প্রিয়_প্রাণ #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ২২

0
539

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২২

আরহামে’র আজ সত্যি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিলো তাই কিছুটা সময় ব্যাস্ততায় কেটেছে তার ফলাফলস্বরূপ ফোন হাতে তোলার সময় পায় নি। নাহলে সে তার তুঁষে’র মিনিটের খবর ও রাখার চেষ্টা করে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো একটা বাজে। মিটিং সবে শেষ হলো। আরহাম ফোনটা হাতে তুলে প্রথমের সিসিটিভি ফুটেজ অন করে। নিশ্চিত তুঁষ’টা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। ভাবতেই মৃদু হাসে আরহাম যা মুহুর্তেই পরিবর্তীত হয়ে আতঙ্কিত রুপ ধারণ করলো। বিগত তিন ঘন্টায় তোঁষা’র করা আচরণ কোনমতে দেখে যেই না ভিডিও টানলো ওমনি আরহাম পাগল হয়ে গেলো। অসম্ভব ভাবে বুকে উঠানামা করছে তার। বিরবির করে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনে। অতঃপর পাগলের মতো দৌঁড়ে ছুটলো আরহাম।
কোনমতে গাড়িতে উঠেই স্টেরিং এ হাত রাখে ও। চোখে এখনও আটকে আছে তোঁষা। প্রচন্ড বেগে হাত কাঁপছে আরহামে’র। বিরবির করে বারংবার বলে যাচ্ছে,

— ত….তুঁষ, আমার তুঁ…ষ। তুই ক…কি করলি?

জোরে জোরে শ্বাস টানে আরহাম। কোনমতে স্টেরিং ঘুরালো। একসময় দিকবিদিক হারিয়ে ড্রাইভিং করলো। আগে পিছে কিছু না দেখে আরহাম শুধু গাড়ি চালালো। গাড়িটা বাসার সামনে পৌঁছাতেই দৌড়ে নেমে গেলো লিফটের কাছে। বাইশতলায় যাবে সে অথচ লিফট এটা এগারোতে আটকে। বা সাইডের লিফটেও ভিড়। পা চলছে না আরহামে’র। কোনমতে সে দৌড়ে লাগালো সিঁড়ি দিয়ে। বাইশ তলা! ঠিক বাইশ তলা সে দৌড়ে উঠতে উঠতে আর কিছু যেন মনে পরে না। দরজায় হাত থাপড়া দিয়ে ডাকতে লাগে,

— তুঁষ!! এই দরজা খোল! দরজা খোল প্রাণ। এই যে আমি। তুঁষ?

দরজা খুললো না কেউ। আরহামের মস্তিষ্ক হঠাৎ কিছুটা সজাগ হলো। তুঁষ কিভাবে দরজা খুলবে? চাবি কোথায়? নিজের বুক পকেটে হাতরায় ও। নাহ। নেই চাবি। কার্ড ও নেই। প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই মিললো কাঙ্ক্ষিত জিনিস। হাত কাঁপার দরুন বারকয়েক চেষ্টা করে দরজা খুলে ও। অতঃপর এক দৌড়ে রুমের সামনে এসে ছিটকিনি খুলে দিলো। সম্মুখে তাকিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পরলো আরহাম। মাথায় হাত দিয়ে আস্তে করে বললো,

— কি করলি এটা তুঁষ?

সারা রুম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তোঁষা’র বইগুলো। কোনটাই অক্ষত নেই। তোঁষা’র জেদ, রাগ সব তারা সহ্য করেছে। আরহাম এবার উঠে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে তোঁষা’র কাছে বসলো। হেলে পড়া তোঁষা’র দেহটা নিজের কম্পমান দেহের ভাজে তুলে নিতেই নজর গেলো তোঁষা’র বা হাতে। চুয়ে চুয়ে র*ক্ত বের হচ্ছে সেখান থেকে। আরহাম শব্দ করে না। ঘার কাত করে দেখে তোঁষা’র র*ক্ত। সাদা চামড়া ভেদ করে ঝরা র*ক্ত। সাদার মাঝে লাল। বেশ মানালো আরহামে’র নজরে। পাশ থেকে তোঁষা’র ওরনা তুলে র*ক্তাক্ত হাতটা পেঁচিয়ে ধরে বুকে চেপে ধরে তোঁষা’র দেহটাকে। কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে অভিযোগ জানায় অভিমানে টাইটুম্বুর কণ্ঠে,

— এটা কেন করলি প্রাণ? কি করলি এটা?
তুই আমার প্রাণের হেফাজত কেন করতে পারিস না?

ক্রমে ঠান্ডা হচ্ছে তোঁষা’র পাখিসম দেখটা অথচ হেলদোল নেই আরহামে’র। সে তার প্রাণ’কে বুকে নিয়ে বসে আছে। মাঝেমধ্যে কথা বলছে। অভিযোগ জানাচ্ছে নিজ স্বরে। সময় কাটলো। প্রায় সাত আট মিনিট। হঠাৎ ই পকেটে কিছু ভাইব্রেট হলো। আরহাম চোখ বড় বড় করে তাকালো। প্রচন্ড জোরে যেন ধাক্কা খেলো। নিজের বুকে তাকাতে নিজেই আঁতকে উঠল যেন। অগোছালো, নিঃস্প্রাণ তোঁষা তার বুকে। কখন, কিভাবে আরহাম যেন ভুলেই গেলো। সে ঠিক কতক্ষণ এভাবে তোঁষা’কে নিয়ে বসে ছিলো? না ভাবতে পারলো না ওর মস্তিষ্ক। বুক থেকে তোঁষা’র মুখটা সরিয়ে অস্থির হয়ে চিৎকার করে আরহাম,

— তুঁষ? এই তুঁষ? কি হয়েছে আমার প্রাণে’র? প্রাণ? তুই এভাবে কেন? উঠ!! উঠ না তুঁষ।

তোঁষা উঠে না। আরহাম উত্তেজিত হলো বহুগুণে। গুনগুন করে তার কান্নার শব্দ ও এলো। তোঁষা’কে বুকে তুলে একসময় শব্দ করে কেঁদে ফেললো সে,

— আ….আমার তুঁষ। আমার প্রাণ, তু…ই কি চলে গেলি? কথা…কথা বল না তুঁষ? এ…এই….

নিঃস্তব্ধতার ঘিরা ফ্লাট’টাতে পুরুষটার কান্না বিকট শুনালো। আরহামে’র মস্তিষ্ক তার সাথ দিচ্ছে না ঠিকঠাক। তোঁষা’র বা হাতটা চেপে ধরে সে উঠে দাঁড়ালো। টলমলে পায়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।
________________

তুহিন পানির গ্লাসটা নিতে গিয়ে ভেঙে ফেললো। গলা শুকিয়ে গিয়েছে আজ বেশি। দৌড়ে রুমে ঢুকেন তোঁষা’র মা। স্বামী’কে বসে হাশফাশ করতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে তারাতাড়ি সামনে আসেন। তুহিন কাঁপা গলায় পানি চাইতেই তারাতাড়ি স্বামী’কে ধরে পানি পান করান তিনি। তুহিনের কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ওরনা’র কোণা দিয়ে তা মুছে দিলো তোঁষা’র মা। অল্প বিস্তর কুঁচকানো চামড়ার হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিতেই তুহিন দম ছাড়লেন। স্ত্রী’র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিয়ংকাল। মায়াময় এক নারী অবয়ব। ছোট্ট সেই কিশোরী বউটা তার কবে যে এতটা বড় হলো? তুহিন উত্তর পান না। নিজের একটা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলেন স্ত্রী’র গাল। আজও বড্ড নরম। অস্থির কণ্ঠে তোঁষা’র মা জিজ্ঞেস করলো,

— বেশি খারাপ লাগছে?

তুহিনের চোখে পানির ছলকানির দেখা মিললো। মানুষটা কাঁদে কেন? আর কত কাঁদবে? কেন ভাবে না তাদের কোন মেয়ে নেই? এটা কি আদৌ ভাবা যায়? এত সখের একটা শেষ বয়সের নাড়ী ঝাড়া সন্তান। কিভাবে ভুলবে? তুহিন ভাঙা গলায় বললো,

— পুতুলটা’র পরিক্ষা গেলো। সকাল থেকে কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাবলাম আসবে। এলো না। দেখ.. আমাকে দেখ। কত ক্লান্ত আমি। পুতুল কি ওর বাবা’কে ভুলে গেলো? আমি না অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। একে একে কত মানুষ এলো আবার চলেও গেলো কিন্তু আমার পুতুলটা এলো না। আচ্ছা ও কি ম’রে গেলো? মে’রে ফেলেনি তো? এতদিন তো কোথাও থাকতে পারে না। দেখ না কেমন ছটফট করে। কোথায় যে আছে পুতুলটা?

তোঁষা’র মা শক্ত করে স্বামী’র হাতটা ধরে। তুহিন নিজেই আবার বললো,

— ম’রে নি বোধহয়। আমার বিশ্বাস আরহাম লা’শ আনবে শেখ বাড়ীতে। বলো? আনবে না? নাকি লা*শটাও দেখাবে না আমাকে?

বলেই হু হু করে কেঁদে ফেললেন তিনি। তোঁষা’র মা শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নেন স্বামী’কে। চোখ উপচে পানি ঝড়ছে তারও।
দরজায় বাইরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছেন তুরাগ। পাশেই তার স্ত্রী আর আদনান। সত্যি ই পুতুলটা বেঁচে নেই।
আজ তুহিন রাস্তায় পরে ছিলো। তুরাগ কল পেতেই ছুঁটে যান। কেন্দ্রের বাইরে গরমে জ্ঞান হারায় তুহিন। এক বাবা’র তৃষ্ণার্ত চোখ তার মেয়ের অপেক্ষায়। শেষ বয়সে পাওয়া এক অমূল্য রতন তার পুতুল। কোথায় যে হারালো?

_______________

সুবহে সাদিক সেরে সূর্য উঁকি দিলো ধরণীর বুকে। এক ধ্যানে তোঁষা’কে দেখছে আরহাম। ডান হাতে স্যালাইন চলছে ওর। হাতের উপরের চামড়া কেটে ফেলেছে তুঁষ’টা। বড্ড জেদী কি না? পরিক্ষা’র জন্য এমন করলো? কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আরহাম না এই পরিক্ষা?

তোঁষা চোখ খুললো দুপুর দিকে। চোখ খুলে প্রথমেই নজরে এলো আরহামে’র মুখটা। প্রতিক্রিয়া দেখালে না তোঁষা। তার মস্তিষ্ক তখনো ধরতে পারে নি। ঝাপসা চোখে দেখে যাচ্ছে তোঁষা। মনে পরে না কিছু। আরহাম হাত রাখলো তোঁষা’র মাথায়। আস্তে করে ডাকলো,

— তুঁষ?

— কে?

— আমি।

— আমি?

— চোখ বন্ধ কর তুঁষ।

তোঁষা চোখ বুজলো। মিনিটের ব্যাবধানে চোখ খুলে দেখলো। হ্যাঁ এবার চিনলো তোঁষা৷ আরহাম ওর সামনে। কথা বললো না তোঁষা। চুপচাপ দেখে গেলো আরহাম’কে। আরহাম ঢোক গিলে তোঁষা’র হাতটা ধরে। কপালে চুমু খেয়ে আদুরে ভাবে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। অভিমান ভর্তি গলায় বললো,

— এমনটা কেন করলি প্রাণ?

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here