#অন্তহীন💜
#পর্ব_৩
#স্নিগ্ধা_আফরিন
ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত ১১:২০। নিজের রুমের বিছানার এক কোণে বসে আছে চৈতি। হৃদয় জুড়ে বয়ে যাচ্ছে এক নীরব ঝড়। অচেনা এক অনুভূতিতে বার বার কেঁপে উঠছে ছোট্ট হৃদয়টা।
পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে চৈতির রুম জুড়ে। রুমের মাঝে চৈতি ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই।সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে রেদোয়ান চৌধুরীদের খাবার পরিবেশন এর জন্য।
সরদার সাহেবের অনেক বলার পর আজ রাতটা চৈতিদের বাড়িতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন রেদোয়ান চৌধুরী।এত রাতে নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়াটা শুভ মনে করলেন না চৈতির পরিবারের সদস্যরা।
বসার ঘরের সোফায় বসে পান চিবোতে চিবোতে চৈতির দাদি বলে উঠলেন,
“মেলা রাইত হইছে।এত রাইতে আমি আমার নাতনিরে নিয়া যাইতে দিতাম না।বাসর ঘর সাজান লাগলে চৈতির ঘরে সাজাও।”
সোফায় বসে থাকা বয়স্ক মহিলার কথা শুনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো প্রহন।”কী বলে এই মহিলা?মাথা খারাপ নাকি?”
রাত্রি গাঢ় হচ্ছে।এখনো সোফায় বসে বসে মোবাইলে কিছু একটা করছে প্রহন। তার পাশেই বসে ঝিমুচ্ছে ইফতিসহ অন্য সব কাজিন রা।
“দেখ দাদু মনি জামাইয়ে যা কইবো সব চুপ কইরা শুনবি। রুমের ভেতর আইলেই সালাম করবি। একদম মাথা উঁচু কইরা তাকাবি না।”
চৈতি চুপ করে দাদির কথা গুলো হজম করলো।প্রতিউত্তর করলো না। ফুলের পাপড়ির ও দেখা নেই চৈতির রুমে।এত রাতে ফুলের দোকান খোলা থাকে না।
সালমা বেগম রুপা আর সিফাকে সাথে করে বেরিয়ে যাবার সময় রুপা চৈতির কানে কানে বলে ছিল,
“কী উপহার দেয় দেখি ও ভাবি কে।”
চৈতি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো রুপার মুখ পানে।
সালমা বেগম তাড়া দিলেন রুপা কে।দাদি শ্বাশুড়ির ডাক শুনে চৈতির রুমের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল রুপা।
.
অনেক জোর করার পর চৈতির রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো প্রহন। নিজের উপর প্রচন্ড বিরক্ত সে। ছুটিতে বাড়ি না আসলে বিয়েটা করতে হতো না।এক বার যদি সিও স্যার জানতে পারেন যে,
একজন আর্মির ক্যাপ্টেন হয়ে বাল্য বিবাহ করেছে তাহলে চাকরিটা যাবে।
এই সব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেই প্রহনের চোখ পড়লো বিছানার উপর লাল শাড়িতে জড়িয়ে শুয়ে থাকা এক অপূর্ব কিশোরীর উপর।
চুল গুলো ছাড়া। পাশের বালিশের উপর ছড়িয়ে আছে।ফ্যানের বাতাসে উড়ছে অবাধ্য চুল। প্রহনের হঠাৎ করেই মনে হলো সে ঘামছে।ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে ও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম এর অবস্থান টের পাচ্ছে।
বিছানায় শুয়ে থাকা মানবী ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিন চৈতির মনের উপর অনেক ঝড় বয়ে গেছে। ক্লান্ত ছিল সে।এত রাত অব্দি জেগে থাকার অভ্যাস নেই চৈতির।রুপা রুম থেকে বেরিয়ে যাবার পরপরই বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই নিদ্রা এসে ভীড় জমায় চক্ষুদ্বয়ে।
এক পা,দু’পা করে ঘুমন্ত চৈতির দিকে এগিয়ে যায় প্রহন। চৈতির মাথার কাছে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চৈতির ঘুমন্ত মুখোশ্রীর দিকে।
ঘুমের ঘোরেই নড়ে চড়ে উঠলো চৈতি।হুস ফিরলো প্রহনের।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চৈতির রুম থেকে বেরিয়ে সদর দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। বসার ঘরে কেউ ছিল না বিধায় প্রহন কে বেরিয়ে যেতে দেখলো না কেউ।
চৈতিদের গ্রামের কিছুই চিনা নেই প্রহনের।বাড়ি থেকে বের হয়ে বাগানের দিকে চললো সে। দুই হাত দিয়ে মাথার চুল গুলো শক্ত করে টেনে ধরে বিড় বিড় করে বললো,
“এই আনম্যাচিউর বাচ্চা একটা মেয়ের সাথে কী করে সংসার করবো আমি? সংসার করা তো দূরের কথা মানিয়ে নিতেও হিমশিম খেতে হবে।”
বসার মতোন কিছু না পেয়ে বাগানের ঘাসের উপর বসে পড়লো প্রহন।”সময় কী অদ্ভুত! দুই দিনের মধ্যেই এক নিমিষে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো। এমন ভাবে বিয়ে করতে হবে ভুলে ও ভাবিনি।একটা ১৫ বয়সী কিশোরী কে নিজের জীবনের সাথে জুড়ে নিলাম।যার জীবনটা সবে শুরু হতে যাচ্ছিলো।”
“আচ্ছা আমাদের বয়সের পার্থক্য কত বছরের? আমার ২৫ বছর আর মেয়েটার ১৫,গুনে গুনে ১০ বছরের ছোট আমার চেয়ে।এত পিচ্চি একটা মেয়ে আমার বউ?ভাবা যায়?”
একটা দুষ্টু মশা সেই কখন থেকে প্রহনের কানের কাছে গান গেয়ে যাচ্ছে। প্রহন যত বারই মশাটাকে মারতে যায় ততবারই মশাটা হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। বিরক্ত হলো সে।
“আব্বু আমাকে শেষ পর্যন্ত একটা পিচ্চির সাথে বিয়ে দিলো।আর সেই পিচ্চি আরাম করে ঘুমিয়ে আছে।আর আমি বাইরে বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছি।এটাই হলো আমার বাসর।”
.
রাতে চৈতির রুমের জানালাটা খোলাই ছিল। সূর্য যখন পৃথিবীকে আলোকিত করতে ব্যস্ত আলোক রশ্মির মাধ্যমে ঠিক তখনই সেই আলোর কিছুটা জানালার ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করে চৈতির রুমে। এতো আলোর মাঝে ঘুম ভেঙ্গে গেল চৈতির।পিট পিট করে চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করতেই চোখ জুড়ে নিদ্রারা আবার ভীড় করার চেষ্টা করলো। তাদের ব্যর্থ করে দিয়ে দুই হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে শোয়া থেকে উঠে বসে চৈতি।
নিদ্রা ভাব কাটিয়ে জানালার দিকে তাকালো।
“সন্ধ্যায় জানালাটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলাম।যার জন্য ঘুম টা ভেঙে গেল।”
বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে পা রাখতেই নিজের শরীরের এলোমেলো কুচির ভাঁজ হয়ে কুঁচকে যাওয়া শাড়িটার দিকে দৃষ্টি পড়তেই গতকালের সব কিছু মনে পড়ে গেল। বুকের বা পাশে ধক করে উঠলো হঠাৎ।
পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো চৈতি। কাউকে দেখতে পেল না।অথচ রুমের দরজা খোলা। বিছানায় বসে পড়লো সে।বুঝে উঠার চেষ্টা করলো রাতে কী হয়েছে?
দাদু আর ভাবিরা চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরেও কাউকে আসতে না দেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ঘুমের জন্য তাকিয়ে থাকা এক প্রকার কষ্ট সাধ্য হয়ে গিয়েছিলো।
চৈতি আর বেশি কিছু ভাবলো না। আসলে তার ভাবতে আগ্রহ হলোই না।তাই তো সে বসা থেকে উঠে মুখ ধোয়ার জন্য স্নানঘরে চলে গেল।
সারা রাত নির্ঘুমে কাটানোর জন্য চোখ গুলো কেমন লাল হয়ে আছে প্রহনের। সরদার সাহেব সেই ভোরে আজানের সময় উঠে মসজিদে চলে গিয়েছিলেন রেদোয়ান চৌধুরীকে সাথে নিয়ে। বাগানের দিকটায় খেয়াল করেননি তারা। খেয়াল করলেই দেখতে পেতেন ঘাসের উপর শুয়ে আছে একজনের ছেলে এবং আরেক জনের একমাত্র মেয়ের জামাই।
ব্যাপারটা বেশ লজ্জা জনক হতো প্রহনের ক্ষেত্রে।
পাখির কিচিরমিচির শব্দে আর বেশিক্ষণ সেই জায়গায় থাকতে পারলো না প্রহন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল বেড় করতে গেলে হাতের মুঠোয় বেড়িয়ে আসে একটা ছোট্ট গয়নার বাক্স।বাক্সটা দেখে মনে পড়ে, গতকাল রাতে মিসেস ইয়াসমিন তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল নতুন বউকে দেওয়ার জন্য।বাক্সটা খুলে তার ভেতর একটা সুন্দর ডিজাইনের আংটি দেখতে পেলো প্রহন। মোবাইল খুঁজে ও পেলো না। রাতে পিচ্চির বিছানার উপরই রেখে এসেছি মনে হয়।উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো। উদ্দেশ্যে সরদার সাহেবের বসার ঘরের সোফা। সেখানে বসেই মুখে গ্লু লাগাবে।কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর দিবে না। কিন্তু তার আগে মোবাইলটা নিতে হবে।
.
মুখ ধুয়ে বের হতেই বিছানার উপর সিফা কে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল চৈতি।
সিফা চৈতির হাতে একটা জামদানী কালো রঙের শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বললো তৈরি হয়ে নিচে নাস্তা করতে আসো।
এমন সময় রুমে অন্য কারো প্রবেশ ঘটলো।রুপা এসেছে। দরজা বন্ধ করতে করতে সিফার দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,
“মেজো, চৈতি কে কী কখনো নিজে থেকে শাড়ি পড়তে দেখেছিস?ও কি ঠিক মতো শাড়ি পড়তে পারে না সামলাতে পারে বল তো?”
রুপার কথার উত্তর দিলো না সিফা। শাড়ির ভাঁজ খুলতে খুলতে চৈতির উদ্দেশ্য বললো,
“বাকি জিনিস গুলো পড়ে আসো। আমি সুন্দর করে শাড়ি পড়া শিখিয়ে দিবো।”
ব্লাউজ আর পেটিকোট হাতে নিয়ে ওয়াস রুমের দিকে যাওয়ার সময় রুপা চৈতির বা হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়। তার পর জিজ্ঞেস করে,
“আমাদের ননদাই রাতে কী উপহার দিয়েছে বললে না তো ননদিনী।”
“কই?কেউ কিছু দেয়নি তো!”
“দেয়নি মানে?প্রহন রাতে তোমার রুমে আসেনি?”
“ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। কাউকে দেখিনি!”
চৈতির কথা শুনে সিফা আর রুপা একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া চায়ি করতে লাগলো।রুপা চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো তুমি আসলেই অনেক ছোট।
এমন সময় দরজায় টোকা পড়ে। রুপা গিয়ে দরজা খুলে প্রহন কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চৈতির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো রুপা।
প্রহন কে ভেতরে আসতে বলে সিফা কে হাতের ইশারায় সরে যেতে বলে নিজেও রুম থেকে বের হয়ে যায় রুপা। রুপার ইশারা বুঝতে পেরে সিফা ও শাড়িটা বিছানার উপর রেখে প্রহন কে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
বিয়ের পর এই প্রথম প্রহনকে দেখলো চৈতি।শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পড়া বিশাল দেহের পুরুষ মানুষটিকে দেখে ঘাবড়ে গেল সে। এই প্রথম বাবা আর ভাইয়েরা ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ তার রুমে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করার সাহস পেলো।
প্রহন এক পলক চৈতির চুপসে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বিছানার উপর থেকে মোবাইল টা হাতে নিয়ে চলে গেল। এতো সময় এই মোবাইল টা কে খেয়াল করেনি কেউ। প্রহনের চলে যাওয়ার দিকে নিষ্পলক চেয়ে বিড় বিড় করে চৈতি বলে উঠলো,
“উনি আমার স্বামী।”
চলবে,,,,