#অতঃপর_তুমি_আমি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_১৬
মায়া বেগম ততক্ষণে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে বসার ঘরে প্রবেশ করেছেন।শেহজাদকে দেখে খুশি হলেন। চোখে পানি আসলো। আঁচলের কোনা দিয়ে মুছে নিলো। এটা হওয়ারই ছিলো। শেহজাদ ওয়ামিয়া দুজন দু’জনকে পাগলের মতো ভালোবাসে।ওয়ামিয়া মায়ের দিকে এক পলক তাকায়।মায়া বেগম কাঁদছেন তবে এখন কাছে যাওয়া সম্ভব না। শেহজাদ সবার দিকে তাকিয়ে বের হয়ে গেলো ওয়ামিয়াকে নিয়ে।অর্নব আর ইফাজ ও বের হয়ে আসে।রাশেদ হাওলাদার পরিস্থিতি বুঝতে পারলেন। হুমায়ন শেখ বললেন,
‘দুঃখিত এমন হবে কখনো ভাবতে পারিনি’
‘তোর বিষয়টা জেনে শুনে ডাকা উচিত ছিলো হুমায়ন। মেহেনাজ মা যখন শেহজাদকে ভালোবাসে তখন আমাদের ডাকার প্রশ্নই উঠে না।’
‘ক্ষমা করে দে আমায়। ভাবিনি এমন কিছু হবে। ভেবেছিলাম শেহজাদ আসবে না। তবে আজ সে উপস্থিত হয়েছে’
‘কার ভাগ্যে কি লেখা থাকে কেউ জানে না হুমায়ন চিন্তা করিস না। শেহজাদ ভালো রাখবে ওকে’
‘চিন্তা কেনো করবো না রাশেদ। তুই তো জানিস সব। আমার বোনটাকে হারিয়েছি আমি! আমি বুঝি আপন কাউকে হারানোর ব্যাথা কতোটা। শেহজাদ যে মেহেনাজকে পাগলের মতো ছোট বেলা থেকে ভালোবাসে তা কম বেশি আমরা সবাই জানি। ভালো ও থাকবে মেহেনাজ। তবে মনকে বোঝাতে পারি না আমি’
‘কষ্ট পাস না বন্ধু।ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে’
রাশেদ হাওলাদার প্রথমে রাগ হলেও পরে পরিস্থিতি বুঝতে পারেন।হুমায়ন শেখকে কি বলে শান্তনা দিবেন বুঝতে পারছেন না।অভি হাওলাদার তার বাবার এমন ব্যবহারে বিরক্ত। এমনিতেও অপমানিত হলো তার উপর এখন শান্তনার বানী শুনাচ্ছেন। অভি মনে মনে ঠিক করে নেয়। সে আজকের অপমানের প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বে। তাকে প্রত্যাখান করেছে।মাহিম তো নিজের রুমের দরজা আটকে বসে আছে। রামিশা রান্না ঘরে কাজ করছে। মনে মনে সে ভীষণ খুশি। যাক শেষ অব্দি ওয়ামিয়া তার ভালোবাসার মানুষকেই পেলো।
*******
গাড়িতে গা এলিয়ে বসে আছে ওয়ামিয়া। পরনে বোরকা এখনো। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর একটা কথাও বলেনি সে শেহজাদের সাথে। এতো সহজ!এসেছে ঠিকই তবে তাকে অবহেলা করা বারবার প্রত্যাখান করা সবই মনে আছে তার। যদিও ভালোবাসে তাকে শেহজাদ। তবে কেনো এতো দিন দূরে ছিলো তাকে প্রত্যাখান করলো। সব কিছু জানবে সে। এবার সত্য উদঘাটন করবে। এতো সহজে তো সে ধরা দিবে না তার কাছে।শেহজাদ প্রেয়সীর মুখ দেখে বুঝতে পেরেছে প্রেয়সী অভিমান করেছে। অভিমান করা জায়েজ। এতো ভালোবাসার পরেও প্রত্যাখান করেছে সে। তবে সে প্রেয়সীর অভিমান ভাঙাবে ধীরে ধীরে।সবাই কাজি অফিসের সামনে আসে। নেমে পরে ছেলেরা তিনজন। ওয়ামিয়াই বলেছে নামতে। পরনের বোরকা খুলে ফেলে। বের হয় গাড়ি থেকে। গাড়ি থেকে বের হতেই চোখ আটকে যায় শেহজাদের। তার প্রেয়সী তার সামনে নীলরঙা জামদানি সাথে কাজল লিপস্টিক পরে সুন্দর করে সেজে আছে।
মাথায় অবশ্য হিজাব বাঁধা। প্রেয়সীর এমন রূপে ঘায়েল হলো শেহজাদ। তার প্রেয়সী অতুলনীয়। চোখ ফেরাতে পারছে না সে সামনে থাকা রমনীর দিক থেকে। সাধারণ সাজেও তাকে অসাধারণ লাগছে।ওয়ামিয়া কুচি ঠিক করছিলো নিচে তাকিয়ে।সামনে তাকাতেই দেখলো শেহজাদ তাকিয়ে আছে তার দিকে তবে সে ইগনোর করলো। অন্যদিকে চোখ ঘুরালো।অর্নব ইফাজ ভেতরে ঢুকে গিয়েছে অলরেডি। অজিফাও এসেছে। অজিফা ওয়ামিয়াকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। সে বিয়ের খবর জেনেছে ইফাজের কাছ থেকে।ওয়ামিয়া ও জড়িয়ে ধরে অজিফাকে।অজিফা ওয়ামিয়াকে ছেড়ে খুশি হয়ে বলে,
‘আজকে তোর বিয়ে মেহু বিশ্বাসই করতে পারছি না। তুই তোর ভালোবাসার মানুষকেই পাচ্ছিস তবে’
‘হুম তবে এর জন্যও অনেক কিছু হারাতে হলো। তবে ইনশাআল্লাহ তারা নিজেরাই একদিন মেনে নিবে সব’
‘হুম ভেতরে চল’
শেহজাদ ততক্ষণে ভিতরে চলে গিয়েছে। দু’জন ভেতরে ঢুকলো। ওজিফা ভেতরে প্রবেশ করে ইফাজকেই দেখছে। কত্ত কিউট লাগছে লোকটাকে। আবারও প্রেমে পরলো সে ইফাজ আবরারের।বিয়েটা সম্পূর্ণ হলো। ওয়ামিয়া কবুল বলে শেহজাদের হলো। আজ থেকে শেহজাদ তার একান্ত ব্যাক্তিগত মানুষ ভাবতেই কেমন কেমন লাগছে।সবাই অভিনন্দন জানালো। শেহজাদের কয়েকজন বন্ধু বান্ধবী ও এসেছে। তারাই সাক্ষী দিয়েছে। অজিফা বিদায় নিয়ে চলে যায়। ওয়ামিয়া অবশ্য তার সাথে নিজের শ্বশুড়বাড়ি যেতে বলেছিলো তবে অজিফা কাজ আছে বলে চলে গিয়েছে।
সবাই মিলে চলে আসলো খান বাড়ি অর্থাৎ চেয়ারম্যান বাড়িতে। ওয়ামিয়ার বুক ধক করে ওঠে। আজ পাঁচ বছর পর সে এই বাড়িতে পা রাখবে। তার ফুপি আম্মুর ইচ্ছা পূরন হলো। ফুপি আম্মুর কথা মনে আসতেই চোখ জ্বলতে শুরু করলো।আহ! নেই সে। কখনোই ফিরবে না। সে যে হারিয়ে গিয়েছে পাঁচ বছর আগে।ওয়ামিয়াকে গভীর চিন্তায় মগ্ন দেখে শেহজাদ হাত ধরলো তার শক্ত করে।
ওয়ামিয়া চমকে উঠলো। একবার হাতের দিকে তো আরেকবার শেহজাদের দিকে তাকালো।শেহজাদ মৃদু হেসে পা বাড়ায় বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওয়ামিয়াকে নিয়ে প্রবেশ করে খান বাড়িতে। ড্রয়িংরুমে মুনতাসিব খান এবং মেহবুবা খান বসে অপেক্ষা করছিলেন তাদের জন্য। মেহবুবা এতো বছর পর ওয়ামিয়াকে দেখে দৌড়ে এসে বুকে জড়িয়ে নেন।ওয়ামিয়া কান্না পায় এবার। এই মানুষটাও তাকে কম আদর করতো না। বাড়ির একমাত্র মেয়ে ছিলো সে। কম বেশি সবাই আদর করতো।মেহবুবাও নিজের মেয়ো মনে করতো ওয়ামিয়াকে।
‘মা তুই এসেছিস এতোগুলো বছর তোর জন্য অপেক্ষা করেছি আমরা’
‘আন্টি কেঁদো না তুমি’
মেহবুবা ওয়ামিয়ার সারা মুখে অধর ছুঁইয়ে দেন। আবারও বুকে জড়িয়ে নেন। আজ যদি শেহতাজ থাকতো তবে কতোই না আনন্দ হতো।মেহবুবা ওয়ামিয়া ছেড়ে দেন। ইশারা করেন মুনতাসিব খানের কাছে যাওয়ার জন্য। ওয়ামিয়া ধীর পায়ে হেঁটে মুনতাসিব খানের পাশে বসে। মুনতাসিব খান এক দৃষ্টিতে মেঝেতে তাকিয়ে আছে।
‘ফুপা!’
উত্তর দেয় না মুনতাসিব খান। সে নিশ্চুপ নিরুত্তর হয়ে একই ভঙ্গিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে।ওয়ামিয়া চোখ মুছে আবার বলে,
‘ফুপা কেমন আছো তুমি। তুমি কি কথা বলবে না আমার সাথে?’
এবার আর আটকাতে পারে মুনতাসিব খান নিজেকে ওয়ামিয়াকে জড়িয়ে ধরে। ছোট্ট মেয়েটা কতো বড় হয়েছে। আজ বিয়ে করে তার বাড়িতে এসেছে তারই বউমা হয়ে। শেহতাজ আর মুনতাসিবের মেয়ের অনেক শখ ছিলো তবে কিছু কারণে হয়নি। ওয়ামিয়া যখন জন্মেছিলো তখনই ওয়ামিয়াকে দিয়েই নিজেদের মেয়ের অভাব পূরণ করেছিলো। ওয়ামিয়া ছিলো সবার চোখের মনি। একমাত্র মেয়ে বলে কথা।মুনতাসিব ভীষণ ভালোবাসতো ওয়ামিয়াকে।
‘মা কতো বড় হয়ে গিয়েছিস তুই’
‘ফুপা তুমি ঠিক আছো তো’
‘আমি ঠিক নেই রে মা। অপরাধ বোধ আমায় এখনো কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। আমার জন্য শেহতাজ এই পৃথিবীতে নেই।’
ওয়ামিয়া মাথা তুললো। মুনতাসিবের গালে হাত রেখে বলল,
‘ফুপা এইটা ভাগ্যের ব্যাপার যা হওয়ার ছিলো তা কি কেউ পাল্টাতে পারবে।কখনোই পারবে না।নিজেকে অপরাধী ভাববে না।ভাগ্য লেখা ছিলো তাই হয়েছে’
‘হুম মা’
শেহজাদ,মেহবুবা, ইফাজ, অর্নব সবাই দাঁড়িয়ে দেখছে। শেহজাদ বাদে সবার চোখে পানি। এই মানুষটাকে তারা কত শক্ত, কঠোর মনের অধিকারী ভেবেছিলো। তবে আজ তারা এক অন্য মুনতাসিব খানকে দেখছে। এ জেনো ৫-৬ বছরের বাচ্চা। ওয়ামিয়া গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পরে মুনতাসিব খানের সাথে।
*********
আজ ওয়ামিয়া শেহজাদের বাসর রাত হলেও রুমে কোনো ফুলের ছিটেফোঁটা ও নেই। নেই ওয়ামিয়া গায়ে জড়ানো বিয়ের ভারী শাড়ি বা মুখে সাজ। ওয়ামিয়া একটা সাধারণ থ্রি পিস পরে বসে আছে সোফায়। ভালো লাগছে না তার কিছুই। কান্না পাচ্ছে। সে তো এমন কিছুই চাইনি। সবাই মিলে হাসি খুশি ভাবে শেহজাদের হাতে তাকে তুলে দিবে এটাই তো চেয়েছিলো সে। এখানে আসার পর থেকে মুনতাসিবের সাথে সময় কাটিয়েছে ওয়ামিয়া। শেহজাদের সাথে দেখা হয়নি আর। রুমে এসেছে আধা ঘন্টার মতো। এসে জামা কাপড় পাল্টে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে।
ওয়ামিয়া সব থেকে অবাক তখন হয়েছে যখন আলমারি খুলে সে নিজের প্রয়োজনীয় সব পেয়েছে।তবে কি শেহজাদ আগে থেকেই সব কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিলো।কে জানে হয়তো!শেহজাদ দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে। রুমে প্রবেশ করেই মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। সে তো এই দিনটার অপেক্ষায়ই ছিলো। রুমে প্রবেশ করেই প্রেয়সীর মুখখানা দেখবে।শেহজাদ জামা কাপড় নিয়ে পাল্টে ওয়াশরুম থেকে বের হয়।ওয়ামিয়া এক পলক তার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে নেয়। শেহজাদ এসে ওয়ামিয়ার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসে পরে।শেহজাদ কাতর কন্ঠে বলে,,
‘আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না প্রেয়সী’
#চলবে