#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_বারো
“ঘর বউ রেখে প্রাক্তনের সাথে ফোনালাপ করাকে পরকীয়া বলে, জানেন? আমারে কেন ঠকাইতাছেন, মাস্টার মশাই? আমি তো আপনারে বিশ্বাস করে আপনার হাত ধরে এই অচেনা শহরে পা রেখেছিলাম। তাহলে আজ কেন আমাকে এভাবে বিশ্বাস ভাঙার কষ্টে জর্জরিত করলেন?”
তারিন এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ। রাতের আধার কেটে আলো ফুটেছে আকাশে। তামজিদ সারারাত তারিনের পাশে ছিলো। দু-চোখের পাতা এক মিনিটের জন্যও বন্ধ করে নি৷ আজানের পর নামাজ পড়ে এসে তারিনের বেডে মাথা রেখে বসে ছিলো বেশ কিছুক্ষণ। তারপর হয়তো চোখ দুটো লেগে এসেছিলো। তারিন ঘুম থেকে জেগে নড়তেই তামজিদের ঘুম ভেঙে যায়৷ ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করে,
“ঠিক আছো তুমি? কষ্ট হচ্ছে? খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকবো?”
তারিন সেসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রচন্ড অভিমানে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। শক্ত বাক্যে উপরোক্ত প্রশ্নগুলো করে বসল। এই মুহূর্তে এসব প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না তামজিদ। অবাক চোখে তারিনের দিকে তাকিয়ে রইল, কিছুক্ষণ । কোনো উত্তর দিলো না। পরক্ষণেই তারিনের কপালে হাত রাখল জ্বর আছে কিনা চেক করার জন্য। তারিন হাতটা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই, তামজিদ শক্ত বাক্যে বলে উঠল,
“একদম হাত সরানোর চেষ্টা করবে না, বলে দিলাম।”
তারিন শান্ত বাক্যে বলল,
“আপনি আমাকে ছোঁবেন না।”
“তোমাকে ছোঁয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে।”
“কিসের অধিকার?”
তামজিদের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় প্রশ্ন করল তারিন। তামজিদ অবাক হয়ে উত্তর দিলো,
“কিসের অধিকার মানে? তুমি কি ভুলে গেছো আমি তোমার কে?”
তারিন খানিক হাসলো। সে হাসি নিষ্প্রাণ। চোখ দুটো টলমল করছে। মুখটা এক রাতেই বেশ শুকিয়ে গেছে। বড্ড ভেঙে পড়েছে মেয়েটা। তামজিদের খুব মায়া হচ্ছে। এত শক্তপোক্ত মনের অধিকারী মেয়েটা আজ এভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তারিন তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“একদম না। আপনি আমার স্বামী। তাইতো?”
তামজিদ জোর গলায় বলল,
“অবশ্যই।”
“তাহলে বউকে লুকিয়ে প্রাক্তনের সাথে কিসের সম্পর্ক আপনার?”
তামজিদ শান্ত হয়ে বসে পড়ল। শান্ত বাক্যে বলল,
“তোমার শরীর অসুস্থ। এসব আলোচনা বাড়ি গয়ে করা যাবে, তারিন।”
তারিন এবার আগের ন্যায় শক্ত বাক্যে বলল,
“যা বলার এক্ষুনি বলবেন আমাকে।”
তামজিদ পুনরায় বলল,
“বুঝার চেষ্টা করো। এসব বলার জায়গা এটা নয়, তারিন।”
তারিন উঠে বসার চেষ্টা করতেই মাথা ঘুরে উঠল। বসতে গিয়েও পারলো না। তামজিদ ধরে ফেলল থাবা দিয়ে। তারিন দুই হাতে ঠেলে তামজিদকে দূরে সরানোর চেষ্টা করল। তামজিদ শক্ত করে তারিনের বাহুদ্বয় ধরে শুইয়ে দিলো। শাসিয়ে উচ্চ বাক্যে বলে উঠল,
“এই মেয়ে, বেশি পাকনামো করতে বারন করেছি না আমি? কথা শুনছো না কেনো? বেশি সাহস বেড়ে গেছে তোমার? তুমি কিন্তু এখনো তামজিদ তাজওয়ার কে চিনো না। আমার ভালো রুপটা দেখেছো। খারাপ রুপটা দেখো নি৷ বাধ্য করো না আমাকে সেই রুপটা দেখাতে।”
তামজিদের এহেন বাক্যে তারিন ঘাবড়ে গেলো। এই প্রথম তামজিদকে এতটা রেগে যেতে দেখলো। তামজিদের চোখ দুটোতে রাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তারিন মনে মনে ভয় পেলেও প্রকাশ করলো না৷ বলল,
“আমার প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া অব্দি আমি আপনার সাথে বাড়ি ফিরবো না, মাস্টার মশাই।”
তামজিদ দমে গেলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তারিনের দিকে। এই মেয়েটা এমন কেন? এইটুকু বয়সে কোনো মেয়ে এতটা শক্তপোক্ত, সাহসী হতে পারে? বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। কিছুতেই তারিনকে দমিয়ে রাখা যায় না। তামজিদের হাত দুটো আলগা হয়ে আসলো। শান্ত হয়ে বসে রইলো কিছুসময়। তারিনও বেশ শান্ত হয়ে আছে তাকিয়ে আছে তামজিদের দিকে। নিরবতা কা’টিয়ে তামজিদ বলে উঠল,
“ভালোবাসা ফুরিয়ে গেলেও মায়া ফুরিয়ে যায় না, জানো?”
“না৷ আর জানতেও চাইনা।”
তারিন স্পষ্ট জবাব দিলো। তামজিদ বলা শুরু করল,
“আমাকে তুমি ভুল বুঝছো, তারিন। আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি না। হ্যাঁ, আমি দিশার সাথে কথা বলছিলাম। কিন্তু সেটা কোনো প্রেমালাপ ছিলো না। দিশা আমাকে সুই’সা’ইডের ভয় দেখাচ্ছিলো। সেটা নিয়েই ওকে বুঝাচ্ছিলাম। কি করবো বলো? ভালোবেসেছিলাম তো। তাহলে এত সহজে ভুলে যাই কি করে? ভালোবাসার মানুষকে কি এত সহজে ভুলে যাওয়া যায়?”
তারিন নিজের অনুভূতি গুলো আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না। শান্ত হয়ে উত্তর দেওয়ার মতো ধৈর্য নেই টলমলে চোখে তামজিদের দিকে তাকালো। তামজিদও শান্ত দৃষ্টিতে তারিনের দিকে তাঁকিয়ে আছে। তারিন এবার জোরে চেঁচিয়ে অভিযোগের স্বরে বলে উঠল,
“দেখুন, এসব সস্তার আবেগ অন্য কাউকে দেখাবেন। আমি এখনো এত আবেগ, ভালোবাসা এত প্যাচিয়ে বুঝে উঠতে পারিনি৷ আপনার যদি তার প্রতি এতই ভালোবাসা থেকে থাকে, তাহলে আপনি আমাকে বিয়ে করলেন কেন? যখন আপনার সামনে আপনার ভালোবাসাকে অপমান করছিলাম আমরা সবাই, তখন চুপ করে ছিলেন কেন? কেনো প্রতিবাদ করেন নি? কেনো মেনে নিয়েছিলেন সব? আমাকে কথা দিয়েছিলেন তো আমাকে ঠকাবেন না। তাহলে এখন কেন তার সাথে প্রতি মুহূর্ত যোগাযোগ রাখেন। আমি তো আপনার অতীত, ভালোবাসা সব কিছু মেনে নিয়েছিলাম। তবুও কেনো ঠকাচ্ছেন আমাকে? আমাকে কেনো এত কষ্ট দিচ্ছেন? একবারো কি ভেবেছেন আমার কতটা কষ্ট হতে পারে? আমি মানছি আমার বয়সটা কম। তাই বলে কি আমার কোনো আবেগ, অনুভূতি, কষ্ট নেই? ভালোবাসা কাকে বলে আমি কি সেটাও এখনো বুঝি না? স্বামী মানে কি বুঝি না? বলুন, বুঝিনা? উত্তর দেন, মাস্টার মশাই। এক্ষুনি দিবেন।”
তারিন উচ্চ স্বরে কথা বলায় এখন নিঃশ্বাস টেনে উঠাতে পারছে না। বড় বড় নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল। নিঃশ্বাস নিতে না পেরে ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো। তামজিদের চোখেও জল জমেছে। নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে অসহায় ব্যক্তি মনে হচ্ছে। কিভাবে বুঝাবে তারিনকে? কোনো শব্দ, ভাষা, বাক্য মাথায় আসছে না। সব কিছু অসহ্য লাগছে। মন, মস্তিষ্কের লড়াইয়ে তামজিদ আজ হেরে যাচ্ছে বারবার। দুজনের মাঝেই নিরবতা। কোনো উত্তর নেই ওর কাছে। এর মাঝেই কেবিনে প্রবেশ করল নার্স। তারিনকে কান্না করতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“এ কি আপনি কাঁদছেন কেনো? এভাবে কান্না করলে আপনার ক্ষতি হবে। টেস্ট রিপোর্টে আপনার শ্বাসকষ্ট ধরা পড়েছে।”
কথাটা শুনে তামজিদ চোখ তুলে তাকাল। চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করল,
“কি বললেন?”
নার্স শান্ত স্বরে বলল,
“জ্বী! এই যে রিপোর্টগুলো দেখুন। আমি আপনাকে ডাকতেই এসেছিলাম। আপনাকে ডাক্তার তার চেম্বারে ডেকেছেন। আসুন।”
তামজিদ রিপোর্ট গুলো নিয়ে এক নজর চোখ বুলিয়ে নিলো। নার্সের হাতে রিপোর্ট গুলো দিয়ে শান্ত বাক্যে বলল,
“আপনি যান। আমি আসছি।”
তারপর তারিনের পাশে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলো। অনুরোধ বাক্যে বলল,
“প্লিজ, কান্না করো না। কান্নাটা থামাও। আমি কথা দিচ্ছি, আজকের পর তোমার চোখের পানি চোখ গড়িয়ে গালে পড়তে দিবো না, ইন শা আল্লাহ। শেষ বারের মতো একবার আমাকে বিশ্বাস করো। যাকে ভালোবেসেছিলাম তাকে ধরে রাখতে পারিনি। এখন যে আছে তাকে হারাতে দিবো না।”
তারিনের মন শান্ত হলো। কিন্তু উপরে প্রকাশ করলো না। তামজিদ চলে গেলো ডাক্তারের কেবিনের উদ্দেশ্য। তামজিদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে তারিন একা একা বলে উঠল,
“আপনাকে আমার কারোর পাশে সহ্য হয় না, মাস্টার মশাই। আমার কষ্ট লাগে৷ কেনো লাগে? আমার তো কষ্ট পাওয়ার কথা না৷ তবুও কেনো কষ্ট লাগে, মাস্টার মশাই?”
তারিন নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
–
–
–
সন্ধ্যার নামার কিছুক্ষণ আগে তারিনকে হসপিটালের থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তামজিদ তারিনকে খুব যত্ন করে বাসায় নিয়ে এসেছে৷ বর্ষা বেগম দরজা খুলে তারিনের অসুস্থ চেহারাপানে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে। কান্নারত স্বরে বলে উঠলেন,
“তুই হঠাৎ করে এমন অসুস্থ হয়ে গেলি কি করে রে, মা। তোর কষ্ট হচ্ছে আমাকে একবার ডাকতে পারতি না? আমি কি তোর কেউ না? আমাকে কি বলা যেতো না? আজকে সারাদিনেও কেউ আমাকে হসপিটালে যেতে দিলো না। তোকে একটা বার খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো রে, মা।”
তারিনের অসুস্থ মস্তিষ্ক হঠাৎ করেই সুস্থ বোধ করল। শাশুড়ী যখন মায়ের মতো আগলে রাখে তখন শশুড়বাড়ি টাও বাবার বাড়ির মতো আপন মনে হয়। তামজিদ বলল,
“মা, ওকে ভেতরে যেতে দাও। বসাও নিয়ে৷”
তারিন বাধা দিয়ে বলে উঠল,
“আমি একদম ঠিক আছি, মা। একদম ব্যস্ত হবেন না আমাকে নিয়ে।”
নাহ! বর্ষা বেগম সে কথা কর্নপাত করলেন না। তারিনকে আস্তে আস্তে ধরে রুমে নিয়ে আসলো। খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে বললেন,
“এখানে বসে থাকবি চুপচাপ।”
তারিন মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। অর্থাৎ ‘ঠিক আছে’।
কিছুক্ষণ তারিনের পাশে নিজেও বসে ছিলেন। তারপর মাগরিবের আযান দিতেই সে নিজের রুমে চলে গেলেন নামাজের জন্য। তারিন ও আস্তে আস্তে উঠে ওযু করে এসে নামাজ আদায় করে নিলো। নামাজ থেকে উঠে ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখলো তামজিদ হাত ভর্তি ফলমূল, আর শুকনো খাবার নিয়ে ভেতরে ঢুকছে। তারিনকে দেখেই তামজিদ শুকনো হাসি দিয়ে উঠল। তারিন সেদিকে খেয়াল না করে সোজা রুমে এসে পড়ল। তামজিদ অবাক হলো বটে। তবে চমকায়নি। তারিন বিছানায় বসে বসে ফোন ঘাটছে। ঢাকায় আসার পর তামজিদ তারিনকে একটা নতুন ফোন কিনে দিয়েছে। কাল রেজাল্ট দিবে মাথার মধ্যে সে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে তামজিদ রুমে ঢুকে প্রশ্ন করল,
“ফোন ঘাটছো কেন? রেস্ট নিতে বলেছি না তোমাকে?”
তারিন সে কথায় পাত্তা দিলো না। এতটা মনোযোগ দিয়ে ফোন দেখছে যেনো রুমে ও ব্যতিত আর কেউ নেই। তারিনের থেকে কোনোরকম উত্তর না পেয়ে তামজিদ পুনরায় বলে উঠল,
“ফোন রাখো। আমার তোমার সাথে কথা আছে।”
তারিন এবারো ও কোনো উত্তর দিলো না। আগের ন্যায় ফোন দেখতে ব্যস্ত। তামজিদ এবার চরম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো তারিনের দিকে। মেয়েটা কি ও’কে ইগ্নোর করছে? পাত্তা দিচ্ছে না? নাকি রাগ করেছে? অভিমান করেছে বোধহয়। তবুও ব্যাপারটা তামজিদের হজম হলো না। আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। তামজিদ ওয়াশরুমে ঢুকতেই তারিনের ঠোঁটদ্বয়ে হাসি ফুটল। দুষ্টু হাসি যাকে বলে। মনে মনে বলল,
“মাস্টার মশাই, আপনাকে অনেক ছাড় দিয়েছি। আর দিতে পারবো না। এবার থেকে দেখবেন তারিন আপনাকে ঠিক কিভাবে বশ করে?”
#চলবে
[নোটঃ- এই ৩দিন আমি অসুস্থ ছিলাম। আজ থেকে আবার নিয়মিত পাবেন ইন শা আল্লাহ। এখন থেকে তারিন আর তামজিদের নতুন অধ্যায় শুরু হবে। কেমন হবে ব্যাপারটা বলুন তো?]
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/