অন্তহীন💜 #পর্ব_৩২ #স্নিগ্ধা_আফরিন

0
404

#অন্তহীন💜
#পর্ব_৩২
#স্নিগ্ধা_আফরিন

ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০টা।নীরব, নিস্তব্ধ, সুনসান রুম। সেই রুমে দুজন মানুষ আছে তা কেউ বুঝতে ও পারবে না।দুটো মানুষ মুখোমুখি বসে আছে। রাগে কপালের রগ ফুলে উঠেছে। মুখে কথা নেই দুজনের কারোরই। মিনিট পাঁচেক পর নীরবতা ভেঙে চিন্তিত কন্ঠে সরদার সাহেব বললেন,”আমি তো তোমাকে সব কিছুই বললাম প্রহন। আমার মেয়ের সম্পূর্ণ নিরাপত্তার দায়িত্ব আমি তোমাকে দিলাম। চৈতির প্রতি তোমার যে টান, ভালোবাসা তা আমি দেখেছি। আমি আশা করছি আমার মেয়ের জীবন টা নষ্ট হতে দিবে না তুমি। ছোট থেকে আমার মেয়েকে অনেক আদর যত্ন করে বড় করেছি আমি। মেয়েটা আমার অনেক বেশি আদুরে। আমার মৃত্যুর পর ও আমার মেয়েটার খেয়াল রেখো তুমি।”প্রহনের দৃষ্টি এত সময় ধরে বেলকনির বাহিরে আকাশের দিকে ছিল। সরদার সাহেব এর কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে লম্বা করে শ্বাস ফেলে বললো,”
প্রথমে চৈতির বয়স কম থাকায় আমি ওকে বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না। একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে এটা করতে আমার বিবেকে বাঁধ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মা বাবার জোড়া জুড়িতে বিয়ে করতেই হয়েছে। তিন বার কবুল বলার পর থেকেই অচেনা অল্প বয়সী কিশোরী মেয়েটার প্রতি এক অন্য রকম টান অনুভব হয়। আমি নিজেই নিজের মাঝে কারন খুঁজতাম,’কেন চৈতি কে এত অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হলো?’ আর্থিক অবস্থা বা অন্য কোনো দিক দেখলাম না যে এত কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিতেই হবে।”
প্রহন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললো,”আজ জানলাম আসল কারণ টা।যেখানে মেয়েটার জীবন নিয়েই আতঙ্কে আছে পরিবারের সবাই সেখানে বিয়ে দিয়ে মেয়েকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়াই হয়তো আপনাদের সঠিক মনে হয়ে ছিল। সেই সময় টায়। কিন্তু বাবা, আমি একটা কথা বলি,রাগ করবেন না আশা করছি। এমন অল্প বয়সী মেয়েদের যত ধরনের সমস্যাই হোক না কেন,এত কম বয়সে বিয়ে দেওয়া টা উচিত না। এতো কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা কখনোই কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না।এতে মেয়েটার মানুষিক এবং শারীরিক সব ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। মেয়েদের জন্য বিয়ে নামক বাঁধনটা সব কিছুর জোড়া দেওয়ার জিনিস হতে পারে না।”
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে দম ছাড়লো প্রহন।বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো রুম থেকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সরদার সাহেব গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন,”আমাকে মাফ করো বাবা। বিষয় টা তোমাকে আরো আগেই জানানো উচিত ছিল। কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠেনি।আর চৈতি কে বিয়ে না দেওয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। মেয়েটা আমার মাশাআল্লাহ।যেখানে সেখানে একা মেয়েকে রেখে আসাটা মন সায় দেয়নি।তাই তো তোমার বাবা মায়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।”
প্রহন সরদার সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,”আমি আপনার পরিস্থিতি টা বুঝতে পারছি বাবা।এতে আপনার ও কোনো অন্যায় নেই।মা বাবা তো সব সময় আমাদের ভালোটাই চায়। রিফাত নামক ছেলে টা কে আমি চিনি না।তাকে চেনার প্রয়োজন আছে। ছেলেটার কলিজা অনেক বড়। আমার চৈতিকে নিয়ে এত বাজে উক্তি,এত নিচু চিন্তা করে ওরে পেলে আমি যে কী করবো তা শুধু মহান আল্লাহ তায়ালা জানেন।”
______
কাপড় চোপড় সব গুছানো শেষে বিছানায় বসলো চৈতি। কাঁধের পোড়া জায়গায় মলম লাগানোর জন্য তেমন একটা কিছু হয়নি।এক বার লাগানোতেই ঠিক হয়ে গেছে।প্রায় এক সপ্তাহ থাকার জন্য এসে ছিল কত আশা নিয়ে। কিন্তু সে গুড়ে বালি।প্রহনের নাকি বাড়িতে কী কাজ পড়ে গেছে।তাই তো এই দুপুরে খাবারের পর রওনা দিবে বাড়ির পথে।
অথচ সত্যিটা তার নিজের অজানা।সব সত্যি যদি চৈতি কে জানিয়ে দেওয়া হয় তবে তো মেয়েটা চিন্তা করতে করতেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। এই দিকে স্কুলে নাকি পরীক্ষা ও আছে।পড়া লেখা করতে হবে তো নাকি!

সব চিন্তা এক পাশে সরিয়ে রেখে দুপুরে বেশ আয়েশ করে শাশুড়ির হাতের রান্না করা মজাদার খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে প্রহন। প্রতিদিনের তুলোনায় একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছে আজ। চৈতির পাশেই আরামে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বসে প্রহনের কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছে চৈতি।

“মাত্র তো গতকাল আসলাম।আজ আবার চলে যেতে হবে!বলি এতো জলদি কেন যেতে হবে শুনি।আরো দু একটা দিন থাকলে তো একটু শান্তি লাগতো মনে।”

প্রহন সেই অবস্থায় জবাব দিলো,”আমাদের বাড়ির চাল গুলো শেষ করতে হবে তো নাকি?মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে চাল শেষ হলো না।”

প্রহনের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলো না চৈতি। চোখ ছোট ছোট করে বললো,”চালের সাথে মাসের কী সম্পর্ক?চাল, ডাল, তেল এর জন্য কী মাস শেষ হতে হবে? এই সব জিনিস তো যখন তখন শেষ হতে পারে। মাসের শুরুতে কিংবা মাসের মাঝামাঝি সময়ে।”

প্রহন শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বললো,”এটাই তো‌।বেড়াতে আসলেও কয়েক দিন পর বা কয়েক দিন আগেও ফিরে যেতে হয়।কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে যেতে পারে। ধারণা আছে তোমার?”

“গুরুত্বপূর্ণ না ছাই।সব অকাজ, মিথ্যা বলে ছুটি নিয়ে আসতে পারে আর দুই দিন ও আমার বাপের বাড়িতে থাকতে পারে না।যত্তসব!”
রাগে গাল ফুলিয়ে রুম থেকেই চলে গেল চৈতি। চৈতির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বালিশ বুকে জড়িয়ে আবারো শুয়ে পড়লো।আপাতত শরীরের শান্তি দরকার। পরে না হয় রাগিনী বাচ্চা বউয়ের রাগ ভাঙানো যাবে।

জুনাইদার পাশেই বসে মুখে পান পুরে দিয়ে চিবোচ্ছিলেন মিসেস ইয়াসমিন।জুনাইদার চোখ মুখ কেমন যেন শুকিয়ে আছে। ইয়াসমিন কে পান বানিয়ে দিলেও নিজের জন্য বানালেন না তিনি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত। মিসেস ইয়াসমিন ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে ছিলেন জুনাইদার মুখের দিকে।কিয়ৎক্ষন পর জুনাইদার হাতের উপর হাত রেখে বললেন,”আপা আপনি কি কোন কিছু নিয়ে বেশি চিন্তিত? না মানে আপনার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে আপনি হয়তো কিছু নিয়ে চিন্তা করছেন। সমস্যা না হলে আমার সাথে ভাগাভাগি করতে পারেন।”
মিসেস ইয়াসমিন এর কথা শুনে তার দিকে এক নজর তাকালেন জুনাইদা। দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে বললেন,”কী নিয়ে আর চিন্তা করবো বলুন আপা? মেয়েকে নিয়েই তো যত চিন্তা।ঐ রিফাতের কু নজর থেকে যে কবে আমার মেয়েটা মুক্তি পাবে আল্লাহ জানে।”

“আল্লাহ ভরসা আপা। কোনো কিছু নিয়ে বেশি চিন্তা করবেন না। খারাপ কিংবা ভালো যাই হোক না কেন, বেশি চিন্তা করা উচিত না।ভালো কিছুর সময় বেশি আশা বা চিন্তা করলে তার বিপরীত হয়।আর খারাপ কিছুর সময় খারাপ জিনিস গুলোই বেশি হয়।”

“আমাদের ভাগ্য কেমন তা দেখেন আপা, চাইলেও মেয়েকে তিন চার টা দিন নিজের কাছে রাখতে পারছি না।মাঝে মাঝে তো মন চায় মেয়েরে কুৎসিত বানিয়ে ফেলে নিজের কাছে আগলে রাখি। আমার মেয়েটা কে এত সুন্দর হতে কে বলে ছিল?যার জন্য তাকে নিয়ে এত চিন্তা।যার তার চোখ পড়ে তার উপর।আমরা মেয়েকে বেশি ভালোবাসি তো তাই আমাদের সাথেই এমন হতে হচ্ছে।”

জুনাইদার প্রতি উত্তরে মিসেস ইয়াসমিন শুধু একটা কথাই বললেন,”সব আল্লাহর ইচ্ছা আপা। মহান আল্লাহ তায়ালা যা করেন সৃষ্টির কল্যানের জন্যই করেন। হয়তো আমরা পাপি বান্দারা তা উপলব্ধি করতে পারি না।ব্যার্থ হই বারংবার। আল্লাহ ভরসা।”

প্রহনের সাথে রাগ করে রুম থেকে বেরিয়ে রুপার রুমে চলে গেল চৈতি। সজীব বাড়িতে নেই।কাজে গেছে। সাদিক ও সজীবের সাথে। রুপার রুমে রুপা আর সিফা বসে কথা বলছিলো। চৈতি গাল ফুলিয়ে হনহন করে হেঁটে রুপার রুমে গিয়ে বিছানায় বসে পড়লো কোলে বালিশ নিয়ে।রুপা লবণ মরিচ দিয়ে তেঁতুল খাচ্ছিলো। চৈতির দিকে এক টুকরো তেঁতুল বাড়িয়ে দিয়ে বললো,”খাবে ননদীনি?”
চৈতি রুপার হাতের তেঁতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমার দরকার নাই। তুমি খাও।সময় হলে খাবোনি।”
চৈতির শেষের কথা শুনে ফিক করে হেসে উঠলো রুপা আর সিফা।রুপা দুষ্টু হেসে বললো,”তাহলে আমার ননদাই কে বলে দি,সময় টা ঘনিয়ে আনতে।”
চৈতি ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষন রুপার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। রুপার কথার অর্থ বুঝতেই নিজের কপালে নিজেই চাপড়াতে লাগলো।
ততক্ষানিক লজ্জা না পাওয়ার জন্যই ভেবে চিন্তে কথা বলা উচিত।
নাহলে নিজের কথার জন্যই যেখানে সেখানে লজ্জায় পড়তে হয়।

#চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here