#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_আট
শাশুড়ী হয়ে বর্ষা বেগম ছেলের বউয়ের হাতটা এত জোরে শক্ত করে চেপে ধরেছে, যে তার হাতের নখ তারিনের হাতে বিধে যাচ্ছে। ব্যাথায় তারিন একবার আর্তনাদ করে উঠল। তবুও ছাড়লেন না তিনি। রক্তিম চোখে তারিনের দিকে তাকিয়ে আছেন৷ সে চোখে তাকিয়ে তারিন খানিকটা ভয় পাচ্ছে ঠিক-ই কিন্তু ঘাবড় যাচ্ছে না। তারিন এবার ব্যাথাতুর স্বরে বলে উঠল,
“আম্মা, আমার ব্যাথা লাগছে।”
বর্ষা বেগম এবার গর্জে উঠলেন। গর্জন করে বললেন,
“লাগুক। তুমি কোন সাহসে আমার ছেলের কাছে পড়ালেখার আবদার করেছো?”
তামজিদ নিজের মায়ের এমন রুপ জন্মের পর কখনো দেখে নি। আজ চোখের সামনে দেখে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ আমজাদ সাহেব স্ত্রীকে ধমকে বলে উঠলেন,
“কী করছো, তাজের মা? পা’গল হয়ে গেছো তুমি?”
তামজিদ এগিয়ে গেলো। বর্ষা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“মা! তারিনের হাতটা ছাড়ো। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
বর্ষা বেগম এবার তামজিদের দিকে চোখ গরম করে তাকালেন। তর্জনী আঙ্গুল তামজিদের দিকে তাঁক করে উচ্চ স্বরে বললেন,
“চুপ! একদম চুপ! বউয়ের হয়ে কৈফিয়ত দিতে এসেছিস?”
তামজিদ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো,
“মা! তুমি ভুল বুঝছো। শোনো, তুমি একটু শান্ত হও। আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি।”
বর্ষা বেগম পুনরায় চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
“কী বুঝাবি তুই আমাকে? আমাকে কি তোর অবুঝ মনে হয়? জ্ঞান নেই আমার? তোর থেকে জ্ঞান নিতে হবে?”
তারিন কিছু বলছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে সবটা। চোখের সামনে একটা মানুষের ভিন্ন রুপ ওকে ভাবাচ্ছে। ভীষণ গভীর ভাবে ভাবছে কিছু। আমজাদ সাহেব এবার কঠিন স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন,
“তাজের মা! বউমার হাতটা ছাড়ো। নয়তো এত বছর বিবাহিত জীবনে আমি যে পাপটা করিনি তা আজ করতে বাধ্য হবো।”
বর্ষা বেগম ঘুরে তাকালেন স্বামীর দিকে। তারিনকে ধরে রাখা হাতটা আলগা হয়ে এলো। অবিশ্বাস্য স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী বললে তুমি?”
আমজাদ সাহেব আগের ন্যায় কঠিন হয়ে জবাব দিলেন,
“একদম ঠিক বলেছি। কী করছো এসব তুমি? বাড়ির বউয়ের গায়ে হাত দিচ্ছো? তুমি তো এমন ছিলে না তাজের মা। কি হয়েছে তোমার? তুমি তো সবসময় চাইতে মেয়েরা যেনো নিজের পায়ে দাঁড়ায়। পড়ালেখা করে। তাহলে এখন কেনো বাঁধা দিচ্ছো? দুদিন পর তুমি বাঁচবে কিনা তার গ্যারান্টি নেই। আর সেই তুমি এখন এত জোর খাটাচ্ছো?”
বর্ষা বেগম এবার ধপ করে দাঁড়ানো থেকে সোফায় বসে পড়ল। হুঁ হুঁ শব্দে কান্না করে উঠলেন। তার কান্না দেখে উপস্থিত সবাইক হকচকিয়ে গেলো। তারিন সবার আগে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। বর্ষা বেগমের পাশে বসে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“আম্মা, ঠিক আছেন আপনি? শরীর খারাপ লাগছে আপনার?”
তামজিদ ও ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,
“মা, ঠিক আছো তুমি?”
আমজাদ সাহেব রাগে চুপচাপ বসে আছেন। জিজ্ঞেস করছেন না কিছু। কিছুক্ষণ নিরবতায় ছেয়ে গেলো পুরো ড্রয়িং রুম। বর্ষা বেগম কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর উদ্দেশ্য বলতে লাগলেন,
“এইযে বললে না ‘আমি দুদিন বাঁচবো কিনা তার গ্যারান্টি নেই’ এখানেই আমার সমস্যা। আমার শাশুড়ী মা ম’রে যাওয়ার সময় এই সংসারটা আমার তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। মাঝে কতগুলো বছর কেটে গেছে। আমি এই সংসার নিজের হাতে যত্ন করে গড়ে তুলেছি। এই সংসারের প্রত্যেকটা জিনিস আমার খুব যত্নে করে সাজানো। আমি ম’রে গেলে আমার সংসারটা যেনো ভেসে না যায় সে জন্য ছেলের জন্য একজন ঘরোয়া মেয়ে চেয়েছিলাম। আমার সংসারটা আমার মতো করে যত্ন করে আগলে রাখবে এমন কাউকে চেয়েছিলাম৷ তারিনকে আমি এইজন্যই পছন্দ করে নিয়ে এসেছিলাম। আমি জানি তারিন বয়সে আমার ছেলের তুলনায় খুব ছোট। তাও নিয়ে এসেছিলাম। কারণ ওর বাড়িতে গুছিয়ে কাজ করাটা আমার নজর কেড়েছিলো। ওর মধ্যে আমি আমাকে দেখতে পেয়েছিলাম। এইটুকু বয়সেই মেয়েটা সব কাজ কত সুন্দর ভাবে গুছিয়ে করে সেটা নিজের চোখে দেখেছিলাম বলেই আমার ছেলের বউ করে এনেছি।”
বলেই থামলেন তিনি। আজকাল সে জোর খাটিয়ে কথা বলতে পারেন না। নিঃশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হয়। তারিন ছলছল চোখে বর্ষা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে। আমজাদ সাহেবের রাগ নিমিশেই গলে পানি হয়ে গেলো। তামজিদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষা বেগম পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে বলে উঠল,
“এই শেষ সময় এসে আমার ছেলের থেকে তার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছি আমি। কিন্তু আমি কি করবো বলো? দিশা আমার ছেলেকে ভালোবাসে আমি মানছি। কিন্তু দিশা আমার সংসারকে ভালোবাসে না। আমার সংসারটা গুছিয়ে রাখতে পারতো না। আমি ম’রে গেলে আমার স্বামীকে দেখে শুনে রাখতো না। আমার ছেলে আর নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। সব বিবাহিত নারীর জীবনে তার স্বামীর থেকে আপন আর কেউ নেই। আমিও স্বার্থপরের মতো আমাদের কথাই ভেবেছি। আমি তো দিশাকে সুযোগ দিয়েছিলাম ও সেই সুযোগ ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি কি করতাম তাহলে? আমার স্বামীর ও তো বয়স হয়েছে। তাকে দেখতো কে বলো? আমার যত্নে গড়া সংসার এলোমেলো হয়ে যেতো। যত্নে রাখা জিনিসপত্রে ধুলো জমে যেতো। শখের বাড়িটার দেয়ালে শেওলা জন্মাতো।”
তারিনের চোখের পানিগুলো এবার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। তামজিদের চোখের কোনও অশ্রুসিক্ত। তারিন ভাবছে একজন নারী সংসারের মায়ায় কতটা গভীর ভাবে জড়িয়ে গেলে এমন করে ভাবতে পারে? বর্ষা বেগম এবার শক্ত স্বরে তারিনের উদ্দেশ্যে বললেন,
“তোমাকে আমি সাংসারিক মেয়ে ভেবে বাড়ির বউ করে এনেছিলাম। আর এখন তুমিও সেই একই পথে হাঁটছো। তাহলে দিশা দোষ করেছিলো কোথায়? দিশাকে অপছন্দ করার এই একটাই কারণ ছিলো আমার। আর কিছু না।”
তামজিদ এবার মুখ খুলল। বলল,
“মা, যে আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে তাকে নিয়ে আমি আর ভাবতে চাইনা। আমি এখানে তোমার দোষ দিচ্ছি না। দিশা আমার ভাগ্যে ছিলো না তাই উপরওয়ালা তাকে আমার জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছেন। কিন্তু মা, তারিন কেমন সেটা তো তুমি আমার থেকে ভালো করে জানো। ওকে এই কয়েকদিনে আমি যেটুকু চিনেছি তাতে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, ও তোমার সংসারটা খুব যত্ন করে সামলে রাখবে। তুমি একবার ওকে সুযোগ দিয়েই দেখো। আমার বিশ্বাস ও পারবে।”
বর্ষা বেগম কিছু বললেন না। আমজাদ সাহেব এতক্ষণ পর মুখ খুললেন। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
“দেখো তাজের মা, আমাদের কার ভাগ্যে কি আছে সেটা আমরা কেউ জানিনা। তুমি শুধু এত কেনো ভাবছো? আজকে বেঁচে আছি কাল নাও থাকতে পারি। উপরওয়ালা তোমার আগে আমাকেও নিয়ে যেতে পারে। তাহলে কেনো আমাকে নিয়ে পড়ে আছো? আমার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। দিশাকে বাড়ির বউ হিসেবে আমিও মানতে নারাজ ছিলাম। কিন্তু তারিন মা, খুব ভালো। তুমি খাঁটি সোনা বেছে এনেছো তোমার ছেলের জন্য। সে তোমার সংসার কখনো অযত্নে রাখবে না।”
তারিন এবার বলে উঠল,
“আম্মা, না চাইলে আমি পড়বো না।”
তামজিদ বর্ষা বেগমের পায়ের কাছে গিয়ে হাঁটু ভেঙে বসল। মায়ের হাত আঁকড়ে ধরে বলল,
“মা, আপু তো সংসার আর পড়ালেখা খুব সুন্দর করে সামলে নিয়েছিলো। যখন ভুল করেছে আন্টি ওকে খুব সুন্দর করে শিখে নিয়েছিলো। আপু নিজেও চাকরি করেছিলো। এখন নিজের প্রয়োজনে ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের সমাজে এমন হাজার, হাজার মেয়ে আছে যারা ঘরে, বাইরে খুব সুন্দর করে ব্যালেন্স রেখে চলছে। তারা সংসার সামলাচ্ছে। বাচ্চা সামলাচ্ছে। আবার চাকরিও করছে। মা, আমাদের দেশের নারীরা এখন অনেক এগিয়ে গেছে। তুমি শুধু তারিনের পড়ালেখাতে বাঁধা দিও না, প্লিজ। তারিন, পড়ালেখা ও বয়সে দুই জায়গায় আমার থেকে অনেক ছোট। আমার সাথে চলতে হলে আমার বউকেও তো যোগ্য হতে হবে। তুমি চাও না, তোমার ছেলের বউ ছেলের যোগ্য হয়ে উঠুক? বলো, চাও না? আমার সাথে বাইরে বের হলে, যখন মানুষ তারিনের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করবে, তখন তো আমার আপমান হবে। মা, আমি আমার ভালোবাসাকে হারিয়েছি। ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু এই মেয়েটার স্বপ্ন ভাঙতে চাইনা। মা, অন্তত আমার বউকে আমার মনের মতো গড়ে তুলতে দাও, প্লিজ।”
বর্ষা বেগম কিছু বললেন না। উঠে দাঁড়ালেন। শক্ত কণ্ঠে বললেন,
“শুনে রাখো, যতই তোমরা আমাকে যা খুশি তাই বলো। আমি বেঁচে থাকতে কোনোদিন এই পারমিশন দিবো না।”
বলেই তিনি নিজের রুমের চলে গেলেন। তারিন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। চোখ থেকে অশ্রুপাত হচ্ছে। তামজিদ আড়ালে সে চোখের পানি মুছে নিলো। তামজিদ অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে বসে আছে। আমজাদ সাহেব নিঃশব্দে উঠে চলে গেলেন। তারিন উঠে দাঁড়াতেই তামজিদ অপরাধী স্বরে বলে উঠল,
“আমি আমার কথা রাখতে পারলাম না, তারিন। আমাকে ক্ষমা করো।”
তারিন সঙ্গে সঙ্গে হাস্যজ্বল স্বরে বলে উঠল,
“আম্মাকে, আমি রাজি করাবো। আর কি করে রাজি করাই সেটাই এবার দেখবেন।”
বলেই ঠোঁট টিপে হাসল। ওর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধিরা হানা দিয়েছে। কি করে বাঁকা মানুষকে সোজা করতে হয় তা তারিন বেশ ভালো করেই জানে। তারিন রান্না ঘরে এসে কাপড়ের আঁচলটা কোমরে গুঁজে নিয়ে নিজে নিজে বলে উঠল,
“আম্মা, ছোট মরিচের ঝাল কত বেশি এবার দেখবেন।”
তামজিদ তারিনের হাস্যজ্বল চেহারা পানে তাকিয়ে বোকাবনে গেলো। এইতো মেয়েটা কাঁদছিলো এখুনি আবার হাসছে? অদ্ভুত! মস্তিষ্ক প্রশ্ন করল,
“তারিন কি করে মা’কে রাজি করাবে?”
#চলবে
[রিচেক দেওয়ার মতো সময় পাইনা, বিশ্বাস করুন তাই বানানে অনেক ভুল থাকতে পারে। ক্ষমা করবেন প্লিজ।]
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/