#অন্তহীন💜
#পর্ব_৯
#স্নিগ্ধা_আফরিন
“হঠাৎ অভ্যস্ত জীবনের সব পাল্টে গেল। নিজের সাথে জড়িয়ে গেল অন্য কেউ।যার আশা কখনোই করিনি।
জীবনের নিয়ম কখন, কোথায় কী ভাবে যেন এক নিমেষে বদলে দেয় সব কিছু।পাল্টে দেয় পথ।আহা জীবন!”
ঘড়ির কাঁটায় রাত ১টা।ঘুমন্ত চৈতির পাশেই শুয়ে আছে প্রহন। ঘুম নেই চোখ জুড়ে। মাথার মধ্যে হাবিজাবি চিন্তারা ঘুরপাক খাচ্ছে।যার কোনো যুক্তি নেই।ঘার ঘুরিয়ে চৈতির দিকে তাকালো প্রহন।গোলাপি রঙের ডিম লাইটের মৃদু আলোতে পুরো রুম আলোকিত। প্রহনের থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে বিড়াল ছানার মতো ঘুমিয়ে আছে চৈতি। প্রহন চোখ সরিয়ে ফেললো। কপালের ওপর এক হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুম পরীরা যেনো আজ শপথ করেছে, কোনো ভাবেই প্রহনের চোখে ধরা দিবে না।
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছেন সরদার সাহেব। চিন্তায় ঘুম নেই চোখে। বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে খবর পেলেন রিফাত ঢাকা থেকে এসে গেছে। অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতর কেপে উঠছে সরদার সাহেবের।
চৈতির জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল সরদার সাহেব কে। তিনি কড়া গলায় না করে দিয়েছিলেন। এমন জঘন্য একটা ছেলের হাতে কিছুতেই নিজের মেয়েকে তুলে দিতে রাজি ছিলেন না সরদার সাহেব।
কত হুমকি দিলো রিফাত।”এত মেয়েকে ছেড়ে আপনার মেয়েকে পছন্দ করেছি, বিয়ে করতে চেয়েছি,ওরে যদি বিয়ে করতে না পারি তাহলে এই দুনিয়া ছাড়তে হবে আপনার মেয়ে কে।কথাটা মাথায় রাইখেন।”
রিফাতের কথাটা মনে পড়তেই কেঁপে উঠলেন সরদার সাহেব।ছেলেটা যে ভীষণ খারাপ।
শোয়া থেকে উঠে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকেন। আদরের মেয়ে কে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো বাবার মন। বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে দরজার সামনে যেতেই মনে পড়লো, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। নিজের হাতে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। প্রহন আছে চৈতির রুমে। সরদার সাহেব বিষন্ন মনে ব্যালকনিতে চলে গেলেন। সেখানে রাখা আরাম কেদারায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
_______
নিশীথিনির গাঢ় অমা দূর করে পূর্ব দিগন্তে উদয়মান দিনমনির রাঙা প্রভায় রঙিন হয়ে উঠেছে ধরিত্রী। বুকের উপর ভারি কিছুর অনুভবে ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রহনের। চোখ মেলে তাকাতেই চৈতির ঘুমন্ত মুখটা নজরে এলো। ঘুমের ঘোরেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে।
জানালার পর্দার ফাঁকে বাইরে তাকালো প্রহন। অনেক বেলা হয়ে গেছে। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে এক ফালি রোদ এসে লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেতে।
চৈতি কে নিজের কাছ থেকে সরাতে চাইলে মেয়েটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। ঘুমের মধ্যেই বিড় বিড় করে,”আম্মু আরেকটু এমন করে থাকো না। আমি ঘুমাই।”
চৈতির বিড়বিড় করে বলা কথা শুনে কপাল চাপড়াতে থাকে প্রহন। ঘুমন্ত চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু স্বরে ডাকলো,
“পিচ্চি উঠো। সকাল হয়ে গেছে।”
নড়েচড়ে উঠলো চৈতি। প্রহনের কাছ থেকে সরে গিয়ে ঘুমের মধ্যেই উত্তর দিলো,”কয়টা বাজে?”
বালিশের পাশ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে সময় দেখে প্রহন জবাব দিলো,”৭টা৫৫।৮টা বেজে গেছে মনে করো।”
ঘুম ঘুম কন্ঠে চৈতি আবদার করে বসলো,”আরেকটু ঘুমাই?”
পিচ্চি বউয়ের আবদার কী অপূর্ণ রাখা যায়? হয়তো যায়। কিন্তু প্রহন তা অপূর্ণ রাখাতে চায় না।এতে পাপ হবে। ভীষণ পাপ!
প্রহন আর ডাকলো না। থাকুক ঘুমাক। শোয়া থেকে উঠে গেল সে।
.
.
ড্রইং রুমের সোফায় প্রহন কে বসে থাকতে দেখে রুপা বলে উঠলো,
“চৈতি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি?”
“না ঘুমাচ্ছে।”
রুপা আর কিছু না বলে চৈতির রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। বেশি বেলা করে ঘুম থেকে উঠলে শরীর ভালো থাকে না। রুপা চৈতির রুমে এসে দেখলো ঘুম থেকে উঠে বসে চোখ কচলাচ্ছে চৈতি। রুপার চোখ পড়লো চৈতির পায়ের দিকে।
“পায়ে এটা কি চৈতি?”
রুপার কথা বুঝতে না পেরে লাফিয়ে উঠলো চৈতি।
“ভয় পাচ্ছো কেন?”জোঁক না তো। পায়েল টার কথা বলেছি।”
“যে ভাবে বলছো মনে হয়েছে জোঁক ধরেছে পায়ে।”
“জোঁকে ভয় পাও যে তাই মনে হয়েছে। এখন বলো এত সুন্দর একটা পায়েল কে দিলো?”
দুই হাত দিয়ে চুলের খোঁপা করতে করতে চৈতি ছোট্ট করে উত্তর দিলো,”উনি।”
মুচকি হাসলো রুপা।”আংটি দেয়নি? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তো সবাই আংটি দেয়। তোমার ভাইয়া ও তো দিয়েছে।”
“জানি না আমি। শুধু রাতে পায়েল টা পড়িয়ে দিয়েছেন।”
“সবার চেয়ে ভিন্ন জিনিস দিয়েছে। ব্যাপারটা সুন্দর!”
চৈতির রুমের জানালার পর্দা সরিয়ে দিতে দিতে রুপা বলে উঠলো,”শ্বশুড় বাড়িতে এত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থেকো না। মানুষে খারাপ বলবে।”
“ঐ দিন ১০ টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিলাম।”
“কেউ কিছু বলেনি?”
“না।”
“নতুন নতুন কেউ কিছু বলে না।আস্তে আস্তে সবাই বলবে।”
রুপার কথার উত্তর দিলো না চৈতি। উঠে ওয়াস রুমে চলে গেল। ভবিষ্যতে কী হবে তা তখনই দেখা যাবে।
.
.
চার দিন প্রায় কেটে গেল। প্রহনের ছুটি আর মাত্র তিন বাকি আছে। চৈতি কে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসার সময় মেয়েটা অনেক কান্নাকাটি করেছে আজ। মেয়ের কান্না দেখে দেখেছেন জুনাইদা। সরদার সাহেবের ও মন খারাপ ছিল।মন সায় দিচ্ছিল না মেয়েকে যেতে দিতে। কিন্তু তিনি নিরুপায়। চাইলে আরো একদিন চৈতি কে নিজের কাছে রাখতে পারতেন। কিন্তু আপদ এসে জুটেছে গ্রামে। মেয়ের কোনো প্রকার ক্ষতি হোক চান না সরদার সাহেব।
.
বিকেলের দিকে নিজের রুমে শুয়ে আছে প্রহন। চৈতি রুমে নেই। রান্না ঘরে মিসেস ইয়াসমিন এর সাথে গল্প করছে আর মিসেস ইয়াসমিন সন্ধ্যার নাস্তা বানাচ্ছেন।আছরের আজান দিয়েছে অনেক্ষণ আগেই। পড়ন্ত বিকেলের এই সময়টায় চা খাওয়া রোজকার রুটিনের মধ্যে পড়ে প্রহনের। রুমে থেকেই চৈতি কে ডাক দিলো,
“পিচ্চি এক কাপ চা দিয়ে যাও তো।”
প্রহনের আদেশ শুনে মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হেসে বললেন,”আমার ছেলেকে কী যাদু করেছিস বল তো মা? বিয়ের আগে তো বিয়েই করতে রাজি ছিল না।আর এখন কোনো কিছু লাগলেই তোকে খুঁজছে।”
মিসেস ইয়াসমিন এর কথায় খানিক লজ্জা পেলো চৈতি।তা দেখে মিসেস ইয়াসমিন চৈতির হাতে এক কাপ চা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,”এত লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।যা চা টা ওকে দিয়ে আয়।”
উপর নিচ মাথা নেড়ে সায় দেয় চৈতি। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে প্রহনের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
চৈতির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন মিসেস ইয়াসমিন।
রুমে এসে প্রহন কে দেখলো না চৈতি। কিন্তু চৈতি কে দেখলো প্রহন। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,”আমি বেলকনিতে আছি।”
প্রহনের কন্ঠস্বর শুনে সে দিকে এগিয়ে যায় চৈতি। প্রহন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চায়ের কাপ টা এগিয়ে দিয়ে বললো,”আপনার চা।”
চৈতির হাত থেকে চায়ের কাপ টা নিয়ে তাতে চুমুক দিতেই ঠোঁট আর জিহ্বা পুড়ে যায় প্রহনের।তা দেখে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে চৈতি। চৈতির হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে চৈতির দিকে তাকালো প্রহন।হাত দিয়ে ঠোট মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলো,”এত হাসার কী আছে?”
প্রহনের প্রশ্ন শুনে চৈতি ও প্রহনকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে,”ফু না দিয়েই গরম গরম চা একেবারে খাওয়ার কী আছে?”
“বাহ কী প্রশ্ন।গরম গরম চা খাওয়ার অভ্যাস আছে আমার।আর চা গরমই খায়।ঠান্ডা না।”
চৈতি বেলকনি থেকে চলে যেতে যেতে বললো,
“অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না।”
চৈতির বলা কথাটা শুনে চুপ হয়ে গেল প্রহন। মেয়েটা কত বড় একটা সত্যি বললো। আসলেই কোনো কিছু নিয়েই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা উচিত না। চৈতির বলা কথাটা শুনে বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে ছিলো প্রহন। কেন জানি কথাটা তার মন ছুঁয়ে গেছে।
.
সন্ধ্যায় প্রহনকে বাইরে বের হতে যেতে দেখে মিসেস ইয়াসমিন বললেন,”ফেরার সময় তোর পিচ্চি বউয়ের জন্য চকলেট নিয়ে আসিস।”
প্রহন মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি না বললে ও নিয়ে আসতাম।”
“কত মোহাব্বত বউয়ের প্রতি। বিয়ের জন্য তো রাজিই হতে চাইছিলি না। বিয়ের দুই দিনেই এত মোহাব্বত বউয়ের প্রতি? এতো ভালোবাসা?”
“ভুল বলছো। ভালোবাসা না।এইসব আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।ওর বাবাকে আমি কথা দিয়েছি ওরে কখনো কষ্ট পেতে দিবো না। আমি শুধু সেই কথাই রাখার চেষ্টা করছি এবং বিয়ে নামক বাঁধনে জড়িয়ে আমার উপরে যে দায়িত্ব পড়েছে আমি সেই দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি।”
প্রহনের কথা শুনে মিসেস ইয়াসমিন বললেন,
“শুধু দায়িত্ব পালন করলেই সংসার করা যায় না। দায়িত্ব পালনের মধ্য শুধু এই সব কিছু পড়ে না। ভালোবাসার ও প্রয়োজন পড়ে। স্বামীর ভালোবাসা
ছাড়া একটা মেয়ে কখনোই সুখী হতে পারে না।”
চলবে,,,,,