#অন্তহীন💜
#পর্ব_৩৯
#স্নিগ্ধা_আফরিন
সময়টা তখন সন্ধ্যা ৭টা। পরীক্ষা নামক প্যারা থেকে মুক্তি পেয়েছে চৈতি। দীর্ঘ ছয় মাস পর আজ প্রহন বাড়ি ফিরে আসছে। সিইও স্যার কে নিজের বিয়ের ব্যাপারে সব কিছু জানিয়ে দিয়েছে প্রহন। প্রহনের কথা শুনে সিইও স্যার কিছু টা রাগ দেখালেও পরে মুচকি হেসে বলেছিলেন,”একা একাই নিজের বিয়ের দাওয়াত নিজে খেলা। এখন আমাদের কারো নাম রাখার অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিবা কখন বলো?”
সিইও স্যারের কথা শুনে মুচকি হাসলো প্রহন।
মিসেস ইয়াসমিন চৈতির বিছানার উপর লাল রঙের একটা শাড়ি রেখে বলে গেলেন পড়ে সুন্দর করে সেজে গুজে থাকতে। বাচ্চা বাচ্চা ভাব টা কেটে গেছে চৈতির। আগের চেয়ে ও ভিষন সুন্দর হয়েছে দেখতে। বাড়িতে আজ জমজমাট আয়োজন করা হয়েছে। চৈতির বাড়ির সবাই ও এসে উপস্থিত হয়েছে। রুপার কোলে শুয়ে থাকা ছোট্ট মেয়ে চৈতালী।ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে চৈতির দিকে। চৈতালী রুপার মেয়ে। চৈতির নামের সাথে মিলিয়ে এই নাম রেখেছেন সরদার সাহেব।এক চৈতি শ্বশুর বাড়িতে চলে গেছে তো কি হয়েছে? আরেক টা ছোট্ট চৈতালী আছে না।যে সারাক্ষণ তার বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখবে। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে দৌড়ে বেড়াবে পুরো সরদার বাড়িতে। হুটহাট চৈতির মতো গাছের মগডালে উঠে নামতে না পেরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করবে।ভাবলেই তো হাসি পায়।
বিছানার এক কোণে বসে আছে চৈতি। তার সামনেই রুপা সিফা বসে আছে।আজ হঠাৎ রিফাত এর কথা খুব মনে পড়ছে চৈতির।ছেলেটা কত গুলো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। তার শাস্তি ও সে এই দুনিয়ায় পেয়েছে।মাস খানেক আগে ট্রেনের ধাক্কায় আহত হয়ে দুই পা হারিয়ে ফেলেছে।ট্রেন একে বারে পিসে দিয়ে গিয়েছে তাকে। দীর্ঘ শ্বাস ফেললো চৈতি। ছেলেটা নিকৃষ্ট। আল্লাহ হয়তো তাকে পরকালেও মাফ করবেন না। কত শত নির্দোষ মেয়ের জীবন কেড়ে নিয়েছে। এখন হয়তো খুব ভালো করেই বুঝতে পারে তাদের কষ্টটা।
“কি রে চৈতি কি এত ভাবছিস? তোর শ্বাশুরি তোকে তৈরি হয়ে নিতে বলেছেন।”
রুপার কথা শুনে ভাবনার ঘোর কাটে চৈতির। অতীতের কোনো কিছুই এখন আর মনে রাখার প্রয়োজন নেই।কারন তার অতীতের চেয়ে ও বাস্তবটা একটু বেশিই সুন্দর।শাড়ি সামলাতে না পারা মেয়েটা ও এখন বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে শাড়ি পরে এবং সামলাতে ও জানে। সাংসারিক কাজ না জানা মেয়ে টা ও এখন বেশ সুন্দর মজার মজার খাবার রান্না করতে জানে। গুছিয়ে চলতে জানে।সময় এবং মিসেস ইয়াসমিন চৈতি কে আগের চেয়ে ও দায়িত্বশীল হিসেবে গড়ে তুলেছে। গোসলের পর চুল না মোছার অভ্যাস টা যায় নি এখনো। চৈতি চায় ও না সেই অভ্যাস চলে যাক। এই কাজের দায়িত্ব পালন করবে শুধু মাত্র একজন।আর সেই মহান ব্যক্তি হলো প্রহন। টুকটুকে লাল রঙের শাড়ি পড়ায় নিজেকে কেমন নতুন বউ বউ লাগছে চৈতির কাছে। গোধূলি বেলায় আকাশ যেমন সিঁদুর রাঙা টুকটুকে লাল রঙে সাজে কী অপরুপ সুন্দর লাগে তখন।ঠিক তেমনি নজর কাড়া সুন্দর লাগছে চৈতি কে। সৌন্দর্য উপভোগ করার মানুষ টা যে আজ বাড়ি ফিরে আসছে। তার জন্যই তো এত সাজানো নিজেকে।
লজ্জায় নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে চৈতির। অদ্ভুত!একা একা ও কারো এত লজ্জা লাগে নাকি? নিজের মনেই নিজের প্রশ্ন ছুড়ে মারলো চৈতি। উত্তর পেয়ে যাবার আগেই চোখ সরিয়ে নিল আয়না থেকে।এক আকাশ সমান ভালো লাগা কাজ করছে মনের ভেতর। সাথে একটু ধক ধক করে কাঁপছে হৃদয়।ছয় মাস পর প্রিয় মানুষ টা কে কাছ থেকে দেখা হবে।হাতে হাত রাখা হবে। কাঁধে মাথা রেখে উপভোগ করা হবে চৈতালী পূর্ণিমা। ভাবতেই তো ভাল্লাগে মনের গভীরে। ঘড়ির কাঁটায় চোখ রাখলো চৈতি। নয়টার কাছাকাছি। কখন আসবে কখন আসবে চিত্ত জুড়ে শুধু একটাই স্লোগান চলছে। অপেক্ষা,মাঝে মাঝে যেন ভীষণ মধুর হয়ে যায়। ভালো লাগে খুব ভালো লাগে প্রিয় মানুষ গুলোর জন্য অপেক্ষা করতে। তবে সেই অপেক্ষাটা দীর্ঘ স্থায়ী না হোক।ক্ষন স্থায়ী হোক। ভালোবাসা টা হোক দীর্ঘ স্থায়ী।যেন মৃত্যুর পর ও এক সাথে থাকা যায়।
কলিং বেল বাজছে।এক বার দুই বার এক নাগাড়ে কয়েক বার। চৈতির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।কারন সে জানে প্রহন এক সাথে এত বার কলিং বেল বাজায়। ছুটে যেতে চাইলে ও গেল না।সবাই কী ভাবে ভেবে বসে রইলো বিছানায়। চৈতির ভাবনাই ঠিক হলো। প্রহন আসলো। জড়িয়ে ধরলো মা কে।ড্রইং রুমে বসে থাকা সবার সাথে কুশল বিনিময় করে বললো,”চৈতি কোথায়?দেখছি না যে? শরীর ঠিক আছে তো?”
“সবুর তো করো ননদাই সাহেব।সবুরেই তো মেওয়া ফলে।”
রুপা একটু বেশি বেশি। বড়দের সামনেই কি করে লজ্জায় ফেলে দিলো প্রহন কে।
মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হেসে বললেন,”রুমে যাও।ফ্রেশ হয়ে নাও। তার পর চৈতি কে নিয়ে খাবার খেতে আসো। তুমি না আসা পর্যন্ত খাবে না বলে বসে আছে রুমে।”
“মেয়েটা আগের মতই বাচ্চা রয়ে গেছে।”মনে মনে বললো প্রহন। রুমে গিয়ে চৈতি কে দেখলো না। সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে নিশ্চয়ই।”লজ্জাবতী বউ আমার। লজ্জা তো পাবেই।”
ধীর পায়ে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে যায় প্রহন। চোখ মুখ খিঁচে ফেললো চৈতি। প্রহনের গায়ের কড়া পারফিউম এর গন্ধটাই জানিয়ে দিচ্ছে প্রহন তার দিকে এগিয়ে আসতেছে।
“বউ তুমি কি আমার দিকে তাকাবে না?দেখবে না আমায়?”
অনুভূতিরা ঝড় তুলেছে হৃদয়ে।ধুকপুকানি বেড়ে গেলো কেন হঠাৎ? বোধগম্য হলো না চৈতির।
ঘাড় ঘুরিয়ে প্রহনের দিকে তাকাতে যাবে এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো।
গলা উঁচু করে বলছে কেউ,”ভেতরে আসতে পারি?”
বিরক্তি নিয়ে রুমের ভেতর চলে গেল প্রহন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রুপা।হাতে খাবারের ট্রে।
“খাবার নিয়ে আসলেন কেন ভাবি?”
“আপনার আম্মু পাঠিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন খাবার টা আপনারা রুমেই খেয়ে নিতে।এত ক্লান্তি নিয়ে আবার নিচে গিয়ে খেয়ে আসতে হবে না।”
রুপার হাত থেকে খাবারের ট্রেটা নিতে নিতে প্রহন বললো,
“আমরা তো নিচে গিয়েই খেয়ে নিতে পারতাম।”
“আমার কথা নয় কিন্তু এই সব কথা আপনার আম্মু বলেছেন আপনাকে বলে দিতে।মানে হলো এই গুলো আপনার মায়ের কথা।আর মায়ের কথা তো শুনতেই হবে।”
প্রহন মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
_____________
গভীর রাত।
শহরের কোলাহল কমেছে অনেক বেশি।ঝি ঝি পোকার ডাক স্পষ্ঠ।ডাহুক পাখির ডাক ও ভেসে আসছে দূর থেকে।বাসা বাড়ির বেশির ভাগ মানুষই ঘুমে মগ্ন। জেগে আছে এক জোড়া কাপোত কাপোতি।
“একটা কথা বলি চৈতি?”
“হুম বলুন।”
“তুমি আমার জীবনে আসার আগে বুঝতাম না প্রেম ভালোবাসা বলতে ও কিছু একটা আছে দুনিয়ায়।বাবা মা যখন প্রথম তোমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিলেন আমি তো রেগে শেষ। কিছুতেই বিয়ে করবো না। কিন্তু মা বাবা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে তোমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করে।”
প্রহনের কথা শুনে মুচকি হাসে চৈতি।
“আমি জানি সবটা। আমি ও কী আপনাকে বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না। জোর করেই বিয়ে দিয়েছিল। ভাগ্যিস দিয়েছিল।না হলে এত ভালোবাসা পেতাম কোথায়?”
চৈতির কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে প্রহন। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,”ভালোবাসো আমাকে?”
“না তো। আপনাকে কে ভালোবাসে?”
প্রহন চৈতির নাকে নাক ঘষে বললো,”তুমি বাসো। জানি তো আমি।”
চৈতি মুচকি হাসলো।আর কিছু বললো না। প্রহন চৈতির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো,”উইল ইউ বি মাই বাবুর আম্মু?”
বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো চৈতির। অদ্ভুত এক অনুভূতির সাথে পরিচিত হলো সে। লজ্জায় নুয়ে পড়লো সিক্ত প্রেমিকের চওড়া বক্ষে।
লজ্জাবতীর লজ্জা দেখে প্রহন হাসলো। খুব খুব হাসলো। এবং নিজ থেকেই বুঝে নিলো নিরবতা সম্মতির লক্ষণ।
ভালোবাসা টা কিছু সময়ের জন্য না হোক। ভালোবাসা টা হোক অন্তহীন। অনন্তকালের জন্য হৃদয়ে টিকে থাক ভালোবাসা নামক অনুভূতি। পূর্ণতা পাক সকল ভালোবাসা। চৈতি আর প্রহন তাদের নিজেদের মতো ভালো থাকুক অনেক অনেক দিন।
_________সমাপ্ত_________