#অতঃপর_তুমি_আমি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_১২
‘আমি কি শুনছি মেহনাজ!তুমি শেহজাদকে ভালোবাসো?’
‘হ্যাঁ আব্বু আমি ভালোবাসি তাকে’
‘মেহনাজ!’
‘আব্বু আমি তাকে ভালোবাসি এটাই সত্য। সে ছাড়া আমার জীবনে অন্য পুরুষের আগমন কখনো হবে না।তবে তার জন্য আমার সবাইকে ছাড়তে হয় আমি তাতেও রাজি’
‘তোমার আজ থেকে বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষেধ।রুম থেকেও বেরোবে না তুমি।’
হুমায়ন শেখ গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন।ওয়ামিয়ার চোখ বেয়ে টুপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পরলো।রামিশা এসে ওয়ামিয়ার কাঁধে হাত রাখলো।ওয়ামিয়া ঝাপটে ধরলো রামিশাকে।এখন খুব করে তার কাউকে প্রয়োজন ছিলো।রামিশার সাথে এ কয়েকদিনে মোটামুটি ভালোই সম্পর্ক হয়েছে।বন্ধুর মতোই থাকে প্রায়।রামিশা রুমে নিয়ে আসে ওয়ামিয়াকে।দরজা চাপিয়ে দেয়।রামিশা ওয়ামিয়াকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে পানি এনে দেয়।ওয়ামিয়া ঢকঢক করে পুরো পানি শেষ করে।হেঁচকি উঠে গিয়েছে কাঁদতে কাঁদতে তার।
‘মেহেনাজ এই শেহজাদটা কে?’
‘আমার ভালোবাসা।যাকে আমি ছোটবেলা থেকে ভালোবাসি’
‘উনি কি চেয়ারম্যানের ছেলে শেহজাদ ইমতিয়াজ খান?’
‘হ্যাঁ।আমার ফুপাতো ভাই হয়।’
‘তাহলে সমস্যা কোথায়?’
‘অনেক বড় কাহিনী ভাবি।তবে কিছু কারণ আছে যার জন্য সম্পর্ক নেই দুই পরিবারের’
‘তোমার ফুপি?’
‘বেঁচে নেই’
রামিশা কি বলবে আর।সে ওয়ামিয়াকে একা ছেড়ে বেরিয়ে পরলো রুম থেকে।এখন একটু একা থাকা প্রয়োজন ওয়ামিয়ার।ওয়ামিয়া ডাইরিটা বের করে।এত দিন পরীক্ষা বিয়ের ঝামেলায় কিছু দেখা হয়নি।ওয়ামিয়া দরজা লাগিয়ে এসে বসে পরে।ডাইরি খুলতেই দেখতে পায় ওয়ামিয়া আর শেহজাদের ছবি।ছবিটা দেখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওয়ামিয়ার ঠোঁটের কোনে।ছবিটার নিচে লেখা।আমার ছেলে আর তার প্রেয়সী।ওয়ামিয়া চমকায়।তবে কি ফুপিআম্মু ঠিক করে রেখে গিয়েছিলো তাদের বিয়ে।কে জানে!পৃষ্ঠা উল্টে পড়া শুরু করে,,,
*********
‘আজকে তোকে পড়াতে আসবে শেহতাজ’
‘নতুন স্যার ভাইজান’
‘হ্যাঁ ইংরেজিতে তো ডাব্বা মারিস তো তার জন্য স্যার লাগবে না’
‘ভাইজান তুমি কিন্তু বেশি বেশি বলছো’
গাল ফুলিয়ে বলে শেহতাজ।হুমায়ন শেখ শব্দ করে হেসে উঠেন।শেহতাজ চোখ ছোট ছোট করে বলে,
‘একদম হাসবে না ভাইজান।একটু ইংরেজি কম পারি তো কি হয়েছে?’
‘বাদ ওসব মুনতাসিব পড়াতে আসবে তোকে’
‘মুনতাসিব ভাই পড়াবে আমাকে!’
আমি ভীষণ অবাক হয়ে বললাম।মুনতাসিব ভাই কখনো কাউকে পড়ায় না।আসলে পড়ানোর কোনো প্রয়োজন পরে না।মুনতাসিব ভাইকে ছোট বেলা থেকেই চিনি।শেখ বাড়ি আর খান বাড়ি এক জায়গায় হওয়ায়।না চেনার কোনো প্রশ্নই উঠে না।আরো ভাইয়ের বেস্টফ্রেন্ড।সেই হিসাবে বাড়িতে প্রায়ই আসে।সত্যি বলতে আমি বেশ পছন্দ করি মুনতাসিব ভাইকে।বেশ মানে অনেকটাই।মনে মনে ভীষণ খুশি হলাম। যাক তাহলে এবার পটিয়ে নিবোই লোকটাকে।পাত্তাই দেয় না মোটে।বজ্জাত লোক।
‘হ্যাঁ অনেক বলার পরে রাজি হয়েছে।তুই কিন্তু মোটেও দুষ্টমি করবি না শেহতাজ’
‘আরে ভাইজান কি বলো তুমি আমি কেনো দুষ্টুমি করবো।আমি তো ভদ্র মেয়ে’
হুমায়ন শেখ শেহতাজের চুল টেনে বলেন,
‘তুই কত ভদ্র তা আমার জানা আছে’
‘ভাইজান’
দুজন মারামারি করতে ব্যস্ত হয়ে পরি।আমি হুমায়ন ভাইজানের বেশি দিনের ছোট না।৫ বছর হবে।দু’জনের মাঝে মারামারি ঝগড়া ঝামেলা চলতেই থাকে। তবে ভালোবাসি দুজন দু’জনকে অনেক।মুনতাসিব বাড়িতে ঢুকে দুই ভাই বোনের মারামারি দেখতে ব্যস্ত।দেওয়ালে হেলান দিয়ে পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে দেখছে।দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ করেই আমার চোখ যায় দূরে দাড়িয়ে থাকা মুনতাসিব ভাইয়ের দিকে।মুনতাসিব ভাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।গভীর চাহুনি।আমি ততক্ষণে থেমে গিয়েছি লজ্জা পেয়ে দৌড়ে রুমে চলে আসি।হুমায়ন শেহতাজকে চলে যেতে দেখে সামনে তাকিয়ে দেখে মুনতাসিব।বন্ধুকে দেখে হেসে বলে,
‘কখন আসলি?’
‘এই তো যখন তোদের মতো দুই গাধা মারামারি করছিলি’
‘বাদ দে চল তোকে শেহতাজের কাছে নিয়ে যাই।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম ভেতর থেকে।তাড়াতাড়ি গিয়ে বই খাতা গোছাতে শুরু করলাম।যা অবস্থা কিছুই ঠিক থাকে না আমার।তখনই রুমে ঢুকলো দু’জন।আমাকে বই গোছাতে দেখে ভাইজান বলে উঠেন,
‘তুই জীবনেও ঠিক হবি না তাই না’
আমি তার দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকালাম।মুনতাসিব ভাই বিছানার উপর বসলেন।এরপর চিরচেনা সেই গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,
‘শেহতাজ আজকে থেকে তোকে আমি পড়াবো।সো তুই যদি বাঁদরামি করিস তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না’
‘মুনতাসিব ভাই তুমি প্রথম দিন এসেই এমন কথা বলছো কেনো?আমি কি বেশি বাঁদরামি করি নাকি?’
‘তুই বেশি না অনেক বেশি বাঁদরামি করিস।এখন টেবিলে বোস’
আমি মুখ গোমড়া করে টেবিলে বসে পরি।ভাইজান বলেন,
‘তাহলে মুনতাসিব তুই পড়া আমি একটু বাজার থেকে ঘুরে আসি।আর ও যদি বেশি বাঁদরামি করে আম্মাকে গিয়ে বলে দিবি।আম্মা পাশের রুমেই আছে’
ভাইজান চলে গেলেন।মুনতাসিব ভাই আমাকে পড়ানো শুরু করলো।পড়া আমার কিছুই মাথায় ঢুকছে না।তবে সামনে থাকা মানুষটা আমার মন মস্তিষ্কের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।তার দিকেই তাকিয়ে আছি।মানুষটা এতো সুদর্শন।বলে বোঝাতে পারবো না।আমার চোখে সেই সব থেকে সুদর্শন পুরুষ।আমি যে তার দিকে তাকিয়ে আছি সে হয়তো বুঝতে পারলো তাই ধমক দিয়ে বলল,,
‘শেহতাজ পড়ায় মন দে’
আমি হকচকিয়ে উঠলাম।পড়ায় মন দিলাম।তবুও মন বসছিলো না।বহু কষ্ট মন বসালাম।সে এক ঘন্টা পড়ালো।অনেক পড়া দিয়েছে।যাওয়ার সময় বলেছে সমানে এইচএসসি ভালো করে পড়তে হবে।আরো জ্ঞান দিলো।তবে সেগুলো কিছুই আমার মাথায় ঢোকেনি সে বাদে।চলে গেলো।ডাইরি নিয়ে বসলাম।আজকের কাহিনী লিখে রাখলাম।আমি আজকের মতো কখনো খুশি হয়নি।এতো খুশি আমি।আমার তো নাচতে মন চাচ্ছে।
–
–
একমাস হলো পড়াচ্ছেন মুনতাসিব ভাই আমাকে।আমি তার প্রেমে গভীর ভাবে পড়ে গিয়েছে। বাইরে মেঘলা আকাশ। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে। আমি ভীষণ উরনচন্ডী।ঘোরাঘুরি,মাছধরা,নৌকা দিয়ে ঘোরাঘুরি করা খালে এগুলো আমার বেশ ভালো লাগে। আর সাথে আছে আমার বান্ধবী।প্রানের বান্ধবী মালা।আরেক জন ইমন।আমার চাচাতো ভাই।একসাথেই পরি তিনজন। তিনজন মিলে ঘোরাঘুরি করে বেড়াই।আম্মা আর আব্বু অবশ্য বকা দেয় কিন্তু ভাইজান তেমন কিছু বলে না। এখন বেড়োবো।বৃষ্টিতে ভিজে শাপলা তোলার মজাই আলাদা।মালা আর ইমনকে ও ডাকতে হবে।গায়ে ওড়না জড়িয়ে বের হলাম চুপিচুপি। আম্মা হয়তো বাড়ির পেছনের দিকে।আর আব্বু তো বাজারে।
বের হয়ে চলে আসলাম মালাদের বাড়ি।মালা শুয়ে ছিলো।ওকে ডেকে তুলে বের হলাম।খালের দিকটায় আসতেই ইমনকে দেখতে পেলাম।মালা আমায় বললো,
‘কিরে শেহতাজ ইমন এখানে যে।ওকে আসতে বলেছিস?’
‘নাহ তবে কে জানে কিভাবে আসলো’
ইমন আমাদের দেখে হাত নাড়িয়ে কাছে ডাকলো।দুজন চলে আসলাম ওর কাছে দেখি নৌকা নিয়ে রেডি সে।আমি আর মালা দু’জনই হাসলাম অনেক।তার ভেতর আসলো আমাদের আরেক বান্ধবী নীলা।ও আসতেই তিনজন জড়িয়ে ধরলাম তিনজনকে।নীলা খালা বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলো।ভেবেছি আসেনি তবে ও চলে এসেছে।
‘কিরে তুই কবে আসলি’
‘কালকে রাতেই এসেছি রে।তবে অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় আর দেখা করতে পারি নি। আরে সমস্যা নেই। এখন চল শাপলা বিল থেকে ঘুরে আসি।’
নীলা লাফিয়ে উঠে বলল,,
‘হ্যাঁ চল চল’
ওরা দু’জন উঠে পরলো।তবে আমি যেই উঠতে যাবো পেছন থেকে কেউ হাত টেনে ধরলে।পেছনে ফিরে মুনতাসিব ভাইকে দেখলাম।উনি হাত টেনে ধরেছেন।উপরে এনে হাত ছেড়ে দেন।ততক্ষণে বৃষ্টি চলে এসেছে।সবাই নিজেদের বাড়ির দিকে ছুটছে।মুনতাসিব ভাই ধমক দিয়ে বলেন,
‘তুই এখন এই অবস্থা নৌকা করে কোথায় যাচ্ছিস?’
‘ভাই একটু শাপলা বিলে যাচ্ছি।তুমি থাকো যাই আমি’
‘তোকে যেতে বলেছি আমি’
আমি থতমত খেয়ে তার দিকে হ্যাবলা কান্তের মতো তাকিয়ে আছি।সে সবগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলেন,
‘সবাই নৌকা থেকে নাম।খালে ঘোরা লাগবে না চল নদীতে ঘুরে আসি।হুমায়নকেও আসতে বলেছি’
ইমন নীলা মালা সবাই তাড়াতাড়ি নেমে পড়লো।এরপর নদীর ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।ঘাটে আসতেই দেখি ভাইজান নৌকা ঠিক করে বসে আছে।আমরা তিনজন লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম।ইমন আর মুনতাসিব ভাইও উঠলেন।মাঝি নৌকা চালাতে শুরু করলো।আমি পা দুলিয়ে বসলাম।মালা আর নীলাও বসেছে।বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দিচ্ছে আমাদের।আমি তাকালাম মুনতাসিব ভাইয়ের দিকে।মুনতাসিব ভাই কথা বলছে ভাইজানের সাথে ইমন বসে আছে।বেচারা একা একা বসে বসে আমাদের কাহিনী দেখছে।
‘মালা দেখ ওই চড়টা যাবি’
‘যাবো কিন্তু হুমায়ন ভাই আর মুনতাসিব ভাই কি যেতে দিবে?
‘দেবে না মানে দিতে হবে’
আমি ভাইজানের কাছে চলে আসলাম।আমাকে দেখে ভাইজান ভ্রু কুচকে বলল,
‘কি বলবি?’
‘ভাইজান চলো না সামনের চড়টাতে’
‘আজকে না শেহতাজ।অন্য একদিন।এখন বাড়ি যাবো অনেক সময় বৃষ্টিতে ভিজেছিস।আর ভিজলে জ্বর আসবে’
*********
ওয়ামিয়া থামে।আজকে আর পরবে না।তবে সে কৌতূহলী অনেক কি হয়েছিলো তার ফুপিআম্মুর সাথে এগুলো জানার জন্য।ওয়ামিয়া জায়গা মতো ডাইরিটা রেখে ফোন করলো অজিফাকে।
‘অজিফা আব্বু ভাইজান সব জেনে গিয়েছে’
‘কি জেনেছে’
ওয়ামিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,’শেহজাদ ভাইকে ভালোবাসি তাই’
অজিফা আঁতকে উঠলো।যে বাড়ির নামই শুনতে পারে না কেউ।আবার যদি শোনে মেয়ে সেই বাড়ির ছেলেকেই ভালোবাসে তবে কি হবে!অজিফা অস্থির হয়ে বলল,,
‘তুই ঠিক আছিস মেহু।আমি আসবো?’
‘নাহ আসা লাগবে না।তোকে জানালাম।ফোন নিয়ে যেতে পারে।বাড়ি থেকে বেরোনো নিষেধ করে দিয়েছে।তবে আমি যে এক পলক তাকে না দেখে থাকতে পারছি না রে অজিফা’
‘চিন্তা করিস না মেহু।সব ঠিক হয়ে যাবে।শেহজাদ ভাই বুঝবে’
‘তাই যে নো হয় রে’
ফোন কেটে দিয়ে জানালার কাছে বসে ওয়ামিয়া।আকাশে মেঘ আজকেও। তবে সে ফুপিআম্মুর মতো মজা করতে পারবে না।আর না সে অতো চঞ্চল। ওয়ামিয়া বেশ শান্তই বকতে গেলে।শেহতাজের একেবারে উল্টো।ওয়ামিয়া বিড়বিড় করে বলে,
‘ভালোবাসা বড্ড অদ্ভুত!কাউকে সুখে রাখে তো কাউকে ভয়ংকর ভাবে শেষ করে দেয়’
#চলবে ইনশাআল্লাহ
আসসালামু আলাইকুম।গতকালকে ব্যস্ত থাকায় দিতে পারিনি।আজ যদি সম্ভব হয় তবে আরেক পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করবো।