#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_দশ
মাঝরাতে নিজের স্বামীকে তার প্রাক্তনের সাথে কথা বলতে শুনে অজানা ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল তারিনের। কিছুক্ষণ আগে তামজিদের ফোনের রিংটোনের শব্দে তারিনের ঘুম ভেঙে যায়৷ তখনি তামজিদ ফোন নিয়ে খুবই সাবধানে বেলকনিতে চলে যায়। বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ বেলকনি থেকে কথা বলার নিম্ন আওয়াজ ভেসে আসছে তারিনের কানে। তারিন আর শুয়ে থাকতে পারলো না৷ বসে পড়লো। ভয় আর সন্দেহে বিদঘুটে অনুভূতি সৃষ্টি হলো মনে। মাথার মধ্যে বেশ যন্ত্রণা শুরু হলো। জ্বরে শরীর বেশ দূর্বল লাগছে। জ্বর এসেছে কখনো ঘুমের মধ্যে টের পায় নি। এখন সব মিলিয়ে শরীর আর টানছে না। মনে হচ্ছে ও এক্ষুনি জ্ঞান হারাবে। যতই হোক একটা মেয়ে নিজের স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারে না। কিন্তু তারিনকে সব জেনে বুঝে সহ্য করতে হচ্ছে। তামজিদকে ওকে ঠকাবেনা জেনেও ভয় পাচ্ছে। চোখ থেকে নোনাজল গড়িয়ে পড়তে লাগলো টপটপ করে। তবুও নিজের মনকে কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো মনে করিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। এইতো কিছুক্ষণ আগে কথা…
তারিনের প্রশ্নে তামজিদ শান্ত বাক্যে বলে উঠল,
“হ্যাঁ, ফোন দেয়। প্রতিদিন নিয়ম করেই দু-তিন বেলা ফোন দেয়।”
তারিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তামজিদের দিকে। বুকটা ভারী হয়ে উঠল হঠাৎ। ছেলেটা এত শান্ত বাক্যে এই শব্দ গুলো উচ্চারণ করছে কিভাবে? বুক কাঁপছে না তার? নিজের স্ত্রীর কাছে বড় মুখ করে প্রাক্তনের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। তারিনের অবিশ্বাস্য চোখের দিকে তাকিয়ে তামজিদ হাসল। সেদিকে তাকিয়ে তারিন অবাক স্বরে প্রশ্ন করল,
“আপনি দিশা আপুর সাথে এখনো যোগাযোগ রেখেছেন, মাস্টার মশাই?”
“হ্যাঁ, রেখেছি৷ কিন্তু সেটা দরকারে।”
“দরকার! তার সাথে আপনার এখনো কিসের দরকার, মাস্টার মশাই?”
“তুমি ছোট মানুষ বুঝবে না।”
তামজিদ কথাটা বলে আড় চোখে তারিনের দিকে তাকালো। তারিনের মুখের প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টা করলো। যখনি দেখলো তারিনের নাকের ডগা রাগে লাল হয়ে উঠছে, তখনি তামজিদের মুখে হাসি ফুটল। তারিন কঠিন হয়ে অধিকার খাটিয়ে কিছুটা জোর গলায় বলতে লাগল,
“দেখুন, আপনি বার বার আমাকে ছোট ছোট বলবেন না। হ্যাঁ, আমি ছোট। তো ছোট মানুষকে বিয়ে করেছেন কেন? শিক্ষক হয়েও তো সেই মায়ের দোহায় দিয়ে কিশোরী একটা মেয়েকে বিয়ে করেছেন। বাল্যবিবাহ বলে এটাকে, জানেন তো? আপনার সাথে আমার বয়সের গ্যাপ জেনেও আমাকে বিয়ে করেছেন। সব জেনে বুঝে বিয়ে এখন ছোট ছোট বলে আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবেন না। আমি আপনার বউ। তাই আমি ছোট কি বড় সেসব নিয়ে বার বার প্রশ্ন তুলবেন না। আমি আপনার বউ এটাই আমার এখন সবথেকে বড় পরিচয়। আমি ছোট বলে এতটাও ছোট না যে,স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কাকে বলে এইটুকু বুঝবো না। স্ত্রীর অধিকার থেকে আপনাকে আমি প্রশ্ন করতে পারি। আপনি সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য, মাস্টার মশাই।বুঝতে পেরেছেন?”
তামজিদ গালে হাত দিয়ে তারিনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চুপচাপ কথাগুলো শুনছিলো। তারিনের কথা বলা শেষ হতেই তামজিদ ফিক করে হেসে ফেলল। তামজিদের হাসি দেখে তারিনের রাগটা তরতর করে বেড়ে গেলো। তারিনের বেশি রাগ হলে ওর চোখের কোনে পানি জমে যায়। এখনো তাই হলো৷ সেই চোখের পানে তাকিয়ে তামজিদ হাসতে হাসতে বলল,
“বাপ রে বাপ! উফফ! সুনামি বয়ে গেলো আমার উপর দিয়ে।”
বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তামজিদ তারিনের নাক টেনে দিয়ে বলল,
“নাকের ডগার ঝাঁল দেখিয়েই আমাকে ঘায়েল করে ফেলবে দেখছি।”
তারিন থেমে গেলো৷ লজ্জা পেলো খানিকটা এহেন কথায়৷ দৃষ্টি নিচে নামিয়ে ফেলল। এক চোখের অশ্রু হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুছে নিতেই, তামজিদ অপর চোখের অশ্রুটুকু মুছে দিতে দিতে বলল,
“এই মেয়ে, এত ঝাঁজালো কেন তুমি? নিজের ঝাঁজ নিজেই সহ্য করতে পারো না। আমি সইবো কিভাবে?”
তামজিদের মুখে এমন কথা এই মুহূর্তে আশা করেনি তারিন। তবে কি প্রশ্নটা খুব সংগোপনে এড়িয়ে যেতে চাইছে তামজিদ? তারিন সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় কঠিন স্বরে প্রশ্ন করল,
“আমার প্রশ্নের উত্তর আমি এখনো পাই নি, মাস্টার মশাই। নিজের প্রাক্তনের সাথে কি দরকার থাকতে পারে আপনার?”
তামজিদ তারিনের মাথায় আলতো করে হাত রাখলো। শান্ত স্বরে বলতে লাগলো,
“শান্ত মেয়ের মতো শোনো, কোনো সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো ‘বিশ্বাস’। পানি ছাড়া যেমন মাছ বাঁচতে পারেনা, তেমনি বিশ্বাস ছাড়া সম্পর্ক টিকে থাকতে পারে না। তুমি আমার সহধর্মিণী। তোমার কাছে আমি কখনো কিছু লুকাবো না। মিথ্যাও বলবো না। আমি সত্যিটাই বলবো। সত্যি বলতে বরাবরই আমি ভয় পাইনা। সত্যিটা বলার পরে যদি আমার ফাঁসি ও হয় তবুও আমি মেনে নিবো। তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করো তাহলে তোমার কাছে বলতে আমার কোনো ভয় নেই। আ…।”
তামজিদের কথা সম্পূর্ণ শেষ না হতেই তারিন সোজাসাপটা বলে উঠল,
“তাহলে আপনার চোখে আমি ভয় কেন দেখেছিলাম, মাস্টার মশাই?”
তামজিদ আগের ন্যায় সুন্দর করে হাসল। হাস্যজ্বল বলতে লাগল,
“হ্যাঁ! ঠিক দেখেছো। তুমি প্রচুর বুদ্ধিমতী মেয়ে। এইজন্যই তোমাকে আমার পছন্দ। তুমি সহজেই সব বুঝে ফেলো। তুমি যখন প্রশ্ন করেছিলে তখন আমি ভয় পাচ্ছিলাম। কারণ, ভেবেছিলাম আমি সত্যিটা বললে তুমি অবিশ্বাস করবে। আমাকে বিশ্বাস করার মতো কোনো কারণ নেই। সত্যিটা বলবো কি বলবো না, এই ভেবে ভয় আর অস্বস্তি হচ্ছিলো খুব। পরেই ভাবলাম তুমি খুব বুদ্ধিমতী, বুঝমান মেয়ে। আমি কিছু বললে বুঝবে।”
তামজিদ থামলো কিছুক্ষণ। তারিন এখনো ওর দিকে অধৈর্য পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছে। পুনরায় তামজিদ বলা শুরু করল,
“দিশা, আমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। আমার মায়ের পর দিশাই প্রথম নারী যে আমাকে সত্যিকারের ভালোবেসেছিলো। হয়তো এখনো আমাকে ভুলে উঠা ওর সম্ভব হচ্ছে না। তাই প্রতিদিন আমাকে ফোন দেয়। এটা, ওটা বুঝিয়ে বলে। আমিও দিশাকে প্রতিদিন বুঝানোর চেষ্টায় আছি। তাই বলে ভেবো না, ও ২/৩বেলা ফোন দেয় বলে আমিও ২/৩ বেলা বুঝানোর নাম করে ওর সাথে আড্ডা জমাই। এটা আমার দ্বারা হবে না আর। আমি আমাদের হালাল সম্পর্কে দাগ লাগতে দিবো না কখনো, এইটুকু বিশ্বাস রেখো৷ আজকে সারাদিনেও ওর ফোন রিসিভ করিনি। আমার কলেজেও গিয়েছিলো কিন্তু আমি ওর সামনে যাইনি বিশ্বাস করো।”
তামজিদের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। সেই দীর্ঘশ্বাসের স্বরে স্বরে তামজিদ বলে উঠল,
“দেখো, দিশার দোষ একটাই ও আমার জন্য সামান্য সেক্রিফাইসটুকু করতে পারে নি। আর তো কোনো দোষ নেই। তাই ওর সাথে আমি তো বাজে ব্যবহার করতে পারিনা। আমার দ্বারা যতটুকু সম্ভব বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। শুধুমাত্র এইটুকু দরকারে ওর সাথে আমার যোগাযোগ আছে এখনো। এই যোগাযোগটুকু ও বন্ধ হয়ে যাবে খুব শিঘ্রই। আল্লাহর কাছে দোয়া করো যেনো, আমি অতীতের রেশ থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। হালাল সম্পর্কটা আঁকড়ে বাঁচতে পারি।”
তারিন কিছু বললো না। দুজনের মাঝে নিরবতায় কেটে গেলো, কিছু মূহূর্ত। নিরবতা শেষে তামজিদ ব্যর্থ স্বরে বলে উঠল,
“সব দোষ আমার। আমি ব্যর্থ পুরুষ। আমার মতো ব্যর্থ পুরুষকে কোনো মেয়ে ভালো না বাসুক।”
বলেই তামজিদ শুয়ে পড়ল। তামজিদের চোখের জল তারিনের চোখ এড়িয়ে যায় নি। তামজিদ চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে আছে। তারিন কাঁপা-কাঁপি হাতে তামজিদের হাত স্পর্শ করল। তবুও তামজিদ কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। তারিন ভরসা দিয়ে বলে উঠল,
“আমি তো আপনার বন্ধু তাই না, মাস্টার মশাই?”
“হুঁ।”
“তাহলে আমাকে ভরসা করুন। আমি আপনাকে কখনো অবিশ্বাস করবো না। সব পরিস্থিতি আমি আপনার বন্ধু হয়ে পাশে থাকবো, মাস্টার মশাই। চিন্তা করবেন না।”
তামজিদ এবার হাত সরালো। তারিনের দিকে তাকিয়ে হাসলো। গাল টেনে বলে উঠল,
“হয়েছে, ম্যাডাম। এবার আপনি শুয়ে পডুন। আপনার শরীর কিন্তু ভালো না।”
তারিনও হেসে শুয়ে পড়ল।
“দেখো দিশা, তারিন ঘুমাচ্ছে। আমি চাই না, এত রাতে ও আমাদের কথা বলতে শুনে ফেলুক। তাহলে আবার সন্দেহ করবে। অনেক কষ্টে আমি ওর বিশ্বাস অর্জন করেছি। সেটা ভেঙে যাক আমি চাইনা।”
তামজিদের এহেন কথা তারিনের কানে আসতেই তারিনের বুকের ভেতরটা চেপে আসলো। তারিন আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে বিছানা থেকে নেমে এসে বেলকনির দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলো। তখনি কথাটা শুনতে পায়। কথাটা শুনা মাত্রই তারিনের সন্দেহ গুলো আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তামজিদকে বিশ্বাস করবে কি না সেটা নিয়ে দোটানায় পড়ে গেলো। তামজিদ কি সব সত্যি বলছে নাকি শুধু মাত্র তারিনকে বোকা বানাচ্ছে? ওর সব বিশ্বাস, ভরসা নিমিশেই এলোমেলো হয়ে গেলো। কি হবে এই সম্পর্কের শেষ পরিনতি?
#চলবে
[আপনাদের কি মনে বলুন তো? হাতে ব্যাথা নিয়েও দিয়েছি একটু মন্তব্য করবেন প্লিজ]
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/