#অন্তহীন💜
#পর্ব_১৮
#স্নিগ্ধা_আফরিন
কৃষ্ণবর্ণ নীরদের ঘন বর্ষনের ঝুম ঝুম শব্দ স্পষ্ঠ। বৃষ্টির পানিতে টুইটম্বুর পিচ ঢালা পথ। পরিবেশ ঝাপসা, টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দে মুখরিত চার পাশ। নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে বৃষ্টির এক ফোঁটা পানি ও কিশোরীর শরীর স্পর্শ করতে পারেনি। বৃষ্টির পানি গায়ে পড়ার আগেই মাথার উপর ছাতা ধরে না দেখা আগুন্তক।হাত ধরে টেনে দৌড়ে নিয়ে গিয়ে দোকানের ছাউনীর নিচে দাঁড় করিয়ে দেয়। বৃষ্টির পানি ছিটকে পড়বে বলে পায়ের সামনে ছাতা বসিয়ে দেয় লোকটা।আনন খানি চোখে পড়তেই বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায় চৈতি।কিয়ৎক্ষন মানুষটার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টা ভ্রু নাচিয়ে মুচকি হেসে চৈতির দিকে এগিয়ে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে বলে,”আমাকে ছাড়া একা তোমাকে কখনো বৃষ্টিতে ভিজতে দিতাম না আমি।তাই তো বৃষ্টি শুরু হবার খানিক পূর্বেই চলে এসেছি।ম্যাজিক দেখেছো পিচ্চি?”বলেই হাসলো প্রহন।
কন্ঠনালিতে কথা আটকে গেল চৈতির। আরো এক দফা অবাক হলো সে। মনে মনে ভাবলো,”মনের কথা বুঝলো কী করে উনি?”
কিন্তু মুখ ফুটে একটা শব্দ ও বের হলো না। এই মানুষ টা কে কাছ থেকে দেখার তীব্র তৃষ্ণার্ত নেত্র পল্লব যেন প্রশান্তিতে শুধু চেয়েই রইলো।
চৈতি কে এমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেললো প্রহন। তার কাছ থেকে কিছু টা সরে এসে বললো,”আমি আসায় খুশি নও তুমি?”
“খুশি না মানে, আমার তো লাফাতে ইচ্ছে করছে।”
মনের কথা মনেই রইলো। মুখ ফুটে বলা হলো না। প্রহনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল চৈতি। ধীর কন্ঠে বললো,”আপনি যে আজ আসবেন বলেননি তো!”
কোমরে দুই হাত রেখে বাইরের বৃষ্টির পানির দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো প্রহন। রাস্তায় জমে থাকা পানির দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি নিজেই জানতাম না যে আজ আসবো।”
প্রহনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো চৈতি। বুঝতে না পেরে বললো,”মানে?”
ঘাড় ঘুরিয়ে চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রহন জবাব দিলো,”মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাড়িতে আসার জন্য ইচ্ছে করছিল খুব। ছুটি তো সহজে পাওয়া যাবে না। তখন একটা শয়তানি বুদ্ধি উদয় হয়।ওটাই প্রয়োগ করে বাড়িতে চলে এসেছি।”
“সেটা আবার কেমন বুদ্ধি?”
“রাত তখন প্রায় ২টা।সিও স্যার কে ফোন করে বললাম,স্যার আমার আম্মু খুব অসুস্থ। আইসিইউতে এডমিট করা হয়েছে। আমি তার এক মাত্র ছেলে তাই আমাকে দেখতে চাচ্ছেন খুব।”
প্রহনের কথা শুনে থ হয়ে যায় চৈতি।”কী মারাত্মক মিথ্যা বললেন উনি।”
“আপনার এমন টা বলা উচিত হয়নি।”
“হুম জানি। কিন্তু মাঝে মাঝে বলতে হয়। তুমি দ্রুত বড় হয়ে যাও তাহলে আর বলতে হবে না।”
প্রহনের অধর জুড়ে শয়তানি হাসি।
চৈতি বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।”এই জন্যই আব্বু আমাকে নিতে আসেন নি।”
“আমার পিচ্চি বউ কে আমি নিয়ে যাবো। আব্বুর এসে কাজ নেই। আমি বারন করে দিয়ে ছিলাম।”
প্রত্যত্তরে চৈতি আর কিছু বললো না।চুপ করে বৃষ্টি পড়া দেখতে লাগলো।
দুজনেই চুপচাপ। যেন নীরবতা পালন করছে। প্রহন কী বলবে বুঝতে পারছে না।অথচ সারা রাস্তায় বাসে বসে বসে শত শত কথা জমিয়ে রেখেছিল প্রেয়সীকে উৎসর্গ করবে বলে।
বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় আছে পথচারীরা। হুটহাট এমন অসময়ের বৃষ্টিতে অনেক সমস্যাই ঘটে যায়।ছাতা থাকে না সাথে। গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজেও যাওয়া যায় না বৃষ্টির জন্য। প্রহনের মতো সব প্রেমিকরা কিন্তু বৃষ্টি প্রেমি না। অনেক এর অপছন্দের তালিকায় নাম লেখা আছে বৃষ্টির।
বেশ কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি পড়া কমে আসে।গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মাঝেই অনেকে রাস্তায় নেমে পড়লো।
সিএনজি ডেকে নিলো প্রহন। চৈতি কে ভেতরে বসিয়ে দিয়ে সে নিজেও চৈতির পাশে গিয়ে বসলো।
“আপনি কত দিন থাকবেন?”
“আম্মু যত দিন হসপিটাল থেকে বাড়িতে না আসে তত দিন।”
“তার মানে আপনি আরো মিথ্যা বলবেন?”
“কিছুই করার নেই।”
“অদ্ভুত তো! মিথ্যা বলা পাপ। আপনি জানেন না?”
“জানি।”
“তাহলে?”
“এত প্রশ্ন করো কেন?চুপ করে বসে থাকতে পারো না?সব কিছু তোমার বুঝতে হবে না।”
প্রহনের কথায় খারাপ লাগলো চৈতির।সাথে রাগ, অভিমান ও হলো।”বললাম না কথা। করলাম না প্রশ্ন।কী হবে? কিচ্ছু না! আমার সাথে কথা বলতে আসুক শুধু। একদম কথা বলবো না।”
গাল ফুলিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো চৈতি। প্রহন চৈতির দিকে তাকিয়ে আফসোসের সরে বললো,”ধুর শুধু শুধু বকলাম মেয়েটাকে।”
____________
ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছতে ব্যস্ত চৈতি। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে টাটকা একটা গোসল না করলে শরীরটা কেমন মেজমেজ করে চৈতির। মেঘের বর্ষনের পর অন্তরীক্ষ পরিষ্কার।শহর জুড়ে আবারও আদিত্যর প্রখর তেজ পড়েছে। কমলা রঙের এক চিলতে রোদ এসে লুটোপুটি খাচ্ছে বেলকনির দেয়ালে। প্রহন বেলকনিতে এসে অবাক হলো।
“বাহ পিচ্চি দেখছি গাছ প্রেমি।”
চৈতি কোনো আগ্রহ দেখালো না প্রহনের কথায়।সে নিজের কাজে ব্যাস্ত। প্রহন আবারো বললো,”যাক আমার বউটা ও আমার মতো।গাছ, ফুল ভালোবাসে।জানো পিচ্চি, আমি যখন বাড়িতে থাকতাম তখন বেলকনি ছাদ গাছে আর ফুলে ভর পুর থাকতো।”
প্রহনের কথা কে পাত্তা না দিয়ে বেলকনি থেকে রুমে চলে আসে চৈতি।ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করে মাথায় কাপড় দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।এত দিন দূরে থেকে অভিমান করা হয়েছে।আজ না হয় কাছে থেকে অভিমান হোক। প্রেমিক পুরুষ কি করে সেই সলাজ অভিমান ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে প্রনয়ের চাদরে জড়িয়ে নিবে সেটাই দেখা হোক।
মিসেস ইয়াসমিন চৈতি কে দেখে মুচকি হাসলেন।ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখতে রাখতে বললেন,”কীরে মুখটাকে এমন বাংলার পাঁচ এর মতো করে রাখলি কেন?”
চৈতি ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে চেয়ারে বসলো। তিন ঢোক পানি খেয়ে বললো,”মাথা ব্যথা করছে একটু।তাই আর কি…”
মিসেস ইয়াসমিন আর কিছু বললেন না।প্লেটে খাবার বেড়ে চৈতির দিকে এগিয়ে দিলেন। কন্ঠ স্বর উঁচু করে প্রহন কে ডাক দিলেন।”প্রহন খেতে আয়। সেই যে আসলি কিছুই খাস নি।”
প্রহন খায়নি কথা টা শোনার পর চৈতির ও খাবার মুখে দিতে ইচ্ছে করলো না।মন সায় দিলো না। কেন দিলো না তা সে জানে না।
চৈতির ইগনোরে প্রহনের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তখন এর কথায় মেয়েটার রাগ হয়েছে।”সামান্য একটা কথায় একেবারে কথা বলাই বন্ধ করে দিলো। ইশশশ কী ঝাল মরিচ রে বাবা।”
_____________
ছাদের গাছ গুলো প্রাণ ভরে বৃষ্টির পানি খেয়েছে। বৃষ্টি টা একপ্রকার উপকার করলো চৈতির। কষ্ট করে আজ আর পানি দিতে হবে না। মাথা টা ধরেছে। বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে চৈতি। তার পাশেই গালে হাত দিয়ে বসে আছে প্রহন।
“ঐ পিচ্চি সরি।”
প্রহনের সরি শুনে চোখ বন্ধ করে ফেলল চৈতি।নিজেই বকবে আবার নিজেই সরি বলবে যত্তসব ঢং।
“আরে পিচ্চি টিয়া পাখি এমন রাগ করতে নেই।”
চৈতি শুনেও না শোনার ভান করে শুয়ে আছে।আজ যত যাই বলুক না কেন সে টু শব্দটি ও করবে না।
“দেখো পিচ্চি, আমি সেই কত দূর থেকে কত মিথ্যে কথা বলে বাড়িতে আসলাম আর তুমি এমন রাগ করে শুয়ে থাকলে কিন্তু হবে না।”
চৈতির কোনো সাড়া শব্দ নেই। প্রহন কিয়ৎক্ষন চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে রুম থেকেই চলে গেল। নিজের চেয়ে বেশি কম বয়সী মেয়ে কে বিয়ে করলে এই এক সমস্যা। কিছুই বলা যাবে না। অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে।
মিসেস ইয়াসমিন এর রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাকে কয়েক বার ডাকদিলো প্রহন। কিন্তু মিসেস ইয়াসমিন এর কোনো সাড়া পেলেন না।খুশিই হলো সে। রেদোয়ান চৌধুরী বিকেলের সময়টাতে বইয়ের ভেতরে ডুবে থাকেন।তাই আর তাকে ডাকলো না প্রহন।চট জলদি রুমে এসে বিছানার উপর থেকে চৈতি কে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে ছাদে উঠে গেল।সব কিছু এত দ্রুত ঘটলো যে চৈতি কিছু বুঝেই উঠতে পারলো না।
চৈতি কে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো। প্রহনের এহেন কান্ডে হতভম্ব চৈতি।আজব মানুষ তো!
“কী হয়েছে সামান্য কথায় এত রাগ করতে হয়?”
মুখ ফিরিয়ে নেয় চৈতি।সে রাগ করেছে। ভীষণ রাগ! কেন এমন করে বলবে?একটাই অভিযোগ তার। আসলে প্রিয় মানুষ গুলোর সামান্য কড়া কথায় ও অভিমান জমে যায় আমাদের মনে। খারাপ লাগে, কষ্ট হয়।
“আমার সাথে কথা বলবে না তো? ঠিক আছে বলো না। আমি আজ রাতেই আবার ফিরে যাবো। আর বছরে ও আসবো না।”
প্রহনের কথা শুনে বুকের বা পাশে চিন চিন করে উঠলো চৈতির। মুখ ফুটে বলেই ফেলল,”আপনি নিজ থেকেই বকবেন,নিজ থেকেই রাগ ভাঙাতে চাইবেন কেন?”
চৈতির কথা শুনে প্রহন চৈতির কোমর জড়িয়ে ধরে এক টানে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। কেঁপে উঠলো চৈতি। আলতো করে চোখের সামনে আসা চুল গুলো কানের পিছে গুঁজে দিল। প্রহনের স্পর্শ পেতেই নেত্র পল্লব কুঁচকে ফেললো চৈতি।
চৈতির লাজুক আননের পানে চেয়ে প্রহন জোর গলায় বললো,
“তোমাকে যখন ইচ্ছে বকবো,যখন ইচ্ছে রাগিয়ে দিবো।যখনই মন চাইবে রাগ ভাঙাবো। ইচ্ছে হলে অনেক টা কাছে যাবো আবার ইচ্ছে হলে অনেক বেশি দূরে সরে যাবো। ইচ্ছে হলে ভালোবাসবো, ইচ্ছে হলে আদর করবো।মন চাইলে কষিয়ে একটা চড় দিবো।যখনই মন চাইবে তখনই কপালে গাঢ় করে চুমু দিবো।কারন তুমি শুধু আমার। একান্তই আমার।বুঝছো বউ?”
#চলবে,,,,,,