#অন্তহীন💜
#পর্ব_২
#স্নিগ্ধা_আফরিন
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামচে আর ড্রইং রুমের সবার হইহুল্লোড় ভ্রু কুঁচকে দেখছে প্রহন। হঠাৎ এত আয়োজন কেন? মস্তিষ্কের আশেপাশে তো একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে,,”বিয়ে”।
প্রহন কে দেখে তার বড় মামি এগিয়ে এসে বললেন,
“এই বিয়েতে সত্যি তোমার মত আছে তো?”
প্রহন এক পলক মামির মুখের দিকে তাকিয়ে বাড়ির সদর দরজার দিকে তাকালো।বড় মামির মেয়ে কাজল আসছে।কাজল কে দেখেই প্রহন বিরক্ত হয়ে বললো,
“হ্যাঁ মত আছে।আর মত না থাকলে ও কী এসে যায় বলুন তো? আব্বুর জন্য তো বিয়েটা করতেই হবে।”
বড় মামির পাশে আর দাঁড়িয়ে থাকলো না প্রহন। নাস্তা করার জন্য চলে গেল।ডাইনিং টেবিলে বসে মাকে বললো নাস্তা দিতে।
মিসেস ইয়াসমিন ও ছেলে কে খাবার পরিবেশন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
পরোটা ছিঁড়ে মাংস ভুনা দিয়ে যেই মুখে পুরতে যাবে তখনই পেছন থেকে কাজিন দলের কেউ একজন বলে উঠলো,,,
“ভাই নাস্তা খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে মানসিক ভাবে বিয়ের প্রস্তুতি নে।”
হঠাৎ এমন কথা শুনে পেছনে তাকালো প্রহন।কাজিনরা সবাই মিলে এক সাথে সোফায় বসে গল্প করছে। তার মধ্যে থেকেই প্রহনের সম বয়সী ইফতি কথা টা বলে উঠলো।
‘কিরে প্রহন বসে আছিস কেন?’
‘খেয়ে নে।’
মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে বসা থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে গেল প্রহন। খাবার টা টেবিলের উপরেই রয়ে গেল। সবাই শুধু হা করে তাকিয়ে ছিল প্রহনের চলে যাওয়ার দিকে।
মিসেস ইয়াসমিন ইফতির কাছে গিয়ে বললো,
“ছেলেটাকে শান্তি মত একটু খেতে ও দিলি না তুই?”কী দরকার ছিল বলতো ওকে এখনি কথা টা বলার?”
“আসলে আমি বুঝতেই পারিনি যে প্রহন এতটা রাগ করে খাবার না খেয়ে চলে যাবে।”
মিসেস ইয়াসমিন আর কিছু না বলে রান্না ঘরে চলে গেলেন।এখনো অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে।
.
বিছানায় বসে পা দুলাচ্ছে চৈতি। বাড়ির এত আয়োজন সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।বসা থেকে উঠে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি মেরে দেখলো সবাই কাজে ব্যস্ত। দরজার কাছ থেকে সরে এসে জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বাইরের বিশাল বড় মাঠের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
পাশের বাড়ির মিতা আরো কয়েক জন মিলে কী সুন্দর মুক্ত পাখির মতো ছুটে বেড়াচ্ছে সেই মাঠে।
চৈতির মনটা ও আনচান করছে খোলা আকাশের নিচে সবুজ ঘাসের বিশাল মাঠে দৌড়ে বেড়াতে।
চৈতি মুচকি হেসে রুম থেকে বের হতে যাবার সময় আবার কিছু একটা মনে পড়তেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ আগেই জুনাইদা এসে বারন করে দিয়ে গেছেন আজ যেনো রুম থেকে এক পা ও বাইরে বের না হয়। তাহলে সরদার সাহেব কে বিচার দিবেন।
বাবা নামক মানুষটাকে চৈতি যেমন খুব ভালোবাসে ঠিক তেমনি খুব ভয় ও পায়। তার এখনো স্পষ্ট মনে আছে,
সে বার ক্লাস 5 এর পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি করে ফেলেছিল চৈতি। সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে গিয়েছিল। চার দিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল। এমন সময় বাড়ির সদর দরজায় পা পড়লো তার। সরদার সাহেব স্কুলে গিয়ে ও খুঁজে এসে ছিলেন কিন্তু তার চঞ্চল মেয়েকে কোথাও পাননি তিনি।সেকি ভয় মেয়ে কে নিয়ে তার।
বাড়িতে ফিরতেই সরদার সাহেব কষিয়ে এক চড় মেরে ছিলেন মেয়ের গালে। সেই বার প্রথম হাত তুলে ছিলেন মেয়ের গায়ে।
এত দেরি হবার কারণ জানতে চাইলে চৈতির উত্তর ছিল,
“দারোয়ান চাচার বাগানের আম চুরি করতে গিয়ে ধরা খেয়ে ৩০ বার কান ধরে উঠ বস করতে করতেই এত দেরী হয়ে গেছে।”
মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে সরদার সাহেব তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন।
সেই চড় খেয়ে রাতে কী যে জ্বর উঠেছিল চৈতির তা ভাবতেই গালে হাত চলে গেল তার।
চৈতি রুম থেকে বের না হয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়েই চেয়ে রইলো আকাশ পানে।
বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে সরদার সাহেব চিল্লাচিল্লি করছেন।বেলা প্রায় ১২টা বেজে গেছে।চৈতী কে তৈরি করে এখনো হলুদ মাখিয়ে গোসল করালো না কেন?এটাই হলো সরদার সাহেব এর রেগে যাবার একমাত্র কারণ।
শ্বশুরের এমন চিৎকার চেঁচামেচি শুনে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে চৈতির রুমে চলে গেল রুপা। বাড়ির সবার মন মানসিকতা ভালো না। চৈতি কে বিয়ে দিতে নারাজ সবাই। কিন্তু!
এই একটা কিন্তুর জন্য এক প্রকার বাধ্য হয়ে রেদোয়ান চৌধুরীর প্রস্তাবে রাজি হন সরদার সাহেব।
রিফাতের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে হবে মেয়েকে।
চৈতি কে জানালার পাশে আনমনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো রুপা। বিছানার উপর রাখা নতুন শাড়িটার ভাঁজ খুলতে খুলতে চৈতির উদ্দেশ্য বললো,
“এই দিকে আসো চৈতি।”
শান্ত মেয়ের মত ভাবীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে শাড়ির দিকে দৃষ্টি রাখা অবস্থায় ছোট্ট করে শান্ত কন্ঠে একটা প্রশ্ন করলো চৈতি।
“আব্বু আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে তাই না?”
শান্ত কন্ঠে বলা চৈতির কথাটায় বেশ খারাপ লাগে রুপার। বিছানার উপর শাড়িটা রেখে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে চৈতি কে বুকের সাথে চেপে ধরে রুপা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
“পিচ্চি মেয়ে এত শান্ত গলায় এত বড় একটা সত্যি কথা কী করে বলে দিলে?”
“আমি বিয়ে করতে চাই না ভাবী।”
চৈতি কে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে তার মুখের দিকে তাকালো রুপা।নয়ন জুড়ে বর্ষার কালো মেঘেদের আধিপত্য।এখনি যেনো টুপ করে গড়িয়ে পড়বে পানি।
রুপার মস্তিষ্কে এখন একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। চৈতিকে কান্না করতে দেওয়া যাবে না।এই ভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেওয়া যাবে না।
“এই পাগলি মেয়ে, কাঁদছো কেন তুমি?কে বলেছে আজ তোমার বিয়ে? আমরা কী এত তাড়াতাড়ি আমার ছোট্ট ননদটিকে বিয়ে দিয়ে পর করে দিতে পারি বলো?”
বড় ভাবীর কথা শুনে মুচকি হাসলো চৈতি। রুপা খেয়াল করলো এই হাসিতে সেই চঞ্চল চৈতি নেই। এই হাসিতে এক বিষাদে ঘেরা চৈতি কে দেখলো সে।
“আমি শুনেছি ভাবী। আব্বু উঠান থেকে চিৎকার করছেন আমাকে হলুদ মাখিয়ে গোসল করানোর জন্য।এমনটা তো বিয়ের কনে কে করে তাই না?”
“ওও এই কথা। তোমার হাত মুখ হলুদ হয়ে আছে।জন্ডিস দেখা দিয়েছে তোমার।তাই তো বাবা এত তাড়া দিলেন হলুদ মাখিয়ে গোসল করাতে।”
“জন্ডিস হলে তো হলুদ দিয়ে গোসল করায় না।চুন দিয়ে করায়।”
“তুমি ভুল জানো।চুন হলুদ সব দেয়।এখন আসো তো শাড়িটা পরে তৈরি হয়ে নাও। নাহলে বাবা আবার রাগ করবেন।”
চৈতি কে কোনো রকম বোঝানোর জন্য এত গুলো মিথ্যা বলতে হলো রুপার।
.
বেলা প্রায় ১টার কাছাকাছি। প্রহন যে বেরিয়েছে আর বাড়ি ফেরার নাম নেই। মিসেস ইয়াসমিন রান্নার কাজ শেষ করে শাওয়ার নিতে চলে গেছেন। রেদোয়ান চৌধুরী ছেলে কে ফোন করে ছিলেন কিন্তু প্রহনের মোবাইল তার রুমের বিছানায় পড়ে আছে।
সবার অপেক্ষার প্রহর শেষ করে বাড়ি ফিরলো প্রহন।ড্রইং রুমে সবাই বসে ছিল।কারো সাথে কোনো কথা না বলে উপরে নিজের রুমে চলে গেল।
এত সময় বাইরের ধুলোবালি শরীরে মেখেছে।টাটকা একটা গোসল না করলে অস্বস্তি জেঁকে বসবে।
.
সবার সব কথা শুনে গোসল করে নিয়েছিল চৈতি।বড় ভাবী তো বলেছে যে এটা এমনিতেই করাচ্ছে।তাই তো চুপ করে সব কিছু শুনলো সে। খুব অল্পতেই মানুষ কে বিশ্বাস করে ফেলে চৈতি। এই তো একটু আগেই যেমন রুপার কথা গুলো চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করলো।
ভেজা চুল থেকে টুপ টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। চৈতি জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নীল আকাশটা কে ছোঁয়ার ব্যার্থ চেষ্টা করছে। আকাশ কী এত কাছে?যে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে?
.
সন্ধ্যার দিকে সকল আত্মীয় স্বজন নিয়ে চৈতিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নেন রেদোয়ান চৌধুরী আর মিসেস ইয়াসমিন চৌধুরী।
প্রহন জিদ করে বসে আছে বিছানার উপর। মিসেস ইয়াসমিন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
অনেক বার বলার পর ও তৈরি হয়নি প্রহন। মিসেস ইয়াসমিন বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত রেদোয়ান চৌধুরী কে ডেকে পাঠালেন।
রেদোয়ান চৌধুরী প্রহনের রুমে এসে তার উদ্দেশ্যে বললেন,
“কাউকে কী পছন্দ করে রেখেছো তুমি?”
“না।”কিন্তু আমি এই বিয়ে টা করতে চাই না। তোমরা আমাকে একটা বার ও জানিয়েছো বিয়ের ব্যাপারে?”
“জানালে তুমি কী বাড়ীতে আসতে?”
“একটা আনম্যাচিউর মেয়ের সাথে কোনো আমাকে জড়াচ্ছো তোমরা?”
“তুমি তো ম্যাচিউর। সমস্যা না।”
প্রহন অবাক হয়ে শুধু বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।অথচ এই মানুষ টা কখনোই বাল্য বিবাহ কে সমর্থন করতেন না।আজ সেই মানুষটি তার নিজের ছেলের সাথে একটা অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে?
৫ মিনিট এর মধ্যে তৈরি হয়ে নিচে আসো।আমরা অপেক্ষা করছি। বলেই রেদোয়ান চৌধুরী প্রহনের আর কোনো কথা না শুনে বেরিয়ে গেলেন। মিসেস ইয়াসমিন ও প্রহনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে গেলেন।
বাধ্য হয়ে তৈরি হতে শুরু করে প্রহন। শুধু একটা বার বিয়েটা হোক আর আমিও এই বাড়ি থেকে যাই আমাকে আর খুঁজে ও পাবে না। এখান থেকে গিয়েই পোস্টিং এর জন্য আবেদন করবো।
মনে মনে কথা গুলো বলে তৈরি হয়ে নিচে গেলো প্রহন।
প্রহন কে দেখে মুচকি হেসে গাড়িতে উঠে বসলেন রেদোয়ান চৌধুরী।
.
ছেলের বউয়ের জন্য লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পাঠিয়েছেন রেদোয়ান চৌধুরী। সেই শাড়ি পড়িয়ে চৈতি কে বউ সাজালো তার দুই ভাবী রুপা আর সিফা।
ছোট মস্তিষ্ক আসল কাহিনী বুঝে ফেলেছে সেই অনেক আগেই। বিছানার উপর বউ সেজে পুতুল হয়ে বসে আছে চৈতি।
অপেক্ষা এক অজানা প্রণয়ের।
সিলেট থেকে মৌলভীবাজারে এসে পৌঁছেছে প্রহনরা। ঘড়িতে তখন রাত ৮টা। সরদার সাহেব এবং উনার দুই ছেলে সাদেক এবং সজিব সাথে আরো কয়েকজন মিলে রেদোয়ান চৌধুরীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বাড়িতে নিয়ে যায়।
মানুষজন তেমন একটা না থাকলে ও কম নেই।হই হুল্লোড়ে মেতে উঠেছে সরদার সাহেব এর দোতলা বাড়িটা।
রাত ৯ টার দিকে রেদোয়ান চৌধুরী তাড়া দিলেন বিয়ের কাজটা শেষ করতে।
কাজি ডেকে বিয়ে পড়ানো হলো।কবুল বলতে প্রহনের গলা ধরে আসছিল। চৈতি তো যেনো হুসেই ছিল না।গড় গড় করে বলে দিয়েছিল,
“কবুল, কবুল, কবুল”
জুনাইদা আড়াল থেকে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন।রুপা দেখেছিলো সরদার সাহেবের চোখের অশ্রু কনা।যা ঝড়ে পড়ার আগেই বিলীন হয়ে গিয়েছিল।
চলবে,,,,,