#রণরঙ্গিণী_প্রেমরঙ্গা |৭৪|
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষে সূর্যের কমলাটে আলো নবোদিত। ভোরের আঁধার কাটিয়ে মেদিনী আলোকিত হচ্ছে৷ সোনালি রোদ উঁকি দিচ্ছে জানালার দুয়ার ভেদ করে পর্দার ফাঁকফুকুর হতে। রড এসে আছড়ে পড়ছে প্রলয়ের পিঠে। রোদ দীর্ঘ সময় একই স্থানে আছড়ে পড়ায় প্রলয়ের পিঠে কিছুটা গরম লাগতে শুরু করেছে। পিঠ ঘেমে গিয়েছে। তারউপর বাতাসের ঝাপ্টায় ঘামে ভেজা পিঠে শীতল অস্তিত্ব। ঘুমের ঘোরে প্রলয়ে মনে হচ্ছে ভূমি তার পিঠে ভেজা চুল দিয়ে আঁকিবুঁকি চালাচ্ছে। ঘুমু ঘুমু ভারী কণ্ঠে প্রলয় বলল‚
“আহ্ ভূমি কন্যা— বিরক্ত কোরো না৷ ঘুমতে দাও প্লিজ।”
পরক্ষণেই ঘুম ভেঙে গেল প্রলয়ের৷ যখনই মনে পড়ল ভূমি তো তার কাছেই নেই— বিরক্ত করবে কোত্থেকে? ঘুমু ঘুমু ফুরফুরে মনটা নিমিষেই বিষাদের কৃষ্ণাভ মেঘমালায় ঢেকে গেল৷ আস্তে করে উঠে বসল প্রলয়। গা থেকে টিশার্ট খুলে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে জানালার কাছে গেল। হুট করে পর্দাগুলোকে সরিয়ে দিতেই সকালের মৃদুমন্দ শীতল সমীরণ এসে তার গা ভাসিয়ে দিল৷ ভালোই লাগছে ভীষণ। এরপর একটা আলমারি থেকে নিজের জামাকাপড় বের করে বিছানার উপর রাখল সে৷ আজ বের হবে। ঘরে বসে থেকে আর ভালো লাগছে না তার৷ বাহির থেকে ঘুরে এলে হয়তো কিছুটা ভালো লাগবে। আজ থেকেই নিজের কাজে লেগে পড়বে সে৷ একটা তোয়ালে বের করে ওয়াশরুমে চলে গেল প্রলয়৷ একটা লম্বা গোসল দিয়ে শরীরের সমস্ত ক্লান্তি আর ভারাক্রান্ত দূর করবে।
অন্যদিকে…
বিছানায় আধশোয়া হয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসেছে মেহরাব শিকদার। আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙে গেল উনার৷ এমনিতে তো ফিরোজাই ডেকে দেন উনাকে। তবে আজ উনি নিজে থেকে উঠে গিয়েছেন৷ বারবার জানালার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে যাচ্ছেন তিনি। মেহরাব শিকদার যখন কিছু নিয়ে এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে ভাবনায় মত্ত তখনই ফিরোজা ঘরে প্রবেশ করেন।
“সেই কখন থেকে দেখছি কিছু একটা ভেবে যাচ্ছ৷ কী ভাবছ শুনি?”
হুট করে ফিরোজার কণ্ঠস্বর শুনে ঘাবড়ে গেলেন মেহরাব শিকদার। আজ সকাল সকাল মহুয়াকে স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। স্বপ্নেও যেন হুম’কি দিচ্ছিলেন। মেহরাব শিকদারের আগের মতো সেই তেজ নেই। স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে। তারউপর ফিরোজার এভাবে চলে আসায় আরও ঘাবড়ালেন তিনি৷ আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন‚
“কিছু বললে তুমি?”
“আচ্ছা আমাকে বল তো— কী হয়েছে তোমার? বেশি কিছুদিন ধরেই দেখছি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাক।”
“ও তেমন কিছু না। কাজের খুব প্রেসার ইদানীং।”
“এত প্রেসার কেন নাও তুমি? তোমাকে কতদিন বলেছি কাজের এত প্রেসার নেবে না তুমি।”
“ও কিছু হবে না। তুমি আমাকে নিয়ে এত চিন্তা কোরো না।”
“আমি যেটা বলছি সেটাই শোনো। আজ হসপিটালে যেতে হবে না। বাড়িতে বিশ্রাম নেবে তুমি। তোমার শরীরটাও ভালো ঠেকছে না আমার৷”
নিজের প্রতি অর্ধাঙ্গিনীর এমন চিন্তা দেখে বরাবরের ন্যায় আপ্লূত মেহরাব শিকদার। ফিরোজাকে তিনি অন্তত বেশি ভালোবাসেন৷ তবে অতীত অর্থাৎ বিশ বছর আগের একটা ভুলের মাশুল আজও দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। উনার আজও মাথায় আসে না সেদিন ভূমিকে হত্যা কে করল? পুলিশ যখন লাশ আইডেন্টিফাই করে জানিয়েছিল সেটা ভূমিরই লা’শ তখন তিনি ভীষণই অবাক হয়েছিলেন৷ তবে এটা ভেবেও খুশি ছিলেন যে আপাতত উনার আর কোনো পথের কা’টা নেই৷ মাঝে মাঝে প্রলয়ের জন্য ভীষণই আফসোস হয় উনার। একমাত্র উনার জন্যই তো প্রলয়ের আজ এই দশা! সেদিন যদি মিথ্যে কথা না বলতে তাহলে হয়তো ঝোঁকের বশে এমন একটা কথা প্রলয় কখনোই বলত না। সে যথেষ্ট বিচারক্ষম একজন মানুষ। এটা মেহরাব শিকদার খুব করে মানেন৷ তিনি এও জানেন‚ সত্যিটা যদি কোনো সবার সামনে আসে তবে প্রলয় উনাকে কখনোই ছাড়বে না। এর উচিত শাস্তি দিয়েই তবে থামবে। মেহরাব শিকদার যেন আলাদা এক দুনিয়ায় হারিয়ে গেলেন। ফিরোজার কোনো কথাই যেন উনার কর্ণগোচরে পৌঁছায়নি। একই ভঙ্গিতে বালিশে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন। ফিরোজা বলতে লাগলেন‚
“আবার কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি?”
এবারও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না মেহরাব শিকদারের কাছ থেকে৷ ফিরোজা এবার বিছানায় বসে স্বামীর হাত ঝাকিয়ে ডাকতে লাগলেন‚
“কী গো শুনছ? কোথায় হারিয়ে গেলে? দিনের বেলায় জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছ নাকি?”
“শুনছি আমি।” এই বলে বিছানা ছাড়লেন মেহরাব শিকদার। ফিরোজা বিছানা গোছানার জন্য উদ্যত হলেন। ওয়ারড্রব থেকে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতেই মেহরাব শিকদার স্ত্রীর উদ্দেশে বললেন‚
“তুমি অহেতুক চিন্তা করছ আমার জন্য।”
“আমি অহেতুক চিন্তা করি? আমি তো দেখতে পাচ্ছি তুমি আজকাল কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাক! আচ্ছা তোমার কী হয়েছে? আমার সঙ্গে অন্তত বল! তাহলে হয়তো নিজেকে কিছুটা হালকা লাগবে৷”
“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। খুব ক্ষিধে পেয়েছে৷ তুমি আমার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা কর— আমি দু মিনিটে বের হচ্ছি।”
“আচ্ছা।”
মেহরাব শিকদার ওয়াশরুমে চলে গেলেন। এদিকে বিছানা আর ঘর ঝাড়ু দিয়ে ফিরোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সকালের নাস্তা আগেই বানিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সাবিনা অন্য কাজগুলো করছিল। ফিরোজা বৈঠকখানার দিকে এসে দেখলেন মোর্শেদ শিকদার খেতে বসে পড়েছেন। আজ উনাকে একটু তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। বাকিদের অর্থাৎ ছেলেমেয়ে গুলো এখনো পর্যন্ত নিচে আসেনি। এরই মাঝে অতিথিশালা হতে তৃপ্তি চলে এলো। তাকে দেখা মাত্রই মাধুরী দ্রুত পায়ে সেদিকটায় গেলেন৷ ফিসফিস করে তৃপ্তিকে শুধালেন‚
“উপরে গিয়ে ওদের সবাইকে একটু ডেকে নিয়ে এসো।”
গটগট করে তৃপ্তি জবাব দিল। যেন সে আগে থেকেই জানত‚ মাধুরী এমনই কোনো কথা বলবেন তাকে। তৃপ্তি বলল‚ “আপনি হয়তো একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন আন্টি।”
“কী বলতে চাইছ তুমি?”
“আমি এটাই বলতে চাইছি যে‚ আপনার ছেলে আমাকে পছন্দ করে না। তাই আমি উনাকে ডাকতে যেতে পারব না।”
তৃপ্তির এহেন কথায় চটে গেলেন মাধুরী। কিছুটা ধমকের স্বরে বললেন‚ “বড়োদের মুখে মুখে বুঝি এভাবেই তর্ক কর তুমি?”
সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা জবাব দিল তৃপ্তি‚ “আপনি যতই বলুন আমি উনার সামনে যেতে চাই না আন্টি। এতে যদি আপনি আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন তাহলে তাই সই! কিন্তু আমি আপনার ছেলের ত্রিসীমানায় যেতে চাই না।”
এবার কিছুটা নরম স্বরে মাধুরী বললেন‚ “প্রলয়কে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। তুমি এসেছ সবে দিন চারেক হলো। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। ওর সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা কর। আর কতদিন আমার ছেলেটা এভাবে গুমরে গুমরে ম’রবে?”
“আই থিংক উনাকে একা ছেড়ে দেওয়া উচিত৷ এমন করতে থাকলে উনি আপনার থেকে আরও দূরে চলে যাবেন৷ আপনি তো মা! আপনার উচিত আপনার ছেলের মনের অবস্থাটা একটু বোঝা৷”
মাধুরী ভাবলেন। গভীর ভাবে ভাবলেন। তৃপ্তির কথা কোনো অংশে ভুল নয়। শুরু থেকেই তিনি ভূমি আর প্রলয়কে আলাদা করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। কখনো এটা ভাবেননি যে ভূমিকে হারিয়ে প্রলয়ের মনে অবস্থাটা ঠিক কী? ছেলেটার মনের উপর থেকে ঠিক কী যাচ্ছে? কই আগে তো তিনি এমন ছিলেন না? মুখে কিছু বলার আগেই ছেলের মনের কথা বুঝে যেতেন তিনি৷ অথচ আজ ছেলের থেকে দূরত্ব বাড়ছে৷ মাধুরী আর কথা বাড়ালেন না।
“পূর্ণ পুষ্পকে ডেকে দিয়ো তো। ওদের কলেজে যাওয়ার সময় হয়েছে।”
“জি আন্টি।” এই বলে তৃপ্তি সিঁড়ি ভেঙে উপরতলায় যেতে শুরু করল৷ মাধুরীও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। প্রলয়ের ব্যাপারে তিনি আর তৃপ্তিকে জোর করবেন না৷ উনার এটা বোঝা হয়ে গিয়েছে যে‚ জোর করে আর যা-ই হোক সম্পর্ক আর ভালোবাসা হয় না৷ এদিকে করিডরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তৃপ্তি। দোতলায় ডানপাশের ঘরটাই পূর্ণ পুষ্পর। আর বাঁ পাশের প্রথম ঘরটা অর্পণের আর দ্বিতীয় ঘরটা প্রলয়ের। আগের বারের ভুল এবার সে করবেন না। পূর্ণ পুষ্পকে ডাকতে ওদের ঘরের দিকে চলল তৃপ্তি৷ এতক্ষণে মেয়ে দুটো হয়তো ঘুম থেকে উঠেই পড়েছে।
সকাল সাড়ে দশটা…
সেই রোজকার রুটিন আজ থেকে আবারও শুরু। মৃত্তিকার সিলেকশন হয়ে গিয়েছে৷ সে এখন একটা পারমানেন্ট জব পেয়ে গিয়েছে৷ অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল এই নাচের স্কুলেই সে জবটা করবে। তার সিলেকশন যে এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে সেটা তার জানা ছিল না। দৈনিক পাঁচ ঘণ্টা এই স্কুলে কাটাতে হবে৷ মনে মনে খুব খুশি মৃত্তিকা৷ তার ইচ্ছে যে পূরণ হয়েছে।
“মামনি দুপুরের খাবার আর ঔষধ কিন্তু টাইম টু টাইম খেয়ে নেবে। আর ফোন সঙ্গে সঙ্গে রাখবে।”
“আগের জন্মে হয়তো তুই আমার মা ছিলিস। এত যত তো আমার জন্মদাত্রী মা-ও করেননি।”
“কী যে বল না তুমি। তবে তোমার জন্য আমার চিন্তা হয়।”
“বুঝলে মাসিমণি— তোমার মেয়ের হয়তো আমার প্রতি বিশ্বাস নেই৷
“মোটেও তেমন কিছু নয় দিদিভাই।”
“হাহা মজা করছিলাম তো পাগলি৷ তুই যা। আমি তো আছি মাসিমণিকে দেখার জন্য। বেস্ট অফ লাক৷”
“থ্যাংক ইউ দিদিভাই।” এই বলে সুদর্শিনীকে জড়িয়ে ধরল মৃত্তিকা৷ ওদের দুজনের মিল দেখে গাল এলিয়ে হাসলেন তনুজা৷ ওদের দুটোকে একসঙ্গে দেখলে মনে হয় যেন দু বোন। অথচ দুজনের ধর্ম আলাদা৷ তাতে কী দুজন মানুষের মাঝে মনের মিল তো রয়েছে। মেয়েটা যখন মাহেন্দ্র রায়চৌধুরী অসুস্থ ক্ষ’তবিক্ষ’ত অবস্থায় পেয়েছিলেন তখনকার মৃত্তিকা আর এখকার মৃত্তিকার মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। সেই ভিতু সহজ সরল মেয়েটা এখন রণরঙ্গিণী। যেকোনো পরিস্থিতিতে রুখে দাঁড়াতে পারে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে। সমাজ তাকে এখন আর অযোগ্য বলে আখ্যায়িত করে না। সে একজন অতি পারদর্শী নৃত্যশিল্পী। মৃত্তিকাকে মেয়ে হিসেবে পেয়ে খুবই গর্ববোধ হয় তনুজার। শুরু থেকেই মেয়েটা তাকে মামনি বলে আসছে। তনুজার কখনো মনেই হয় না তিনি নিঃসন্তান। এই তো মৃত্তিকাই তো উনার শেষ ভরসা। বাকিটা জীবন মা মেয়েতে মিলে খুব ভালো ভাবেই কাটিয়ে দিতে পারবেন।
“কী এত ভাবছ মামনি?”
“কিছু ভাবছি না রে মা। আচ্ছা শোন— সাবধানে যাবি। নাচের জন্য নিজের অযত্ন করিস না। সময় মতো খাবারটা খেয়ে নিবি।”
“তুমি চিন্তা কোরো না মামনি। তোমার মৃত্তিকা তোমাকে প্রমিজ করছে৷”
“আমার সোনা মেয়ে।”
“আসছি মামনি। আসছি দিদিভাই।”
“সাবধানে যাস বোনু।”
“হুম!”
সুদর্শনী এবং তনুজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মৃত্তিকা ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে বলে এসেছে সদর দরজা যাতে ভালো করে আটকে দে। তার কথানুযায়ী সুদর্শিনী সদর দরজা ভালো ভাবেই আটকে দিয়েছে৷ সে হয়তো আরও কিছুদিন এখানেই থাকবে৷ অর্ণব এখনো ঢাকা ফেরেনি।
চলবে?…..