#অন্তহীন💜
#পর্ব_২৭
#স্নিগ্ধা_আফরিন
রান্না ঘর থেকে জুনাইদার কন্ঠ ভেসে আসছে। তিনি উচ্চ শব্দে চৈতি কে ডাকছেন। প্রহন কে রুমে রেখে চৈতি চলে যায় মায়ের কাছে। রুপা আর সিফা মিলে ডাইনিং টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছে। রুপা কে দেখে কেমন জানি অন্যরকম লাগছে চৈতির কাছে। মুচকি হাসিটা সরছেই না অধর থেকে।জুনাইদা চৈতি কে দেখে চৈতির উদ্দেশ্যে বললেন,”কীরে মা, তোর শ্বশুড় শ্বাশুড়ি কে ডেকে নিয়ে আয় নাস্তা করার জন্য। অনেক বেলা হয়ে গেছে। সাথে প্রহন কে ও ডেকে নিস।”
চৈতি কিছুক্ষণ মায়ের ঘর্মাক্ত শরীরের দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইল।আজ যেন মাকে আলাদা রকম সুন্দর লাগছে। হয়তো কখনো এমন করে তাকিয়ে থাকা হয়নি দেখে মায়ের ক্লান্ত মুখটার মায়া দেখা হয়নি। চৈতি
রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রুপা ভেতরে ঢুকে।পাশ কাটিয়ে যখন আসছিল চৈতি তখন বললো,”কী খবর ভাবি?এত খুশি খুশি লাগছে কেন?”
চৈতির কথা শুনে রুপা যেনো একটু লজ্জা পেল। চৈতি মৃদু হেসে চলে গেল মিসেস ইয়াসমিন এবং রেদোয়ান চৌধুরী কে ডাকতে।
জার্নি করে ক্লান্ত মিসেস ইয়াসমিন। বিছানার এক পাশে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন তিনি। রেদোয়ান চৌধুরী বসে বই পড়ছেন। গতকাল রাতে নতুন একটা উপন্যাস পড়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি।ব্যাগে করে সেই বইটা ও নিয়ে চলে এসেছেন। চৈতি দরজায় টোকা দিয়ে বললো,”আসবো বাবা?”
রেদোয়ান চৌধুরী বই থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকালেন। চৈতি কে দেখে মুচকি হেসে বললেন,”আয় মা।”ততক্ষণে মিসেস ইয়াসমিন ও শোয়া থেকে উঠে বসেছেন। চৈতি রুমের ভেতর এসে বললো,”আম্মু তোমাদের নাস্তা করার জন্য ডাকতেছে।”রেদোয়ান চৌধুরী বইয়ের ভেতর চোখ রেখে উত্তর দিলেন,”এই পৃষ্ঠা শেষ করে যাচ্ছি।”
মিসেস ইয়াসমিন বিরক্ত হয়ে রেদোয়ান চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন,”কোথাও যেয়ে ও কী তোমার শান্তি নাই? আমার জীবনটা তুমি শেষ করে দিলা। আমার শ্বশুড় যে কেন তোমার সাথে বইয়ের বিয়ে দিলো না। আমারে পুড়লা।”
রেদোয়ান চৌধুরী শুনেও শুনলেন না। মিসেস ইয়াসমিন রাগে গজগজ করে রুমে থেকে বেরিয়ে গেলেন। চৈতি হাসলো।”যলদি আসুন বাবা।”রেদোয়ান চৌধুরীর উদ্দেশ্যে কথাটা বলে রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেল চৈতি।
প্রহন বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে মোবাইল টিপছিল। চৈতি কে ভেতরে ঢুকতে দেখে নড়ে চড়ে উঠলো। হাতের মোবাইল টা বিছানার উপর রেখে চৈতির উদ্দেশ্যে বললো,”ক্ষুধা লাগছে বউ। তোমাদের বাড়িতে কী খাইতে ও দিবে না নাকি?”
চৈতি ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমাদের বাড়িতে খাবারের অভাব পড়ছে। আপাতত কোনো খাবার নাই। আপনি আজ না খেয়েই থাকেন।”
প্রহন অসহায় কন্ঠে বলে,”আমার সত্যি ক্ষিধা লাগছে তো।রাতে ও খাইনি তোমার জন্য।”
“আপনাকে খাইতে যাওয়ার জন্যেই ডাকতে আসছি আমি। আসুন।”প্রহন কে কথা টা বলেই চলে গেল চৈতি। পেছন পেছন প্রহন ও চলে গেল।
সরদার সাহেব নিজ হাতে মেয়ের শ্বশুড় বাড়ীর লোকজনদের জন্য বাজার করতে বেরিয়েছেন। জুনাইদা নিজের হাতে সবাই কে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। চৈতি কে খেতে বসার জন্য বললে সে বলে পরে খাবে। রুপার পাশে গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে বলে,”সত্যি করে বলো তো কী হয়েছে বড় ভাবি। একটু বেশিই অন্যরকম উৎফুল্ল হয়ে আছো যেনো।”
রুপা এক পলক চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চোখের সামনে আসা চুল কানের পিছে গুঁজে দিয়ে বললো,”একটা সুখবর আছে ননদীনি।”
চৈতি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,”কী সুখবর ভাবি?”
রুপা লাজুক হেসে বললো,”আল্লাহর রহমতে তুমি ফুফু হতে যাচ্ছো।”
রুপার মুখে এমন কথা শুনে খুশিতে আল্লাহ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো চৈতি। রুপা জলদি করে চৈতির হাত জোরে চাপ দিয়ে ধরলো। চৈতি বিড়বিড় করে বললো,”সরি সরি একটু বেশিই খুশি হয়ে গিয়েছিলাম।”
এই দিকে চৈতির এমন চিৎকার শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সবাই। প্রহন তো জিজ্ঞেস করেই ফেলেছে,”কী হয়েছে?”
চৈতি মিনমিনে গলায় বলে,”কিছু হয় নাই।”
_______________
রৌদ্রময় ঝলমলে মধ্যান্হ!
ভাসমান তুলোরাশিদের ধীর গতির চলন স্পষ্ঠ অম্বরে।
সরদার সাহেবের বাড়ির ভেতর থেকে দারুন সব রান্নার ঘ্রান ভেসে আসছে। বিয়ের পর এই প্রথম বার শ্বশুড় বাড়িতে এসেছে প্রহন। আয়োজনের কোনো রকম ক্রুটি রাখেননি সরদার সাহেব এবং জুনাইদা। সকাল থেকেই এক নাগাড়ে কাজ করে যাচ্ছেন জুনাইদা। হাঁটুর ব্যাথাটা বেড়েছে। কিন্তু তবুও নিজের হাতেই মেয়ের জামাই কে রেঁধে খাওয়ানোর জেদ চেপেছে যেনো। মিসেস ইয়াসমিন হাতে হাতে টুকিটাকি কাজ করে দিতে চাইলেও নারাজ তিনি।কড়া গলায় নিষেধ করে বলেন,”আপনি হলেন অতিথি বেয়ান। আপনি কাজ করবেন কেন?এটা একদম উচিত না। আপনি বসে থাকুন। আমি এবং আমার ছেলের বউয়েরা মিলে করছি তো।”
মিসেস ইয়াসমিন আর কিছু বলতে পারলেন না।
রেদোয়ান চৌধুরী সরদার সাহেবের সাথে গ্রামের পথে হাঁটতে বেরিয়েছেন এই ভরদুপুরে। অনেক বারন করার পর ও শুনেনি তারা।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল মুছতে ব্যস্ত চৈতি।পরনে কালো রঙের জামদানী শাড়ি।আর হালকা গয়না। জুনাইদা কিনে রেখেছিল মেয়ের জন্য শাড়িটা। চৈতির হাতে দিয়ে বলেছেন,যেন দুপুরে গোসল করে শাড়ি টা পরে।শাড়িতে যে মেয়েকে দেখতে একটু বেশিই সুন্দর লাগেপ্রহন গোসল করছে। সেই কখন গোসল করতে ডুকেছে বের হবার নাম নেই। চৈতি বাথরুমের দরজায় কয়েক টা টোকা দিল।
ভেতর থেকে প্রহন দুষ্টুমি করে বলে উঠলো,”আরে বউ বুঝছি তো আমাকে ছেড়ে এক মুহুর্ত ও থাকতে পারো না। কষ্ট হয় তোমার জানি তো আমি।তাই বলে কি গোসল করতে ও দিবা না?”
এপাশ থেকে চৈতি অবাক হওয়া গলায় বলে,”অদ্ভুত তো! আমি আবার কখন আপনার জন্য এমন পাগল ছিলাম?যাই হোক জলদি বেরিয়ে আসুন তো।আর কয়েক মিনিট পরেই এক ঘন্টা হয়ে যাবে গোসল করতে ঢুকলেন যে।”
সরদার সাহেবের সামনে হঠাৎ কেউ একজন এসে পথ আটকে দাঁড়ায়। অগত্যা ব্যাক্তিকে এই সময় এখানে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি।
তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টা বাঁকা হেসে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সরদার সাহেব ভ্রু কুঁচকে রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,”কী হচ্ছে কী রিফাত? তুমি আমার পথ আটকে দাড়িয়েছো কেন?”
রিফাত বাঁকা হেসে বললো,”হবু শ্বশুড় মশাই আমাকে ছেড়ে অন্য কারো সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দেয়ার মাশুল কিন্তু গুনতে হবে আপনাকে।”
সরদার সাহেব বিরক্ত মাখা গলায় বললেন,”হবু শ্বশুড় মশাই মানে কি? এই সব কোন ধরনের অভদ্রতা?”
রিফাত কোমরে দুহাত রেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।হাসতে হাসতে বলে,”আপনার বর্তমান মেয়ের জামাই কে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়ে চৈতি কে আমার করে নিবো। আপনি শুধু দেখতেই পারবেন কিচ্ছু করতে পারবেন না।”
রিফাতের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গেলেন সরদার সাহেব। এই রিফাতের নামে অনেক খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে। সব কিছু জানা আছে তার। কিন্তু তাই বলে ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা রিফাত কে বুঝতে দিলে চলবে না। তিনি কঠোর গলায় বললেন,”আমার মেয়ের জামাই এর দিকে চোখ তুলে তাকালেও চোখ তুলে ফেলবো তোর। শুধু মাত্র তোর জন্য আমার মেয়েকে এত জলদি বিয়ে দিয়েছি আমি। তুই যদি এখন ওদের কোনো ক্ষতি করতে চাস তাহলে এই আসমান জমিন কে স্বাক্ষি রেখে বলছি তোকে আমি নিজের হাতে কুকুরের মতো মারবো। একদম দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়ে দরকার হলে নিজে জেল খাটবো।”
সরদার সাহেব এর কথা শুনে হো হো করে হাসতে রিফাত। সরদার সাহেব যেনো তাকে কোনো চমৎকার হাসির জোকস শুনিয়েছে। রেদোয়ান চৌধুরী এমন ভিলেন শুধু গল্পেই পড়েছেন। বাস্তবে দেখেননি।আজ বাস্তবে দেখে খুশি হবেন না কষ্ট পাবেন বুঝতে পারছেন না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিফাত এবং সরদার সাহেব এর দিকে তাকিয়ে আছে এবং কথা গুলো মনো যোগ দিয়ে শুনছেন।আচমকা হাসি বন্ধ করে সরদার সাহেবের দিকে এগিয়ে যায় রিফাত। সরদার সাহেব এর চোখে চোখ রেখে, দাঁতে দাঁত চেপে ধীর গলায় বলে,”মেয়ের জামাই এর আগে দেখছি মেয়ের বাপকেই দুনিয়া থেকে সরাতে হবে।”
#চলবে,,,,