আমার_নিঠুর_মনোহর #লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী #পর্ব_তেরো

0
350

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_তেরো

রাস্তার মাঝে নিজের স্বামীকে তার প্রাক্তন দুই হাতে জড়িয়ে ধরেছে। এমন দৃশ্য দেখে তারিন কয়েকপা পিছিয়ে গেলো। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে বারবার। বুকের ভেতরটায় ও কেমন ধুকপুক করছে। কান্নাগুলো ঝট পাঁকিয়ে আসছে। এ কি! এমন লাগছে কেন? তারিন আর সহ্য করতে পারলো না। চিৎকার করে বলে উঠল,
“মাস্টার মশাই! দিশা আপুকে এক্ষুনি আপনার কাছের থেকে সরে আসতে বলেন। নয়তো আমি ভদ্রতা ভুলে যাবো।”
তারিনের চিৎকারে তামজিদ হকচকিয়ে তাকায় তারিনের দিকে। এর মাঝে কেটে গেছে দু’দিন। তারিনের রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছে৷ জিপিএ ফাইভ পেয়েছে শুনে পুরো পরিবারে খুশির ঢল নামলেও, কলেজের ভর্তির ব্যাপারে কিছুতেই বর্ষা বেগমকে রাজি করানো যায় নি। দিশাকে নিয়ে সেদিনের পর তারিন তামজিদকে এড়িয়ে চলে। কথাও বলেনা। অতিরিক্ত দরকার ছাড়া। আজ দিশা নিজেই তারিনকে ফোন করেছিলো সকালে। অনেক অনুরোধ করে বলেছিলো, শেষবারের মতো তামজিদকে নিয়ে দেখা করতে আসতে। তামজিদ অবশ্য বারন করেছিলো। কিন্তু তারিন এই সম্পর্কের শেষটা দেখার জন্যই রাজি হয়ে এসেছে। দিশার দেওয়া ঠিকানাতে আসতেই দিশা কয়েক সেকেন্ডের মাথায় তামজিদকে রাস্তার মধ্যেই জড়িয়ে ধরে। সেটাই তারিনের সহ্য হয় নি। আর তামজিদও ভাবতে পারেনি রাস্তার মাঝে হঠাৎ করে এমন বিবস্ত্র পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। তারিনের মুখপানে তাকিয়ে দিশা নিজেই তামজিদকে ছেড়ে দিলো। অসহায় ভঙ্গিতে তামজিদের দিকে একবার তাকালো। সে মুখমণ্ডলে কালো মেঘে ঢেকে আছে। দৃষ্টি তারিনের দিকে। দিশা আর দেরি করলো না। সশব্দে তামজিদের থেকে দূরে সরে আসলো। অপরাধী ভঙ্গিতে বলল,
“স্যরি! স্যরি! আসলে অনেকদিন পর তামজিদকে দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি নি।”
তারিন অশ্রুসিক্ত নয়নে তামজিদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দিশার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। শক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আমাকে এমন দৃশ্য দেখানোর জন্য বুঝি এখানে ডেকেছেন?”
দিশা আমতা আমতা করতে লাগলো। ও তো এজন্য ডাকে নি। ডেকেছিলো সব পিছুটান শেষ করার জন্য। তামজিদ ও অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। তারিন উত্তরের আশায় ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। দিশা কিছু সময় চুপ থেকে বলল,
“স্যরি, তারিন। আমার তোমাদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে তাই ডেকেছি।”
তারিন আর কিছু বলল না। তামজিদ শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“কি কথা আছে?”
দিশা প্রস্তাব দিলো সামনের রেস্টুরেন্টে যেয়ে বসার।তারপর তিনজনে মিলে সামনের রেস্টুরেন্টের ভেতরে গিয়ে বসলো। তামজিদ তারিনের পাশেই বসলো। আর দিশা অন্য পাশে৷ দিশা ওয়েটার বয়কে ডেকে তিন কাপ কফি অর্ডার দিলো। কিছু মুহূর্তের নিরবতা কাটিয়ে তারিন প্রশ্ন করল,
“আপনার কি কথা আছে, দিশা আপু?”
দিশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। শান্ত বানীতে বলতে শুরু করল,
“আমি জানি, আমি তোমাদের মাঝে কাটা হয়ে গেছি। তাজের জীবনে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছি। তাজকে আমি সত্যিই খুব ভালোবাসতাম আর এখনো বাসি। এত ভালোবেসেও আমি তাকে পাইনি। না! না! আমি বলছি না এটা তোমার বা তাজের দোষ। আমাদের মাঝে তোমার কোনো দোষ নেই, তারিন। তুমি বয়সে আমার থেকে খুব ছোট। আমার ছোট বোনের সমান। এতকিছুর মাঝে তোমার কোনো হাত নেই তাই তোমাকে দোষারোপ আমি করতে পারি না। সেই অধিকার আমার নেই। সেদিন রাগের বশে তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি আমাকে ক্ষমা করো পারলে।”
বলেই থামলো দিশা। তারিনের মন এতক্ষণে গলে পানি হয়ে গেছে৷ তাই দিশা থামতেই অপরাধীর ন্যায় বলে উঠল,
“ক্ষমা তো আমার চাওয়া উচিত। আমি আপনার সাথে সেদিন প্রচন্ড বাজে ব্যবহার করেছি। বেয়া’দবি করেছি। কিন্তু আমি কি করতাম বলেন? কোনো মেয়ে কি তার স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দিতে চায়? যতই আপনাদের আগের একটা সম্পর্ক থাকুক। বিয়ে তো আমার সাথে হয়েছে, তাইনা বলেন? আমি বলছি না আমি ভুল ছিলাম। আমার জায়গায় আমি ঠিক ছিলাম। হ্যাঁ, আমার ভুল ছিলো আপনাকে বুঝতে পারি নি সেটা। তার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন, দিশা আপু।”
তামজিদ চুপ করে আছে। একবার তারিন আর একবার দিশার দিকে তাকাচ্ছে। সাপ, নেউল একসাথে হয়েও পরিবেশ এত শান্ত আছে কি করে ভাবছে? সূর্য কি তবে অন্য দিকে উঠল? বিস্ময়ে ওর মুখ হা হয়ে আছে। দুজনের কথা শুনছে চুপচাপ। আসল ঘটনা কি বোঝার চেষ্টা আছে। তারিনের কথা শুনে দিশা অল্পস্বল্প হাসল। পুনরায় বলতে শুরু করল,
“তুমি মেয়েটা অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী! এত গুছিয়ে কথা বলে নিজের সুন্দর ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিলে আবার। শোনো মেয়ে, পুরানো কথা থাক। আমার সাথে যেটা হয়েছে তার জন্য সম্পূর্ণ দোষী আমি। তাজ আমাকে বুঝানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু আমি বুঝি নি৷ নিজের জেদ থেকে সরে আসি নি। নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি নি। আন্টির উপর রাগ থেকে তাজের একটা কথাও বুঝার চেষ্টা করি নি। আমার পরিবার ইন্ডিয়া থাকে। ছোট বেলা থেকে বাবা-মায়ের অশান্তি দেখতে দেখতে পরিবারের উপর বিরক্তি এসে পড়েছিলো। তাই বুঝমান হতেই মামার সাথে বাংলাদেশে চলে আসি। এখন অব্দি তাদের কাছে ফিরে যাই নি। এই যে এতগুলো বছর আমি পরিবার থেকে দূরে থেকে পরিবারের আসল মানে টাই ভুলে গেছি। তাই আমিও চেয়েছিলাম তাজ নিজের পরিবার ছেড়ে আমার কাছে চলে আসুক। আমরা আলাদা সংসার গড়বো। তাজকে নিজের পরিবার থেকে সরানোর জন্যই নিজের সিদ্ধান্তে অটুট ছিলাম।ভেবেছিলাম, তাজ আমার কাছেই ফিরে আসবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। নিজের রাগ, জেদ টিকিয়ে রাখতে গিয়ে ভুলে গিয়েছিলাম আমি পরিবারের মর্ম না বুঝলেও, বাকি সবাই বুঝে। আমার মতো সবার একাকিত্বের জীবন না।”
দিশার গলা ধরে আসছে। আবার থামলো। তামজিদের দৃষ্টি টেবিলের দিকে। তারিন টলমল চোখে দিশার দিকে তাকিয়ে আছে। দিশা আবার বলা শুরু করল,
“জানো, আমিও খুব ভালোবাসতাম আমার পরিবারকে। কিন্তু চোখের সামনে নিজের মাকে কতদিন অত্যাচারিত হতে দেখা যায়। মাকে অনেক বুঝিয়েছিলাম বাবাকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু মা নিজের সংসার ছেড়ে আসতে কখনোই রাজি হয় নি। তাইতো আমারো সংসারের প্রতি এত অনীহা। আন্টি এইজন্যই আমাকে পছন্দ করতেন না। অবশ্য না করাটাই স্বাভাবিক।”
বলে অল্প বিস্তর হাসার চেষ্টা করলো। তারিন দিশার কষ্টের সীমা বুঝতে পারলো। একবার তামজিদের দিকে তাকিয়ে নিলো আড় চোখে। ছেলেটার দৃষ্টিতে অপরাধবোধ আর অনুতাপের ছোয়া স্পষ্ট। দিশার চোখের কোনেও জল জমেছে। কী আশ্চর্য! তিনজন মানুষের কষ্টের কারণ একই। অথচ তিনজন মানুষ কয়েক দিন আগে অব্দি কেউ কাউকে চিনতো না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ তিনজন একই সূত্রে গেথে গেছে৷ কষ্টটাও বুঝি সে
জন্যই হচ্ছে! তারিনের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। ভেতরাঙ্গে হাহাকারের শব্দ বাজছে। তবুও শান্ত থাকলো। চোখের জমে থাকা অশ্রু বিন্দু খুব সর্তকে মুছে নিলো। অতঃপর খুব শান্ত, মোলায়েম স্বরে বলে উঠল,
“আপনি একবার যদি মায়ের সব শর্তে রাজি হয়ে যেতেন তাহলে আজকে আমাদের তিনজনের জীবন তিন রকম হতে পারতো। আমরা তিনজন দহনের যন্ত্রণায় প্রতি রাতে ছটফট করতাম না। অবিশ্বাসের বীজ আমার মনে ফুটতো না। প্রতিনিয়ত সংসার ভাঙার ভয় আমাকে কাবু করতে পারতো না। আপনারা দুজন একসাথে থাকতেন। সুখে থাকতেন। অন্যরকম কিছু হতে পারতো। আপনাদের তিনজনের রাগ, অভিমান, জেদ এর জন্য আমার জীবনের বলি দান আমি কেনো করবো, দিশা আপু?”
তামজিদ দৃষ্টি তুলে তাকালো। এই মেয়েটা এত শক্ত কেন? কোনো কিছুতেই তাকে দূর্বল করা যায় না৷ সত্যিই মেয়েটার ব্যক্তিত্ব অসাধারণ! তামজিদ না চাইতেও বারবার তারিনের ব্যক্তিত্বের প্রসংশা করে ফেলছে। এত এত ঝামেলা, অশান্তি কত সুন্দর করে সামলাতে জানে। প্রসংশানীয়! যখন তিনজন তিনরকম ভাবনা চিন্তায় ব্যস্ত। তখনি দিশা হুট করে প্রশ্ন করে,
“আমি তোমার কাছে কিছু চাইলে আমাকে দিবে?”
তারিন অকপটে জবাব দিলো,
“দেওয়ার সামর্থ্য থাকলে অবশ্যই দিবো। বলে দেখুন।”
“তাহলে আমার আর তাজের জীবন থেকে সরে যাও। চলো, আমরা তিনজনে আবার নতুন করে সবটা শুরু করি।”
কথাটা শোনামাত্র তারিন আর তামজিদ যেনো আকাশ থেকে পড়লো। কী বলছে ও? তারিন বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছে দিশার দিকে। আর দিশার মুখে লেগে আছে রহস্যময় হাসি। সে হাসির মানে কি? নতুন কোনো ঝড় নাকি সব ঝড়ের সমাপ্তি?

#চলবে

[নোটঃ- আসসালামু আলাইকুম। সবাইকে রামাদান মোবারক। দুইদিন রমজানের প্রস্তুতির কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এখন থেকে প্রতিদিন ইফতারের পর গল্প আসবে, ইন শা আল্লাহ। আর যেদিন দিতে পারবো না সেদিন আগের থেকে জানিয়ে দিবো, ইন শা আল্লাহ।]

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here