#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ৩৬
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
আয়মান সাহেব বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা শেষে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
—একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখেছিস কি, আরিফ?
আরেফিন সাহেব মাথা নেড়ে বললেন,
—কোন ব্যাপার, ভাই?
—সেদিন ডিনারে নিশীথ ও আবুল সাহেবের মেয়ে কথা বলছিলো।
—তাই নাকি? কই আমি তো দেখিনি!
আরেফিন সাহেব জবাব দিলেন। ডিনারে গেস্টদের সাথে কথা বলায় তিনি এতই ব্যস্ত ছিলেন যে কখন কে কার সাথে কথা বলেছে খেয়াল করার সময়ই পাননি! কিন্তু এটা নিয়ে এত চিন্তাভাবনা করার আছে, আরেফিন সাহেব বুঝলেন না! ডিনারে আসা গেস্ট এর সাথে নিশীথ কথা বলতেই পারে, তো কি হয়েছে। এরই মাঝে আয়মান সাহেব বললেন,
—আমি দেখেছি!
আরেফিন সাহেব এবার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন,
—আচ্ছা। কথা বলেছে ভালো কথা। কিন্তু এটা নিয়ে আপনি এত ভাবছেন কেন? আপনার মাথায় কি চলছে ভাইজান, সত্যি সত্যি বলেন তো?
আয়মান সাহেব ফোস করে এক শ্বাস ছাড়লেন। ছোটভাইয়ের দিক তাকিয়ে স্বাগোতিক কণ্ঠে বললেন,
—ছেলে বড় হয়ে গেছে, আরিফ। সেদিন শুনলি না কি বললো? বিয়ে করতে চায় সে! আমার কেন যেন সেদিন মনে হলো নিশীথ কথাটা সিরিয়াসভাবেই বলেছে।
আরেফিন সাহেব মাথা নাড়লেন। নিশীথকে দেখে ওনারও মনে হয়েছিলো সে বিয়ের ব্যাপারে যথেষ্ট সিরিয়াস। তাই মাথা নেড়ে বললেন,
—কথাটা ভুল বলেননি যদিও। তো আপনি এখন কি করতে চাইছেন? খন্দকারের মেয়েটাকে ভালো লেগেছে আপনার? কি নাম যেন ওর.. লিরা মনে হয়। তাইনা?
—হুম। আমার তো খারাপ লাগেনি। বরং এ সম্পর্ক যদি অগ্রসর হয় তবে সবচেয়ে খুশি তো আমিই হবো।
আয়মান সাহেব হেসে বললেন। আরেফিন সাহেব ভ্রু কুচকে বললেন,
—কেন? এক সাক্ষাতে ওই মেয়েকে এতটাই ভালো লেগেছে নাকি? আমার তো ওরকম কিছু মনে হলোনা ওকে দেখে!
আয়মান সাহেব ভাইয়ের বোকা কথায় কুটিল হাসলেন। স্বভাবসুলভ ভংগিতে ছোটভাইয়ের পিঠে হাত রেখে বললেন,
—ঠান্ডা মাথায় ভালো করে ভেবে দেখ, আরিফ। নিশীথ আর লিরার যদি বিয়ে হয় তবে এ সম্পর্ক শুধু একটা পারিবারিক সম্পর্কই হবেনা, বরং ওদের এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে আমাদের ও খন্দকারদের মধ্যে একটা আত্মিয়ের সম্পর্ক হবে। যে সম্বন্ধের রেশ ধরে আমরা ফিউচারেও অনেক বিজনেস বেনিফিটস পেতে পারি!
ভাইয়ের কথায় চোখ তুলে তাকালেন আরেফিন সাহেব। উনি নিঃসন্দেহে ঠিক বলেছেন বিষয়টা। যদি নিশীথ-লিরার বিয়েটা হয় তবে আসলেই দুই কোম্পানির বেশ ব্যবসায়িক লাভ হবে। কিন্তু তাই বলে কি নিশীথের উপর বিষয়টা আবার ভাইজান চাপিয়ে দেবেন না তো? তবে তো ব্যাপক অশান্তি হবে পরিবারে। আরেফিন সাহেব ভ্রু কুচকে ভাবলেন! প্রশ্ন করলেন,
—আপনি কি তবে নিশীথের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাইছেন?
—ভাবছি। নিশীথকে আগে বলবো নাকি খন্দকারদের সাথে কথা বলে লিরা সম্পর্কে আগে একটু খোজখবর নিবো বুঝতে পারছিনা! আজকালকার ছেলেমেয়ের নিজেদের পছন্দ থাকে আবার জানিস না? যদি ওই মেয়েরও কেউ থাকে?
আরেফিন সাহেব ওটাই ভাবছিলেন। তবে লিরার কথা নয়, তিনি ভাবছিলেন নিশীথের কথা। তার কেন যেন মনে হয় নিশীথের জীবনে কেউ আছে, নয়তো নিশীথকে উনি যতদুর চিনেন ও কখনোই এভাবে স্বেচ্ছায় আগ বাড়িয়ে বিয়ের কথা বলবেনা। তাই মনের কথা ভেতরে না চেপে উনি সরাসরি ভাইকে বললেন,
—একি ঘটনা যদি আমাদের সাথেও হয়, ভাইজান? তবে কি করবেন আপনি?
—মানে? কি বলতে চাইছিস, আরিফ?
আয়মান সাহেব ভ্রু কুচকান। আরেফিন সাহেব দম নিয়ে বললেন,
—বলছিলাম যদি দেখা যায়, আমাদের নিশীথই অন্য কাউকে নিজের জন্য পছন্দ করে রেখেছে, তবে? তখন আপনি কি করবেন? তবে তো নিশীথ লিরাকে বিয়ে করতে চাইবেনা অবশ্যই।
ভাইয়ের কথায় আয়মান সাহেবের চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। তাইতো! এ ব্যাপারে তো তিনি ভেবেই দেখেননি। নিশীথ এর যদি কোনো মেয়েকে আগে থেকে পছন্দ হয়ে থাকে? তবে কি করবেন তিনি? তবে তো তার মনের আশা পূর্ণ হবেনা আর। অথচ কালরাত থেকে কতকিছু জল্পনা কল্পনা করে রাখলেন তিনি, তবে কি নিশীথের জন্য সবকিছু জলে ভেসে যাবে?
মনের চাপা রাগ আয়মান সাহেবের মুখভঙ্গিতে প্রকাশ পায়। ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেন,
—এটা তো আমি ভেবে দেখিনি, আরিফ। যদি সত্যিই নিশীথের কেউ থাকে তবে আমরা কি করবো?
আরেফিন সাহেব হেসে বললেন,
—কি করবো মানে আবার কি, ভাইজান? মেয়ে দেখবো, পছন্দ হলে ছেলেবউ করে বাসায় আনবো!
উনার কথায় আয়মান সাহেব যেন ঠিক খুশি হতে পারলেন না। উল্টো মুখটা থমথমে করে বললেন,
—যদি এমন হয় তবে ভালো হবেনা, আরিফ। লিরার সাথে যেভাবেই হোক নিশীথের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
—অদ্ভুত কথা বলছেন, ভাই। নিশীথকে আপনি আমার চেয়ে ভালো চিনেন। ও আমাদেরই ছেলে, রাগটাও পেয়েছে আমাদের মতোই। বরং অনেকক্ষেত্রেই আপনার-আমার চেয়ে অধিক জিদ ওর। এর জন্য কত কি হয়েছে তা কোনোটাই আপনার অজানা নয়। এমন অবস্থায় আপনি কি করে নিশীথের মতের বিরুদ্ধে ওর সাথে লিরার বিয়ের কথা তুলতে চাইছেন? আমার মাথায় আসছেনা একদমই।
আয়মান সাহেব কথা বললেন না এবার। উনি অস্বীকার করতে পারবেন না আরেফিনের কোনো কথাই। যা যা বলেছে সবকিছুই একদম সঠিক। কিন্তু উনিও নিশীথের বাপ। ছেলে জেদি হলে বাপও মহাজেদি। কিছু না কিছু তিনি করেই ছাড়বেন! তার বিশ্বাস লিরার সাথে নিশীথের বিয়ে হলে বিয়েটা পারিবারিক-ব্যবসায়িক উভয়দিক দিয়েই সকলের জন্য ভালো হবে। তাই যে করেই হোক না কেন!
______________________
অফিসে বাবা-ছেলের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। কিন্তু, মনে মনে দুজনই একে-অপরের সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার শ’খানেক প্র্যাক্টিস করে ফেলেছেন ইতোমধ্যেই। আয়মান সাহেব ও আরেফিন সাহেব একটু আগেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। নিশীথের কিছু এক্সট্রা কাজ থাকায় ও আরেকটু পরে রওনা হবে। ঘণ্টাখানেক মন লাগিয়ে কাজ করার পর অতঃপর হাফ ছেড়ে বাচলো নিশীথ। এখন বাড়ি যাবে সে।
গ্যারেজ থেকে বাইক নিয়ে রাস্তায় বের হওয়ার আগে কি মনে করে একবার দোলাকে কল দিলো। কিছুক্ষণ রিং হতেই মেয়েটা ফোন ধরলো। মিষ্টি স্বরে ফোন ধরেই বললো,
—হ্যালো। আপনি বাসায় গেছেন?
নিশীথ ইষত হাসলো। এইযে দোলা আনমনেই ধীরে ধীরে এমন প্রেমিকাসুলভ আচরণ করছে, তা সে কি এখনো উপলব্ধি করতে পারছে? একবার ভাবলো ওকে জিজ্ঞেস করবে, পরে ভাবলো থাক! মেয়েটা লজ্জা পেয়ে ফোন কেটে দিতে পারে। তাই এ মুহুর্তে আর সে প্রশ্ন করলোনা। বরং বললো,
—বাসার জন্য রওনা হচ্ছি। নামাজ পড়েছো?
দোলা খানিকটা অবাক হলো। নিশীথ তো কখনো ওকে নামাজের কথা বলেনা। তবে আজ এভাবে বলছে কেন? সে জবাব দিলো,
—এশার নামাজ পড়িনি এখনো। একটু পরেই পড়বো। কেন?
নিশীথ একটা শ্বাস ফেলে বললো,
—ওযু করে এসে নামাজ পড়তে বসো। আমার জন্য দোয়া করবে অবশ্যই।
এবার দোলার ভয় লাগলো। নিশীথ আজ হঠাৎ এভাবে কথা বলছে কেন? নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। সে ব্যস্ত হয়ে তড়িঘড়ি করে বললো,
—কি হয়েছে বলুন না? আমার টেনশন হচ্ছে এখন!
নিশীথ মলিন হাসলো। কিন্তু ফোনের ওপার থেকে দোলা তা দেখতে পেলোনা। সে জিজ্ঞেস করেই গেলো বারবার। নিশীথ শুধু বললো,
—অত চিন্তা করোনা। বাবার সাথে তোমায় নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি আজকে। বাসায় গিয়েই আজকে কথা বলবো। যতক্ষণ না মানবে আমার কথা, কিছু খাবোনা আজকে আর। তাই তোমায় নামাজ পড়ে দোয়া করতে বললাম আমার জন্য। আমাদের জন্য!
দোলা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এতক্ষণ সে ভয়ে কি না কি ভেবেছিলো! কিন্তু মুখে বললো,
—আল্লাহ ভরসা। আপনি আগে ভালোভাবে বাসায় পৌছান। বাকিটা পরে দেখা যাবে।
নিশীথ উত্তর দিলোনা। দোলা খানিকবাদে একা একাই বিড়বিড়িয়ে বললো,
—বেশি মাথা গরম করবেন না। আর পারলে বাসায় যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে বাসায় যাবেন!
ওর শেষ কথা শুনে নিশীথ এবার হো হো করে হেসে উঠলো। ওর চিন্তায় মেয়েটা কেমন বোকা বোকা কথা বলছে! একিসাথে মায়া কাজ করলো দোলনচাঁপার প্রতি। এ মেয়েটাকে যেন ওর পরিবার স্বীকার করে, নিজেও মনে মনে দোয়া করলো নিশীথ। অতঃপর ফোন কেটে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
দোলা ভালোভাবে ওযু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে বসলো। সমস্ত ধ্যানজ্ঞান এক করে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাফ নিয়তে নামাজ আদায় করলো। নিশীথের পরিবার যেন ওদের এ বিয়ের ব্যাপারে রাজি হয়, নিশীথ যেন ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে পারে সবকিছু নিয়েই দোয়া করলো।
নামাজ শেষ করে নিশীথের পরবর্তী ফোন আসার অপেক্ষায় দুরুদুরু বুকে ফোনের দিক চেয়ে রইলো।
#চলবে
আমি এ মাসে এত বাজেভাবে গ্যাপ দেওয়ার জন্য ভীষণভাবে দুঃখিত পাঠকদের নিকট। আমি অনেক চেষ্টা করছি কাজ গুছিয়ে সময় বের করে গল্প লেখার। দোয়া করবেন আমার জন্য যেন নিয়মিত গল্প লেখার জন্য সময় বের করতে পারি।
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/