#মোহ_মায়া
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_৩১
অন্ধকার রুমে কয়েক জন লোকের আত্ম চিৎকার শুনা যাচ্ছে। সম্রাট পাগলের মতো আঘাত করছে তাদের।হাত পা বাধা অবস্থায় ফ্লোরে পরে আছে দানব আকারের লোক গুলো।
ফ্লোরে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে।লোক গুলোর অবস্থা খুব একটা ভালো না। আর কিছুক্ষণ এভাবে মার খেতে থাকলে এখন ই মরে যাবে হয়তো।
অবস্থা বেগতিক দেখে সুমন সম্রাট কে টেনে সরিয়ে নিলো। সম্রাট এখনো রাগে ফোসফাস করছে। এদের মেরেই দম নিবে সে।
— আরে ভাই থাম।একেবারে মেরে ফেলবি নাকি?ওদের মেরে কি লাভ।আসল মানুষ টাকে এখনো আনা বাকি আছে। তার জন্য ও একটু ধৈর্য ধর।
সুমনের কথা শুনে সম্রাট নিজেকে শান্ত করলো। সায়েম আর ইসহাক বসে আছে চেয়ারে। সম্রাট গিয়ে ওদের পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পরলো। অনেক টা হাপিয়ে গেছে সে। ঘন ঘন নিশ্বাস নিয়ে সায়েমের দিকে তাকালো সম্রাট। আজ কয়েক দিন যাবত সায়েম অনেক টা চুপচাপ হয়ে গেছে। কারণ টা আন্দাজ করতে পেরেছে সে।তবুও একটা কিন্তু থেকেই যায়।ইসহাক যেটা করেছে সেটা নিস্বন্দেহে একটা জঘন্য কাজ।একটা মেয়ের সাথে এমন আচরণ করা মোটেও উচিত নয়। তবে সম্রাট ওদের দুজনের মধ্যে ঢুকতে চাচ্ছে না। ওদের সমস্যা ওরা নিজেরা,মিটিয়ে নিলেই ভালো হবে।
ভাবনা রেখে সায়েম আর ইসহাকের দিকে তাকাতেই ভ্রু কুচকে গেলো সম্রাটের। ওরা দুজনেই বিরক্তকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই ওর নিজের কপালে বিরক্তির ভাজ পরলো। সুমন লোকগুলোর পেট টিপে টিপে কিছু একটা করছে।
— কি করছিস ভাই?
— মরে গেলো নাকি দেখছি!নরাচরা করেনা কেন ভাই।
সুমনের কথায় বেক্কল হয়ে গেলো সবাই।আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থেকে সায়েম বললো,
— ওটা হাতের নারি চেক করলে বুঝতে পারবি।পেট দেখে কেমনে বুঝবি ভাই!(অসহায় ভাবে)
সুমন বোকার মতো হেসে বললো,
— হ্যা তাইতো!
— 😠😠😠 (সবাই)
সম্রাট বিরবির করে কয়েকটা গালি দিলো নিজেকে।বন্ধু গুলো সব কয়টা মাঝে মাঝে আধ পাগলের মতো বিহেইভ করে।
🌸
রাস্তার পাশে দাড়িয়ে এক জোড়া কপতকপতি নিজেদের মধ্যে প্রেম বিলাশে ব্যস্ত। তাদের দিকে নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে তানিয়া।এখন আর নিজের মধ্যে কোন অনুভূতি কাজ করে না হয়তো। না হলে নিজের ভালোবাসার মানুষের পাশে অন্য কাওকে কি মেনে নেয়া যায়?কিন্তু সে তো অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে আছে। তাহলে কি তার ভিতর আর কোন অনুভূতি অবশিষ্ট নেই!
তাদের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,
‘এক সমুদ্র ভালোবাসার পরেও
যে মানুষটার অন্যের প্রতি থাকে ঝোক,
সে মানুষ টা আমার না হোক,,,
আমার আমি টাকেই প্রিয় না করে
অন্যের কথায় অনবরত থাকে যার মুখ,
সে মানুষ টা আমার না হোক,,,
আমাকে আঘাত করে, কাদিয়ে
যার বড্ড বেশি লাগে সুখ,
সে মানুষ টা আমার না হোক,,
আমাকে অন্যের সাথে কথা বলতে দেখে
যার এতো টুকুও হয়না ক্ষোভ,
সে মানুষ টা আমার না হোক,,,
আমার মন খারাপের গল্প শুনে,
আমাকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ শান্তনা না দিয়ে
বিরক্ত হয়ে যে চলে গেলো,
সে মানুষ টা আমার নাই বা হলো,,
~কাজী ইশরাক জাহান।
অনেক দিন পরে নিজের ভালবাসার মানুষ টা কে দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না বনানী। ইসহাকের বুকে ঝাপিয়ে পরলো।ইসহাক ও আলতো হাতে আগলে নিলো তাকে।
দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে রইলো তানিয়া।সে দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলো সে।এখন আর তাকিয়ে থেকে অশ্রু বিসর্জন দিতে ইচ্ছে হয় না।
বনানী কে বুক থেকে তুলতেই রাস্তার অপর পাশে তানিয়ার দিকে নজর পরল ইসহাকের। সাথে সাথেই হাজার অস্বস্তি ঘিরে ধরলো তাকে।তানিয়ার নির্লিপ্ত চাহনি তাকে আরও অবাক করে তুললো। এই মেয়েটাই তো একটা সময় তার পায়ে পরে আকুতি করে ভালোবাসা ভিক্ষা চেয়েছিলো। আজ তাহলে এতটা উদাসীন কিভাবে হতে পারে সে!মনে মনে আওরালো সে,
‘ নারীর ভালোবাসা যতটা প্রখর, তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর তার ঘৃণা’
আজ তানিয়ার দৃষ্টিতে শুধু ঘৃণা দেখা যাচ্ছে। একসময় যেখানে ভালোবাসার প্রজাতিরা উড়াউড়ি করতো আজ সেখানে ঘৃণার বসবাস। সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে।
🌸
পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো আদওয়া। আজ দুই দিন পরে তার জ্ঞান ফিরেছে।মাথায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হতেই চোখ কুচকে বন্ধ করে ফেললো সে।
আদওয়ার জ্ঞান ফিরতে দেখেই নার্স দৌড়ে গিয়ে ডক্টর কে ডেকে নিয়ে এলো। ডক্টর আদওয়া কে চেক করে চিন্তিত মুখে বেরিয়ে গেলেন। আদওয়ার আরো কিছু টেস্ট করা এখনো বাকি আছে। টেস্টের রেজাল্ট দেখেই বাকিটা বলা যাবে।
আদওয়ার জ্ঞান ফিরেছে শুনে দশ মিনিটের মাথায় হাসপাতালে পৌঁছায় ওরা সবাই। তরিঘরি করে কেবিনে ঢুকে পরে সম্রাট। সেকেন্ডের সাথে পাল্লা দিয়ে তার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে চলেছে। জ্ঞান ফিরলেও আদওয়াকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে। জ্ঞান ফিরতেই অস্থির হয়ে উঠে সে।চিৎকার করে নিজেকে আঘাত করতে চাইছিল বারবার।ডাক্তাররা পরিস্থিতি খারাপ দেখে আদওয়াকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেয়।সব কিছু শুনে সম্রাট চিন্তায় পরে গেলো। আদু যথেষ্ট স্ট্রং পার্সোনালিটির মেয়ে।এই ঘটনা আদুর জন্য খুবই ভয়ংকর ছিলো। তবুও এতটা পাগলামি আদু করবে না। তাহলে?
টুল টেনে আদুর পাশে বসতেই আদুর ঘাড়ে কিছু একটা দেখতেই সম্রাটের নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। একটু ভালো করে তাকাতেই বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো সে।সমস্ত শরীর তিরতির করে কাপছে।কপালে থেকে চিকন ঘাম বের হচ্ছে। দ্রুত গতিতে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো সম্রাট। দ্রুত গতিতে নিশ্বাস উঠা নামা করছে।এটা সত্যি হতে পারে না। কাপা কাপা হাতে কপালের ঘাম মুছে টলমল পায়ে ডাক্তারের কেবিনের দিকে ছুটলো।
🌸
যুবরাজের সামনে বসে আছে তানিয়া। যুবরাজের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলেও তানিয়া ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে।
— তুমি কি কিছু বলতে চাও তানিয়া?
যুবরাজের কঠোর গলায় বলা কথাটা শুনে সামান্য কেপে উঠল তানিয়া।কিন্তু চেহারায় তার লেশ মাত্র ও আনলো না।নির্লিপ্ত গলায় বললো,
— কোন বিষয় নিয়ে কথা বলছেন ভাইয়া?
তানিয়ার কথা শুনে তপ্ত শ্বাস ফেললো যুবরাজ।চারিপাশে সবার জীবন কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। আগের সেই প্রানবন্ত ভাব কারোর মধ্যেই আর অবশিষ্ট নেই।
— আমি তোমার বড় ভাইয়ের মতো তানিয়া।আমি সাফা আর প্রিয়া কে যতটা ভালোবাসি তোমাকেও ঠিক ততটাই স্নেহ করি। ইসহাকের সাথে কি হয়েছে তোমার আমি ঠিক জানি না। আর সত্যি বলতে জানতে ও চাই না। তুমি খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে।আশা করি মরিচিকার পিছনে ছুটবে না।জীবন হচ্ছে স্রোতের গায়ে ভাসানো নৌকার মতো। সে কারোর জন্যই থেমে থাকবে না। তাহলে কারোর দেয়া প্রতারণা সেই জীবন তরীতে বয়ে নিয়ে যাওয়ায় কি দরকার। তাকে সেই স্রোতের সাথেই ভাসিয়ে দাও।যে তোমার মুল্য বোঝেনি তাকে জীবন থেকে এমন ভাবে বের করে দাও যেন সে তোমার অস্তিত্বের কোথাও কোন কালেই ছিল না। জীবন টা কে উপভোগ করো তানিয়া।এই সময় গুলো আর ফিরে আসবে না।নিজের জীবনের এই মুল্যবান সময় গুলো এমন একজনকে ভেবে নষ্ট করছো যার ভাবনার সিমান্তের বহুদূরেও তুমি নেই।
যুবরাজের কথা শুনে মুচকি হেসে যুবরাজের দিকে তাকালো তানিয়া।তানিয়ার শান্ত চোখে তাকিয়ে কিছুটা মায়া হলো যুবরাজের। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো সে।
— আমি ভালোবাসার বিনিময়ে সুখ কিনতে গিয়েছিলাম ভাইয়া।ব্যাবসায় ছিলাম খুব কাচা।অবুঝ আবেগ,পবিত্র মন।ভাবলাম আমার মতোই বুঝি পবিত্র সবাই।😊ওই যে বললাম, কাচা ব্যাবসায়ী।তাই বুঝতে পারিনি সেখানে সবাই মুখোশ ধারি। আমার পবিত্র ভালোবাসাকে পায়ে পিষে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে সুখের বদলে দুঃখ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। পবিত্র ভালোবাসা খুব সস্তা ভাইয়া।মানুষের কাছে একেবারেই মূল্যহীন। এই আমাকেই দেখুন,আমি ছলনা কে কতটা মুল্য দিয়েছি।নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসেছি।অথচ আমার পবিত্র ভালোবাসার বিনিময়ে কি পেলাম? ধোকা!আর দেখুন, তার ছলনার বিনিময়ে সে কিন্তু ঠিকই আমার সমস্ত অস্তিত্ব কে বিলীন করে নিয়ে গেছে।তাহলে সত্যিকারের ভালোবাসার চেয়ে ছলনার মুল্য বেশি হলো না?
আমার জন্য চিন্তা করবেন না ভাইয়া।আমার মনটা খুব কঠিন। এত সহজে ভেঙে পরব না।
তানিয়ার দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে যুবরাজ।
চলবে,,