অন্তহীন💜 #পর্ব_৩৩ #স্নিগ্ধা_আফরিন

0
386

#অন্তহীন💜
#পর্ব_৩৩
#স্নিগ্ধা_আফরিন

অরুণ রাঙা প্রভায় বিভাসিত অপরাহ্নের প্রহর।নীরদ ছোঁয়া তরুর মগডালে বসে আছে এক ঝাঁক পরিযায়ী পাখি। শান্ত, স্নিগ্ধ পড়ন্ত বিকেলের সোনা রাঙা এক ফালি নরম রোদ এসে পড়েছে ছাদের রেলিং এর উপর।যুগল বন্দি পায়রা দুটো সেই রোদে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। ঠোঁট দিয়ে একে অপরকে ঠোকর মেরে খুনসুটির প্রমান দিচ্ছে যেন।ঝুঁটি ওয়ালী পায়রা টা বাক বাকুম বাক বাকুম করে ডেকে উঠে সরে গেল কিঞ্চিৎ দূরে।কার কবুতর কে জানে। তাদের থেকে কিছু টা দূরে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে সেই পায়রা দুটো কেই দেখছে চৈতি। ভেজা চুল থেকে এখনো পানি ঝড়ছে। ঘন্টা খানেক আগেই ফিরে এসেছে।জার্নি করে ফেরা তার উপর জ্যামে আটকে থেকে গা গুলিয়ে উঠেছিল।একটা ঝাঁকা নাকা গোসল না করলেই নয়।
ছাদে আসার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে কেউ।মুখে তার একটাই কথা,”চৈতি, কোথায় তুমি?”
কন্ঠটা তার অতি প্রিয়।
জবাব না দিলে ধমক দিবে তা চৈতির জানা আছে।তাই ছোট্ট করে বললো,”আমি এখানে।”
“হুম দেখতেই পাচ্ছি ম্যাডাম আপনি এখানে।”
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো চৈতি।হাতে তোয়ালে। প্রহন কে দেখে মুচকি হেসে বললো,”একটা বায়না করতে পারি?”
প্রহন চৈতির দিকে এগিয়ে এসে বললো,”সব বায়না টায়না পরে।আগে বলো তো গোসলের পর চুল মুছোনি কেন?”
চৈতি ঠোঁট ফুলিয়ে উত্তর দিলো,”আলসেমি”

“একটা মাইর ও কম পরবে না।”
কড়া গলায় বললো প্রহন।নিজ হাতে চুল মুছতে মুছতে কন্ঠ নরম করে বললো,”আমি না থাকলে এই ছোট খাটো কেয়ার গুলো কে করবে তোমার?”

“থেকে যান আপনি। আমার যত্ন করার জন্য। ছোট্ট একটা চাকরী করুন। এই যেমন ১০ হাজার টাকার বেতনের।দিব্যি চলে যাবে দিন।”

“হ্যাঁ বলছে তোমাকে।১০ হাজার টাকায় দিব্যি যাবে দিন?শুনো চৈতি আবেগে জীবন চলে না।”

চৈতি মিটিমিটি হাসলো। উত্তর দিলো না। চুল মুছা শেষে
রেলিং এর কাছে চলে যেতে নিলে চৈতি প্রহনের হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে চোখের ইশারায় বুঝালো,”সে দিকে না যেতে।”
প্রহন অবাক হয়ে বললো,”কেন?কী হয়েছে?”
চৈতি আঙ্গুলের ইশারায় দেখালো”ঐ যে কারণ।”
প্রহন চৈতির দৃষ্টি অনুসরণ করে রেলিং এর উপর তাকালো।দুটো পায়রা কে প্রেম করতে দেখে হেসে বললো,”আমার তো আর ওদের মতো প্রেম হচ্ছে না।যাই ওদের একটু বিরক্ত করে আসি।”
চৈতি ভ্রু কুঁচকে রাগি কন্ঠে বললো,”যাবেন না। দূরে থাকুন ওদের থেকে।আপনাকে দেখলেই উড়ে যাবে।”
চৈতির কথা শুনলো প্রহন। গেল না রেলিং এর কাছে।বা হাত দিয়ে চৈতির কাঁধ জড়িয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে মুখের উপর ফুঁ দিয়ে বললো,”কী জানি বায়না ধরবে বলে ছিলে?”
চৈতি পায়রা গুলোর দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,”এক জোড়া পায়রা কিনে দিবেন?একটা হবেন আপনি আরেকটা হবো আমি।”

“বাহ আমার বাচ্চা বউ দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছে।কত কিছু বুঝে।”

ইশশ লজ্জা! প্রহন ছেলে টা বড্ড খারাপ। শুধু মেয়েটাকে লজ্জা দিবে।কী আনন্দ পায় সে ভালো জানে।একটু ভালো করে পরক্ষ করলেই তো দেখতে পাবে, লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলার জন্য হাঁসফাঁস করছে।
চৈতি প্রহনের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে যেতে নিলে হাত ধরে বাঁধ সাধলো প্রহন।
চোখের ইশারায় মাথা নাড়িয়ে বুঝালো,”যেও না।”
চৈতি অবাধ্য হলো।স্পষ্ঠ করে বললো,”থাকবো না। আপনি শুধু লজ্জায় ফেলেন।”

প্রহন ঠোঁট কামড়ে হাসে।ধীর গলায় বলে,”তোমার লজ্জা বেশি।লাজুক লতা কী আর সাধে বলি? সামান্য কথায় ও এত লজ্জা পেলে নাতি নাতনির মুখ দেখতে হবে না আর।”

“ধ্যাত ছাড়ুন তো। আপনি লোকটা একটু বেশি বেশি। খারাপ লোক একটা।”

চৈতি কে আর পায় কে? প্রহন কে বকতে বকতে দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নেমে যায়। চৈতির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো প্রহন।প্রহনের হাসির শব্দে পায়রা যুগল উড়ে গেল।ডানা মেললো শূন্য গগনে। এতেই যেন শান্তি।আহাহ স্বাধীনতা!
_______
নিশুতির আঁধারের জন্য সবে মাত্র প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রকৃতি।রুপ বদল করতে হবে যে। এখন সকাল,একটু পর দুপুর, তার পর বিকেলে,প্রত্যেক দিনের এক রুপ। সায়াহ্নের রুপ নেবার প্রহর এখন। রান্না ঘর থেকে টুং টাং শব্দ আসছে।
শব্দ শুনেই উপলব্ধি করলো প্রহন,যে চৈতি এখন রান্না ঘরে।সে ছাড়া রান্না ঘর থেকে এত শব্দ কেউ করতে পারে না। মিসেস ইয়াসমিন তো একদম না।কারন তিনি খুব নিরবতা প্রেমি মানুষ। এমন বাসন কোসনের শব্দ তার অসহ্য লাগে।আলতো হাতে ধরেন এবং আলতো হাতে কাজ করেন।
নবাবের মতো চৈতি কে হুকুম করলো প্রহন।
“বেগম সাহেবা এক কাপ কফি দিয়েন তো।”

রান্না ঘর থেকে চৈতির গলার স্বর শোনা গেল।সে বললো,”বেগম এখন মহা ব্যস্ত। অনেক কাজ!ফ্রী হলে কফি পাবেন।”
বেগমের স্পষ্ঠ কথা শুনে আর কিছু বললো না প্রহন।
চুপ করে সোফায় বসে রইলো।

রেদোয়ান চৌধুরীর শরীর টা ভালো লাগছে না বিকেল থেকেই। বুকের ব্যথাটা আবার বেড়েছে। বিছানায় শুয়ে ছিলেন তিনি।আজ আর কোনো নতুন বই পড়া হয়নি। শরীরে শান্তি থাকলেই তো সব কিছুতে মন বসে।
চলতি মাসের শেষ প্রায়।আর দুই দিন বাকি। এই মাসে একবার ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়া উচিত ছিল। হার্টের পেশেন্ট কিছু টা সতর্ক না থাকলে হয় না।
মিসেস ইয়াসমিন চা আর নাস্তা নিয়ে রেদোয়ান চৌধুরীর কাছে গেলেন।
মিসেস ইয়াসমিন এর হাতে খাবার দেখে বললেন,
“ইয়াসমিন, আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে না। এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত বানিয়ে দাও তো।”
মিসেস ইয়াসমিন সম্মতি জানিয়ে বললেন,”তা দিবো। কিন্তু তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে?মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।”

“ঐ একটু বুকে ব্যথা করছে। ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ।”

বাড়ির সামনের বড় আম গাছটার কোনো এক ডালে বসে এক নাগাড়ে ডাকছে সন্তান হারানো হুতুম পেঁচা টা।কী গম্ভীর এবং কষ্ট দায়ক সেই ডাক।গা ভাড় হয়ে আসে চৈতির। রাতের বেলায় পেঁচার ডাক টা ঠিক হজম হয় না তার। কেমন যেন একটা হারিয়ে ফেলার ভয় হয়।
পড়ার টেবিলে বসে ক্লাস টেস্টের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। পাশেই বিছানার উপর বসে আছে প্রহন। মোবাইলের স্ক্রিনে দৃষ্টি তার।কারো সাথে চ্যাট করছে হয়তো।
হঠাৎ চৈতি বলে উঠলো,”আপনি আমার থেকে দূরে যাবেন না তো কখনো?”
আচম্বিকে চৈতির এমন প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকে যায় প্রহনের। কিছুটা গম্ভীরভাবে চৈতির প্রশ্নের উত্তর দিলো,”না যাবো না। কিন্তু তুমি হঠাৎ এই কথা বলছো কেন?পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার নিনজা টেকনিক ব্যবহার করতে চাচ্ছো?”
চৈতির মুখ মলিন।ভীতু কন্ঠে বললো,”প্রিয় মানুষ গুলো কে হারিয়ে ফেলার ভয় হয়।”
কথাটা বলেই হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো চৈতি।তাজ্জব বনে গেল প্রহন। হঠাৎ মেয়েটার এমন কান্নায় প্রস্তুত হয়ে গেছে। বিছানার উপর মোবাইল টা রেখে দ্রুত চৈতির কাছে গিয়ে চৈতি কে দুই হাতের বাঁধনে আগলে নেয় বুকের ভেতর। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”কান্না করছো কেন বোকা মেয়ে? শুধু শুধু কেউ কান্না করে? কিচ্ছু হয়নি তো।কারো কিচ্ছু হয়নি সবাই ঠিক আছে।কান্না থামাও পাগলী।”
হঠাৎ কী হলো চৈতির বুঝলো না প্রহন।প্রিয় মানুষ গুলো কে হারিয়ে ফেলার ভয়ে কত মানুষ কাঁদে সে খবর কে রাখে?কেউ না।
নাক টেনে লম্বা শ্বাস নেয় চৈতি।কান্না থামে। ভালো লাগছে না কিচ্ছু। কেমন জানি করছে বুকের ভেতর। অচেনা এক ভয় ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে চিত্ত কোণে।
চৈতি কে স্বাভাবিক করে প্রহন বললো,”সকালে উঠে বাকি পড়াটা শেষ করে নিও। এখন আর পড়তে হবে না।”

ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত প্রায় ১০টা।
মিসেস ইয়াসমিন ডাকছেন চৈতি আর প্রহন কে। খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য।রাত হয়েছে অনেক।জার্নি করায় ক্লান্ত তিনি। ঘুম এসে ভীড় করছে চোখে। চৈতি কে নিয়ে খাবার খাওয়ার জন্য চলে যায় প্রহন।
রেদোয়ান চৌধুরী কে ডাকার জন্য রুমে গেলেন মিসেস ইয়াসমিন। রেদোয়ান চৌধুরী শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন। পাশেই আরিফ আজাদের লেখা বেলা ফুরাবার আগে বই টা পরে আছে বিছানায়।
মিসেস ইয়াসমিন রেদোয়ান চৌধুরী কে বেশ কয়েক বার ডাক দিলেন।সাড়া পেলেন না। গভীর নিদ্রায় মগ্ন তিনি।
সাধারণ ডাকে ঘুম ভাঙ্গবে না। মিসেস ইয়াসমিন রেদোয়ান চৌধুরীর পাশে রাখা বই টা নিয়ে বুকশেলফ এর তাকে সাজিয়ে রাখতে রাখতে বললেন,”খাবার খেয়ে ঔষধ খাবে না?উঠো জলদি। ছেলে মেয়ে অপেক্ষা করছে তো তোমার জন্য।”
সাড়া না পেয়ে মিসেস ইয়াসমিন রেদোয়ান চৌধুরীর মাথার পাশে গিয়ে বসলেন। বুকের উপর হাত রাখতেই কেঁপে উঠলেন তিনি। মনের অশুভ চিন্তা টা দূর করতে শ্বাস প্রশ্বাসের প্রক্রিয়া পরীক্ষা করতেই চিৎকার দিয়ে প্রহন কে ডেকে বললেন,
“প্রহন রে বাবা আর নাই।”

#চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here