#অতঃপর_তুমি_আমি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_১৮
দিনগুলো ভালোই কাটছিলো আমাদের।লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করা,ঘুরতে যাওয়া গ্রামের আশেপাশে এগুলো অভ্যাসে পরিনত হচ্ছিল।সে যে অনেক ভালোবাসে তার প্রমান পেয়েছি আমি অনেক বার।আমি বহুবার বলেছি মুনতাসিব ভাইকে রাজনীতি ছেড়ে দিতে তবে সে আমার কথা ইগনোর করেছে।বুঝিয়েছি বাবার ছেড়ে দাও এগুলো আব্বু ভাই মানবে না তাহলে।তবে সে শুনলো না। এর জন্য বেশ কয়েকদিন কথা বলিনি তার সাথে। তবে ছটফট করছিলাম। ভাবছিলাম কখন সে আসবে।তবে সে আসলো কিন্তু রাজনীতি নিয়ে কথা বললো। রাজনীতি আমার ভীষণ অপছন্দের জিনিস।সে আমায় বুঝালো বললল,
‘ শেহতাজ রাজনীতি করলেই কি মরতে হয়। কখনোই না। তাহলে দেশটা আর দেশ থাকতোনা বলো।তুমি মেনে নেও। আমি হুমায়ন আর চাচাকে বলবো।বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই তাহলে।’
আমি মানলাম।সে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো তার পরিবারকে দিয়ে।তার পরিবার আমায় ভীষণ পছন্দ করতো। আমার কথা জানানোর পর আর কেউ না করে নি। তবে বিপত্তি তো তখন ঘটে যখন আমার আব্বু মানা করে দেন।তার এক কথা সে তার মেয়েকে কখনোই রাজনীতিবিদের কাছে তুলে দিবে না। আমি আব্বুকে বোঝালাম।আব্বু গায়ে হাত তুললো প্রথম বারের মতো।আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলাম।যে কখনো আমার গায়ে ফুলের টোকা পর্যন্ত দিতে দিতো না সে নিজেই আমায় মারলো।আমি এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম।পালিয়ে যাবো তার সাথে। তবে আমার কষ্ট হচ্ছিলো পরিবার ছাড়তে একদিকে পরিবার আরেকদিকে ভালোবাসা। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।
পাগল প্রায় অবস্থা হলো আমার। মুনতাসিবের সাথেও যোগাযোগ ছিলো না। কারণ আমার বাড়ি থেকে বেরোনো নিষেধ ছিলো।পাত্র দেখা শুরু করলো।পাত্র পক্ষ দেখতে আসার আগের দিন আত্নহত্যা করার হুমকি দিলাম। মেনে নিলো তারা। আমি হতভম্ব হলাম।এতো সহজে।এরপর ভালোভাবেই বিয়েটা হলো।দিনগুলো ভালোই কাটছে।সবাই মিলে আনন্দ উল্লাসে মেতে থাকি আমরা।ভাইকেও বিয়ে দিবো।মেয়ে খুঁজতে থাকলো সবাই। মায়া নামের একটা মেয়েকে আমার ভীষণ পছন্দ হলো। কলেজে আমার এক বছরের জুনিয়র ছিলো। খোঁজ খবর নিলাম। মেয়েটা প্রচন্ড ভদ্র শান্ত একটা মেয়ে। ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হলো।
তখন আমার আর মুনতাসিবের সংসার রমারমা।নতুন সংসার নতুন সব কিছু।তবে এতো কিছুর মাঝেও তার রাজনীতি ছাড়াতে পারলাম না।সবাই আমাদের মেনে নিয়েছে। আমি সুখী ছিলাম ভীষণ সুখী।মেহবুবা আমি শাশুড়ী আম্মা তিনজন মিলে সারাদিন গল্প করতাম।একসাথে রান্না বান্না সব করতাম।আমার শ্বশুরের আব্বু নাকি জমিদার ছিলো।বাড়িটাও অনেকটা জমিদার বাড়ির মতো। বিশাল বড়।শ্বাশুড়ি আম্মু কাজ করতে দিতেন তাই আমি মেহবুবার সাথে ছাদে গাছ লাগাতাম গল্প করতাম আরো কত কি।আর সাথে তো তার অফুরন্ত ভালোবাসা।
বাড়িতে দাওয়াত দিলাম নীলা,মালা আর ইমনকে।সবাই আসলো।তবে নীলার চোখে আমি হিংসা দেখেছি।মালা খুশি হয়েছে আমার বিষয়ে তা তার চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি আমি।ইমন যেনো কিভাবে আমার দিকে তাকালো। ওর চোখে কেমন না পাওয়ার যন্ত্রণা দেখলাম আমি। তবে কি ও আমায় ভালোবাসতো কে জানে!দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিলো।বিয়ের এক বছরের মাথায় জানলাম আমি অন্তঃসত্ত্বা।সে কি খুশি খান বাড়ি আর শেখ বাড়ির মানুষ। তারা পারে না আমায় মাথায় তুলে রাখে।আমার জানার ১০ দিন পর জানতে পারলাম মায়াও অন্তঃসত্ত্বা। আমি ভীষণ খুশি দুটো বাচ্চা আসবে বাড়িতে একসাথে।ইশশ কতো মজা হবে।দশ মাস দশদিন পর আমি আমার সোনার টুকরো শেহজাদের মুখটা দেখলাম।
আর মুনতাসিব সে তো পাগল প্রায়।আমাকে যখন ওটিতে নিয়েছে সে নাকি বাচ্চাদের মতো কেঁদেছে। আমি ভীষণ হেসেছি তার কাজের কথা শুনে।লোকটা সত্যিই আমায় বড্ড ভালোবাসে।দিন কাঁটতে লাগলো।শেহজাদ বড় হচ্ছে।তার ভেতরেই জেনেছিলাম মালার বিয়ে হয়েছে। নীলা নাকি কোন ছেলের সাথে ভেগেছে। এটা শুনে খারাপ লাগেনি।কারণ আমরা জানতাম নীলা এমন।
–
–
আজ আমি আমার আরেক কলিজাকে পেলাম।আমার ওয়ামিয়া।দেখতে একদম জীবন্ত পুতুল। আমার ছোট্ট শেহজাদ তাকে ধরার জন্য বায়না ধরছে।মাহিম পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো।সে তো বনুকে দেখেই চলেছে।হুমায়ন ভাই চুপচাপ বসে আছে।মুনতাসিব মিষ্টি আনতে গিয়েছে।মায়ার এখনো জ্ঞান ফিরেনি।আমি ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম,
‘ভাই দেখো আমাদের ছোট্ট ওয়ামিয়া।তোমার মেয়ে ভাইজান কোলে নাও’
ভাইজান কোলে নিলো।মেয়েটা কান্না করে উঠলো।হুমায়ুন ভাইজান দ্রুত আমার কোলে তাকে দিয়ে দিলো।সে মায়াকে দেখবে।কেভিনে ঢুকলো।নার্স বাচ্চাকে নিয়ে গেলো।শেহজাদ মাহিম আমার পাশেই বসে আছে।ওরা আমাকে বললো
‘আম্মু ওই পুতুলটা কি আমাকে দিবে মামু আর মামি’
‘তোমার লাগবে ওকে’
‘হ্যাঁ আম্মু কতো কিউট’
‘আচ্ছা ফুপি ও কবে বড় হবে আমাকে ভাইজান বলে কবে ডাকবে’
আমি দু’জনের কথায় হেসে ফেললাম।জড়িয়ে ধরলাম দুজনকে।ওরা এটা ওটা প্রশ্ন করে চলেছে।আমি উত্তর দিচ্ছি।মুনতাসিব আসলো। বাকি সবাই তো এখানেই ছিলো।মেহবুবারও বিয়ে হয়েছে।একটা ছেলেও আছে।বয়স ৭ শেহজাদ মাহিমের থেকে বেশি ছোট না।সেও দৌড়ে আসলো আমার কাছে।এসেই এটা ওটা বলতে লাগলো।আমি এই তিন বাচ্চাকে সামলাতে সামলাতে শেষ।রাতে মায়ার কাছে থাকলাম।আমার মেয়ের ভীষণ শখ ছিলো।তবে মুনতাসিব আমাকে আর বাচ্চা নিতে দিবে না।আমাকে হারানোর ভয় নাকি তাকে ঘিরে ধরেছিলো।তাি আর নেওয়া হলো না।তবে এটা তো আমার মেয়ে আমার ওয়ামিয়া মেহেনাজ।ওকে আমি শক্ত,প্রতিবাদী, কঠোর ব্যক্তিত্বের একজন নারী করে গড়ক তুলবো।
–
–
দিন কাটছে আর আমার ছেলেটা ছোট ওয়ামিয়ার সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে।ওয়ামিয়ার দশ বছরের জন্মদিন আজ।আমার ছেলেটা এখন ২০ বছরের যুবক।ওয়ামিয়াকে সে পছন্দ করে।ওয়ামিয়া ও তার শেহজাদ ভাই বলতে পাগল।কোনোমতে কলেজ করে শেহজাদ ওয়ামিয়ার কাছে চলে আসে।শেহজাদ যতোটা পারে সবার কাছ থেকে আগলে রাখে তার ওয়ামিয়াকে।আমি ভীষণ অবাক হই এতে।।আমি তাকে নিজের রুমে ডেকেছি।সে আমাকে বন্ধু মনে করে সবই বলে।আজ আমি তাকে জিজ্ঞেস করবো।
‘আম্মু ভেতরে আসবো’
‘হ্যাঁ বাবা আসো’
শেহজাদ এসে আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরলো।আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
‘আব্বু আমাকে সত্যি কথা বলবি’
‘আম্মু তুমি তো জানো আমি তোমাকে কখনোই মিথ্যা বলি না’
‘আব্বু তুই এই ছোট্ট মেয়েটার ভেতরে কি দেখলি’
‘আমি জানি না আম্মু।জীবনে অনেক মেয়ে দেখেছি,মিশেছি।তবে ওকে দেখলে বুক কেঁপে উঠে।সারাদিন মনে হয় কোলে নিয়ে বসে থাকি।’
‘আব্বু নিজের পড়াশোনায় ক্ষতি করিস না।সময় হলে আমি নিজেই তোদের এক করে দিবো।ভরসা রাখ’
‘আমি জানি আমার আম্মু আমাকে কতোটা ভালোবাসে।ভরসা তো আছেই।ওয়ামিয়াকে পছন্দ তো তোমার ছেলের বউ হিসাবে’
‘একশো তে একশো’
শেহতাজ হাসি মুখে বললেন কথাটা।শেহজাদ বেরিয়ে গেলো।আমি চোখ মুছলাম।এই দুইজনকে একসাথে কতো সুন্দর মানাবে।আমি শাড়ি পরে নিলাম। তৈরি হয়ে বেরিয়ে পরলাম।সারাবাড়ি মেহমানে গিজগিজ করছে। ওয়ামিয়া একটা লাল টুকটুকে ফ্রক পরে সোফায় শেহজাদ আর মাহিমের মাঝে বসে আছে।মাহিম বোঝে শেহজাদ ভালোবাসে ওয়ামিয়াকে।সে এতে ভীষণ খুশি। যোগ্য মানুষের হাতে তার বোনকে তুলে দিবে সঠিক সময়ে।
পরিবারের সবাই আসলো।কেক কাটলো ছোট্ট ওয়ামিয়া।তখন তার একপাশে ছিলো মাহিম আরেকপাশে শেহজাদ।সে দুজনকে ভীষণ ভালোবাসে।ওয়ামিয়ার দশতম জন্মদিন আমরা সবাই আনন্দ করে কাটালাম।আজকের দিনটা এতো ভালো কেটেছে।
*********
ওয়ামিয়া থামলো।ডাইরিটা বন্ধ করলো।অনেক পরেছে। প্রতিটা পৃষ্টাতে তার ফুপি আম্মু তার নিজের অনুভূতি গুলো প্রকাশ করেছে। তাহলে শেহতাজের জীবনেও ঝড় এসেছে।নিজের ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য লড়াই করতে হয়েছে। ওয়ামিয়া ডাইরিটা সাবধানে নিজের শাড়ির ভেতরে লুকিয়ে রাখলো।তার জানতে হবে এখন কোথায় মালা। শেহজাদ তার মতো খুঁজুক সেও না হয় চেষ্টা করলো।তার পক্ষে সম্ভব নয় এটা তবুও সে ইফাজকে দিয়ে খোঁজ লাগাবে।একমাত্র ইফাজকেই বিশ্বাস করে সে। ইফাজই তাকে সঠিক তথ্য দিতে পারবে।
‘আমি বের করবো সব। ইমন শেখ! হ্যাঁ ফুপিআম্মুর চাচাতো ভাই। মানে আমার চাচ্চু। এর খবর তো আমি সহজেই বের করতে পারবে।ইশ এতো দিন মাথায় কেনো আসলো না’
ওয়ামিয়া অনেক সময় ভাবে কি করে খবর নিবে সে। মাহিম বা হুমায়ন শেখ ছাড়া জানার কোনো পথ নেই।হঠাৎ রামিশার কথা মাথায় আসে তার। ফোন বের করে দ্রুত কল করলো রামিশাকে।রামিশা তখন রুমেই ছিলো।বিছানা গোছাতে ব্যস্ত ছিলো সে।কল আসায় ফোনে কাছে আসে।মেহেনাজ নাম দেখে দ্রুত রুমের দরজা বন্ধ করে।রামিশা ফোন রিসিভ করে বলে,
‘আসসালামু আলাইকুম।কেমন আছো মেহনাজ?’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাবি।আলহামদুলিল্লাহ ভালো তুমি এবং বাড়ির সবাই?’
‘ভালো নেই ওয়ামিয়া কেউ। আম্মা কাঁদছে।আব্বু ঠিকমতো খেতে আসে না।উনিও কেমন হয়ে গিয়েছে।’
ওয়ামিয়া চোখ জ্বলছে। মানুষগুলো কষ্টে আছে।তবে সেই বা কি করবে।মনে অন্য পুরুষ নিয়ে কি অন্য কাউকে বিয়ে করা যায়।মন প্রান জুড়ে তার পাথর মানবের বসবাস। ওয়ামিয়া গাল বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পরলো।ভাঙা গলায় বললো,
‘ভাবি তুমি একটু তাদের খেয়াল রেখো।আমি চেষ্টা করবো ঝামেলাটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ করার’
‘হুম তুমি কষ্ট পেও না।ইনশাআল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে’
‘আচ্ছা ভাবি যার জন্য ফোন করলাম তোমাকে।তুমি কি ভাইয়ার কাছ থেকে শুনে বলতে পারবে আমায়’
‘বলো কি শুনতে হবে।আমি চেষ্টা করবো’
তুমি পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইবে।বলবে আব্বুর কতগুলো চাচা,চাচাতো ভাই।পরিবার সম্পর্কে আরো কিছু তবে ফুপিমণি সম্পর্কে কিছু শুনতে চাইবে না যদি না বলে।আর যদি ইমন শেখ ভাইয়া বলে তাহলে তার সম্পর্কে একটু খুঁটিয়ে শুনবে’
‘আচ্ছা ঠিক আছে মেহেনাজ আমি যথা সম্ভব চেষ্টা করবো’
#চলবে