেলে দিয়ে আসো যাও।”
প্রহনের কথা শুনে চৈতি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল প্রহনের অদর পানে।বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো চৈতি।পা বাড়াতে যাবে তখনই শাড়ির কুঁচি সাথে পা আটকে পড়ে যেতে যেতে পড়লো না। প্রহন আগলে ধরেছিল।
চৈতির কোমর ধরে উঁচু করে তুলে বসিয়ে দিল বিছানায়।সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো চৈতির।দ্রিম দ্রিম করে হাতুড়ি পেটা শুরু করলো বুকের বা পাশে। হৃদয় স্পন্দন বেড়ে গেল কয়েক গুণ।
চোখ মুখ খিঁচে ফেললো চৈতি।
চৈতির কান্ড দেখে মিটি মিটি হাসছে প্রহন।
“বাচ্চা একটা মেয়ে,ও নাকি প্রহন চৌধুরীর বউ।”
চৈতির হাত থেকে তোয়ালে টা নিয়ে বেলকনিতে চলে গেলো প্রহণ। রুমে এসে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ঘড়ি বের করে হাতে পড়তে পড়তে চৈতির উদ্দেশ্য বললো,
“নিজেকেই এখনো সামলাতে পারো না পিচ্চি।আর এই শাড়ি কী করে সামলে রাখবে?”

চৈতি মিন মিনে গলায় উত্তর দিলো,
“শাড়ি পড়ার অভ্যাস নেই আমার।আগে কখনো শাড়ি পড়িনি।”

প্রহন এগিয়ে আসলো চৈতির দিকে। চৈতির সামনাসামনি বসে মুখটা চৈতির মুখের কাছাকাছি এনে বললো,
“শাড়ি সামলাতে শিখে নিও। না হলে আমাকে কী করে সামলাবে? আমি যে শাড়ির চেয়ে ও বেশি বেসামাল।”

প্রহনের কথা শুনে কাশি উঠে গেল চৈতির। গলায় কেমন ঝাল ঝাল লাগছে।এত কাছ থেকে এত আবেগীয় ভয়ংকর কথা এই প্রথম শুনেছে। লজ্জাবতী গাছের মতো লজ্জায় নুয়ে পড়লো। নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে।নবনী কিশোরীর লাজুক অদর দেখে ভীষণ ভালোলাগা কাজ করলো পুরুষের সেই কঠিন হৃদয় জুড়ে।

দরজায় টোকা পড়লো। প্রহন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দরকার দিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো।
“আম্মু কোথায়?”

রুমের ভেতর প্রবেশ করতে করতে কাজল উত্তর দিলো,
“ফুপ্পি নামাজ পড়ছে।তাই আমাকে বললো পানি দিয়ে যেতে।”

কাজলের হাত থেকে পানির জগ নিয়ে প্রহন বলে উঠলো,
“দেওয়া হয়ে গেছে? এই বার যাও এখান থেকে।”

“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে প্রহন ভাইয়া।”

“দেখো কাজল, আমার মন মেজাজ একদম ভালো নেই।তাই উল্টা পাল্টা কিছু বলে নিজের খারাপ ডেকে এনো না।”

“সেই তো আমার চেয়ে ছোট একটা মেয়েকেই বিয়ে করেছ। তার পর ও এত মেজাজ আমার উপর দেখাতে এসো না।”চৈতির দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলে রেগে প্রহনের রুম ত্যাগ করলো কাজল।
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো প্রহন।

বিছানার পাশে রাখা টেবিলের উপর পানির জগ টা রেখে রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় পেছনে তাকিয়ে চৈতির উদ্দেশ্য বললো,
“নির্ঘাত বিয়ে নামক বাঁধনে জড়িয়ে তোমার দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হচ্ছি।তাই বলে যাচ্ছি, মায়ের কাছ থেকে তোমার জামা কাপড় নিয়ে এই শাড়ি টা বদলে নাও বাচ্চা।”
কথা গুলো বলেই গট গট করে চলে গেল প্রহন।কী থেকে কী হলো? কিছুই বুঝতে পারলো না চৈতি।সব তার মাথার উপর দিয়ে গেলো। কিন্তু প্রহনের বাচ্চা, পিচ্চি বলে ডাকা ডাক গুলোর প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত হলো চৈতি।”কী আজব! আমি কী এখনো ছোট বাবুদের মতো?যে আমাকে বাচ্চা ডাকতে হবে?”
.
ধরিত্রী তখন নিশিথীনির গাঢ় অমায় ছেয়ে গেছে। তবু ও শহরের কোলাহল কমলো না। গাড়ির হর্নের শব্দে বারংবার কেঁপে উঠছে চৈতি।পড়নে তার সেলোয়ার কামিজ।মা বাবার জন্য মনটা কেমন ছটফট করছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন সময় রাত ১০টা। প্রহন যে সেই বেরিয়েছে আর ফিরেনি। কিছুক্ষণ আগেই মিসেস ইয়াসমিন চৈতি কে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে গেছেন। একটা মেয়ের ভীষণ ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু আল্লাহ তার ইচ্ছে টা পূরন করেছেন চৈতির মধ্যে দিয়ে। চৈতি কে নিজের মেয়ের চোখেই দেখেন মিসেস ইয়াসমিন।
সরদার সাহেব এর মুখে যখন চৈতির জীবন সংসয় নিয়ে শুনলেন, তখনই প্রস্তাব দিয়ে বসে ছিলেন,
“আপনার আদরের মেয়ে কে আমাকে দিবেন ভাই? কথা দিচ্ছি কখনো অনাদরে অবহেলায় রাখবো না।”

সরদার সাহেব প্রতি উত্তরে বলেছিলেন,
“কোন অধিকারে?”

রেদোয়ান চৌধুরী উঁচু গলায় বলেছিলেন,
“আমার এক মাত্র ছেলের বউয়ের অধিকারে।”
.
“এত রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কী করছো পিচ্চি?”
পুরুষালীর ভারি কন্ঠস্বর কর্ণ কুহরে পৌঁছাতেই মৃদু চমকে উঠলো চৈতি। চৈতির এমন অবস্থা দেখে প্রহনের বুঝতে বাকি রইলো না যে, পরিবারের পুরুষ সদস্যদের বাইরে সে কখনো অন্য পুরুষের কথা শুনে অভ্যস্ত না।

প্রহন এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে লাগলো চৈতির দিকে।বেলকনির গ্রিলের ফাঁক দিয়ে লাল নীল আলো দেখতে ব্যস্ত চৈতি। মুখের ভাব ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে মন খারাপি কালো মেঘেরা এসে ভীড় জমিয়েছে।
মেয়েটা কে দেখে মায়া হলো প্রহনের।
নরম সুরে প্রহন চৈতিকে জিজ্ঞেস করলো,
“বাচ্চা, তোমার কী মন খারাপ?”

প্রহনের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো চৈতি।রেগে গেলে সজীব আর সাদিকের দিকে যে ভাবে চোখ বড় বড় করে তাকাতো, ঠিক তেমনি প্রহনের দিকে ও তাকালো। এমন চোখ বড় বড় করে তাকানোর অর্থ হলো,
সে রেগে গেছে।প্রহনের জায়গায় সজীব কিংবা সাদিক থাকলে পিঠে কিল ঘুষি মেরে হাত ব্যাথা করে ফেলতো। কিন্তু এখানে যে এক অতি অচেনা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।এত সাহস নেয় তার।
“আপনি আমাকে বাচ্চা, বাচ্চা বলে ডাকছেন কেন?”

ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে প্রহন উত্তর দিলো,
“তুমি তো একটা বাচ্চা মেয়ে।তাই তোমায় বাচ্চা বলে ডাকছি।”

“এই সব আমার ভালো লাগে না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু বাচ্চা তোমার নাম কী?”

হাল ছাড়লো চৈতি।অযথা তর্ক করে লাভ নেই।
“চৈতি”

“চৈত্র মাসে জন্ম গ্রহণ করে ছিলে নাকি পিচ্চি?”

ছোট থেকেই যখন কাউকে নিজের নাম বলতো তখন সবাই মুচকি একটা হেঁসে বলতো বাহ বেশ সুন্দর নাম তো।কে রেখেছে?
চৈতি বেশ খুশি হয়ে উত্তর দিতো,
“আমার আব্বু।”
কিন্তু এই প্রথম প্রহনের মুখে এমন কথা শুনে তাজ্জব বনে গেল চৈতি।
“কারো নাম শুনে কেউ এমন আজব প্রশ্ন করে?”
তা জানা নেই চৈতির।

চৈতির উত্তর না পেয়ে প্রহন আবারো বলে উঠলো,
“পিচ্চি, উত্তর দিচ্ছো না যে?”

“মা বলে ছিল, সেদিন রোদ্দুর ছিল।খা খা রোদে পুড়ে গিয়েছিল বসুন্ধরা।”

“গ্রীষ্মের উত্তপ্ত কোনো এক দিনে?”
“হুম।”
“তাহলে তো তোমার অনেক তেজ থাকার কথা। তুমি এত শান্ত কেন?”
উত্তর দিলো না চৈতি।সময় এবং পরিস্থিতি চঞ্চল চৈতি কে ও শান্ত করে দিয়েছে।সে খবর কী প্রহন জানে?
নাহ!জানে না।

হাত ঘড়িতে সময় দেখলো প্রহন। ঘড়ির কাঁটা ১০টার ঘর পেরিয়ে ১১ এর ঘর পৌঁছানোর জন্য আর অল্প কিছুক্ষণ সময় বাকি আছে।
ঘড়ির দিক থেকে চোখ সরিয়ে চৈতির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো প্রহন। তারপর রাশ ভারি গলায় বললো,
“খেয়েছো বাচ্চা?”
চৈতি ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
“হুম। ভালো মা খাইয়ে দিয়ে গেছে।”
“ভালো মা,সে আবার কে?”
“আপনার আম্মু।”
“সুন্দর তো ব্যাপারটা। ভালো মা বানিয়ে নিয়েছো?ভেরি গুড।”
প্রহন বেলকনি থেকে রুমের ভেতর যেতে যেতে বলে উঠলো,
“অনেক রাত হয়ে গেছে। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো পিচ্চি।”

প্রহনের পেছন পেছন চৈতি ও এলো। বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ একটা কথা বলবে বলবে করেও বলার সাহস হয়ে উঠছে না চৈতির।ডান হাত দিয়ে বা হাতের আঙ্গুল মোচড়াতে মোচড়াতে আমতা আমতা করে বললো,
“আব্বু আম্মুর কথা খুব মনে পড়ছে।”

চৈতির দিকে তাকালো প্রহন। নতুন জায়গায় যে মেয়েটার মন কেন খারাপ ছিল তা এই মাত্র বুঝতে পারলো সে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে বললো,
“তোমার আব্বুর নাম্বার তো আমার কাছে নেই পিচ্চি।”

“আমার মুখস্থ আছে।”

“ওয়েল। আমি লক খুলে দিচ্ছি। তুমি কল করে কথা বলে নাও।”

বাবাকে কল করেছে ঠিকই কিন্তু টু শব্দটি ও করেনি চৈতি। সরদার সাহেব ফোনের ওপাশ থেকে হ্যালো কে,বলে গেছেন টানা ১ মিনিট ধরে। বাবার কন্ঠস্বর শুনে কল কেটে দেয় চৈতি। প্রহন অবাক হয়ে চৈতির দিকে চেয়ে আছে।
কল কেটে দিয়ে প্রহনের দিকে মোবাইল বাড়িয়ে দেয়।
চৈতির হাত থেকে মোবাইল টা হাতে নিয়ে প্রহন কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসে,
“এমন করলে কেন পিচ্চি?”

চৈতির সোজা সাপ্টা উত্তর,
“জানি না।”

প্রহন আর কিছু বললো না এই ব্যাপারে। সোফায় গিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো।আর চৈতি কে ও লাইট অফ করে শুয়ে পড়তে বললো।
চৈতি বিছানার দিকে তাকালো।”এত বড় বিছানা ছেড়ে এমন একটা সোফায় কেন ঘুমাচ্ছে?”মনে মনে ভাবলো চৈতি।
মনের মধ্যে ভেসে উঠা প্রশ্ন টা করেই ফেললো চৈতি।
প্রহন শোয়া থেকে উঠে চৈতির কাছে আসতেই ঘাবড়ে গেল চৈতি।
হাসলো প্রহন। নিজের মুখটাকে চৈতির মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে মুচকি হেসে বললো,
“তুমি এখনো অনেক ছোট পিচ্চি। বুঝবে না।”

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here