#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_এগারো
“খাটে বউ রেখে বেলকনিতে এসে লুকিয়ে প্রাক্তনের সাথে কথা বলতে বলতে আপনার বিবেকে বাঁধা দিলো না, মাস্টার মশাই?”
হুট করে তারিনের কণ্ঠস্বর পেয়ে তামজিদ কেঁপে উঠল। পেছন ঘুরে দেখলো তারিন দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে সে কি অসহায়ত্ব মেয়েটার! তারিনকে এমন ছন্নছাড়া ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তামজিদের বড্ড কষ্ট হলো। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। তামজিদ কানের থেকে ফোন নামিয়ে শান্ত বাক্যে বলল,
“তারিন, ভুল বুঝো না আমাকে। আ…।”
তারিন হাত উঁচু করে থামিয়ে দিলো তামজিদকে। শক্ত বাক্যে বলে উঠল,
“চুপ করেন। আর আমাকে ভুল বুঝাতে আসবেন না। আমার যা বুঝার আমি বুঝে গেছি।”
তারিন আর কিছু বলতে পারলো না। ওর খারাপ লাগছে। কণ্ঠস্বর রোধ পাচ্ছে। তামজিদ নিচু স্বরে বলল
“তারিন! আমি তোমাকে ভুল বুঝাচ্ছি না বিশ্বাস করো।”
“এতক্ষণ আমাকে যা যা বলেছেন আমি বিশ্বাস করেছিলাম। আপনি আমার সামনে দিশা আপুর সাথে কথা বললেও আমি মেনে নিতাম। আমাকে লুকিয়ে কেন কথা বলতে হবে, মাস্টার মশাই?”
তামজিদের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে। তারিন যেই শক্ত মনের মেয়ে ওকে এত সহজে বুঝানো যাবেনা। তামজিদ তারিনের হাত ধরার জন্য হাত বাড়াতেই তারিন হাত সরিয়ে নিলো। শক্ত বাক্যে বলল,
“একদম আমাকে ছোঁবেন না। কি ভেবেছেন আমাকে? আমি খুব সরল মেয়ে? একদম না। একদম এসব আবোলতাবোল ভাববেন না। আমি কেমন মেয়ে সেটা বোঝার ক্ষমতা আপনার এখনো হয় নি। কি ভেবেছেন, আপনি বউকে লুকিয়ে প্রাক্তনের সাথে পরকিয়ার সম্পর্কে জড়াবেন আর আমি চুপচাপ সব মেনে নিয়ে চলে যাবো। হাসালেন, মাস্টার মশাই। তারিন নিজের অধিকার এত সহজে ছাড়বে না। আমি এর শেষ অব্দি দেখবো। আমাকে ঠকানোর বিন্দু মাত্র চেষ্টা করলে, তার ফল বড্ড খারাপ হবে, মাস্টার মশাই। আমি আপনাকে ছেড়ে কথা বলবো না। মনে রাখবেন।”
বলেই বিছানার দিকে এগিয়ে আসলো। ব্যাথা পায়ে জোর দিয়ে হেঁটে আসার রক্ত বের হওয়া শুরু হয়েছে। তারিনের অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে একাধারে৷ শেষ অব্দি তারিন ঠকে গেলো তাহলে! কী হবে এখন? জীবন এমন নিঠুর খেলায় মেতে উঠলো? নাহ! মানতে পারছে না ও। কিছুতেই না। নিজের স্বামীকে লুকিয়ে অন্য একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখা কোনো স্ত্রীর পক্ষে মানা সম্ভব না। তারিন বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। জ্বরে শরীরে কাঁপুনি হচ্ছে। তারিনের ছোট থেকেই জ্বর আসলে খিঁচুনি উঠে যায়। তারিন মনে মনে এই ভয়টাই পাচ্ছে। যদি এখন তেমন কিছু হয় তাহলে কি হবে? মনে মনে আল্লাহর কাছে সুস্থতা প্রার্থনা করতে লাগলো। পাতলা কম্বলটা গায়ে প্যাঁচিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো জোর করে। চোখ থেকে নিরবে অশ্রুরাশি ঝরঝর করে পড়ছে। তামজিদ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তারিনের ঠোঁট কেঁপে হালকা শব্দ হচ্ছে। সেই শব্দ তামজিদের কানে পৌঁছালো কোনোরকম। ত’ন্দ্রা কেটে গেলো ওর। হন্তদন্ত হয়ে আসল তারিনের কাছে। তারিনের চোখ বন্ধ, ঠোঁট কাঁপানো দেখে তামজিদ চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করল,
“তারিন, কি হয়েছে? খারাপ লাগছে? শীত করছে? জ্বর এসেছে?”
তারিন কোনোরকম জবাব দিলো,
“আমার কিছু হয় নি, মাস্টার মশাই। আপনি যান।”
বলে অন্যপাশে ফিরে গেলো। কিন্তু তামজিদ সে কথা কানে নিলো না। তারিনের কপালে হাত রাখতেই আঁতকে উঠল। জোরে বলে উঠল,
“তোমার শরীর তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।”
তারিন হাতটা সরিয়ে দিলো। বলল,
“ছোঁবেন না আমাকে।”
তামজিদের বেশ কষ্ট হচ্ছে। এই ছোট্ট মেয়েটা আজকের ঘটনাটা মানতে পারেনি। তামজিদ অনুতাপ হচ্ছে। কেনো কথা বলতে গেলো দিশার সাথে? নিজের উপর রাগ হচ্ছে। তামজিদ তো তারিনকে কিছু মিথ্যা বলে নি৷ সত্যিই তামজিদ দিশার সাথে ইচ্ছাকৃত কোনো প্রকার যোগাযোগ রাখে নি। নিজেই সরে আসার চেষ্টা করছে দিশার থেকে। যতই হোক নিজের ভালবাসার মানুষটাকে ভুলতে একটু সময় তো লাগবে। দিশা অনেকক্ষণ যাবৎ তামজিদকে কল দিচ্ছিলো। তাই বাধ্য হয়ে দিশার ফোনটা ধরেছিলো। আর দিশা ফোন দিয়েই তামজিদকে সুই’সাই’ডের ভয় দেখাচ্ছিলো। তাই তামজিদ ঠান্ডায় ওকে বুঝানোর চেষ্টায় ছিলো। তখনি তারিন শুনতে পায়। তামজিদ রাগে, কষ্টে নিজের চুলগুলো দুই হাতে খাবলে ধরলো। সব দিকের যন্ত্রণাটা ও নিতে পাচ্ছে না আর। জীবনটা হঠাৎ করেই কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেলো। সব এলোমেলো হয়ে গেলো। তারিনের মুখের দিকে তাকিয়ে তামজিদের মায়া হচ্ছে অনেক। মেয়েটা বয়সে ছোট কিন্তু বুঝার ক্ষমতা বেশি বলেই মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। তামজিদ মনে মনে ভাবছে,
“এই ছোট মেয়েটার তো কোনো দোষ নেই৷ তাহলে ও কেন আমার জন্য কষ্ট পাবে?”
তারিন বেশ নিস্তেজ হয়ে পড়েছে জ্বরে। চোখ খুলছে না। কোনো শব্দ করছে না। চুপচাপ আছে। তামজিদ তারিনের হাতটা আলতো করে আঁকড়ে ধরল। নিচু স্বরে তারিনের হাত ছুঁয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল,
“দিশা, যা খুশি তা বলুক বা করুক আজকের পর আমি আর ওর ফোন ধরব না৷ ওর সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবো না। তোমাকে আর আমার জন্য কষ্ট পেতে হবে না, তারিন।”
তারিনের হাত ধরে জ্বরের মাত্রা অতিরিক্ত বুঝতে পেরে তামজিদ উঠে পড়ল। লাইফ অন করে থার্মোমিটারটা নিয়ে এসে তারিনকে আলতো ডেকে বলল,
“তারিন! তারিন! তারিন মুখটা খুলো, প্লিজ। জ্বরটা মেপে দেখি। তোমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। প্লিজ, মুখটা খুলো।”
তারিন শুনলো না। জবাব দিলো না। তারিনের কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে তামজিদের বুকটা ধক করে উঠল। অনেকক্ষণ ধরে ডাকার পরেও তারিনের সাড়া না পাওয়ায় তামজিদ নিশ্চিত হলো যে, তারিন জ্ঞান হারিয়েছে৷ তামজিদ এবার নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না। ভয়ে বুকের মধ্যে হার্ট বিট বেড়ে গেছে। কি করবে উপায়ন্তর না পেয়ে দৌড়ে গেলো ওয়াশরুমে। এক বালতি পানি এনে তারিনকে ঠিক করে শুইয়ে দিলো। তারপর বেশ অনেক সময় ধরে তারিনের মাথায় পানি ঢালতে লাগলো। মুখেও বেশ কয়েকবার পানির ছিটে দিয়েছে৷ কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। রাত তখন ২টার কাছাকাছি। এত রাতে কী করবে কিচ্ছু মাথায় আসছে না। চিন্তায় দম বন্ধ হয়ে আসছে তামজিদের। নিজে নিজেই হাসফাস করতে লাগলো। প্রায় ১৫-২০ মিনিট ধরে তামজিদ তারিনের মাথায় পানি ঢাললো। এখনো তারিনের কোনো হুঁশু নেই। এবার আর তামজিদ নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না। জ্বরটাও কিছুতেই কমছে না। তামজিদ বেশ আতঙ্কিত স্বরে তারিনকে ডাকতে লাগলো,
“তারিন! এই তারিন! চোখ খুলো। প্লিজ, চোখটা খুলো। তারিন!”
নাহ! কোনো সাড়া নেই। তামজিদ তারিনের নাকের কাছে হাত নিয়ে চেক করলো নিঃশ্বাস নিচ্ছে কি না? হ্যাঁ! নিঃশ্বাস পড়ছে। এবার তারিনকে কাঁত করে শুইয়ে দিলো৷ তারপর দৌড়ে গেলো জাহেলার কাছে। গিয়ে জাহেলাকে তারিনের কাছে পাঠালো। চিৎকার চেঁচামেচি করতে না করলো। নিজে গেলো আমজাদ সাহেবদের রুমে। গিয়ে আস্তে করে তাকে জাগালো। যেনো বর্ষা বেগমের ঘুম না ভেঙে যায়। তারপর তাকে রুমের বাইরে এনে তারিনের অবস্থা ব্যাখা করলো। এর মধ্যেই জাহেলা চেঁচিয়ে উঠল। আমজাদ সাহেব আর তামজিদ দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো রুমে। গিয়ে দেখলো তারিনের খিঁচুনি উঠে গেলো। তামজিদ উপায়ন্তর না পেয়ে এবার তারিনকে কোলে তুলে নিলো। আমজাদ সাহেবকে বলল,
“বাবা, অমিত কাকাকে বলো তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করতে।”
আমজাদ সেদিকে ছুটলো। তামজিদ তারিনকে নিয়ে গাড়িতে বসালো। সাথে জাহেলাকে নিয়ে, আমজাদ সাহেবকে বাসায় রেখে গেলো। তারিনকে তামজিদ খুব যত্ন করে নিজের বুকে আগলে রেখেছে। বার বার মাথায় হাত বুলিয়ে ভয়ার্ত স্বরে স্বান্তনা দিচ্ছে,
“কিছু হবে না তোমার। তোমার বাবাকে কথা দিয়ে এসেছিলাম তার চাঁদের গায়ে আমি দাগ লাগতে দিবো না। সেই কথার খেলাপ আমি করবো না। কিছুতেই করবো না।”
চিন্তা আর ভয়ে তামজিদের নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। এর মধ্যেই ওর ফোনটা আবার বেজে উঠল। ফোন স্কীনে দিশার নামটা দেখেই রাগে শরীর গিজগিজ করে উঠল। ফোনটা রিসিভ করেই তামজিদ রাগে চিৎকার করে বলতে লাগলো,
“আমাকে কি তুই কোনোদিন শান্তি দিবি না? প্লিজ ভাই, আমাকে একটু শান্তি দে। আমাকে সুস্থ ভাবে বাঁচতে দে। আমি ম’রে যাচ্ছি। মানসিক অশান্তিতে দিন দিন ভেঙে যাচ্ছি। তুই তো আমাকে ভালোবেসে সামান্য সেক্রিফাইস টুকু করতে পারলি না। তাহলে এখন কেন আমাকে ঠিক ভাবে বাঁচতে দিচ্ছিস না? আমার কি করার আছে এখন? অনেক চেষ্টা করেছিলাম ধরে রাখার। পারি নি৷ সেটার কারণ তুই। প্লিজ, আর আমাকে ফোন দিস না। আমার জীবনে আর অশান্তি ডেকে আনিস না। এত অশান্তির সাথে লড়াই করে বাঁচতে পারছি না আমি। আজকে পর আমাকে ফোন দিলে আমার খারাপ রুপটা দেখবি তুই। মনে রাখিস?”
#চলবে
[নোটঃ- আমি অসুস্থ। জ্বরের কারণে মাথা তুলতে কষ্ট হচ্ছে। দুইদিন লিখে আজকে দিলাম। জানিনা কাল দিতে পারবো কি না। সুস্থ হলে দিবো, ইন শা আল্লাহ।
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/