#অপ্রিয়_রঙ্গনা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫
তাখলিফ দরজা লাগাতে লাগাতে ভাবলো এর আবার কি হলো! প্লেটে খাবার নিতে গিয়ে দেখলো একটা চিরকুট। সেখানে লিখা, “সকালের দুর্ব্যবহার ভুলিনি। ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত আপনার সাথে কথা বলবো না।”
তাখলিফ দু’বার পড়ে চিরকুটটা। এরপর দুমড়েমুচড়ে পকেটে রেখে বলে ওঠে, “নাটকবাজ মেয়ে একটা।”
ঝুমুর অবশ্য নিজের কথা রাখলো। নিজে থেকে এসে কথা বললো না তাখলিফের সাথে। অন্য উপায় বের করলো। চিরকুট লিখতে শুরু করলো। তাখলিফ সেগুলো পড়তো আর দুমড়েমুচড়ে ফেলতো। তবে ক্ষমা চাইলো না। না বলুক কথা, ও তো এটাই চায়। এই মেয়েকে আস্কারা দিলে ভবিষ্যতে পস্তাতে হবে। নিজেকে নিয়ে ওর ভাবনা নেই। ও সব সয়ে নেবে। স্বাভাবিক জীবনটা আর হারাতে চায় না তাখলিফ। বাবাকে নিয়ে ভালো আছে সে!
___________
ঝুমুরের পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না একদমই। তেমন ভালো ছাত্রীও নয়। তবুও ভার্সিটির বাংলা বিভাগে ভর্তি হতে হয়েছে ওকে। এইচএসসি শেষ করার পর থেকেই ওর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ আসতে শুরু করেছে। আর ঝুমুর একটু সুন্দরী হওয়ায় ওকে নিয়ে মা-বাবা চিন্তায় থাকেন এটাও জানে ও। বখাটেরা ওর পিছু পড়ে থাকে, কোনদিন না আবার কিছু করে বসে সেই চিন্তায় ঘুম হয়না তাদের। এসব নিয়ে ঝুমুরও ভয়ে থাকে। তবে কাকতালীয় ও স্বস্তির একটা ব্যাপার হলো ওর ভার্সিটির খুব কাছেই তাখলিফের অফিস। এদিক দিয়ে ঝুমুর খুব খুশি। হয়তো কোনো এক বৃষ্টি দিনে হুট করে দু’জনের দেখা হয়ে যাবে। বৃষ্টিতে ভিজে রিকশায় করে বাড়ি ফিরবে দু’জন। তোয়ালে দিয়ে ভেজা মাথা মুছে দেবে তাখলিফের। নিরিবিলি বাড়ির তিন তলায় ওদের ছোট্ট একটা সংসার হবে। বারান্দায় মুখোমুখি বসে দু’জনে কফি খাবে, রাতের উজ্জ্বল আকাশ দেখবে! মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখবে প্রিয় মানুষটাকে। ঝুমুরের অনেক স্বপ্ন। সব স্বপ্নকে ঘিরে আছে তাখলিফ। ওর ছোট্ট জীবনের একমাত্র চাওয়া! মানুষটাকে নিজের করে পেয়েও যেন পাওয়া হচ্ছে না ওর। এই দুঃখ, আফসোস কখন ঘুচবে বা আদৌ ঘুচবে কি-না জানে না সে! ঝুমুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে ভার্সিটির গেইটে। গরমে ফর্সা মুখখানি লাল বর্ণ ধারণ করেছে। একটা রিকশাও দেখা যাচ্ছে না। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে খেলো, ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে হাঁটা ধরলো ফুটপাত দিয়ে। কি যেন মনে হলো! তাখলিফের অফিসের সামনে ঘুরঘুর করলো কিছুক্ষণ। ছায়ায় বসে ফুচকা খেলো। লাঞ্চ টাইম শুরু হওয়ায় দেখলো অফিস থেকে বেরিয়ে অনেকে দল বেঁধে পাশের একটা রেস্তোরাঁয় যাচ্ছে। আশা করেনি ঝুমুর, হঠাৎই তাখলিফকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে গেলো। তাখলিফ তখনো দেখতে পায়নি ওকে। হাত নাড়িয়ে কথা বলছে একটা মেয়ের সাথে, সম্ভবত কলিগ! দেখেই ঝুমুরের মন খারাপ হয়ে গেলো, লুকিয়ে পড়তে যাবে তখনি তাখলিফ ওকে দেখে ফেললো। ঝুমুর এখানে কি করছে ভেবে কতক্ষণ বিস্ময়াভিভূত হয়ে থমকে রইলো সে। এরপর গটগটিয়ে হেঁটে কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “তুই এখানে কি করছিস?”
ঝুমুর ভুলেও কথা বললো না৷ তাখলিফ বিরক্তিকর চাহনি দিতেই নোটে লিখে জানালো, “ভার্সিটিতে এসেছিলাম।”
সন্দেহী চোখে তাকালো তাখলিফ, “ভার্সিটি তো
এদিকে নয়!”
“রিকশা পাচ্ছিলাম না৷ তাই খুঁজতে খুঁজতে এদিকে এসে গেছি। আচ্ছা, এখুনি চলে যাচ্ছি।”
তাখলিফ লিখাটা পড়লো। ঝুমুরও চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই পিছু ডাকলো। ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো, “খেয়েছিস কিছু?”
ঝুমুর মাথা নাড়ালো। তাখলিফ ওকে লাঞ্চ করার অফার দিবে কিনা ভাবলো! রোদে পুড়ে গেছে লালা হয়ে আছে চেহারা। মেয়েটাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। হয়তো কিছু খায়নি। পাগলের ভূত মাথায় চেপেছে বলে এই দুপুরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। বোকাটা যে ওর জন্য এসেছে তা বেশ বুঝেছে ও। নেহাৎই মানবিকতার খাতিরে লাঞ্চের অফার করতেই ঝুমুর রাজি হয়ে গেলো। রেস্তোরাঁয় ঢুকে খাবার অর্ডার দিয়ে বসে
রইলো দু’জন। খাবার চলে এলো একটু পর। এমন সময় অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা ঘটলো৷ ওয়েটার সফট ড্রিংকস নিয়ে আসার সময় হোঁচট খেলো। ড্রিংকস পড়ে তাখলিফের শার্ট ভিজে গেলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো ও৷ ঝুমুর লাফিয়ে ওঠে ওয়েটারকে কড়া কথা শুনিয়ে দিলো। ওয়েটার বেচারা বারবার ক্ষমা চাইতে লাগলো। তাখলিফ ব্যাপারটা সামলে নিলো। ঝুমুরকে রিকশায় তুলে দিতে গেলে নিজের ওড়না দিয়ে তাখলিফের চোখমুখটা মুছে দিলো ঝুমুর। আকস্মিক এমন কান্ডে বাক্যহীন হয়ে পড়লো সে!
তপ্ত দুপুরে ক্লান্ত রমণীর ওড়নায় থাকা সুবাসটা মন-মস্তিষ্কে জেঁকে বসেছিলো তাখলিফের। পরের সময়টা অফিসের কাজে তেমন একটা মন দিতে পারলো না ও! বাড়ি ফিরে ও একটা কাগজে লিখলো, “স্যরি ঝুমুর।”
কিন্তু চিরকুটটা আর দেওয়া হলো না। তিথির কাছ থেকে জানতে পারলো ঝুমুর বিকেলেই বোনের বাড়ি বেড়াতে গেছে। কয়েক দিন থাকবে। এই ক’টা দিন তাখলিফের কয়েক বর্ষের ন্যায় মনে হলো। দিনগুলো কাটলো উলটপালট। কোনো কাজই ঠিকঠাক করতে পারলো না৷ ঝুমুরও যেন ওকে বেমালুম ভুলে গেলো।এই ক’দিনে একটাও ম্যাসেজ করলো না ওকে। নিজের কাজগুলো তাখলিফের অভ্যাসে পরিণত করে হারিয়ে গেছে, চালাক হয়ে গেছে বোকাটা! চিরকুটটা কুটি কুটি করে আগুনে পুড়িয়ে ফেললো তাখলিফ। নিজের কাজে পরে
নিজেরই রাগ হলো। এসব কি করছে সে?
___________________
এর মধ্যে আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। ঝিনুকের শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলো। ঝুমুরকে ছোট ছেলের বউ করে নিতে আগ্রহী ঝিনুকের শ্বাশুড়ি। পাখি বেগমের খুব মনে ধরলো এই প্রস্তাব। ছেলে ভালো, সরকারি চাকুরিজীবী। ঝুমুরকে নাকি ছেলের খুব পছন্দও হয়েছে। তবে তাদের বিশাল বড় পরিবার ও রক্ষণশীল মনোভাবের বলে শামসুল হক দ্বিধায় পড়ে গেলেন। বড় মেয়ে ঝিনুক এই সংসারে মানিয়ে নিতে বেজায় হিমশিম খাচ্ছে এমনিতেই। তার মধ্যে আবার ঝুমুর! ঝিনুকের মতো এত ধৈর্য্যশীল মনোভাবের নয় তার এই ছোট মেয়েটি। তাছাড়া ইয়াসিফ জানলে আবারও হুলস্থুল কান্ড ঘটাবে। এখনি বোনের বিয়ে দিতে চায় না সে। প্রস্তাব দেওয়ার ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে গিয়েও কাজ হলো না। জানাজানি হয়ে গেলো। আর এতে সবচেয়ে বেশি রেগে গেলো তাখলিফ, রাগলো সে ঝুমুরের ওপরই! তবে ইগো বা অস্বস্তি যে কারণেই হোক না কেন ঝুমুরকে সরাসরি ফোন বা ম্যাসেজ দিতে বাঁধলো ওর। মাঝরাতে সে ফোন করলো ইয়াসিফকে। একমাত্র ও-ই দু’জনের সাথে ঘটা কাহিনী একমাত্র জান্তা। তবে এই প্রথমবার ইয়াসিফ ফোনটা রিসিভ করতে পারলো না। রাগে নিশপিশ করতে করতে সারারাত প্রায় নির্ঘুম কাটলো তাখলিফের। সকাল সকাল ফোন এলো ইয়াসিফের। তাখলিফ রিসিভ করেই ধমক দিলো, “বেশি ব্যস্ত হয়ে গেছিস না? এত ফোন দিলাম তোর চোখে পড়লো না?”
ইয়াসিফ বুঝলো বেজায় রেগে আছে তার এই মাথা
গরম ভাইটি। সে তাই শান্ত স্বরে হেসে বলল, “আমার বোনের ফোনও তো তোমার চোখে পড়ে না।”
তাখলিফ ভ্রু কুঁচকালো। এরপর রুক্ষ স্বরে বলল,
“বোনের পক্ষ নেওয়া হচ্ছে? তোর বোন কই?”
“কেন? তোমার ওকে কি প্রয়োজন?”
তাখলিফের মেজাজ বিগড়ে ছিলো। প্রশ্ন শুনে আরো
চটে গেলো, “পড়াশোনা গাঙে তুলে বেড়াতে গেছে
না? গাধা টার কি করার কথা ছিল? পড়াশোনা করে ভবিষ্যৎ গড়বে, কিন্তু কি করছে? মানুষের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে আর সেখান থেকে প্রস্তাব আসছে। নে, তোর বোনকে তুই বিয়ে দিয়ে দে। আমাকে বলিস ডিভোর্স লেটারটা পাঠিয়ে দেবো।”
ইয়াসিফ আঁৎকে ওঠে বলল, “আরে এত রাগছো কেন? আজই বাড়ি ফিরতে বলবো ওকে। কোথাও তো যায় না বেড়াতে, তাই আরকি! আবার কোথা থেকে প্রস্তাব এলো?”
“যায় না তো একেবারেই পাঠিয়ে দে। বেয়াইয়ের সাথে বিয়ে করিয়ে দে। সারাজীবন বড় বোনের ছত্র ছায়ায় থেকে যাবে।”
“তুমি এত ভাবছো কেন? তুমি তো নিজেই চাও না আমার বোন তোমার আশেপাশে ঘেঁষুক।”
“সামনে পেলে গলা টিপে মার’বো!”
বলে তাখলিফ ফোন কেটে দিলো। রাগে গায়ে জ্বালা
ধরে যাচ্ছে তার। সানওয়ার হক দরজায় এসে বারবার ডাকছেন। তাখলিফ বিরক্তি নিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“আমাকে ঘুমুতে দাও।”
“অফিসে যাবি না?”
“না।”
“আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। মেইন ডোরটা আটকে দে।”
“যাও তুমি।”
সানওয়ার হক পুত্রের মনের অবস্থা ধরতে পারলেন
না। তিনি নিজের কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।
তাখলিফ মেইন ডোর লক করে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে নাস্তা করতে বসলো। নোটিফিকেশনর শব্দে চোখ তুলে ম্যাসেজ পড়লো, “ডিভোর্স না দিয়ে মৃত্যু দিলে খুশি হবো।”
বহুদিন পর ঝুমুরের ম্যাসেজ পেয়ে তাখলিফ রাগে ফোনটা সোফায় ছুঁড়ে মারলো, “তোকে মৃত্যুই দেবো।”
’
_________
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]
#চলবে….