#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_পনেরো
“পাশে স্ত্রীকে বসিয়ে রেখে প্রাক্তনকে হারানো শোক পালন করছেন, মাস্টার মশাই?”
তারিনের শক্ত বাক্যে প্রশ্নগুলো শুনে তামজিদ অবাক হলো। অবাক নয়নে তাকালো তারিনের দিকে। মেয়েটার মুখ শান্ত। কোনো রাগ, ক্ষোভ, খুশির চিহ্ন নেই। আছে শুধু অভিমান, অভিযোগের চিহ্ন। তামজিদ পালটা প্রশ্ন করলো,
“তোমার কেনো মনে হলো আমি দিশার জন্য শোক পালন করছি?”
“আপনার মুখ বলে দিচ্ছে, মাস্টার মশাই।”
“মুখ দেখে যদি মনের খবর বলা যেতো তাহলে পৃথিবীতে ভাঙা মনের মানুষ গুলো সদা হাস্যজ্বল থাকতে পারতো না।”
তারিন চুপ করে গেলো। নিঃশব্দে কফির মগে চুমুক বসালো। আনমনে প্রশ্ন করলো,
“এবার আমি কিছু কথা বলতে পারি?”
তামজিদ বেশ শান্ত স্বরে বলল,
“অবশ্যই।”
তারিনের দৃষ্টি বাইরের ব্যস্ত রাস্তার দিকে। ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত মানুষগুলো যে যার মতো চলছে জীবনের গতীতে। কারোর দিকে কারোর তাকানোর সুযোগ নেই। নিজেদের কথা চিন্তা করার সময় পায়না এরা, অন্যের কথা কি ভাববে? এরাই ভালো না নিজেদের চিন্তায় মগ্ন সারাক্ষণ। তারিনকে চুপ করে থাকতে দেখে তামজিদ আলতো স্বরে ডেকে উঠলো,
“তারিন।”
“হুঁ।”
ধড়ফড়িয়ে উঠে জবাব দিলো তারিন। তামজিদ প্রশ্ন করল,
“কি ভাবছো?”
“কই? কিছু না তো।”
“তাহলে চুপ করে আছো যে?”
“এমনি।”
“কী যেনো বলবে, বলছিলে?
তারিনের হুঁশ ফিরলো। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হ্যাঁ! বলবো। অনেক কিছু বলবো। অনেক কিছু বলার আছে আমার।”
তামজিদ আরেকবার কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে উঠল,
“তাহলে বলতে থাকো।”
“শুনবেন?”
“আপনার কথা না শুনে থাকার মতো দুঃসাহস আমার আছে নাকি?”
তারিন বুঝলো তামজিদ কথাটা মজার ছলে বলেছে। অন্য সময় হলে তারিন হাসতো কিন্তু এসময় ভিন্ন। মুখে আগের ন্যায় গম্ভীর্য ভাব ধরে রেখে বলা শুরু করলো,
“ দিশা আপুকে যতটা খারাপ ভেবে ছিলাম, সে ততটাও খারাপ নয়। অত্যন্ত বুঝমান একটা মেয়ে সে। আমরা রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। তাই অনেক সময় বুঝমান হয়েও অবুঝের মতো আচরণ করি। কারণ একটাই নিজেদের অনুভূতিগুলোকে চেপে রাখার সাধ্য আমাদের সবার থাকে না। দিশা আপু বলল যে, সে আপনাকে ভালোবাসতে পারে নি___কথাটা সম্পূর্ণ ভুল। সে আপনাকে ঠিকই ভালোবেসেছিলো। কিন্তু ধরে রাখার চেষ্টা করে নি। ভালোবাসার মানুষকে পেতে হলে কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। দিশা আপু সেই ত্যাগ করতে পারেনি বলেই আপনাকে হারিয়েছে।”
তারিন থামতেই তামজিদ প্রশ্ন করলো,
“এসব কথা বলছো কেনো?”
তারিন পুনরায় বলা শুরু করলো,
“দেখুন আপনারা দুজন ভালোবাসার মানুষ এক হতে পারেন নি। এটাতে আপনার, দিশা আপু বা মায়ের কোনো হাত নেই। উপরওয়ালা আমাকেই আপনার ভাগ্যে রেখেছিলো। নয়তো পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে আপনার সাথেই কেনো আমার বিয়ে হবে?”
তামজিদ নিশ্চুপ। চুপচাপ তারিনের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছে৷ মেয়েটা এত সুন্দর করে কথা বলে! যে কোনো পুরুষ মেয়েটার বাচনভঙ্গির প্রেমে পড়তে বাধ্য। তারিন থেমে থেমে বলছে কথাগুলো। কফি ইতোমধ্যে শেষ। তামজিদ কফির মগের তলানিতে খানিক কফি রয়েছে এখনো। তারিন খালি কফির মগটা হাতে চেপেই বলতে লাগলো,
“আমাদের শরীরে যখন টিউমা’র হয় তখন আমরা সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার জন্য সে টিউমা’রটা অপারেশনের মাধ্যমে শরীর থেকে কেটে ফেলে দেই। ঠিক তেমন কিছু মানুষ আমাদের জীবনে ‘টিউমা’রের’ মতো, যাদের সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে আমাদের জীবন থেকে সরিয়ে ফেলেন। যেনো আমরা সুখে, শান্তিতে সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারি তাই।”
তামজিদ চোখের পাতা ঝাপটে বলে উঠল,
“মাঝে মাঝে আমি তোমার কথা শুনে ডিপ্রেশনে চলে যাই। তোমার বয়স আর কথা দুটো শব্দের মধ্যে পার্থক্য বিশাল। এত সুন্দর করে, গুছিয়ে কথা বলতে পারো কি করে?”
তারিন সোজাসাপটা বলে উঠল,
“আপনার বলার প্রয়োজন মনে করছি না।”
তামজিদ আরেক দফা অবাক হলো। এভাবে মুখের উপর কথা বলাটা মেনে নিতে পারলো না। তবুও কিছু বললো না। চুপ থাকলো। তারিন নিজের ধ্যানে শক্ত বাক্যে বলে উঠল,
“আপনাকে আমি যথেষ্ট ভালো ও সুন্দর ব্যক্তিত্বের পুরুষ ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি আমি ভুল ছিলাম। আপনি নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করছেন এটাকে ‘হ্যাংলামিপনা’ বলে। যা নিচু শ্রেণীর ব্যক্তিত্বের পুরুষদের থেকে আশা করা যায়৷ ভালো ব্যক্তিত্বের পুরুষরা কখনো নিজেকে এমন ভাবে উপস্থাপন করে না। একদিকে বউকেও ছাড়বেন না। অন্যদিকে বউকে পাশে রেখে প্রাক্তন প্রেমিকার জন্য আফসোসও করবেন। বাহ! কী সুন্দর চরিত্র আপনার! এমন চরিত্রের পুরুষকে এক কথায় ‘চরিত্রহীন’ বলে জানেন? কি ভেবেছেন, আমি সব মেনে নিবো? আমি এতদিন ভদ্রতার খাতিরে চুপ ছিলাম। আপনাকে সময় দিয়েছিলাম সবটা সামলে উঠার জন্য। অতীত ভুলে নতুন করে সবটা শুরু করার জন্য সময় ও সুযোগ দিয়েছিলাম। ধৈর্য ধরেছিলাম। আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাও শুরু করেছিলাম। কিন্তু আজকে আমার সব চিন্তা ভাবনা, স্বপ্ন এমনকি ধৈর্য ও শেষ। দিশা আপু চলে যাওয়ার সময় আপনার চোখে আমি আফসোস আর হাহাকার দেখেছি। সেই আফসোস আর হাহাকার আমাকে আপনার কাছের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো, মাস্টার মশাই। আর মানতে পারলাম না। কিছুতেই পারলাম না। আপনার মা আর আপনার জন্য আমাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হলো। তাই সবার আগে আপনার মায়ের নিচু চিন্তা ভাবনা দূর করবো। তারপর আপনাদের সবার জীবন থেকে আমি দূরে সরে যাবো। আপনার মতো এমন মেরুদন্ডহীন পুরুষের সাথে আর যাইহোক সংসার করা যায়না। ভালোবাসা তো অনেক দূরের কথা।”
তারিনের গলা ধরে আসছে। কান্না পাচ্ছে খুব। মেয়েটাই বা কি করবে? আর সহ্য করতে পারছে না। দিশার চলে যাওয়ার সময় তামজিদের চোখের কোনে জমে থাকা জলটুকু আজ তারিনকে খন্ড খন্ড করে ভেঙে দিয়েছে। সদ্য জন্ম নিতে যাওয়া ভালোবাসা শব্দটাকে দশ হাত দূরে সরিয়ে দিয়েছে।তামজিদের এমন আচরণ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। দিশার চলে যাওয়াতে যতটা খুশি হয়েছিলো, তামজিদের আচরণে তার থেকেও দ্বিগুণ কষ্ট পেয়েছে। তামজিদ একদম শান্ত, নিশ্চুপ। অসহায় চোখে তারিনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। বুকের ভেতরে চিনচিন ব্যাথা করছে। চোখ দুটো জ্বলছে। এ কি পুরুষ মানুষ এত সহজে কাঁদে? নাকি তারিন নামক ষোড়শী কন্যার শক্ত ও সত্য বাক্য মেনে নেওয়া তামজিদ নামক পুরুষের পক্ষে অসম্ভব হয় দাঁড়িয়েছে? তারিন নিজেকে সামলে কঠিন বাক্যে বলে উঠল,
“ দিশা আপু, একদম ঠিক করেছে আপনার জন্য ত্যাগ স্বীকার না করে। আপনি ত্যাগের মূল্য দিতে জানেন না, মাস্টার মশাই। একদম জানেন না। আপনার মতো পুরুষ স্বামী হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।”
তামজিদ এবার অসহায় সুরে ‘তারিন’ বলে ডেকে উঠল। আর কিছুই বলতে পারলো না। তারিন সে ডাকে সাড়া না দিয়ে বলে উঠল,
“বাসায় যাবো।”
বলেই তারিন উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। তামজিদের অপেক্ষা না করে হনহন করে বাইরে চলে আসলো। গাড়িতে উঠে বসে পড়ে জোরে নিঃশ্বাস নিলো। মুখে হাত চেপে কান্না করে উঠল। কেনো কষ্ট হচ্ছে এতো? মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো,
“যতোই কষ্ট হোক ও কিছুতেই তামজিদের সামনে দূর্বল হবে না।”
নিজেকে সামলে নিলো মুহূর্তেই। চোখের অশ্রু টুকু কাপড়ের আঁচল দ্বারা মুছে নিলো। শক্ত ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বাক্যে বলল,
“আপনি খুব শিঘ্রই আমাকে বুঝবেন, মাস্টার মশাই। ভালোবাসবেন। আগলে নেওয়ার জন্য অস্থির হবেন। কিন্তু তারিন এত সহজে আপনার কাছে ধরা দিবে না। কিছুতেই দিবেনা। আজকে যে আফসোস আপনি দিশা আপুর জন্য করলেন, তার থেলেও দ্বিগুণ আফসোস নিয়ে আমার ভালোবাসা খুঁজবেন। এটা আমার নিজের কাছে নিজের প্রতিজ্ঞা।”
#চলবে
[ভুলগুলো ক্ষমা করবেন। কাল দিবো কিনা শিওর না। চেষ্টা করবো দেওয়ার। তারিন কি ঠিক কাজ করছে? আপনাদের কি মনে হয়?]
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/