#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_চার
বাসর রাতে স্বামীর কলার চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে তারিন। চোখে মুখে তার অগ্নী ঝড়া রাগ। সব ঝামেলা শেষে রাতে ঘরে ঢুকে তারিনকে কিছু শক্ত বাক্য শুধাতেই তারিন বাঘিনী রুপে তামজিদের উপর হামলে পড়েছে। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
“আপনি কি ছেলে খেলা পেয়েছেন সব? কেমন পুরুষ আপনি, মাস্টার মশাই? আপনাদের মতো পুরুষদের কি বলে জানেন? ব্যক্তিত্বহীন, কাপুরুষ বলে। একটা মেয়েকে ভালোবাসলেন তারপর তাকে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দিলেন। পরিবারের চাপে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুললেন। দুইটা মেয়ের জীবন নিয়ে আপনি ছিনিমিনি খেলছেন, মাস্টার মশাই। যাকে ভালোবাসলেন তাকে নিজের মায়ের মনের মতো গড়ে নিতে পারতেন। তার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে পারতেন৷ তা না করে কাপুরুষের মতো ছেড়ে দিলেন। কেনো করলেন এইসব? আজকে আপনি আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিবেন। আর সেটা এক্ষুনি। বলেন কেনো করলেন এতসব কিছু?”
তারিনের কথা পাল্টা জবাবে তামজিদ এবার শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
“আমি তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।”
এবার তারিন আরো শক্ত করে কলার চেপে ধরল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“একদম ভুলে যাবেন না, আমি কে? আমি আপনার বিয়ে করা বউ। কয়েক ঘন্টা আগে তিন ‘কবুল’ বলে আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন। তাই আমার কাছে আপনি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য। শুনেন মাস্টার মশাই, আমাকে গ্রামের সাদাসিধা, অবলা মেয়ে ভাববেন না। আমি কোনো অবলা প্রানী না যে আপনারা আমার সাথে যা খুশি তা করবেন। আমি নিজের অধিকার নিজেই আদায় করে নিতে পারি। আর নিবো। বয়সের তুলনায় ম্যাচুরিটি আমার মধ্যে অনেক বেশি। বুদ্ধিটাও বেশি।”
তামজির এবার কঠিন হয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুলল। পরক্ষণেই তারিনের এমন অগ্নী রুপ দেখে তামজিদ দমে গেলো। নিস্তব্ধে তারিনের থেকে নিজের কলারটা ছাড়িয়ে নিলো। খাটের উপর ধপ করে বসে পড়ল। কিছুক্ষণ নিরবতায় কেটে গেলো দুজনের। তারিনের চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে একাধারে। যতই উপরে শক্ত থাকুক না কেন ভেতরে ভেতরে না চাইতেও ভেঙে যাচ্ছে বার বার। জীবনের নৌকা ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে থামবে সেটা ভেবেই অস্থির হয়ে উঠছে বার বার। তারিন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। ভেতর থেকে চাপা আর্তনাদে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। তামজিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বলে উঠল,
“আমার কথাগুলো একটু শুনবে, প্লিজ?”
তামজিদের গলার স্বর খুব অসহায় শুনালো। সেই স্বরে চাপা আর্তনাদ স্পষ্ট। তারিনের উত্তর না পেয়ে তামজিদ পুনরায় বলে উঠল,
“শুনবে আমার কথাগুলো?”
তারিন কঠিন স্বরেই বলল,
“বলুন। শুনছি।”
তামজিদ আগের ন্যায় শান্ত হয়ে অনুরোধ বাক্যে শুধালো,
“এখানে এসে বসো।”
তারিন কিছু না বলে চুপচাপ তামজিদের পাশে গিয়ে বসে পড়ল। অবশ্য খানিক দূরত্ব বজায় রেখেছে ঠিক_ই। তামজিদ এবার শান্ত স্বরে বলতে শুরু করল,
“আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করব না, তারিন। তোমার অধিকার থেকে তোমাকে বঞ্চিত করব না। কম বেশি সবার জীবনে অতিত থাকে। তাই বলে কি মানুষ অতিত আকঁড়ে বসে থাকে? আমার জীবনেও একটা অতিত আছে। তাই বলে কি আমি কখনো অতিত ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে পারবো না?”
তারিন বেশ শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“দেখেন মাস্টার মশাই, আপনার জীবনে যদি শুধু অতিত থাকতো আমি মেনে নিতাম। কিন্তু এটা তো অতিত না। এটা বর্তমান। যাকে ছেড়ে আসলেন তার কি হবে ভেবেছেন?”
“ভেবেছি।”
“ভাবলে ছেড়ে আসলেন কিভাবে?”
“কী করব আমি? তুমি একবার আমার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করো। তারপর বলো কী করতাম আমি?”
“আপনার মায়ের কেনো পছন্দ না দিশা আপুকে?”
“দিশা শহরের স্মার্ট মেয়ে।”
“তাহলে আপনার মায়ের যেমন মেয়ে পছন্দ তেমন করে দিশা আপুকে গড়ে তুলতে পারতেন।”
“চেষ্টা করেছিলাম। হয় নি।”
“কেনো হয় নি, মাস্টার মশাই?”
তামজিদ এবার দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ল। তারিন প্রশ্নোত্তর চোখে তামজিদের মুখ পানে তাকিয়ে আছে। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“কেনো হয় নি?”
তামজিদ এক বুক হাহাকার নিয়ে বলে উঠল,
“আমার মা কোনোভাবেই মেনে নিবে না, দিশাকে। দিশাকে তার অকারণেই বড্ড অপছন্দ।”
“অকারণে কাউকে অপছন্দ করা যায় না।”
তামজিদ এবার খুব উৎসাহ নিয়ে বলে উঠল,
“দিশা, খুব ভালো মেয়ে বিশ্বাস করো। তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে আমি মানছি। ওর জায়গায় থাকলে তুমিও হয়তো এমনটাই করতা। শিক্ষিত, ভদ্র, স্মার্ট ও ভালো ফ্যামিলির মেয়ে দিশা। আমাদের সম্পর্ক খুব বেশিদিনের না৷ মাস ছয় হবে। কিন্তু বন্ধুত্বটা সেই কলেজ লাইফ থেকে। আস্তে আস্তে ওর প্রতি কখন যে ভালোবাসা জন্মে গিয়েছিলো টের পাইনি। বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে। পেয়েও হারিয়ে ফেললাম। না পাওয়ার যন্ত্রণা কোনো একসময় ভুলে যাওয়া যায়। কিন্তু পেয়ে ও যেই মানুষ শখ জিনিস হারায়, সেই মানুষ যন্ত্রণা ভুলে কি করে?”
তারিন খেয়াল করল তামজিদের চোখ অশ্রুসিক্ত। তারিনের বুকটাও কেঁপে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করে বসল,
“তাইলে আমি ক্যামনে সইমু, মাস্টার মশাই?”
তামজিদ এহেন প্রশ্নে অবাক হয়ে বলল,
“মানে?”
তারিন এবার অশ্রুসিক্ত নয়নে তামজিদের দিকে তাকাল। তামজিদ তারিনের দিকেই চেয়ে ছিলো। দুজনের চোখে চোখে একবার বনিবনা হয়ে গেলো। তারিন দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলল,
“কিছুনা। আমার ভালো লাগতাছে না।”
“তাহলে তুমি ফ্রেশ হয়ে এসে সুয়ে পড়ো। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। আ…।”
এর মধ্যেই তামজিদের ফোনটা বেজে উঠল। তামজিদ তারিনের দিকে একবার আড় চোখে তাকাল। তারপর বলল,
“দিশা, ফোন দিয়েছে। তুমি ফ্রেশ হতে যাও। আমি আসছি৷ ”
বলেই বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তারিন হাত ধরে আটকে দিলো। তামজিদের হাতের থেকে ফোনটা ছুঁ মেরে নিয়ে রিসিভ করল। লাউড স্পিকারে দিতেই ওপাশ থেকে দিশার কণ্ঠে ভেসে আসল,
“তাজ, আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারছিনা। প্রতি মুহূর্তে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ, তুমি ওই মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। তুমি যেভাবে বলবে আমি সেভাবেই তোমার মায়ের মনের মতো হয়ে উঠব।”
তামজিদ তারিনের উত্তরের আশায় না থেকে বলে উঠল,
“তোমার হাতে এখন আর সেই চান্স নেই, দিশা। তোমাকে আমার মায়ের কাছে অনেকবার আনার চেষ্টা করেছি। তুমি আসো নি। আমার থেকেও তোমার কাছে নিজের তোমার ক্যারিয়ার মূল্য অনেক বেশি ছিলো। এখন আমার আর কিছু করার নেই।”
দিশা পুনরায় বলে উঠল,
“প্লিজ তাজ, তুমি ওই গাইয়া মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। ওর পাশে তোমাকে একটুও মানাচ্ছে না।”
এবার তামজিদের উওরের অপেক্ষায় না থেকে তারিন বলে উঠল,
“আমার পাশে আমার স্বামীকে না মানালেও তাকে সারাজীবন আমার সাথেই থাকতে হবে। স্বামীর অধিকার আর ভালোবাসা দুটোই আমি আদায় করে নিব। আর আমাদের স্বামী, স্ত্রীর মাঝে যদি কোনো কাটা আসে তাহলে তাকে শিকড়সহ উপড়ে ফেলে দিব৷ মনে রাখবেন।”
বলেই ফোনটা কে’টে দিলো। তামজিদের উদ্দেশ্য বলল,
“এখন থেকে যার তার ফোন রিসিভ করার আগে মনে কইরা নিবেন, আপনে বিবাহিত। আপনার স্ত্রীর এসব কিছু পছন্দ নাও হইতে পারে।”
বলেই টেবিলের উপর থেকে একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। ওয়াশরুমে গিয়েই দরজার ছিটকিনি আটকে, দরজায় পিঠ ঘেষে বসে পড়ল। এতক্ষণের জমানো সব কষ্ট, আর্তনাদ গুলো এবার বেরিয়ে আসল। তারিন মুখ চেপে কান্না করে উঠল। যেন শব্দ না হয়। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে। মায়ের বুকে মাথা একটু কাঁদতে মন চাচ্ছে ওর। সবকিছু হঠাৎ করেই এত পরিবর্তন হয়ে গেলো কেন? জীবন কি অন্য রকম হতে পারতো না? জীবন হঠাৎ করেই একটা কিশোরি মেয়ে কত বড় বানিয়ে দিলো! জীবন বড় অদ্ভুত। তারিন নিজে নিজেই কান্নারত স্বরে বলে উঠল,
“ক্যান এমন হইলো, আল্লাহ? আমি কি এমন চাইছিলাম? আমার আব্বার কত সাধ ছিলো আমার লইয়া। আমি আমার জামাইর কাছে রানীর মতো থাকমু। আব্বা! আজকে তোমারে আমি কইতে পারলাম না। তোমার মাইয়া শশুড় বাড়ি রানী হইয়া থাকবো ঠিকি কিন্তু স্বামীর আদর পাইবো না।”
তারিনের বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। যখন একিটা মেয়ে বুঝতে শিখে। তখন থেকে বিয়ে, স্বামী, শশুড় বাড়ি এসব নিয়ে প্রতিটা মেয়েরই স্বপ্ন থাকে। তারিনের স্বপ্ন ছিলো। সেসব স্বপ্ন গুলো এক নিমিশেই ভেঙে গেলো। এভাবেই কেটে গেলো ঠিক কতক্ষণ, কতসময় বুঝা গেলো না।
–
–
–
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখল তামজিদ বিছানায় উপড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে। ডিম লাইটের আবছা আলোয় মুখটা বড্ড মায়াময় দেখাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের উপর ছড়িয়ে আছে। গায়ের কালো রঙের একটা ট্রি-শার্ট ও ট্রাউজার। তামজিদের মুখের দিকে তাকাতেই তারিনের বুকটা ধক করে উঠল। এক অদ্ভুত ভালো লাগা ছেয়ে গেলো সারা অঙ্গে। চোখের কোনে জল জমে আছে। তা দেখে বেশ বুঝতে পারছে তামজিদ ভেতরে ভেতরে বড্ড কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। হুট করেই তারিনের বেশ কান্না পেলো। কি আশ্চর্য! এখন কান্না পাচ্ছে কেনো? কেনো চোখের কোনে জল জমছে? উত্তর খুঁজে পেলো না। চুপচাপ গিয়ে তামজিদের পাশে সুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে মায়ের বলা কথা গুলো মনে করতে লাগল। মনে মনে ভাবতে লাগল, আম্মায় তো কইছিলো,
“হুনো তারু, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হইলো গিয়া পবিত্র সম্পর্ক। এই সম্পর্কে আল্লায় নিজে হাতে রহমত দিয়া দেয়। এই সম্পর্ক ভাঙন এত্ত সোজা না৷ স্বামীর উপর একবার মহব্বত জন্মায় গেলে ওই মহব্বতের মরনের আগে অব্দি কোনোদিন শেষ হইবো না।”
সত্যি কি তাই? চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল, তামজিদ কি কখনো ওকে বউ হিসেবে মেনে নিবে? ভালোবেসে কাছে টানবে? নাকি শুধুই দায়িত্ব পালন করে যাবে?
#চলবে
[নোটঃ- যারা সামাজিক গল্প পছন্দ করেন না৷ তাদের কাছে এই গল্পটা হয়তো বিরক্ত লাগতে পারে। মনে হতে পারে শুধুই টানছি৷ আমি আসলে এই গল্পে স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্কের দুষ্টু, মিষ্টির গল্প, একটা কিশোরী মেয়ের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর গল্প, দায়িত্ব থেকে ভালোবাসা শুরু, ভ্রমণ ও কিছু বাস্তবতা মিলিয়ে লেখার চেষ্টায় আছি। সেই অনুযায়ী গল্প এগিয়ে যাবে। তাই দয়া করে কেউ প্রথমেই বিরক্ত হবেন না]
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/