#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭৩|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
কিছুক্ষণ আগেই রাতের খাবার খেয়ে অর্পণ নিজের ঘরে এসেছে৷ খাবার টেবিলে প্রলয়কে খুবই চুপচাপ মনে হলো৷ অন্যদিনের তুলনায় আরও বেশি গম্ভীর মনে হয়েছে। অর্পণ বুঝেছে ভূমিকে নিয়ে তার ভাইয়ের যত ভাবনা। এখন আপাতত ভাইকে সময় দেবে৷ খুব বেশি ভাইয়ের পেছন পেছন ঘুরঘুর করা যাবে না৷ এদিকে সেও তো শুধুমাত্র ভূমিকে নিয়েই ভাবছে৷ মাথায় তার অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে। কী করে ভূমি আর প্রলয়কে আবারও কাছাকাছি নিয়ে আসবে সেটাই পরিকল্পনা করছে। এমনিতে যে তার বোন এ বাড়িতে আর ফিরবে না তা সে বেশ বুঝেছে৷ অভিমানের পাহাড় খুব বেশি উঁচু কি-না! হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। নারী প্রচণ্ড অবহেলা আর অবিশ্বাসে নিজেকে পালটে ফেলে। অর্পণের মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে৷ তা হলো‚ সে তার বোনকে আবেগের জালে জড়িয়ে এ বাড়িতে পুনরায় ফেরার জন্য রাজি করাবে। কীভাবে কী করতে হবে সেসব কিছু ভাবা হয়ে গিয়েছে তার৷ অর্পণের ভাবনার মাঝেই ইরার নাম্বার থেকে ভিডিও কল এলো। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! সঙ্গে সঙ্গেই রিসিভ করল সে। স্ক্রিনে ইরার মুখটা দেখে ক্ষীণ হাসল অর্পণ। তাকে এভাবে হাসতে দেখে ইরা জিজ্ঞেস করল‚
“হাসলে কেন? আমাকে কী ফানি দেখাচ্ছে?”
“আমি কি সে জন্য হাসলাম?”
চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে ইরা বলল‚ “তাহলে?”
“তোমাকে সুন্দর লাগছে ইরাবতী। আচ্ছা তোমার কী মনে হয় না— আমাদের দ্রুত বিয়ে করে নেওয়া উচিত?”
হুট করে বিয়ের কথা শুনে সহসাই অবাক হলো ইরা। তারা তো বিয়ের প্ল্যান আরও দুবছর পর করেছিল৷ অর্পণ এখনই কেন বিয়ের কথা বলছে? বুঝতে পারল না সে৷ ইরা জিজ্ঞেস করল‚
“তা মশাই হুট করে বিয়ের ভূত মাথায় চাপল কেন?”
“পুরো এক বছর তো প্রেম করলাম। এবার ইরাবতীকে প্রেমিকা রূপে নয় বউ রূপে দেখতে চাই। তো এখন তোমার সিদ্ধান্ত বল! তাহলে আমি মাকে আজই জানিয়ে দেব।”
“তোমার মতো তো আমি নির্লজ্জ না। নিজের বিয়ের কথা আমি কী করে তাদের বলব?”
“তোমার কাউকে কিছু বলতে হবে না৷ যা ব্যবস্থা করার আমিই করব৷”
“হঠাৎ বিয়ে করার কথা তুললে কিছু কী হয়েছে? ভাই এনি চান্স— বাড়ি থেকে কী তোমার জন্য মেয়ে খুঁজছে?”
ইতিমধ্যেই ইরাকে এতদূর ভেবে ফেলতে দেখে এবার সশব্দে গা কাঁপিয়ে হেসে উঠল অর্পণ। যেন ইরা কোনো জোকস শুনিয়েছে। তাকে এভাবে হাসতে দেখে ইরা গাল ফুলিয়ে বলল‚
“আমাকে ছাড়া যদি অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করার ভাবনা মাথায়ও এনেছ তাহলে তোমার কী অবস্থা হবে— সেটা তুমি ভাবতেও পারছ না!”
“তুমিও চাইলে আমার জন্য মেয়ে খুঁজে দিতে পারো। বয়স হচ্ছে তো। বিয়েথা করে বাচ্চা সামলাতে হবে না? এরপর বুড়ো হয়ে গেলে কেউই বিয়ে করবে না।”
“আমার সঙ্গে মশকরা করা হচ্ছে? বদ লোক একটা৷”
আবারও হেসে উঠল অর্পণ। সঙ্গে সঙ্গে বলল‚ “চোখের সামনে একটা বাচ্চাকে দেখছি। একেই তো আমাকে সারাজীবন চোখে চোখে রাখতে হবে। আমার কী আর অন্যদিকে তাকানোর সময় আছে?”
ইরা আর কিছুই বলল না৷ অর্পণের সঙ্গে কথা বলবে না সে৷ লোকটা কারণে অকারণে তাকে শুধু ক্ষেপায়৷ এরপর দুজনের মাঝে নেমে এলো এক অবাক নীরবতা৷ অর্পণ গম্ভীর হয়ে কিছু একটা ভাবছে। এদিকে নীরবতা সহ্য হচ্ছে না ইরা৷ তাই সে নীরবতা কা’টাতে নিজে থেকেই বলল‚
“কী ভাবছ?”
“তোমাকে একটা কথা বলব ভাবছি।”
“কী কথা?”
“এ কথাটা কিন্তু পাঁচ কান হওয়া যাবে না।”
“এই বুঝি তুমি আমাকে ভরসা কর?”
“তেমনটা না রে পাগলি৷ ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস। আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িত।”
“আচ্ছা বল— এ কথা আর কেউই জানতে পারবে না।”
“ভূমি বেঁচে আছে।”
অর্পণের কাছ থেকে এমন অবিশ্বাস্য কথা শুনে চেঁচিয়ে উঠল‚ “কীইইইইইই?”
নিজের ঠোঁটে তর্জনী ছুঁয়ে অর্পণ বলল‚ “আস্তে চেঁচাও। যা শুনেছ সেটাই বলেছি আমি।”
“ভূমিকে তুমি কোথায় পেলে?”
অর্পণ পরপর সব কথা খুলে বলল। শুধু মেহরাব শিকদার আর ভূমির মাঝে সম্পর্কের কথাটা এড়িয়ে গেল। সত্যিটা তো একদিন সবার সামনে আসবেই। সেদিনই না-হয় সবাই সব সত্যি জানবে। তার আগে কিছু কথা সকলেরই অজানা থাকুক৷ অর্পণ আবারও বলল‚
“ওহ হ্যাঁ আরেকটা কথা!”
“কী?”
“ভূমি কনে পক্ষ থাকবে। তোমার বন্ধু হিসেবে।”
“কেন?”
“তোমাকে তো বললাম— ভূমি ভাইয়ের জীবনে আর ফিরতে চায় না৷ আর আমি চাই ওরা দুজন আবারও এক হোক৷ তারজন্য আমাদেরই কিছু করা উচিত।”
“তোমার কী মনে হয় আমাদের পরিকল্পনা কাজে দেবে?”
“অবশ্যই দেবে৷ তবে কোনো তাড়াহুড়ো নয়৷”
এরপর দুজনে আরও অনেক কথাই বলতে শুরু করল৷ নিজের পরিকল্পনা একে অপরের সঙ্গে শেয়ার করতে শুরু করল৷
অন্যদিকে…
নীলচে ঘুম বাতির আবছা আলোয় প্রলয়ের ভাবভঙ্গি টের পাওয়া যাচ্ছে না৷ তবে এটা বুঝা যাচ্ছে যে‚ সে বিছানায় শুয়ে রয়েছে। বারবার এপাশ অপাশ করেও ঘুম আসছে না তার৷ এমনটা তার সঙ্গে প্রতিদিনই হয়। ভূমি তার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থেকে গিয়েছে৷ আর তাদের অনাগত বাচ্চাটা হয়তো এতদিনে কিছুটা বড়ো হয়েছে৷ ভূমি আর তাদের সন্তানকে ফিরে পাবার আশায় প্রতিনিয়ত দিন গুনছে প্রলয়৷ আদতে মৃত্তিকাই ভূমি কি-না তার জানা নেই। মৃত্তিকাই যদি ভূমি হয়ে থাকে তাহলে তার অভিমানের পাহাড় ভাঙানোর জন্য অনেক কাঠখড় পোহাতে হবে৷ নিজের সন্তানকে অস্বীকার করার মতো মস্ত বড়ো ভুল সে করেছে। সে-ও চায় ভূমি আর তাদের সন্তান দুজনেই তার জীবনে ফিরে আসুক। যতদিন না ভূমি তাকে ক্ষমা করবে‚ তার জীবনের পুনরায় ফিরে আসবে ততদিন ধরেই সে প্রায়শ্চিত্ত করে যাবে। এটাই তার প্রাপ্য। প্রলয় বালিশ আঁকড়ে ধরে বলতে শুরু করল‚
“তুমি যেমন এক আকাশসম অভিমান নিয়ে চলে গিয়েছ। ঠিক তেমনই ভাবে আমার জীবনে রয়ে গিয়েছে এক আকাশসম বিষণ্ণতা। স্ত্রী‚ সন্তান আর ছোট্টো পরিবার থাকা সত্বেও আমি শূন্য। অপূর্ণ হয়ে থেকে গিয়েছি আমি। অপেক্ষার প্রহর যে আমাকে বড্ড তড়পাচ্ছে৷ ক্রমশ আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। তোমাদেরকে কী আমি কোনোদিনও ফিরে পাব না ভূমি কন্যা?”
এই বলে বালিশে আবারও মুখ গুজল। মনে হলো যেন ভূমিকেও জড়িয়ে ধরেছে সে। কপালের ক্ষ’ত কিছুটা শুকিয়েছে৷ তবে চিনচিনে ব্যথাটা এখনো রয়েছে। প্রলয় আবারও মুখ তুলল৷ বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে গ্যালারি থেকে ভূমির ছবিগুলো দেখতে শুরু করল। এই ছবিগুলো দেখেই তার রাত কে’টে সকাল হয়৷
❑
বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষে ঘোর অমা। কোথাও কোনো আলোর দিশা নেই৷ ল্যাম্পপোস্টের বাতি গুলোতে ঝিঁঝি পোকার ঝাঁক বসেছে৷ অবসাদগ্রস্ত রাতটা মৃত্তিকার পাথর হৃদয়কে আরও বিচলিত করে তুলছে৷ বারান্দায় আলোয় বসে উপন্যাসের বই পড়ছে সে৷ আজ প্রলয়কে খুব করে মনে পড়ছে৷ ভাগ্য মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায় তা ঘুনাক্ষরেও আগে থেকে উপলব্ধি করা যায় না! যদি আগে থেকে উপলব্ধি করা যেত তাহলে হয়তো মানুষের জীবন আড়ালে আবডালে এলোমেলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে থাকত না৷ কোথাও কোনো বিচ্ছেদ থাকত না৷ বিষাদ নীল ব্যথায় প্রতি মুহূর্তে কাউকে ডুকরে ম’রতে হত না৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলল মৃত্তিকা৷ ঘুম আসছিল না তার৷ তনুজা হয়তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সুদর্শিনীও হয়তো ঘুমচ্ছে৷ তখন দেখে এসেছিল অর্ণবের সঙ্গে কথা বলছিল৷ এদিকে ভূমিকে ঘরে দেখতে না পেয়ে সুদর্শিনী বারান্দায় চলে এসেছে৷ তার ভাবনাই সঠিক৷ মৃত্তিকা বারান্দাতেই ছিল৷ সে জিজ্ঞেস করল‚
“কী করছিস?”
“বই পড়ছিলাম। ঘুম আসছিল না।”
“আয় আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুম চলে আসবে।”
“জানিস দিদিভাই— আমার এখন আর এই শহরটা ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে সবকিছু ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই।”
“তুই আবারও পুরোনো কথা ভাবছিস? তোকে কতবার বলেছি না‚ ওসব কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট দিবি না। মেসো মশাই চলে যাওয়ার পর মাসিমণি তোকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে।”
ভাঙা গলায় মৃত্তিকা বলল‚ “পুরুষ যে নারীকে খুব সহজেই পেয়ে যায় তাকে মূল্যায়ন কম করে।”
“আবার সেই মানুষটার কথাই ভাবছিস? ভুলে গেলি— সেই মানুষটা তোকে অবিশ্বাস করে একা ছেড়ে দিয়েছিল?”
সুদর্শিনী এটুকু বলতেই মৃত্তিকা ফুঁপিয়ে উঠল। সুদর্শিনী শুধাল‚ “অ্যাই তুই কী কান্না করছিস? আমার দিকে তাকা তো!”
মৃত্তিকা তাকাল না। অশ্রুসিক্ত চোখে কী করে তাকাবে সুদর্শিনীর দিকে! তবুও মেয়েটা তার ভাঙা গলার স্বরেই বুঝে গেল। সুদর্শিনী আবারও বলল‚
“তাকাবি না আমার দিকে?”
“দিদিভাই আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও৷ কতদিন শান্তিতে ঘুমতে পারি না!”
সুদর্শিনী বুঝল মৃত্তিকা নিজেকে আড়াল করতে চাইছে৷ তাই সে খুব একটা ঘাটল না। ইচ্ছে হলে নিজেকে থেকে মনের দুঃখ গুলোকে শেয়ার করবে৷ মৃত্তিকার হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল সুদর্শিনী। সে বিছানায় গিয়ে বসতেই তার পেছন পেছন মৃত্তিকাও চলল৷ বালিশে হেলান দিয়ে সুদর্শিনীকে জাপ্টে ধরল। অবসাদগ্রস্ত চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছে মৃত্তিকা৷ সুদর্শিনী তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে চুলও টেনে দিচ্ছে৷ আরাম লাগছে কিছুটা৷ নিমিষেই যেন চোখের পাতায় গহীন নিদ এসে হানা দিচ্ছে৷
চলবে?…..