গল্পের নাম : #বৃষ্টি_থামার_পরে
পর্ব ১৬: #স্বামী_বলে_মানি
লেখিকা: #Lucky_Nova
এরোন কোমড়ে হাত ছোঁয়ানোর সাথে সাথেই মিহি ঘাবড়ে গিয়ে সজোরে ওর গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।
এরোন মুখটা হালকা ঘুরিয়ে নিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় অনেক বেশিই অবাক হলো ও। তবে পর মুহূর্তেই রাগে চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। মুখটা তুলে অগ্নিদৃষ্টিতে মিহির দিকে তাকালো ও। তার চোখে যেন আগুন জ্বলছে। আজ অব্দি কারো সাহস হয় নি এমন কাজ করার।
মিহি ওর চোখ মুখ দেখে অনেক ভড়কালো। নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়ে উঠল ওর। তবে তাও দ্রুত কাঁপা হাতে শাড়ির আঁচল নামানোর জন্য আঁচলের দিকে হাত বাড়ালো।
কিন্তু সে হাত খপ করে ধরে নিলো এরোন। তার মুখের ভাব কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে এসেছে।
মিহি ভয়ে শিউরে উঠলো। ভয়ে চোখের কোনে পানিও চলে এসেছে ওর। লোকটা এত নিকৃষ্ট!
“ছাড়ুন আমাকে।” হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় বলল মিহি।
কিন্তু লাভ হলো না।
না পেরে অন্য হাত মুঠ করে এরোনের বুকে আঘাত করতে করতে বলল,”জানোয়ার আপনি একটা।”
বার দুয়েক আঘাত করার পর তৃতীয় বারে সেই হাতটার কব্জিও এরোনের হাতের মুঠোয় শক্তভাবে ধরা পরে গেল।
মিহি এবার কেঁদেই ফেলল।
কিন্তু তার মুখোভাব এতে বিন্দুমাত্র সহজ হলো না।
মিহি হাত মোড়ামুড়ি করতে করতে কাতর গলার বলল,”প্লিজ, আমার সাথে নোংরামি…।”
এরোন কবজি আরো চেপে ধরতেই মিহি ব্যাথায় শব্দ তুলে ঠোঁট কামড়ে ধরলো।
“আমি কাছে আসতে চাইলে না বলার কোনো স্কোপ পাবা তুমি?” দাঁতেদাঁত চিপে তীব্র রাগের সাথে বলল এরোন।
মিহি ভয়ে ভয়ে এরোনের দিকে চোখ তুলল। পুরো শরীরে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে ওর।
“কী মনে করো কী তুমি আমাকে?” ধমকে উঠলো এরোন।
মিহি লাফিয়ে উঠলো।
“কিছু সমস্যা নাকি?” বাহির থেকে চিন্তিত গলায় হাক ছাড়লো মাঝি।
এরোন রাগে ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। তারপর মিহির দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে থেকে হালকা উচ্চ গলায় বলল,”না। কিছু হয়নি। তুমি যাও।”
বলে এক ঝটকায় হাত ছেড়ে দিলো মিহির।
মিহি বুকের কাছে দুইহাত ধরে কাচুমাচু হয়ে গেল।
এরোন অতিরিক্ত রেগে দাঁতেদাঁত চিপে মিহিকে বলল,”এত নিম্নমানের চিন্তা তোমার?কোমড়ে জোঁক তোমার এজন্যই আমি…।”
মিহি অশ্রুসিক্ত সংকুচিত চোখে এরোনের দিকে তাকালো।
এরোন এখনো কটমট চাহনির সাথে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
জোঁক!
মিহি সংকুচিত চোখ আস্তে আস্তে নামিয়ে নিজের কোমড়ের দিকে তাকালো।
সাথে সাথে চোখ বড়সড় করে পর পর অনেকগুলো চিৎকারে ঘর কাঁপিয়ে দিলো ও।
এরোন তাচ্ছিল্যের চোখে তাকালো। ও জানত যে এসব জিনিস দেখলে মেয়েরা এমনভাবে চিল্লাপাল্লা শুরু করে যেন সাক্ষাৎ অজগর এসেছে। তাই না বলে আগে ওটা ফেলতে চাচ্ছিলো।
মিহি ঘৃণা আর ভয়ে দুইহাত সামান্য উঁচু করে চেঁচাতে শুরু করলো, “প্লিজ, প্লিজ, এটাকে সরান। আমি ভয় পাই এসব। প্লিজ, দয়া করে সরান।”
বলতে বলতে চোখমুখ খিচে ফেলেছে সে।
মুখে অনবরত একটাই কথা ‘এটাকে সরান’।
কিন্তু বলে লাভ হচ্ছে না। এরোনের নড়চড় নেই। সে কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
“আ..আপনি দাঁড়িয়ে কেনো আছেন? সরান এটাকে।” সজোরে একশ্বাসে বলে যেতে লাগল মিহি।
“তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি।”
“এখন কেনো?” তাচ্ছিল্যের সাথে বলল সে।
মিহি ভয়ে চোখ বন্ধ অবস্থাতে দ্রুত এরোনের খুব কাছে এগিয়ে দুইহাতে ওর কাধ খামচে ধরলো। আর পা দাপাদাপি করতে করতে বলল,”প্লিজ প্লিজ, দয়া করে এটা সরান। আপনার পায়ে পড়ি।”
উম্মাদ হয়ে উঠল মিহি। ঠোঁট আর বন্ধ চোখের পাতা অস্থির ভাবে কাঁপছে ওর। বুকও দ্রুত ওঠানামা করছে। জিনিসটার প্রতি যে ওর তীব্র ভয় আছে সেটা যে কেউ দেখেলেই বুঝতে পারবে।
এরোন ভ্রুকুটি করে নিজের কাধের দিকে তাকালো। ইতিমধ্যে ধারালো নখ বসিয়ে দিয়েছে মিহি। জ্বলে যাচ্ছে কাধটা। আবার নিজে থেকে এত কাছেও এসেছে মিহি। ভয় পেলে সবই ভুলে যায় বোধ হয়।
গম্ভীর মুখে ওর দিকে তাকালো এরোন।
সে মুখে অনবরত বলে চলেছে ওটা সরানোর কথা। গা ঘিনঘিন করছে ওর।
“সরান না।” করুনভাবে বলতে লাগল মিহি।
“একটু আগে কি করেছো?” ভরাট কণ্ঠে বলল এরোন।
“যা করছি জীবনেও আর করব না, সরি। এখন প্লিজ এটাকে সরান।” মিহি একশ্বাসে বলে উঠল। ওর পা দাপাদাপি আর ভয়ে মুখের যে হাবভাব তা বাচ্চাদেরকেও হার মানিয়ে দেবে।
এরোন নিজেকে দমালো না। উচিত শিক্ষা আজ দিতেই হবে।
“ওটা সরাতে গিয়ে তোমার মত সতী সাবিত্রীকে আমি কেনো টাচ করব?” ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল এরোন।
মিহি এবার কেঁদে ফেলল। এরোনের কাধে নখ আরো দাবিয়ে দিয়ে আঁকড়ে ধরলো।
“দয়া করে মজা না করে সরান এটা। আর এমন করব না বলছি তো।” কাঁদো কাঁদো হয়ে বলতে লাগল মিহি।
“আমি আবার আমার বউকে ছাড়া কাউকে টাচ করতে চাই না।” সোজাসাপ্টা বলল এরোন।
“দয়া করে সরান না।” কাতর গলার বলল মিহি।
এরোন দ্রুত কিছু চিন্তা করল। তারপর হালকা ভরাট গলায় বলল,”আগে বলো যে, তুমি আমাকে স্বামী বলে মানো।”
মিহি এক মুহূর্তের জন্য দেরি না করেই বলল,”হ্যাঁ, মানি। দয়া করে সরান এটা। সরান।”
বলতে বলতে ওর কাধ ঝাকালো মিহি। পা দাপাদাপি ত করছেই।
“পুরো লাইন বলো যে স্বীকার করো।”
মিহি ভয়ে একশ্বাসে বলে উঠল,”আমি আপনাকে স্বামী মানি আর স্বীকার করি। দয়া করে এখন তো সরান। পায়ে পড়ি আপনার।”
এরোন সরু চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তবে এই কথাটা শুনে যতটা ভাল লাগছে তত খারাপও লাগছে।কারণ ও জানে যে জোঁক থেকে বাঁচার জন্য সহজেই এই কথাটা বলে দিয়েছে মিহি। এমনি সময় হলে মরে গেলেও বলত না।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মিহির কোমড়ে হাত দিলো এরোন। অতঃপর জোঁক নামক অজগরকে ছাড়িয়ে উলটো দিকে ছুড়ে ফেলল।
“হয়ে গেছে।” গম্ভীর গলায় বলল এরোন।
মিহি মাথা নিচু রেখেই ওর কাধের কাছের বাঁধন আলগা করল। কিন্তু ছেড়ে দিল না। কারণ ও এখনো ভয়ে কাপছে আর চোখমুখ বুজে রেখেছে। শ্বাস-প্রশ্বাসও অস্বাভাবিক।
“আগে জানলে তোমাকে জোঁকের ভয় দিয়েই বিয়েটা করে নিতাম।” মুচকি হেসে বলল এরোন।
মিহি কানে নিলো না। তার গা এখনো ভয়ে আর ঘৃণায় ছমছমে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন আরো কয়েকটা আছে শরীরে।
মাথা নুয়ে রেখেই চোখ খুলল ও। কিন্তু ভয়ে এখনো ওর চোখ থেকে টপটপিয়ে পানি পরছে।
“সরিয়েছি ত! মেরেও ফেলেছি। তাও কাঁদছো কেনো?” উৎকন্ঠা হয়ে বলল এরোন।
“আ..আরো আছে।” কান্না মাখা কণ্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলল মিহি।
এরোন কপাল কুচকে ওর হাতদুটো নিজের ঘাড় থেকে নামিয়ে নিজের হাতের ধরলো।
“কই আছে?” ভালো মত মিহির দিকে পরখ করে বলল এরোন।
“আ..আছে। আরো আছে। আপনি দেখুন প্লিজ।” মিহি মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলতে লাগল।
এরোন মৃদু হাসল। তারপর এগিয়ে একহাতে মিহির কোমড় আগলে নিলো। আর অন্য হাতে ওর মাথাটা নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে দিলো।
“আর নেই কাপকেক। শান্ত হও।” সিক্ত কণ্ঠে বলল এরোন।
মিহি হাত বাড়িয়ে এরোনর পিঠ আঁকড়ে জড়িয়ে ধরলো। সে এখনো ভয়ে কাঁপছে।
এরোন মিনিট কয়েক পরে নিজের থেকে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে কোমল গলায় বলল, “ঠান্ডা লাগবে, চেঞ্জ করো। আমি বাহিরেই আছি। যদি একটাও থাকে তাহলে আমায় ডেকো।”
মিহি চোখের জল মুছলো। আর এদিকে ওদিক তাকাতে লাগল। এতসময়ে তার হুশ হলো।
এরোন নিজের ফোন বের করে ফ্লাশলাইটটা জ্বালিয়ে মিহির দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিলো।
“এটা রাখো।”
মিহি হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো।
এরোন মৃদু হেসে নিচে পরে থাকা শার্টটা হাতে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
🌸
অনেক সময় পর মিহি কালো ব্লাউজের সাথে সামান্য মলিন একটা গ্রামীণ চেক শাড়ি পরে বেরিয়ে এলো। যদিও সে আর জোঁক খুঁজে পায় নি কিন্তু তাও পুরো শরীর এখনো ঘিন ঘিন করছে।
এদিকে কোমড়ে যেখানে জোঁকটা কামড়েছিল সেখানটা জ্বলছে।
লোকটার সাথে সব হিসেব মিটিয়ে ওরা ফিরে যাবার জন্য গাড়িতে উঠল।
এরোন গাড়ি স্টার্ট দিলো। আশপাশ অনেক অন্ধকার হলেও গাড়ির হেডলাইটের আলোতে সামনের রাস্তা দেখা যাচ্ছে।
ওদের গাড়ি ছাড়া কোনো গাড়িই চলছে না। কারণ রাত এখন দুটোর বেশি গড়িয়েছে।
মিহি আড়চোখে এরোনে একবার দেখে নিলো।
সে গম্ভীরমুখে মনোযোগের সাথে গাড়ি চালাচ্ছে।
থাপ্পড় মারার জন্য এখন অনুশোচনা হচ্ছে ওর। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলা হয়ে উঠছে না।
এরোন সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে এক হাতে গাড়ির সামনের বক্সের মধ্যে থেকে একটা সেভলন ক্রিম বের করে ওর দিকে ধরলো। মিহি আমতাআমতা করে সেটা নিলো আর এক পাশ ঘুরে কোমড়ে লাগিয়ে নিলো। তারপর সেভলনটা নিজেই ঢুকিয়ে রাখলো।
গোপনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নড়েচড়ে জালানার দিকে মুখ ঘুরিয়ে সিটে মাথা হেলিয়ে দিলো মিহি।
এই কয়েকদিন শান্তিতে ঘুমই হয়নি। তাই আজ খুব ঘুম পাচ্ছে ওর।
জালানার অল্প নামানো কাচের ফাঁক দিয়ে আসা হালকা বাতাসে যেন শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। মিহি আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো। আর মিনিট কয়েকের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
এরোন সেটা খেয়াল করে একহাতে ওর সিটটা একটু নামিয়ে দিলো।
ঘন্টাখানেক পরে বাড়ির সামনে পৌঁছালো ওরা।
সিট বেল্ট খুলতে খুলতে মিহির দিকে তাকাতেই দেখলো সে ওর দিকে মুখ করে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
তবে ব্লাউজ ঢিলে হওয়ায় তা কাধ গড়িয়েছে।
এরোন নির্দ্বিধায় হাত বাড়িয়ে ব্লাউজটা ঠিক করে দিলো।
তারপর গাড়ি থেকে নেমে ওর সাইডের দরজাটা খুলে অনেক ধীরে ধীরে মিহিকে কোলে তুলে নিলো। সে তখনো ঘুমাচ্ছে।
যদিও মিহির ঘুম এত গাঢ় না কিন্তু কয়েকদিন না ঘুমানোর দরুন আজ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
এরোন ওর মুখের দিকে গম্ভীর চোখে একপলক তাকিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
ওকে ওর থাকার ঘরটায় নিয়ে এলো।
ঘর জুড়ে সাজানো মরিচবাতিতে আলো জ্বলছে। আর বিছানার চারিপাশে গোল ভাবে সিলিং থেকে সুতার সাহায্যে ফুল ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এরোন নিঃশব্দে হাসল। ওদের সাজাতে বলে গিয়েছিল ও। ভালোই সাজিয়েছে ওরা।
কিন্তু যে দেখবে সেই ঘুমাচ্ছে।
বিছানার কাছে নিয়ে গিয়ে আস্তে করে মিহিকে গোলাপের পাপড়ি গুলোর উপর শুইয়ে দিলো এরোন।
নরম বিছানা পেয়ে মিহি ঘুমের ঘোরেই গুটিশুটি মেরে উল্টোপাশ ঘুরলো।
এরোন মুচকি হেসে ওর গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে অন্য রুমে ফ্রেস হতে চলে গেল।
তারপর ফ্রেস হয়ে মাথা মুছতে মুছতে আবার মিহির রুমে ঢুকলো। সে ঘুমাচ্ছে।
এরোন তোয়ালেটা বারান্দায় রেখে দিয়ে এসে মিহির পাশে শুয়ে পরলো।
আর ওর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় ভরে নিলো।
(চলবে…)